ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
১০
সারাদিন ধরে কুনিহা গ্রামটি থমথমে অন্ধকার হয়ে রইল। মাঝেমাঝে চমক দিয়ে সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঘনঘটা। কুটিরগুলো ঘিরে একটা বিশাল আটচালা ঘরের মাঝে গোরাচাঁদের নির্দেশমত কুয়ো খুঁড়তে লেগেছিল জন তিরিশেক লোক। ওই আটচালা একটি প্রার্থনা সভা মিটিং ও শিক্ষাদানের কেন্দ্র। বাইরে কুয়ো হলে তাতে এখন বিষাক্ত বৃষ্টিজল জমবে, সেটা পান করলে হবে আরো খারাপ। কিন্তু মাত্র চার পাঁচ হাত খুঁড়তেই ফিনকি দিয়ে কুয়োতে জল আসতে শুরু হয়ে গেল। সারাদিন ধরে তেষ্টায় থাকা মানুষগুলোর তখন ভীষণ আনন্দ। এমনসময় গোরাচাঁদ প্রায় ছুটতে ছুটতে আটচালার নিচে এলেন। বালতিতে জল ভরে ছাকতে লেগেছে ওরা সেই জল পান করার জন্য। কয়েকজন খেয়েও নিয়েছে ইতিমধ্যে। গোরাচাঁদ বালতি উল্টে দিলেন।–খবরদার, এই জল পান কোরোনা কেউ। পাশেই সরোবরের দূষিত জল। তাই এতো তাড়াতাড়ি গর্তে জল এসেছে। এইজল বিষাক্ত। মাটির ভিতর দিয়ে চুইয়ে এসেছে। আর্সেনিক এন্টিমনি সাংঘাতিক বিষাক্ত ধাতু। এর নমুনা তো তোমরা দেখছো।
সবাই চুপ। যারা জল পান করেছে তারা মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করছিল। প্রত্যেকের মুখে অসহায়তা। গোরাচাঁদ সবাইকে বৃষ্টি থামলে নিজের ঘরে ফিরতে নির্দেশ দিলেন। উনি নিজের কুটিরের দিকে পা বাড়াবেন,সেইসময় তড়বড় করে বৃষ্টি নামল। ইশারায় সবাইকে মানা করলেন না যেতে। এইজল গায়ে পড়লে আর বাঁচতে হবেনা। প্রায় আধঘণ্টা তুমুল বৃষ্টিপাতের পর বৃষ্টির ধারা কম হতে দেখাগেল সেখানের একধরনের জংলী বেতে বোনা মস্ত ঘেরাওলা ছাতা নিয়ে পেরো হাজির। গোরাচাঁদকে নিয়ে যাবার সময় আশ্বাস দিল প্রত্যেককে নিয়ে যাবে। কেউ যেন না বেরোয়।
গোরাচাঁদের ঘরে জেরেকা জোহা পেরো ও পাঁচজন সেবক বসেছিল। চুপচাপ। বৃষ্টির ছাটে জোহা মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল আর মাঝে মাঝে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছিল। পেরো ওর কাঁধে হাত রাখলো। গোরাচাঁদ মুখ খুললেন।
-কুয়োর জল পান করা কোনোমতেই যাবেনা। যেমন বৃষ্টি পড়ছে মনেহয় রাতভর পড়বে। আগামীকাল বৃষ্টি থামলে আমাদের এখানের যত বহুমুল্য জরুরী ঔষধি ফল ফুলের চারা, শস্যবীজ ও খাদ্য শস্য সংগ্রহ করতে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব এখান থেকে যাওয়া দরকার।
একজন সেবক বললেন,-গুরুজি চিন্তা করবেন না। আমাদের এখানে একধরনের গাছ আছে যার কান্ড হাঁড়ির মত ফোলা। সেখানে ছেঁদা করলে যে জল বেরোয় তাতেই আমাদের পিপাসা মিটে যাবে।
-কিন্তু তা আর কতক্ষন?
বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। কুটিরের বাইরে জল থৈ থৈ। কিন্তু জলাশয়ে জলস্তর অনেক নেমে গেছে। যেন দ্রুত খালি হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কড়কড় শব্দে এখানে ওখানে বাজ পড়ছে। ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানো নতুন অভিজ্ঞতা নয় বনবাসীদের কাছে। কিন্তু এমন অদ্ভুতভাবে পাহাড় ফেটে চৌচির হওয়া? আর সাথে সাথে এমন ভয়ানক বৃষ্টিপাত? প্রকৃতি নিজের পছন্দমত সৃষ্টি করেছে এই ভূস্বর্গ,এখন নিজেই তা নাশের জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। গোরাচাঁদ সরোবরের দিকে চোখ রেখে বললেন,-আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব। -আমরা কি কোনোদিন এখানে ফিরব না? জোহার হাহাকার। সবাই নতমুখে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভেষজ রেডির তেল দিয়ে জ্বালানো প্রদীপ নিভু নিভু। -অনেক রাত হোলো এবার তোমরা নিজের ঝোপড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়। সকাল থেকে অনেক কাজ। জেরেকা গোরাচাঁদের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।-না গুরুজি,আমাকে আজ এখানেই থাকতে দিন। এই রাত আপনিই আমার বাঁচার আশা। তারপর তো আমাদের কিছুই করার নেই। আমি হেরে গেছি গুরুজি।মনে হয় এই ধরতি আমাদের জন্য নয়। আমরা সর্বকালে সবার কাছ থেকে প্রতারিত বিতাড়িত। প্রকৃতিও আমাদের উপর জুলুম করেছে। এক জায়গায় তিষ্ঠতে দেয়নি। ও আমাদের চায়না তার কোলে আমরা শান্তিতে বাস করি।
-ওরকম কথা কেন বলছ জেরেকা। প্রকৃতি তো নিজেই এখানে শোষিত। তাকে উদ্ধার করতেই তো সে আমাদের এখনো সুস্থ সবল রেখেছে। তারই কোলে তোমাদের সবার মন প্রাণ শরীরের পরিবর্তন হোলো এটা দেখছো না? পেরোকে দেখ? কেমন আদিম মানুষের মত চেহারা আর স্বভাব ছিল? শুধু পেরো কেন? এখানের প্রতিটি মানুষ বহির্জগতের জন্যে আদর্শ পুরুষ হয়ে উঠতে পারে। এই বিপর্যয় কোনো বাধাই নয়। আমাদের এখন নতুন করে বাঁচতে হবে। ভেবে দেখ। এখানে আসার পর প্রত্যেক জনজাতি মানুষের বুদ্ধি বেড়েছে,শরীরে বল এসেছে, ডিসিপ্লিন শিখেছে,প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা হয়েছে। প্রতিটি মানুষ জানে অমূল্য বনৌষধি গুল্ম লতা বৃক্ষের জীবনরক্ষাকারী গুণ। প্রত্যেকে চিনে ফেলেছে সেই সব গাছ। গতানুগতিক শস্যদানা শরীররক্ষার খাদ্য ছাড়া অনেককিছু মহারণ্যে রয়েছে যাতে সারাজীবন সুস্থ জীবনযাপন করা যেতে পারে।তবে আর কিসের ভয়?এবারে আমরা নতুন করে বাঁচবো।
গোরাচাঁদ আরো অনেককথা বলতে লাগলেন। একসময় খেয়াল হলো কেউ সাড়া দিচ্ছেনা। বাইরে বৃষ্টি তুমুল। সবাই ভীষণ ক্লান্ত। উত্কণ্ঠার অবসানে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোর হওয়া অব্দি জেগে রইলেন গোরাচাঁদ। আকাশ এখনো থমথমে। বৃষ্টি একটু ধরেছে। সবার আগে পেরো জাগলো। ঘুম থেকে উঠেই সটান বাইরে। একটু পরে দেখা গেল একে একে সবাই সরোবরের কিনারে উপস্থিত। সরোবরের জল প্রায় শেষ। পড়ে রয়েছে পদ্মের শিকড় জলজ শৈবাল মৃত সাপ আর প্রচুর মাছ। ওরা খাদ্য বস্তু,কিন্তু এখন জলহীন মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখে সবার চোখে জল। দূরে পাহাড়ের ভগ্নস্তুপ দেখা যায়। বিশাল পাহাড় ছিল কিন্তু এখন বোঝা যায় সেটার ভিতরটা একেবারেই ফাঁপা ছিল।এখন তো সেখানে টইটম্বুর জল। যারা এই কাজ করেছে তাদের খনিজ আকর উদ্ধার করা এখন প্রায় অসম্ভব। গোরাচাঁদ জেরেকাকে তদারকি করতে বললেন সবাইকে নিজের জিনিষপত্র গুছিয়ে নিতে। পেরো ও জোহাকে বললেন বনৌষধি ও মুল্যবান সব গাছের চারা গুল্ম বীজ সংগ্রহিত মধু ও শস্য সব আজকেই জোগাড় করতে। আজ দুপুরের মধ্যেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর জোহা হবে আমাদের গাইড।
দুপুরের সময় আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আকাশ অন্ধকার। দুর্যোগ মাথায় করে বেরোতেই হবে এই আদেশ গোরাচাঁদের। সবাই কিন্তু এমনি অসময়েও তৈরি হয়ে গেল। গোরাচাঁদ ও পেরো প্রত্যেককে বয়ে নিয়ে যাওয়া অহেতুক অবাঞ্ছিত জিনিসগুলো রেখে দিয়ে প্রয়োজনীয় চারাগাছ খাদ্য শস্য বীজ ওষুধ ইত্যাদি বেশি করে দেওয়া হলো। যারা কুয়ো খোড়ার সময় জল খেয়েছিল, তাদের সেবকেরা একধরনের পাচন খেতে দিয়েছিল যাতে বিষ মল মুত্রের সাথে বেরিয়ে যায়। ওরা একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল। একসময় শুরু হলো যাত্রা। প্রায় তিনশো মানুষ খুব সংযত হয়ে নিয়মানুবর্তিতা মেনে লাইনবন্দী হয়ে চলতে লাগলো। মহিলা বেশি নয় মাত্র কুড়ি আর বাচ্চা দশজন। সব পুরুষের কাঁধে বাঁক। মেয়েদের মাথায় ঝুড়ি। কয়েকজন পদ্মের বীজ সংগ্রহ করেছে। পাকদন্ডি বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে গোরাচাঁদ লক্ষ্য করলেন মস্ত সাপের মত মানুষের লাইন এঁকেবেঁকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাহাড়ের উপর উঠছে। এতো উপর থেকে দক্ষিণ দিকটা আবছা দেখা যায়। সেদিকে শুধু জল আর জল। গোরাচাঁদের মনে পড়ে সেই পুরাণে বর্ণিত মহাপ্লাবনের কথা। সেইসময় সৃষ্টি রক্ষার তাগিদে মহর্ষি মনু ঠিক এমনিই গাছপালার চারা বীজ সংগ্রহ করে মত্স্যবাহী নৌকোতে চেপে অপেক্ষা করছিলেন প্লাবন থেমে যাওয়ার জন্য। জলস্তর নেমে নতুন উর্বর মাটি পাওয়ার পর তিনি আবার প্রকৃতি রোপণ করেছিলেন। তিনি জোহার দিকে তাকালেন। জোহা খুব অন্যমনস্ক হয়ে পথ চলছে। চোখে জল। পিছু ফিরে দেখছে বারবার। আচ্ছা ! জোহা কি পারবে নতুন উর্বর মাটি দিতে? এই দুর্লভ অমৃত চারাগাছ ও বীজ রোপণ করার?
0 comments: