0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in


আমার বামদিকে একখানি চওড়া পিচের রাস্তা আর ডানদিকে অনুচ্চ মালভূমির সারি, মধ্যিখানে যতিচিহ্নের মতো এই মাঠা বনবাংলো। বঙ্গালদেশে কার্ত্তিকমাস অতিথি হয়ে এসেছে ক’দিন হল, মেঘ এখনও বিদায় জানায় নাই এই শ্যাম ভূখণ্ডকে, মাঠা ও পাখি পাহাড়ের গায়ে গায়ে দোলা খাচ্ছে মেঘের দল। কুয়াশার মায়া রচনা করে উনানের ধোঁয়ার মতো ভেসে ভেসে কী জানি কোথায় চলেছে।

বাংলোটির বাহুল্য নাই, সবুজ রঙ করেছে এরা দেওয়ালে। সকাল থেকেই আজ খুব বৃষ্টি, কার্ত্তিকের দ্বিপ্রহরে বৃষ্টি হলে ভালো লাগে না, মন বিষণ্ন হয়, নরম হলদে মতো আলো প্রত্যাশী হৃদয় তোমার কথা মনে করে ভার হয়ে থাকে।

উঠানে বসে আছি। একখানি টিনের চাল মাথার ওপর, অনবরত জলপাতের শব্দ সেখানে পতঙ্গের পায়ের মলধ্বনি হয়ে বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে। আমার এপাশে দুটি যমজ তেঁতুল গাছ একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর উঠানের ওপারে পাহাড়ের সানুদেশে যৌবনকালের ভালবাসা হয়ে ফুটে আছে বৃক্ষরাজি। শাল আর মহুয়া। এখন ভারী সবুজ চারধার। অত সবুজ রঙের উৎসব দেখলে মহাপ্রাণের কথা মনে ভেসে ওঠে। সরু পথখানি পায়ে পায়ে মাঠা পাহাড়ের ওপরের দিকে গেরুয়াবসন সন্ন্যাসীর মতো চলে গেছে। সহদেব বলল, ও পথেই সায়ংকালে হাতির দল যাতায়াত করে।

সহদেব, ওঁরাও উপজাতির মানুষ। ওদের জাহেরদেবীর একটি প্রাচীন থান আছে ওইখানে, আমার সে অনার্য দেবীকে দেখার বড় বাসনা জেগেছে, একমুঠো বুনো ফুল কয়েকটি পাতা ভিজা শালপাতায় মুড়ে নিয়ে যাব, তবে বাসনা ক্ষয় করব বললেই তো আর করা যায় না, তার জন্য সংস্কার দরকার হয়। তবুও পথ বেয়ে যেতে ইচ্ছা করে তাঁর কাছে।

নিবিড় বৃষ্টিসম্পদে ভরা পথটি বেয়ে দেখি মাঠা পাহাড়ের সানুদেশে নেমে আসছে দুজন যুবতি। একজনের পরনে হেমন্তঋতুর বসন, অন্যজন নীলাম্বরী। টান করে চুল বেঁধেছে, তেলতেল জলে ভেজা মুখ। বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে। আজ বিষ্যুদবারে হাট বসে, দুয়ারসিনির হাট। কলহাস্যমুখর যুবতিরা বোধহয় হাটেই চলেছে।

কী কিনবে হাট থেকে কে জানে ! মাথার ফিতা, মোটা চাল, শুয়োরের মাংস নাকি ভাগা দিয়ে বিক্রি হয় হাটে, বড় বড় কাঁচা শালপাতায় মুড়ে দেয়, হয়তো মাংসও খানিক কিনবে। সর্ষের তেল, ঝাঁঝওয়ালা শুকনো লঙ্কা, তাজা মেটে আলু। আমি দীন নগরজন, জঙ্গলবিলাসী হাটের এসব চিত্রমালা তৈরি করি, জিনিস কিনতে পয়সা লাগে, ওদের হাতে পয়সা আছে কিনা তা জানা নাই। দুমুঠো ভাত জোগাড় করতেই আমাদের দিন ঢলে পড়ে রাত্রির দিকে, তারপর আবার অলঙ্কার আর জিভের স্বাদ! ওসব অরণ্যপ্রণয়কথা বাবুদের সাহিত্যেই ভালো!

দু ফাঁকওয়ালা ল্যাজ নিয়ে একটা ফিঙে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে শালগাছের মাথায়। শব্দহীন দ্বিপ্রহরে ওই দুজন যুবতি আর আমিই যেন জগত রচনা করেছি এখানে। আর কোথাও কোনও শব্দ নাই, শনশন শব্দে হাওয়া বইছে, ওপর থেকে পাহাড় মুছে দিয়ে নেমে আসছে শ্লেটরঙা মেঘ। 

এমন জলের দিনে হাট বসে না ভালো। দু চারজন জীর্ণ লোক ক’টি ক্ষেতের সবজি নিয়ে ভুঁইয়ের ওপর বসে থাকে। কোনও রঙ নাই, সন্ধে নেমে আসে চারপাশে, বেচাকেনা জমে না, আমার মতো বনবাংলোয় বেড়াতে আসা দিকুরা অশ্লীল রসিকতার মতো সস্তা বাজারে ঘুরে বেড়ায়। চা সিগারেট খায়, তাজা মউল খোঁজে, সেই কবে থেকে এমনই হয়ে চলেছে। আজকাল তো মোবাইল ফোন উঠেছে এদিকেও, হিন্দি গান বাজছে একটা ছোট চা-দোকানে। কাঠের আখার চায়ে ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। ডালবড়া ফুলুরি ভাজা চলছে কড়াইয়ে। 

একটু পরেই ময়লা মেঘের আলো ফুরিয়ে যাবে। হাতির দল যাতায়াত করে এ পথে, দুপাশে সাদা হলুদ পুটুস ঝোপ, পাতা ছিঁড়ে আঙুলে ঘষলে বুনো কষাটে গন্ধ লেগে যায় হাতে। জোনাকপোকা উড়বে আঁধারে, এমন পথের মাঝে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে, মনে মনে কত কথা ওঠে। সব অস্পষ্ট, কতক বুঝতে পারি কতক বোধবুদ্ধির সীমানার বাইরে বসে থাকে।

পথ বেয়ে একজন বুড়া লোক এক বালককে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে চলেছে। লোকটির উদোম শরীর, মলিন খেটো ধুতি পরনে, সারা দেহে আঁচড়ের মতো বলিরেখা। বালকটির খালিগায়ে বৃষ্টির জল মুক্তোর মতো ফুটে উঠেছে। ভারী সাধ হয় ওদের সঙ্গ নি, ওই রাস্তায় ভারতবর্ষ নামক এই বিচিত্র ভূমি হেঁটে চলেছে চার হাজার বছর পাঁচ হাজার বছর। 

ওই যাত্রাপথটুকুই শুধু বোধহয় বেঁচে থাকে,মহাকালসাগর স্রোতে মানুষের মতো ক্ষুদ্র অসহায় প্রাণীর হাত পা ছুঁড়ে আপ্রাণ ভেসে থাকার অসম যুদ্ধের কথা লেখা থাকে সেখানে। পথের প্রতিটি বাঁকে অস্ত সূর্যের আভায় ঝোপ জঙ্গল উঁচু উঁচু গাছেদের মাথায় কুয়াশাবৃত সন্ধ্যা ও সকালে প্রত্নচিহ্নের মতো লেগে থাকে নশ্বর ধুলাখেলার বাসনা রেণু। 

ভারী ভালো লাগে ওসব দেখতে, কোথাও পৌঁছে যাওয়ার তাড়া নাই আমার, সময়ের তীর নাই ঘাড়ের ওপর, শুধু সামনের দিকে চলা এখন, অনির্দিষ্ট পথে।



তবে বৈকালে মেঘ দূরদেশে রওনা দিল, দরিদ্র আলো ফুটে উঠল মহাকাশে, ভিজে ভিজে, জলে ধোওয়া নূতন ধান হতে তৈরি চালের মতো। 

আমার ঘরের ওদিকে পাহাড়, সবুজে সবুজ। তার পূর্বে চঞ্চলা নদী। পাথর আর পাথর নদীর দেহে, মাঝে ঝিরিঝিরি জলের শব্দ। 

জানলার পর্দা সরিয়ে চেয়ে আছি, উপত্যকায় চাঁদ উঠি উঠি তখন। কত রাত কে জানে! ঘড়ি নাই, চোখে আঁঠা আঁঠা তন্দ্রা। পাহাড়ের ঢালে রুপো রুপো আলো। দেখি জানলার বাইরে একজন বলিষ্ঠ মানুষ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, গায়ে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সরু পাড় মিলের ধুতি, হাতে একখানি ছড়ি। অবাক হয়ে চেয়ে আছি, একটু যেন ছায়া ছায়া দেহ। আমার দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন
—খোকা! যাবি বেড়াতে ?
—এখন ?! এই এত রাতে ?!
—ভয় কী! আমি আচি তো! চল, তোকে গাচ চেনাব কেমন!
—কী গাছ ?
—কেন, এলাচ গাচ! তুই চিনিস খোকা এলাচ গাচ ?
—এখানে কি এলাচ হয় খুব ?
—হয় তো! তারপর দেকবি কেমন পাখি আচে! এই বড় বড় মুরগির মতো!
—কী পাখি ?
—ওরা তো কালিস বলে ডাকে শুনেচি!
—কালিস ?
—হ্যাঁ রে!
বলেই কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল মানুষটির মুখ। চাঁদের আলোয় দুঃখী মানুষের মুখে অতীন্দ্রিয় ছায়া খেলা করে, প্রথমবার দেখলাম আমি। একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলেন
—সবাই ওদের মারতে চায় জানিস খোকা! শিকার করে! কালিসের মাংস নাকি খুব ভালো খেতে। 
—ইসস
—খুব লোভ রে চারধারে! দেকচিস না কেমন মানুষকে ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া করার বিচার বসেচে। 
—আপনি কি এখানেই থাকেন ?
এ-কথা শুনে হা হা করে খোলার মতো হেসে উঠলেন তিনি, তারপর বললেন
—আমাদের কি ঘর আচে, খোকা! 
—নাই ?
—নাহ! কেউ আমাদের ভালবাসে না রে বাবু
—তাহলে ?
—সে জন্যই তো তোকে নিতে এলাম!
—কোথায় যাব, আপনার সঙ্গে ?
—ওই যে দ্যাক, পাহাড়, তারপর একটা বরপের পাহাড়, তারপর ফুলের উপত্যকা, তার আগে ভালুকের দেশ, ওসব পার করে, সে এক দুনিয়া বুজলি কিনা!
—ভালুকের দেশ ?
—হ্যাঁ রে, এদিকে বলে ভুঁই-ভালু!
—তারপর ?
—তারপর, মৃত মানুষের জগত! কতরকমের বাসনার মানুষ!
—আপনি জানলেন কী করে ?
একটু মুচকি হেসে বললেন
—আমি জানি! ওসব যে আমারই তৈরি রে!
ভারী অবাক হয়ে শুধোলাম
—আপনার তৈরি ?
—হ্যাঁ রে! আমারই জগত! আমি মারি আবার বাঁচাই, আবার মারি, আবার বাঁচাই! সব আমার খেলা!
—আপনি কি লেখক ?
উঁচু গলায় হেসে উঠলেন তিনি।
—ওসব লেখা টেকা তোদের ব্যাপার খোকা! বুজলি কিনা, এই নিয়েই নিজের জগত আমার!
তারপর একটু থেমে ফের বললেন
—যাবি ? ওসবের পরেও এক অন্য ভুবন আচে! যাবি ? সেকেনে কিচুই নাই! আবার সব আচে! যেমন তুই ভাববি! তেমন! যাবি ? খোকা, যাবি না ?

তন্দ্রায় চোখ জুড়িয়ে এসেছে তখন। আমার মনে পড়ছে গত সন্ধ্যার কথা। সেই যে সহদেব আগুন জ্বেলে বসতে দিলেন আমায়,তাজা মহুয়া এনে দিলেন যত্ন করে। আকাশে কুচি কুচি তারা, চাঁদ ওঠে নাই তখনও। ওসব আগুন নক্ষত্রের দেশে পরী নামে বলে শুনেছিলাম, হাঁ করে কতক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে তার মন ভাবছিলাম, সেই যাকে কখনও আমার বলা হল না পীরিতের কথা, সেই তার কথা, ভাবছিলাম।

যাব কি ওই মানুষটির সঙ্গে, ঠিক বুঝতে পারি না। কী একটা পাখি ডাকছে, আধবোজা চোখে ঘুম পিঁড়ি পেতে এসে যেন বসেছে। একটা স্বপ্ন দেখার বড় বাসনা আমার, কতদিন স্বপ্ন দেখি না, সেই কতকাল পূর্বে যৌবনবেলায় দেখতাম, সুঁড়িপথ, দুপাশে পুটুসের দল, লোহার ঝোলাপুল পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি, সামনে, আরও সামনে, পূর্ব দিগন্তের দিকে!

গাছেদের শরীরে কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে বসে আছে হব্যবাহ, তার দাঁতগুলি সোনা দিয়ে বাঁধানো। তপ্ত কাঞ্চণবর্ণ পিঠ, স্বর্ণকেশরাজি কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। প্রথমে পুড়ছে চামড়া তারপর শুকনো পাতা সরু সরু ডাল, কৃষ্ণবর্ণের ধূম পাখা মেলেছে অন্তরীক্ষের দিকে।

বসে বসে ধুঁকছে একটি বুনো হাতি। পেটের কাছে দগদগে ক্ষত, ঝলসে গেছে শুঁড় আর চোখদুটি। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। ভকভক করে পেটের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে টাটকা রক্ত, আর কিছুক্ষণ মাত্র তারপর প্রাণবায়ুটুকু মিশে যাবে লেলিহান অগ্নিশিখায়।

চিতাবাঘের কুশি কুশি বাচ্চাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। ওদের চোখে এখন সবকিছুই রক্তবর্ণ। গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই উড়ছে বাতাসে, গতকাল থেকে ওদের মা ফেরেনি। কালো আঙরা হয়ে পড়ে আছে তার দেহখানি, দুপাশে যতদূর চোখ যায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বৃক্ষশরীর। 

আজ অনেকদিন পর দেখা হল আমার এক পুরাতন সখার সঙ্গে। সাদা ধুতি আর জামা পরে বাড়ির দরজা খুলে দিল। উঠান জুড়ে এই বড় বড় বর্ষাঋতুর দলঘাস। কাঠচাঁপা গাছে কত ফুল এসেছে। সেই বিকশিত সজল কুসুম আমাকে শোনাল অগ্নির কথা, তাদের আত্মজনের পুড়ে মরার গল্প।

হরি মহারাজ শশী মহারাজদের নিয়ে কথা হল। সেসব এই ধুলামলিন পৃথিবীর ভালবাসার আখ্যান। বন্ধুটির ওষুধ বিক্রি এখনও ফুরোয়নি, একটু বুড়ো হয়েছে, বলল, অবুঝমারের জঙ্গল নষ্ট করে দিয়েছে খনিজ সম্পদ লোভী বানিয়ার দল। 

আমার আর কখনও জঙ্গলে যাওয়া হবে না। চুকেবুকে গেছে ওসব পীরিত। বনবাংলোর অন্দরমহল নিয়ে যে লেখা আমি দেখেছিলাম, সংসারের কারাগার সেখানে ঢেলে দিয়েছে বিষ। 

আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম, অনেক বৃক্ষ, প্রাচীন দেবতার মতো তারা আমাকে বলছে, তুমিও বিস্মৃত হলে ? আমি হাত বাড়িয়ে মান ভাঙানোর চেষ্টা করলাম, দেখি করতলে সাদা সাদা ছাই লেগে গেল।

ফেরার সময় চারটি রুটি কিনলাম, আর এক কৌটো আলুর তরকারি, রাতে খাব। তারপর ঘুমোব। গাছেদের কথা ভেবে কী করব আমি! ওসব মহাজগতের বিষয়।




গাঢ় ঘুম নেমে এলো বোধহয় এবার, রাত কি এখনও বাকি ?শুনেছি শেষরাতের ঘুমে কামনা লেগে থাকে। ওই টানেই তো এখনও তাঁর দেখা মেলে না, শুধু চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে কাল কেটে যায়। ওই ভবচক্রেই এবারের মতো খেলা ফুরোবে আমার, জানি! কিন্তু আর কতদিন ?

0 comments: