4

মুক্তগদ্যঃ দময়ন্তী দাশগুপ্ত

Posted in


মুক্তগদ্য





গোলাপসুন্দরী
দময়ন্তী দাশগুপ্ত



তাহার কক্ষে গোলাপসুন্দরীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ গোলাপ জানিত কক্ষখানি একান্ত তাহারি। গোলাপকে দেখিলেই সে মুখখানি ফিরাইয়া লয়, দ্বার বন্ধ করিয়া দেয়। গোলাপসুন্দরী দ্বারে করাঘাত করিয়া প্রতিদিন বলিয়া যায়, ‘তুই মর।’ দ্বার খুলে না। কেবলমাত্র অন্যপার্শ্বে সে ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ শুনিতে পায়, গোলাপ সাড়া দিয়া বলিয়া উঠে, ‘যাইই...।’ দ্বার খুলে না। দ্বার শুধু ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। 

মধ্যে মধ্যে তাহার বড় শ্রান্ত লাগিতে থাকে। এই জীবন, এই বাঁচিয়া থাকা – আপনার মনে অস্ফুটে ডাকিতে থাকে সে – ‘গোলাপ, গোলাপ’। চক্ষে জল আসিয়া পড়ে। গোলাপ কি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে? সাড়া দেয় না কেন? – ‘গোলাপ, গোলাপ...’।

কলম দিয়া কি চক্ষের জল পড়ে? তাহা না হইলে অক্ষরময় পৃষ্ঠাগুলি আবছায়া হইয়া যায় কেন? নিদ্রা আসিতেছে, ‘ও গোলাপ, মস্তকে হস্ত বুলাইয়া দিবি না? ওষ্ঠে অঙ্গুলি বু্লাইবিনা তোর? ও গোলাপ, স্বপনে আসিবি তো ঠিক?’

গোলাপ প্রাতঃকালে স্নান করিয়া পাটভাঙা শাড়িখানি পরিয়া আসিয়া দ্বারে করাঘাত করিতে থাকে, ডাকিয়া কহে, ‘ওঠ মরণ, উঠিয়া পড়, প্রাতঃকাল যে কখন হইল।’ দ্বার কেহ খুলিয়া দেয় না। স্বপনের ঘোরে শুনিতে পাওয়া যায় অস্পষ্ট কন্ঠস্বর, ‘গোলাপ, গোলাপ’।

দিন কাটিয়া যায়, নিঃশব্দতায়। কেবলমাত্র গোলাপের কঙ্কনগুলি রিনিঠিনি বাজিয়া কহে, ‘মরণ, মরণ’। সূর্য উঠিবার সময় ডাক দিয়া যায়, ‘ও গোলাপ, গোলাপ’। নামিবার সময় ফিসফিস করিয়া বলিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠে, ঠোঁট চাপিয়া ভ্রুভঙ্গী করিয়া কহে, ‘মরণ’। নিদ্রা যাইবার পূর্বে স্নান সারিয়া আসিয়া পুনরায় দ্বারে করাঘাত করিয়া যায়, হাসিতে হাসিতে বলিয়া উঠে, ‘খুলিয়া দে, একমুষ্টি হলাহল দিয়া যাই, মক্ষিকাসুধা তো মুখে রুচিবে না’। দীর্ঘশ্বাস শুনিতে পাওয়া যায় দ্বারের অন্যপার্শ্ব হইতে।

একেকটিদিন বড় বেদনা হইতে থাকে তাহার। স্থির থাকিতে পারেনা। পালঙ্কে এপাশ-ওপাশ করিতে থাকে সে। সেইসব রাত্রে গোলাপসুন্দরী বৃক্ষ হইয়া যায়। বৃক্ষ হইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে, ডালপালায়, শিকড়ে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে। গোলাপকে সে দুই হস্তে ঠেলিয়া দেয়। গোলাপ তাহাকে পুনরায় জড়াইয়া ধরিয়া কহে, ‘মরিতে চাহিয়াছিলি অদ্যপি ভীত হইলে চলিবে কেন?’ সে মরিতে থাকে অতঃপর। কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করিয়া বৃক্ষদেহে মিশিয়া যাইতে যাইতে মরিতে থাকে। তাহার ইহকাল পরকাল, অতীত বর্তমান সব হারাইয়া যায়। একটি ক্রমশঃ গভীর মরণে সে শ্বাস বন্ধ করিয়া ডুবিয়া যায়। গোলাপ তো ঠিকই কহিয়াছে, সেতো মরিতেই চাহিয়াছে আজীবন।

পরদিন প্রাতঃকালে পালঙ্কে শুষ্কপত্র পড়িয়া থাকে।

কোনো কোনোদিন গোলাপসুন্দরীর দেহে নদী বহে। নদী হইতে লবণাক্ত সমুদ্রের লাবণ্যে ঢেউ উঠিতে থাকে। লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শে ঘুম ভাঙিয়া যায় তাহার। জলে ডুবিতে ডুবিতে খড়কুটো খুঁজিতে থাকে – অথচ সর্বত্র ঢেউ বহে - ওষ্ঠে, স্তনে, নাভিতে, জঙ্ঘায়। গোলাপ দন্ত দিয়া ওষ্ঠ চাপিয়া ফিসফিস করিয়া বলিয়া ওঠে, ‘আ, মরণ, কেবলমাত্র দুষ্টামি’।

প্রাতঃকালে সিক্ত শয্যাবস্ত্রটি পড়িয়া থাকে পালঙ্কে।

একেকটিদিন গভীর রাত্রিতে তৃষ্ণায় তাহার ছাতি ফাটিয়া যায়। অন্ধকারে হাতরাইয়া হাতরাইয়া ডাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ জল রাখিয়া যায় নাই কেন? গোলাপ জল হইয়া আসে নাই কেন? ‘গোলাপ, খানিক বৃষ্টি দিয়া যা গোলাপ’। গোলাপসুন্দরী তাহার কক্ষে নিদ্রা যাইতে যাইতে মৃদুস্বরে বলিয়া উঠে, ‘মরণ’।

প্রাতঃকালে শয্যায় লাগিয়া থাকে অশ্রু এবং স্বেদ।

কোনো রাত্রিতে গোলাপ আসিয়া তাহার দ্বারে আছড়াইয়া পড়িয়া বলিয়া উঠে, ‘উঠ, উঠ, অগ্নি লাগিয়াছে’। সে আসিয়া গোলাপকে তুলিয়া কহে, ‘কোথা?’ গোলাপ বলিয়া উঠে, ‘চক্ষুর মাথা খাইয়াছিস নাকি, দেখিতে পাইতেছিস না?’ অতঃপর অগ্নি জ্বলিতে থাকে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতে চাহে - উত্তাপে, ধূম্রে। সে পুড়িতে থাকে। সে মরিতে থাকে।

প্রাতঃকালে শয্যায় কিয়ৎখানিক ভস্ম পড়িয়া থাকে।

এই কাহিনিটি আমি শুনিয়াছি তাহার কাছেই। চিত্র অঙ্কন করিত সে। গোলাপসুন্দরীর চিত্র দেখাইয়াছিল আমায়। গোলাপ - নদী, বৃক্ষ, আগুন। প্রাতের আলোক আর সন্ধ্যাকালের স্নিগ্ধতা। বলিয়াছিল, হয়তো গোলাপসুন্দরী বলিয়া কেহ ছিল না। অথবা গোলাপসুন্দরীরা হয়তো হারাইয়াই যায় চিরকাল। বলিয়াছিল, হয়তো সকল পুরুষের কল্পনাতেই গোলাপসুন্দরীরা বাঁচিয়া থাকে, বাঁচিয়া থাকিতে চাহে। 

শুনিতে শুনিতে অকস্মাৎ মনে হইল, নূপুর নিক্কনশব্দে হাসিয়া কে যেন কহিয়া উঠিল, ‘মরণ’।

4 comments:

  1. অনেক ধন্যবাদ সৌম্য।

    ReplyDelete
  2. দময়ন্তী আমাকে অবাক করলো । ওর গদ্যলেখার মুন্সিয়ানা আমার পরিচিত । কিন্তু ছোট পরিসরে এই গদ্যের বিন্যাস অনবদ্য । মুক্তগদ্য কি, কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই কম । মনে হলো এই লেখাটা মুক্ত গদ্যের একটা মডেল হতে পারে । অভিনন্দন দময়ন্তী । - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

    ReplyDelete
  3. ফাল্গুনীদা, আপনার ভালোলাগা আমার আশীর্বাদ। হঠাৎ করেই কবিতার মতো লেখাটা এসেছিল। সাধু গদ্যে এই প্রথম লিখলাম।

    ReplyDelete