0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in




















২২ 

কাঞ্চন ঘোষ দস্তিদারকে আর শিলিগুড়ির কে পি বাজোরিয়ার সেই মুনিমজিকে এক সাথে পুলিস গ্রেফতার করেছিল দু জায়গা থেকে। 

একসাথে চারটে খুন আলাদা আলাদা জায়গায়, আর একটা অ্যাসিড অ্যাটাক। একটা আত্মহত্যার কারণ, সব একসাথে মেটানর পরে পুলিসকে মিডিয়ার মুখমুখি হতেই হত। সুব্রত সেনগুপ্ত পরেশ সামন্তকে অনুরোধটা করায় সামন্ত প্রায় একহাত জীভ কেটে বলেছিল ওসব প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজ যারা করে তাদের জন্য নয়। তাদের যদি লোকে চিনেই ফেলে তবে চুপিচুপি কাজটা কি করে করবে? 

সুব্রত সেনগুপ্ত মিডিয়ার সামনে এসে একে একে সব জানালেন। সেও একটা গল্পেরই মতো। যার শুরু সেই টি ভ্যালী রিসর্টে উদ্বোধনের রাতে। 

ঐ ভিডিও ফুটেজ দেখার পরেই কেপি তার ছেলের বৌয়ের অসম্মানের জন্য তার মুনিমজিকে বলেছিলেন যেন তেন প্রকারেণ ঐ গায়ককে যেন পথের ভিখারি করে দেওয়া হয়। 

মুনিমজির হাতে অ্যান্ডির কন্ট্যাক্ট বলতে তখন কাঞ্চন। পুরো ব্যাপারটা তাকে বলে একটা বিরাট টাকার টোপ দিয়েছিল মুনিমজি। বসে খাওয়া কাঞ্চনের কাছে সেটা ছিল একটা লটারি পাওয়ার মতো। অবশ্য রক্তের সম্পর্কের নাহওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রী অলি অ্যান্ডিকে খুব ভালবাসত সেটা তার একটা ঈর্ষা বা সন্দেহের কারণও হতে পারে, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অ্যান্ডিকে বাড়িতে আনার পরে থেকেই সে অ্যান্ডির পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ খবর করা শুরু করে এবং ব্যাকট্র্যাক করে সঞ্জয়ের পরিবারকে সে খুঁজে বার করে। 

সঞ্জয় আর তার মাকে অ্যান্ডির বাবা অনিকেত মৌলিক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন যখন তার বয়েস মাত্র তিন। তারপরে উত্তর শহরতলীর পাঠ চুকিয়ে দক্ষিণ শহরতলীতে এই নতুন হাউসিং এ ফ্ল্যাট নিয়ে তিনি চলে আসেন। এই ফ্ল্যাটের অর্ধেকের বেশী টাকা অ্যান্ডির মা তাঁকে দেন। আর সঞ্জয়ের মা তাকে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ীতে ফিরে যান। 

তিনি এখানে থিতু হয়েই নিজের ফর্মে ফেরেন। অত্যাচার অনাচার যৌন নির্যাতণ সবই তিনি নিজের ইচ্ছামতো করেছেন অ্যান্ডি ও তার দিদির উপরে কারণ এরা দুজন কেউই তার নিজের ঔরসজাত সন্তান ছিল না। তাঁর মানসিক নির্যাতনে অ্যান্ডির দিদির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়। অ্যান্ডির মা এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকবার মারধরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর তাঁর এই দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তিনি এঁটে উঠতে পারতেনও না। 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অ্যান্ডি এই সব কিছু থেকে মুক্তির রাস্তা হিসাবে নেশার রাস্তা বেছে নেয়। গানের গলা ভাল ছিল তাই গান টান করত বন্ধুদের সাথে আর করত নেশা। 

হঠাৎ তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে যান অনিকেত মৌলিক। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অ্যান্ডির একটা দুষ্কর্মের জন্য। সেখান থেকে বহু ঘাটের জল খেয়ে তার আশ্রয় হয় ঘোষদস্তিদারপরিবারে। 

যেকোন কারণেই হোক কাঞ্চনবাবু ওনার স্ত্রী অলির অ্যান্ডিকে ভালবাসাটা মেনে নিতে পারেননি। হতেই পারে, উনি ওনার পরিবারে একমাত্র সন্তান, তাই ভাই বোন দিদি ইত্যাদি ব্যাপারটা বা স্নেহ মায়া মমতার ব্যাপারটা তাঁর হয়ত খুব একটা পছন্দের তালিকায় ছিল না। 

নিজের স্ত্রীকে কিছু না জানিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের ও আপার্ট্মেন্টের অন্যান্য বাসিন্দাদের মাধ্যমে উনি অ্যান্ডিদের পরিবারের খবরাখবর জোগাড় করতে থাকেন। তারপরে খুঁজে বার করার পালাটাও খুব সন্তর্পণে সমাধা করেন কাঞ্চন। 

তিনি খুঁজে পান সঞ্জয় মৌলিক ও তার অসুস্থা মাকে। বলে অলস মাথা শয়তানের বাসা, কাঞ্চন ঘোষদস্তিদারহচ্ছেন তার একটা আদর্শ উদাহরণ। উনি বাবার কাছ থেকে পাওয়া ক্লায়েন্টেলকে প্রপার সার্ভিস দিতে খুব অনীহা বোধ করতেন। একদিকে কিছু ইমপ্রেসেরিও বন্ধুদের সাহায্যে অ্যান্ডির প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে দিতেন, অ্যান্ডি গান করত উনি কাট মানি খেতেন। অন্যদিকে সঞ্জয়কে গুছিয়ে মগজ ধোলাই করতেন। 

এই কাজটাকে উনি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। আর ওনার ছাত্র সঞ্জয় ছিল আরো এককাঠি সরেস। শয়তানিটা জিনগত ভাবে বোধ হয় নিজের জন্মদাতা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। 

দুটো স্ট্রিট হুলিগানকে তাদেরই অস্ত্র দিয়ে খুন করা দিয়ে হাতেখড়ি। তারপরে নজরে পড়ে গণেশ নামের এক বড়োমাপের মস্তানের। সে খুব বুদ্ধি করে সঞ্জয়কে তার দলের বাকীদের থেকে আড়ালে রেখে কাজ করাতে থাকে। 

দুজন প্রোমোটারের অনেক টাকা একজন মেরে বসে ছিল, সেই লোকটিকে শিক্ষা দেওয়ার দ্বায়িত্ব নিয়ে তাকে চোখে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দেয় সঞ্জয়। এইখানে তার অসম্ভব একটা কূট বুদ্ধির ছাপ আমরা দেখতে পাই। সেই লোকটির সমস্ত খবরাখবর সঞ্জয় একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দিয়ে নেওয়ায়। একদম পেশাদার খুনিদের মতো নিখুঁত ভাবে কাজ করে বেরিয়ে যায়। 

সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া লোকটি পরে টাকা শোধ করে দেয় ঐ দুই প্রোমটারকে, গণেশের নাম ছড়িয়ে পড়ে ঐ মহলে। 

পরেরটা ছিল একজনের স্ত্রী তাঁরই ড্রাইভারের সাথে প্রচুর পরিমাণে ক্যাশ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় সেই স্ত্রীকে আর সেই টাকাকে উদ্ধার করে দেওয়া, সাথে যার সাথে সেই ভদ্রমহিলা পালিয়েছিলেন সেই ড্রাইভারকে শিক্ষা দেওয়ার কাজ। । 

আবার গণেশ ও সঞ্জয়ের জুটি কাজটা নিঁখুত ভাবে করে। আর সেই লোকটি তার পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী ও টাকা ফেরত পায়। 

নাম বাড়তে থাকে, এবারে কাজ আসে সিন্ডিকেট থেকে অন্য সিন্ডিকেটের এক মাথাকে সরিয়ে দেওয়ার বরাত। এইখানে এসে সঞ্জয় তার প্রথম ভুলটা করে ফেলে একই এজেন্সিকে সে তিনবার কাজ দেয়। হয়ত সেটাও ধরা পড়ত না, কিন্তু এজেন্সির মালিকও ধুরন্ধর বুদ্ধিমান লোক। আর বোধহয় ধর্মের কল বাতাসে নড়েও গেছিল খানেকটা। যে লোকের খবর নেওয়ার জন্য সঞ্জয় গেছিল, সেই লোকটি এই এজেন্সির মালিকের ব্যক্তিগতভাবে পুর্বপরিচিত। আর তাকে যখন বলা হয় যে ঐ লোকটি সঞ্জয়ের জামাই তখন তার সন্দেহ গাঢ় হয়, কারণ সেই লোক বিয়েই করেনি। বাই দ্য ওয়ে সঞ্জয় সেখানে একজন বৃদ্ধ সেজে গেছিল। আর তার হাটাটা একটু ভুলভাল হয়ে গেছিল এজেন্সি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়। সেটাও খটকাটাকে আরো বাড়িয়ে দেয় সেই ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিকের। 

উনি তখন ওনার ঘরে রাখা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ইত্যাদি নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের অফিসের একজন প্রিয় সহকর্মীকে সঞ্জয়ের দেওয়া ঠিকানা খোঁজ করতে পাঠায়। 

সঞ্জয় কি ভাবে যেন বুঝতে পারে যে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সঞ্জয় ঐ লোকটিকে পেয়ে যায় তার নিজের দেওয়া ঠিকানা ভেরিফিকেশানের সময়। সেই ঠিকানাটা ছিল ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা বড় গোয়ালের। এবারে এজেন্সির সেই লোকটি সঞ্জয়ের শিকার হয়। 

ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিক এবার ব্যাপারটা পার্সোনালি নিয়ে নেন। আর সঞ্জয়কে খোঁজা শুরু করেন, আর আমাদের ও খবরটা দেন। 

এই খোঁজের একটা অংশে এসে তিনি বার করেন যে সঞ্জয় আরো দুজনের খোঁজ করিয়েছিল ওনার এজেন্সিকে দিয়ে। এবারে উনি খুঁজতে যান সেই দুজনকে আর তাতেই তার সামনে আসে সঞ্জয়ের আরো দুটো দুষ্কর্মের। এই দুটো কাজের মধ্যে একটাই মাত্র যোগ সুত্র ছিল ক্লোরোফর্ম। সঞ্জয় যাকে যাকে আক্রমণ করেছে তার সাথে আর যাকে পেয়েছে তাকে নাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে পালিয়েছে। আর এই ক্লোরোফর্মের সুত্র ধরে উনি বার করেন যে গায়ক অ্যান্ডিকে দুবার আক্রমণের শেষ বার নাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে নাকে কোকেনের গুঁড়ো দেওয়া হয়েছিল। 

এই সুত্রধরে আমরা মোট তিনজন প্রোমোটারকে গ্রেপ্তার করি, তাদের থেকে গণেশর নামটা পাই। ইতি মধ্যে আমাদের লোকেরা সঞ্জয়ের শেষ টার্গেট ভালূয়ার উপরে নজর রাখতে থাকি। সেখানে গণেশকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। সঞ্জয়ের অনুপস্থিতিতে সে নিজেই ভালুয়াকে মারতে চেষ্টা করেছিল এবং ধরা পরে গেছিল আমাদের লোকেদের হাতে। আর গণেশের সাহায্যে আমরা পাজলের বেশ কিছু টুকরোর খোঁজও পেয়ে যাই। 

এরমধ্যে টি ভ্যালীর ওপেনিং সেরিমনির রাতের আরো একটি ভিডিও ক্লীপীংস মিডিয়ার হাতে চলে আসে। আর তার ফলে সেখানকার মালিক প্রেস কনফারেন্স করে জানিয়ে দেন তিনি তাঁর বর্তমান স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন যার সাথে ঐ ক্লীপীংস এ তাকে দেখা গেছে। ওনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেন প্রায় সাথে সাথে, ঐ প্রেস কনফারেন্স থেকে কেউ একজন ওনাকে তাঁর মোবাইল থেকে সরাসরি সাক্ষাতকারটা শোনাচ্ছিল। উনি ব্যাপারটা জাস্ট মেনে নিতে পারেননি। 

পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নেয়। কে পি বাজোরিয়ার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন ওনার ছেলের বৌ। উনি আবার ওনার মুনিমজিকে মাঠে নামান। আর মুনিমজি তাঁর কোলকাতার কন্ট্যাক্টকে সিগন্যাল দেন অ্যান্ডি শুড ডাই। 

কিন্তু সঞ্জয় ততদিনে নিরুদ্দেশ। তার মা দুজন নার্সের সেবায় বেঁচে রয়েছেন। এই খবরটা আমরা পাই গণেশের কাছে থেকে। আমরা নার্স দুজনের উপরে নজরদারই বাড়াই। আর তার থেকেই আমরা জানতে পারি যে তাদের দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেউ একজন ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। আর সেই নম্বরটা কাঞ্চন ঘোষ দস্তিদারের। আমরা ওনার উপরেও নজর রাখা শুরু হয়। সেই নজরদারি থেকে আমরা জানতে পারি ওনার কাছে আসা ফোনের ব্যাপারে। আর সেখান থেকেই আমাদের কাছে খবর চলে আসে যে অ্যান্ডিকে মারার চক্রান্ত চলছে। 

অ্যান্ডির উপরে আগে দুটো অ্যাটাক হয়ে গেছে। সে দুটো যে করেছে সে খুব ভালো ভাবে চারপাশের খবরাখবর নিয়েই কাজ দুটো করেছে। আর চলে যেতেও সক্ষম হয়েছে। কাছের লোক না হলে এই খবরগুলো দেবে কে? সিসি ক্যামেরারতেও ধরা যায়নি সঞ্জয়ের মুখের সুস্পষ্ট ছবি। কাছে এলেই স্ক্রীনে ইন্টারফিয়ারেন্স। যেটা এজেন্সির লবির ক্যামেরাতে হয়েছিল। ফ্রন্ট ডোরের ক্যামেরাতে হয়েছিল, অ্যান্ডির রাজারহাটের ফ্ল্যাটের ক্যামেরাতে হয়েছিল, কিন্তু এজেন্সির মালিকের ঘরের ক্যামেরাতে হয়নি। কারণ ঐ একটা মাত্র ক্যামেরা ছিল যেটার কাছে সঞ্জয় পৌছতে পারেনি। ওর মাথায় একটা স্ন্যাপব্যাক টুপি থাকত সর্বদা যেটার মাথার উপরে একটা এল.ই.ডি প্যানেল সঞ্জয় খুব দক্ষতার সাথে লাগিয়ে রেখেছিল আর এল.ই.ডি প্যানেলের উপস্থিতি সিসি ক্যামেরায় রেকর্ডিংএ ইন্টারফিয়ারেন্স ক্রিয়েট করে দিত। ফলে ওর মুখের ছবি ক্যামেরাতে সুস্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায়নি এজেন্সিতে তৃতীয়বার আসার আগে। আগের দুবার ওনার সাথে কথা বলেন এজেন্সির অন্য দুজন লোক। তৃতীয়বারে এজেন্সির মালিক নিজে সঞ্জয়ের সাথে কথা বলেন। 

এবার সমস্ত ইনফর্মেশানকে অ্যানালিসিস করে আমরা কনফর্ম হয়ে যাই যে কে এই সব ব্যাপারের পিছনে রয়েছে। তখন আমরা অ্যান্ডির বাড়িতে যোগাযোগ করি। আর কিরণ বাবুকে জানিয়ে দিই যে অ্যান্ডির প্রাণনাশের চেষ্টা চলছে। উনি সত্যিই অ্যান্ডিকে ভালবাসেন। আর তাই আমাদের সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন। 

এবারে আসে সেই খুনি সঞ্জয়কে ধরার ব্যাপার। আমরা সবদিক থেকে আট ঘাট বেঁধে কাজ শুরু করে দিই। 

দিন কতক বাদেই ছিল অ্যান্ডির একটা সিনেমাতে নায়ক হওয়ার ঘোষণা। আর অন্য একটা মিউজিক ডিভিডি লঞ্চের অনুষ্ঠান। আমার প্রযোজক সংস্থার সাথে কথা বলে অনাদের টাইম সিডিউলের আচমকা এদিক সেদিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। 

আর অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্যে অ্যান্ডির বাবাকে সামনে এনে একটা মৃত্যুপুর্ব দৃশ্যের প্রচার করতে শুরু করে দিই। অ্যান্ডিকে সেখানে আনার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আমাদের লোক তৈরী ছিল। অ্যান্ডি সেখানে পৌছায়, সঞ্জয় ও পৌছায়। তাকে মারতে। এর মধ্যে আমাদের লোক ছিল ঐ ঘরের মধ্যে। তার গুলিতে সঞ্জয় মারা যায়। তাকে গ্রেফতার করাটা সম্ভব হয়নি কারণ ঐটুকু সময়ের মধ্যে সে ঐ ঘরের প্রায় সবাইকে আহত করে দিয়েছিল। 

আর এর সাথে খতম হয় এক ভয়ংকর খুনীর মারত্মক খুনের প্রচেষ্টা। আমরা এই ষড়যন্ত্রের বাকী সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। 

আশা করি আপনাদের আর কোন প্রশ্ন নেই? 

বেশ নাটকীয় ভাবে প্রেস কনফারেন্স শেষ করে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে গেলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। 

বিকেলে পরেশ সামন্ত ফোন করে বললেন, 

স্যার আরো একবার দেখা করা দরকার যে। 

সুব্রত সেনগুপ্ত ভুরুটা একটু কোঁচকালেন, তারপরে বললেন, 

চলে আসুন। 

আধঘণ্টা বাদে পরেশ সামন্ত ঘরে ঢুকে একটা সাদা খাম ওনার টেবিলে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন স্যার। আমি কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরে নিজে বডি আইডেন্টিফাই করতে চেয়েছিলাম। 

সুব্রত সেনগুপ্ত খামটা তুলে তার ভেতর থেকে চিঠিটা বারকরে পড়তে শুরু করলেন। 

মিঃ সামন্ত। 

একজন বুদ্ধিমানের সব সময় তার প্রতিপক্ষকে মর্যাদা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, আর সেই সুত্রে আমি প্রথমেই আপনাকে আমার শ্রদ্ধা জানাই। 

কিন্তু আপনার বড়কর্তা (সত্যিই উনি আপনার বড়কর্তা কিনা জানিনা, কারণ আমার মনে হয় উনি ও ওনার দপ্তর আপনার সাথে প্রযোজনভিত্তিক হাত মিলিয়েছেন) উনি মশাই বেজায় মিথ্যাবাদী একজন লোক। তা নাহলে উনি মিডিয়ার সামনে বেমালুম চেপে গেলেন যে ঐ গণেশদা ও কাঞ্চন ঘোষদস্তিদার(যিনি কিনা আমাকে নিজের নাম বলেছিলেন হিরণ্ময় নন্দ) ডেডবডি দেখে বলে যে ওটা আমার বডি নয়। আর আপনারা ঐ দুজন নার্সকে ধরতে পারেছেন ঠিকই কিন্তু আমার মাকে উদ্ধার করতে পারেননি সেটাও ওনার বলা উচিত ছিল। 

আপনাকে কয়েকটা ব্যাপার আমি বলে দিই যেটা আপনি হয়ত মেলাতে পেরেছেন বা পারেননি। 

কাঞ্চন ঘোষদস্তিদারএসে যেদিন আমাকে বলেন আমার জীবনের দুঃখের কারণ ঠিক কে সেটা তিনি জানেন, আর তিনি একদিন আমাকে তার ঠিকানাও জানিয়ে দেবেন সময় এলে। আর এই সব বলে আমাকে তাতাতে শুরু করেন আমিও সেই দিন থেকে ওনার ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে শুরু করে দিই। 

মানতে হবে উনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন যেগুলো আমি আমার ঐ অল্প বয়েসে জানতামই না। আর যে শিক্ষাগুলো আমাকে অনেকের থেকে এগিয়ে যে রেখেছে সেটা আপনি আমার এই চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারছেন। 

এবারে আসি সেদিন আমি কি করেছিলাম। কাঞ্চন ঘোষ আমাকে যখন অ্যান্ডিকে মেরে ফেলার কথা বলল আর তার জন্য প্রচুর টাকা অফার করল আমি তখন থেকেই একজনকে এই কাজের জন্য ফিট করি। আপনি ভাববেন হয়ত যে ব্যাপারটা কি ছেলের হাতের মোয়া? না তা নয়। কিন্তু এ দেশে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্যাশ দিলে একটা গরীব ছেলেকে দিয়ে অনেক কিছু করা যে যায় সেটা আপনিও দেখলেন। আমি শুধু ছেলেটাকে টোপটা ঠিকঠাক খাওয়াতে পেরেছিলাম। 

কাঞ্চন ঘোষ সেই দিন আমাকে যে খবর দিচ্ছিল, আমি সেটা তৎক্ষণাৎ আমার সেই ছেলেটিকে দিচ্ছিলাম। নিজে অনেকটা দূরে ছিলাম যাতে কোন ভাবেই ধরা না পড়ে যাই। 

আসলে আমি টাকাটা পাওয়ার পরে ভাবলাম এটা না থাকার জন্যেই তো আমার আর মায়ের জীবনে এত ভোগান্তি। তা এতটাকা পেলাম সেটা ভোগ করব না? 

তাই ঘুঁটি সাজাব বলে বেরিয়ে প্রথমে আমার মাকে আমি সরিয়ে ফেলি ঐ দুই নার্সের হাত থেকে। তারপরে ঐ ছেলেটাকে টাকাটা দিয়ে দিই। এবারে ও মারতে পারলে ভালো না পারলে আমার কিছু অসুবিধা নেই। এবারে দেখুন ব্যাপারটা কেমন হল। 

আমি বেঁচে আছি সেটা আপনি জানতে পারলেন। পুলিস ও জানবে আপনার কাছ থেকে। আমি নিজের ভোল পালটে কোথায় আছি সেটা আপনি বা পুলিস জানতে পারবে না। 

আমার বাবা যিনি আমাদের বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে অন্য একটা সংসার করে সেখানেও অত্যাচার চালিয়ে এতদিন বেঁচে আছেন তিনিও দু এক দিন বাদে জানতে পারবেন যে আসল লোকটা এখনো বেঁচে আছে। আর তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনাটা এখনো বাতিল হয়নি। যে কোন দিন যে কোন মুহুর্তে সে আঘাত হানতে পারে। জীবনের বাকি দিনগুলো তার মোটামুটি নারকীয় হয়ে গেল। 

অ্যান্ডির ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার, কারণ আমি আঘাত করব কি করব না সেটা আপনাকেও আমি জানাচ্ছি না। তাই সে বা আপনি কেউই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। 

আর আপনাকে কুরে কুরে খাবে আপনার অফিসের ঐ লোকটার মৃত্যু। এরপরে আপনি হয়ত আবেগতাড়িত হয় আমাকে খুঁজতে বেরতে পারেন। কিন্তু কোথায় খুঁজবেন আর কতদিন সেই খোঁজ আপনি চালু রাখতে পারেন সেটাও আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। 

পুলিস ডিপার্টমেন্ট আপনার আঘাতের সুযোগে আপনাকে এড়িয়ে বডি আইডেন্টিফাই করিয়ে নিয়েছে। তার উপরে ভিত্তি করেই এখন কেস সাজাবে। এখন যদি জানতে পারা যায় যে আসল খুনি ধরা পরেনি আর অনেক রাঘব বোয়ালকে পুলিস ধরেছে তখন আপনাদের ঐ বড়কর্তার কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখুন। 

কাঞ্চন ঘোষ যদি সাজা পায় তাহলেও সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, কারণ তার তৈরী করা ফ্যাঙ্কেনস্টাইন এখন তাকেই চিন্তায় রেখে দেবে। খারাপ লাগছে ওনার বাবার আর স্ত্রীর জন্য। কিন্তু কি আর করা যাবে বলুন? আমার পুর্ন সহানুভূতি ওনাদের প্রতি রইল। 

আমি যে ঐ প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলাম সেটার প্রমাণ এই চিঠির শুরুতেই দিয়ে আরো একবার আমি আপনাদের কাছে প্রমান করে দিলাম যে আমার ছদ্মবেশ নেওয়ার শিক্ষাটা বেশ ভালোই হয়েছে। 

আর একটা কথা যে মিডিয়ার রিপোর্টারের উচ্চাকঙ্কার জন্য এতকিছু ঘটল একজন আত্মহত্যা অবধি করে ফেলল, আমি তাকে মেরে অজ্ঞান করে তার নিজের গাড়ীর ডিকিতে রেখে দিয়েছি। ওনার ফ্ল্যাট কম্পাউন্ডেই গাড়ীটা আছে। আপনারা গিয়ে ওনাকে উদ্ধার করে নিলে ভদ্রলোক প্রাণে বাঁচেন। 

আরো একটা ব্যাপার, যে ভদ্রলোকের স্ত্রী তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে আশি লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছিল আর আমার হাতেই মরেছিল সে আসলে অনেক বেশীটাকা নিয়ে চলে এসেছিল ঐ মহিলার সাথে বোধহয় জানত না দুজনের কেউই। আমি শুধু পরে গুনে গেঁথে গণেশদার হাতে পঁচাত্তর লাখটাকা ফিরত দিয়ে দিই। বাকীটাকাটার সঠিক পরিমাণ একটু গণেশদাকে আর ঐ ভদ্রলোককে জানিয়ে দেবেন। সেটা কম বেশী এক কোটি। আর সেটা দিয়েই আমি আমার পালানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম, অনেক আগে থেকেই। 

আমি নিজে উধাও হয়ে গিয়ে আমার ছায়াকে রেখে যাচ্ছি আপনাদের মধ্যে। আপনারা প্রতিনিয়ত শুনবেন তার পায়ের শব্দ। 

নমস্কার নেবেন। 

ইতি 

সঞ্জয় মৌলিক।

0 comments: