0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক




বানরায়্ণ, পর্ব ৯
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়






কিষ্কিন্ধ্যার কাছাকাছি যে পৌঁছে গেছি, সেটা দিন তিনেক আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম বাঁদরের সংখ্যা দেখে। চারিদিকের গাছে অসংখ্য বাঁদর। এবং তারা এত মানুষ একসঙ্গে দেখে বা এত আওয়াজ শুনেও বিশেষ বিচলিত হচ্ছে না। কিষ্কিন্ধ্যাবাসীদের পূর্বজদের আত্মা এরা? কথাটা ভেবে প্রথমে একটু হাসি পেলেও হঠাৎ কেন জানি না জন্তা বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। হাজার বছরের বুড়ো অশ্বত্থের গোড়ায় ফোকলা হাসির মতন ফোঁকড়টা... কই, তাকে জন্তা বাবা বলে বিশ্বাস করতে তো এক মুহূর্তও লাগেনি! কথাটা মনে পড়ার পর আর হাসি পায়নি।

যেটা বেশ আশ্চর্য লাগলো, সেটা হলো বাঁদর আর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমাদের ওদিককার বাঁদরগুলো এরকম শান্তশিষ্ট, ভব্যসভ্য নয়। রীতিমতন বাঁদরামি করে। এখানে সে বালাই নেই। শুনলাম, কিষ্কিন্ধ্যার লোক বাঁদরদের শুধু পালনপোষণ, তোয়াজই করে না। প্রয়োজন মতন শাসনও করে। প্রশিক্ষণ দিয়ে নানান রকমের কাজে ব্যবহারও করে। তাই তারা এত শান্ত আর অনুবর্তী।

নগর কেমন হয়, সে বিষয়ে কোনও ধারনা ছিলো না আমাদের। সেই প্রথম দেখলাম। যদিও করন্দর মতন বহুদর্শীরা বলছিলো যে কিষ্কিন্ধ্যাও সেই অর্থে নগর নয়, তবু আমাদের মতন জংলীদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এই অনেক! একটা অনুচ্চ পাহাড়ের মতন জায়গাকে ঘিরে আছে পাথরের তৈরি অগুন্তি ছোট বড় বাড়ি। সেই সব বাড়িতে থাকে কিষ্কিন্ধ্যার সাধারণ নাগরিকরা। আর ওই পাহাড়টার ভিতর কিষ্কিন্ধ্যার রাজকীয় আবাস।

পাহাড়ের ভিতর রাজার বাড়ি শুনে প্রথমটা আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর করন্দ বুঝিয়ে বললো, ওই পাহাড়ের গর্ভে আছে মানুষের তৈরি গুহাকন্দরের এক বিস্তীর্ণ ও জটিল শৃঙ্খলা। অনেকটা খরগোশের গর্তের মতন। সেই গিরিগর্ভ নাকি সজ্জায় ও সৌন্দর্যে কোনও রাজপ্রাসাদের চাইতে কম নয়। মহারাণী তারার নিজের হাতে সাজানো...

মহারাণী তারা! নামটা আগেও কয়েকবার শুনেছি। ইনি বালীর মহিষী ছিলেন। এখন সুগ্রীবের স্ত্রী, কিষ্কিন্ধ্যার পাটরাণী। যুবরাজ অঙ্গদের মা। দাক্ষিণাত্য ছাড়িয়ে আর্যাবর্ত অবধি ছড়িয়ে পড়া রূপের খ্যাতি নাকি তাঁর।সে রূপ দেখার জন্য নতুন সৈনিকরা সবাই উদ্গ্রীব।

কিন্তু সবার আগে বিশ্রাম। এতদিনের পথশ্রমের ক্লান্তি অপনোদন। পাথরের বাড়িগুলোর চৌহদ্দির ঠিক বাইরে সার সার তাঁবু খাটানো হয়েছে।আর সেই সব তাঁবুর ফাঁকে ফাঁকে মাটির তৈরি বিশাল বিশাল গভীর গামলার মতন পাত্রে সুগন্ধী ভেষজ মেশানো ঠাণ্ডা জলে স্নানের ব্যবস্থা! এত আরামে জীবনে কোনওদিন স্নান করিনি আমরা কেউ।

স্নান সেরে উঠে পাওয়া গেলো প্রত্যেকের জন্য দু’প্রস্থ করে নতুন কাপড়। আমাদের যাদের এর আগে কাপড় পরার সুযোগ জোটেনি কপালে, তারা তো আনন্দে প্রায় আত্মহারা। তারপর যখন খাওয়ার পালা এলো, তখন সবার চক্ষুস্থির হয়ে গেলো! শিবিরে যা খেয়েছি, সে খাবারও এর তুলনায় কিছু নয়। কত রকমের যে মাছ-মাংস, শাক-সব্জী‌, ফল-দুধ-মিষ্টির পদ, গুনেই শেষ করা যায় না। ভরপট খেয়েও আফশোস থেকে গেলো, অর্ধেকেরও বেশি খাবার চেখেই দেখা হলো না বলে।

কিন্তু এই সব আরামে গা ভাসিয়ে দিয়ে যে একেবারে টইটম্বুর হয়ে যাবে কেউ, সে উপায় নেই। লাঠি হাতে পাথুরে মুখের দল নিরন্তর পাহারা দিয়ে চলেছে। লাঠি যে খুব কারও ঘাড়ে পড়েছে, তা নয়। এই এত দিনে বড় জোর বার কয়েক। কিন্তু লোকগুলোর ঠাণ্ডা, কঠিন মুখের দিকে তাকালে আর ওদের বিরূদ্ধাচরণ করতে সাহসে কুলোয় না কারও।

যাই হোক, খাওয়া দাওয়ার পর তাঁবুর ভিতর আরামদায়ক বিছানায় শুতেই শ্রান্তি আর পরিতৃপ্তিতে চোখ ভেঙে ঘুম এলো। ঘুম ভাঙলো যখন, সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। কিষ্কিন্ধ্যার পাহাড়ের পিছনে আকাশ কমলা থেকে আস্তে আস্তে গাঢ় লাল হচ্ছে... যেন এই শান্তি আর আরামের পরিবেশে আশ্বস্ত মানুষগুলোকে আসন্ন যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু সেকথা নিয়ে আপাতত কেউই ভাবিত নয়। যুদ্ধ করতেই এসেছে সবাই। তাই নিয়ে আর ভেবে লাভ কি? বরং আজকের দিনটা উপভোগ করা যাক। আজ ছুটি। সম্পূর্ণ বিশ্রামের দিন। সামনে সারা সন্ধ্যেটা পড়ে আছে। আমি, গোর্তন, মাহারু, দুরন আর মণ্ডু একসঙ্গে বেরোলাম নগর দর্শনে। পাথরের বাড়িগুলোর সারির মাঝখান দিয়ে সর্পিল ভঙ্গীতে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাথরেই ঢালাই করা সরু সরু পথ। উঁচুনীচু, অমসৃণ পথ। কিন্তু পরিচ্ছন্ন।

সেই পথেএকটা অদ্ভূত জিনিস দেখলাম। বাঁশের পোক্ত মাচার মতন জিনিসের সঙ্গে বড় বড় কাঠের চ্যাপ্টা গোল গোল খাঁজকাটা চাকতি জুড়ে তার উপর মালপত্র বোঝাই করে সেগুলোকে মহিষ দিয়ে টানানো হচ্ছে। দুটো করে মহিষ টানছে একেকটা মাচা, আর সেই মাচার উপর বসে সরু বাঁশের কঞ্চির আগায় পাতলা চামড়ার ফালি লাগানো ছপটির মতন জিনিস দিয়ে মেরে মেরে মহিষগুলোকে চালাচ্ছে একেকজন মানুষ... মুখে ‘‘হুররর, হৈঃ হৈঃ!’’ গোছের শব্দ করতে করতে। মালপত্র বওয়ার বেশ সুবিধাজনক ব্যবস্থা। পুরো ব্যবস্থাটার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ওই মাচার সঙ্গে লাগানো বড় বড় কাঠের চাকতিগুলো। ওগুলো আছে বলেই মাচাগুলো ওই ভাবে চলছে। পরে জেনেছিলাম, ওগুলোকে বলে চক্র বা চাকা, আর পুরো ব্যাপারটাকে বলে শকট।

আরেকটা ব্যাপার আরও আশ্চর্য লাগলো। পথের দু’ধারে খড়ের তৈরি ছোট ছোট গুমটির মতন ঘর। কোনওটাতে একেকজন নারী, কোনওটাতে একেকজন পুরুষ বসেছে ফল, মাছ-মাংস, দুধ, শাক-সব্জী, মাটির তৈরি ঘটি-মালসা এবং আরও অনেক রকম কি কি সব আমাদের অচেনা জিনিসপত্র নিয়ে... আর কিছু নারীপুরুষ তাদের কাছ থেকে সেই সব জিনিসপত্র নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমটা ভেবেছিলাম, নগরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিলি করার ব্যবস্থা বুঝি এই রকমই। কিন্তু তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম, যারা নিচ্ছে তারা জিনিসগুলোর পরিবর্তে ছোট ছোট ধাতুর চাকতির মতন কি যেন সব দিচ্ছে। ব্যাপার কিছু বুঝলাম না। বোকা, গেঁয়ো প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে গিয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না। হাসি হাসি মুখ করে চলে এলাম।

শিবিরে ফিরে করন্দকে খুঁজে বার করলাম। ততক্ষণে নেশায় তার দু’চোখ লাল। জিজ্ঞেস করাতে প্রথমটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর জড়ানো গলায় হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, ‘‘ওগুলো তো দোকান রে ব্যাটা! ওখান থেকে জিনিস কিনতে হয়।’’

‘‘কিনতে হয়? মানে?’’

‘‘এক্কেবারে জংলী ভূত!’’ বলে মদের পাত্রে লম্বা চুমুক দিলো করন্দ। কথাটা শুনতে আমার ভালো না লাগলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমার অনভিজ্ঞতার জন্যই হোক, বা করন্দর নেশার জন্যই হোক, দোকান, কেনা, বেচা, মুদ্রা বিনিময়ের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো আমার। বেশ জটিল ব্যাপার। এর থেকে আমাদের সোজা সাপটা জিনিস অদলবদলের নিয়ম সহজ। কিন্তু এটাও ঠিক, যে এখানে ব্যবহার্য জিনিস অনেক বেশি, সেই সব পণ্যের প্রস্তুতকারকও অনেক, আর ক্রেতার তো কথাই নেই। তাই এখানে আদানপ্রদানের ওরকম সরল ব্যবস্থা চলবে না। সেই জন্যই মুদ্রা বস্তুটার আমদানি। ও দিয়ে সব কিছুর মূল্যমান নির্ধারণ করা সহজ। তবে এই মুদ্রার মান সর্বত্র কি এক? তা না হলে তো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে অসুবিধায় পড়তে হবে। অত বিস্তারিত বোঝানোর মতন অবস্থা করন্দর তখন ছিলো না। থাকলেও পুরোটা ও নিজেই বোঝে কি না, তাই নিয়েও আমার সন্দেহ ছিলো। শুধু বুঝলাম, শিখতে হবে... ভালো করে শিখতে হবে এই সব খুঁটিনাটি বিষয়।

সে রাতেও খাওয়া দাওয়ার খাসা বন্দোবস্ত ছিলো। দুপুরের তুলনায় পদের সংখ্যা কিছু কম হলেও স্বাদে ও বৈচিত্রে অতুলনীয়।সব চাইতে আনন্দের কথা, সে খাদ্য পরিবেশন করছিলো একদল সুন্দরী যুবতী। বেশির ভাগ সৈনিক খাওয়ার কথা ভুলে তাদের সঙ্গে রসালাপে মগ্ন হয়ে পড়ছিলো। খাওয়ার আগে পান করা রসের ভূমিকা যে সে আলাপে অতি গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বলাই বাহুল্য। মেয়েগুলো বেশ চটুল, লাস্যময়ী যাকে বলে। শরীরিক ভাবেও বেশ সপ্রতিভ। আমাদের মেয়েরাও যথেষ্ট খোলামেলা। কোনও পুরুষকে মনে ধরলে সেটা তাকে জানিয়ে দিতে মোটেই রাখঢাক করে না। কিন্তু এদের হাবভাব কিরকম যেন অন্য রকম!

কেমন যেন সবটাই বেশি বেশি করছে মনে হচ্ছিলো। শরীর আর চোখমুখের ভঙ্গী থেকে আরম্ভ করে খাবার পরিবেশনের কায়দা অবধি... সব কিছুতেই কেমন একটা আকর্ষণ করার চেষ্টা। বাছবিচারহীন ভাবে সবার সঙ্গে শরীর মেলানোর আহ্বান। আমাদের অদ্ভূত লাগছিলো। অস্বস্তি হচ্ছিলো। 

পরে জেনেছিলাম, এরা দেহোপজীবিনী। মুদ্রার বিনিময়ে পুরুষের সঙ্গে শারীরিক ভাবে মিলিত হওয়াই এদের ব্যবসা। সে রাতে এদের আনা হয়েছিলো রাজকীয় বাহিনীর নবনিযুক্ত সৈনিকদের চিত্তবিনোদনের জন্য... এবং সে কাজটা এরা বেশ ভালোভাবেই করেছিলো।

পরদিন ভোরবেলা ঢ্যাঁঢরা পেটানোর শব্দে সবার ঘুম ভাঙলো। সবাই ধড়মড় করে উঠে দেখলো, লাঠি হাতে পাথুরে মুখের দল শিবিরে টহল দিচ্ছে, আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে ঢ্যাঁঢরাওয়ালারা। আজ থেকে শুরু আবার সৈনিকের নিয়মবদ্ধ জীবন। সকাল থেকে অনুশীলন। তারপর বিকেলবেলা সূর্যাস্তের আগে রাজকীয় সম্ভাষণ।

এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে। রাজা বা তাঁর সেনানায়করা কেউই এই মুহূর্তে রাজধানীতে উপস্থিত নেই। আমাদের নিয়েগশিবিরের অধ্যক্ষ সেনাপতি গবাক্ষও থামেননি কিষ্কিন্ধ্যায়। আমাদের পৌঁছে দিয়ে যাত্রা করেছেন কুমারিকার পথে। তাহলে কে করবে রাজকীয় সম্ভাষণ? সে তো যে সে লোকের কাজ নয়! বিকেল অবধি সংশয়টা থেকে গেলো।

তারপর... এক রক্তবর্ণ অপরাহ্নের পটভূমিকায় আমরা সবাই গিয়ে দাঁড়ালাম রাজকীয় পর্বতাবাসের প্রবেশপথের সম্মুখে... সারিবদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত, নিশ্চুপ। 

পাহাড়ের গায়ে অগণিত গুহাদ্বার। প্রবেশপথের ঠিক উপরে একটা প্রশস্ত রন্ধ্রপথ। সেখানে দু’পাশের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন ভল্লহস্ত শান্ত্রী। খানিকক্ষণ শ্বাসবন্ধ করা নিস্তব্ধতা...

তারপর... দলনেত্রী হস্তিনীর মতন ধীর অথচ দৃঢ়, নমনীয় অথচ চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে সেই রন্ধ্রপথে এসে দাঁড়ালেন রক্তবস্ত্র পরিহিতা, রত্নালঙ্কার শোভিতা, চোখ ঝলসানো সুন্দরী প্রগাঢ়যৌবনা কিষ্কিন্ধ্যার মহারাণী তারা।



0 comments: