4

প্রবন্ধঃ রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ




পাল যুগের শিল্প
রিয়া চক্রবর্তী



ভারতীয় ভাস্কর্য‌-চিত্র কলার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে গুপ্তসম্রাটদের শাসন কালে, অর্থাৎ ৩২০ থেকে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ বা তার কাছাকাছি সময়ে। এই সময়টিকে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে মার্গ যুগ বা ক্ল্যাসিকাল যুগ বলে ধরা হয়। এই সময়ে ভারতীয় চিত্রকলা যে কতখানি উন্নত হয়েছিল তার প্রমান আমরা পাই বাঘ, অজন্তা ও বাদামীর গুহাচিত্রে। এই গুহাচিত্রগুলিকে শিল্প ঐতিহাসিকরা মার্গ চিত্রকলা বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতীয় মার্গরীতির চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার প্রবহমান নিরবচ্ছিন্ন ছন্দোময় রেখা ও বর্ণের ব্যবহারে পরিপূর্ণ রূপসৃষ্টি। গুপ্তযুগের এই রূপাদর্শ পরবর্তীকালে ভারতীয় কলাশিল্পের বিকাশে এক চিরায়ত আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

এই মার্গ রূপকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রং ও রেখার পরিপূর্ণ অলংকরণে শিল্পের সৃষ্টি। আবার প্রাক মধ্যযুগের ভারতে প্রধানত এই আদর্শের অনুবর্তন দেখা যায় তার ভাস্কর্যশিল্পে।

কিন্তু এই সময় আবার অন্য এক চিত্ররীতির বিকাশ ঘটে, যে রীতিকে শিল্পৈতিহাসিকগণ ‘মধ্যযুগীয় চিত্ররীতি' বলে অভিহিত করেছেন। এই চিত্ররীতির লক্ষণ হল ডৌলবিহীন তীক্ষ্ণ রেখা এবং অলঙ্করণহীন সমতল রঙের প্রলেপ।

এই রীতির চিত্র আমরা দেখতে পাই ইলোরার প্রাচীরচিত্রে।

গুপ্ত যুগের পরবর্তী কালে পাল রাজাদের আমলে এই চিত্রশিল্পের আরও বিকাশ ঘটে। শিল্পী ধীমান ও বিটপাল ভারতীয় মার্গরীতিকেই পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। কেননা তারনাথ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ধীমান তাঁর শিল্পরীতিতে ছিলেন ‘নাগ’ শিল্পের অনুগামী। আর ‘নাগ’ পদবীধারী রাজাদের শাসিত মথুরা ছিল এই মার্গ রীতির আদি কেন্দ্র। তবে আনুমানিক নবম শতাব্দী থেকে যে সব প্রস্তর ও ধাতুমূর্তির আবিষ্কার হয়েছে পাল শাসিত পূর্ব ভারতে, সেগুলি যে গুপ্ত কালীন আদর্শেই রূপায়িত তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারো।

পাল যুগের অধিকাংশ চিত্রিত পাতার পুঁথিগুলির মধ্যে অজন্তা ও বাঘের প্রভাব দেখা যায়। বুদ্ধের জীবনের ঘটনা নিয়ে আঁকা পাল পুঁথিচিত্রের মধ্যেও অজন্তার ও বাঘের গুহা চিত্রের রূপ দেখতে পাই।

এই পাল পুঁথিচিত্রের ‘মধ্যযুগীয়’ রীতির প্রথম সাক্ষাৎ মেলে মহীপালদেবের সময় রচিত মহাযান গ্রন্থ ‘অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতায়’। এই গ্রন্থ এখনও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সযত্নে রক্ষিত আছে। এই গ্রন্থে পনেরোটি চিত্র পরীক্ষা করলে সহজেই জানা যায় পশ্চিম ভারতের জৈন পুঁথিচিত্রের বিশেষ চরিত্রগুলির লক্ষণগুলি। যেমন দ্বিমাত্রিক রূপসংস্থান, তরল পীতবর্ণের প্রলেপন, এবং তীক্ষ্ণ রেখার অলঙ্করণহীন প্রয়োগ।

কিন্তু অনেকে আবার এই মহীপালদেবকে দ্বিতীয় মহীপাল দেব বলে মনে করেছেন। এই দ্বিতীয় মহীপালদেবের রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। তাছাড়া বজ্রযান মতের ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘কারণ্ডব্যূহ’,‘কালচক্রযান’ প্রমুখ গ্রন্থের প্রমান পাওয়া যায়। যা প্রণিধানযোগ্য, তা হল পুঁথির গ্রন্থ ও চিত্রের মধ্যে কোন সম্পর্কের অভাব। অর্থাৎ, চিত্রের গ্রন্থগুলি চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়, বরং স্বমহিমায় স্বতন্ত্রসত্তায় ছিল বিরাজমান। পুঁথি নির্বিশেষে চিত্রের বিষয় হল গৌতম বুদ্ধের জীবনের প্রধান আটটি ঘটনা আর মহাযান–বজ্রযান সম্মত দেবদেবীর প্রতিকৃতি।

দেবদেবীর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, লোকনাথ, মৈত্রেয়, মহাকাল, বজ্রপাণি, বসুধারা, কুরুকুল্লা, চুন্দা, বজ্রসত্ত্ব, মঞ্জুঘোষ, প্রমুখ। একাদশ শতকের শেষ থেকে দ্বাদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সময় রামপালদেবের রাজত্বকাল। এই সময়ে যে সাতখানি পুঁথিতে বহু দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল তার সবকটিই মার্গরীতি অনুযায়ী, অলঙ্করণযুক্ত, রং ও রেখায় রূপায়িত।

পরবর্তীতে পালশাসনের অবসানের পরে, অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের অন্তিমকালে পূর্ব ভারতে এই ‘মধ্যযুগীয়’ রীতি বেশ কিছুটা ছাপ ফেলেছিল। আমরা তিনটি সুত্র থেকে এর প্রমান পাই। ১) বাংলায় আবিষ্কৃত তিনটি তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ রেখাচিত্রে। ২) বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরে মেঝের প্রস্তরফলকের রেখা চিত্রে। ৩) পাল পরবর্তীকালের তিনটি পুঁথিচিত্রে।

প্রথম মহীপালের সময় থেকে রামপালের সময় পর্যন্ত পালচিত্রকলার দুই ধারার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বল্প সংখ্যক ছবি হলেও স্বতন্ত্র এক চিত্ররীতির ধারা পাওয়া যায় পালযুগের চিত্র কলায়। তবে পাল চিত্রকলার অস্তিত্ব এখন আর পুঁথি নির্ভর নয়। কয়েক বছর আগে নালন্দার সরাই ঢিবি খনন করে যে বৌদ্ধমন্দিরটির নিম্নভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভিতরে পাল যুগের আঁকা ভিত্তিচিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

কালের বিপর্যয়ে এই চিত্রের যে সামান্য অংশটুকু টিঁকে আছে, তা হল মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে অঙ্কিত ফুল, লতা, পাতা, চলমান হাতি ও বৌদ্ধ দেবতা কুবের। ছবিগুলি ছিল বহুবর্ণের। কিন্তু এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফলে এই ছবিগুলির শৈলী বিচার পুরোপুরি করা সম্ভব নয়। তবুও ছবিগুলির যতটুকু আদল দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে এই ভিত্তিচিত্র পাল আমলের পুঁথিচিত্রের এক অমূল্য শৈলীর অভিব্যক্তি।

4 comments:

  1. আমি এই সব জানতাম না, ধন্যবাদ ,রিয়া

    ReplyDelete
    Replies
    1. এতো বড় লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ দাদাভাই।

      Delete
  2. অনেকদিন পর প্রাচীন শিল্প বিষয়ে এত সমৃদ্ধএকটি প্রবন্ধ পড়লাম। বড় লেখা??? আমার তো মনে হলো বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! অদূর ভবিষ্যতে ঋতবাকের ওয়েবপৃষ্ঠায় এরকম আরও লেখা পড়ার আশায় রইলাম।

    ReplyDelete
  3. ভারতীয় চিত্রকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বহু শতাব্দী প্রাচীন। তারই সুমহান এই পরম্পরার একটি বিশেষ সময়ের চিত্রকলা (পাল যুগ) সম্বন্ধে এক তথ্য সম্বৃদ্ধ এই প্রবন্ধ পাঠে বেশ আনন্দ পেলাম।শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ জানাই এ জাতীয় লেখায় দু-একটি সে সময়ের আর্টপ্লেট দিলে পাঠকের কাছে তা আরও মনোমুগ্ধকর হতে পারতো। এ ব্যাপারে লেখিকা বা সম্পাদিকার দৃষ্টি আকর্ষন করছি। - গৌতম সেন

    ReplyDelete