1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মনোরঞ্জন ব্যাপারী

Posted in

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় হাজার বছর ধরে মহিলাদের প্রতি যে চরম দলন দমন-পীড়ন অত্যাচার প্রবহমান সে সত্য তো কম বেশি সবাই জানে- সংবেদনশীল প্রাণকে ব্যথিত করে- খানিকিটা হলেও বিড়ম্বিত করে চিন্তাশীল পুরুষ মানুষ সকলকে। কিন্তু যে মহিলা একাধারে দলিত এবং দরিদ্র সামাজিক অবমাননা অত্যাচার ছাড়াও সংসার জীবনে পরিবার পরিজনদের নিকট থেকে যে কি ভয়াবহ বর্বর দলন দমন অত্যাচার প্রতিনিয়ত তাকে সহ্য করতে হয় সে-সংবাদ বহু মানুষের কাছেই অজানা। 

দলিতরা সাধারণত বাস করে নোংরা বস্তিতে, খালপাড়ে, রেল লাইনের ধারে বা প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। সেখানে সচরাচর সেই সব মানুষের পদার্পণ বড় একিটা ঘটে না যাঁরা মাঠে- ঘাটে বক্তৃতা দেন, পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখেন বা সমাজকল্যাণমূলক কাজ-কর্ম করেন, অন্যায়-অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। ফলে সেই বিশাল সংখ্যক নারীর পারিবারিক জীবন কি দুঃসহ যন্ত্রণায় কাটে সে- তথ্য চাপা পড়ে থাকে অজানা এক অন্ধকারের গর্ভে। 

আমি নমঃশূদ্র নামে অভিহিত এক দলিত পরিবারের সদস্য। ফলে এই সমাজের নারীদের জীবন বাল্যকাল থেকে দেখে দেখে বড় হয়েছি। যে – নির্মম নিষ্ঠুর পারিবারিক অত্যাচার তাদের জন্ম থেকে মৃত্যুকাল অবধি সহ্য করে যেতে হয় সে করুণ কাহিনী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। 

পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র, এপাড় বাংলার কাওড়া-বাগদি, জাত পরিচয়ে ভিন্ন হলেও মোটামুটি শিক্ষা-সংস্কার, পেশা জীবন-যাপন প্রণালি, খাদ্যাভাস-পরিচ্ছদ প্রায় একই। ফলে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও খুব একটা প্রভেদ পাওয়া যায় না। এই সব দলিত পরিবারেই তারা নিগৃহীত, সমান অমানবিক অত্যাচারের শিকার। 

যে ব্যক্তি-মানুষটির অবস্থান বর্ণবাদী ব্যবস্থার সর্বনিম্ন ধাপে, যে অপরাধে সে আর্থিক দিক থেকে অতীব দুর্বল, সুশিক্ষা-সুসংস্কার থেকে বঞ্চিত, প্রতিটা দিনযার কাটে চরম অপমান, অত্যাচার আর অনাহারের মধ্যে, খুবই স্বাভাবিক কারণে সেই মানুষের মনে দয়ামায়া-স্নেহ-ভালোবাসা- অর্থাৎ মানবিক যে সাধারণ অনুভূতি-সেগুলি ততটা বৃদ্ধি-বিকাশ পেতে পারে না। তার বিকাশ প্রকাশ বিস্তারের সামনে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় যাপিত জীবনের ক্লেদ পাঁক তীব্র হলাহল। যা তাকে অধৈর্য্য-উগ্র-ক্রোধী চন্ডস্বভাবের লোকে পরিণত করে তোলে। ফলে সে যদি সামান্য কোন ব্যাপারে তর্ক করে তার শেষটা হয় ঝগড়ায়। গলার শিরা ফুলিয়ে বিরাট চিৎকার আর অকথ্য গালি গালাজের মাধ্যমে। আর সে যদি কাউকে শাসন করে, শুধু ধমক ধামক দিয়ে ছাড়তে পারে না- মনের সব ক্রোধ উগরে দিয়ে নির্মমভাবে ঠেঙ্গায়। সেই নির্দয় নির্মম মার দেখে মনে হয়- যেন আত্মজন নয়-কোনো চোর-ডাকাতকে ঠেঙ্গাচ্ছে। 

দলিত সমাজের মহিলা- একে তো মহিলা হবার কারণে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে ভীষণ দুর্বল। যে-দুর্বলতার অন্তর্নিহিত কারণ লুকানো রয়েছে সামাজিক ভেদভাবমূলক দৃষ্টিভঙ্গির গোপন কন্দরে। এই সমাজে পুত্রের যে-কদর, কন্যার তার কানাকড়িও নয়। বলাই হয়ে থাকে যে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। শুধু পুত্র উৎপাদনের জন্যই ভার্যার পালন পোষণ। আর কন্যা এখানে শুধু একটা দায়। অবাঞ্চিত একটা উৎপাত তাই-“মেয়ের নাম ফেলি, পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি।” এই মনোভাবের কারণে- বহুস্থানে তো কন্যা সন্তান জন্ম নেবার পরে গলা টিপে বা নুন খাইয়ে মেরে ফেলা হয়। যখন সেটা পারা যায় না সে মেয়ে বেঁচে থাকে। বেড়ে ওঠে চরম অনাদরে অবহেলায়। পুষ্টিকর খাদ্যের অপ্রতুলতায় রোগা পাতলা অপুষ্ট দুর্বল হতে থাকে এই সব কারণে। মরে যায় না বটে, বাঁচে মরো মরো হয়ে। 

দলিত পরিবারে এমনিতেই তো চিরদিনের ভাতের আকাল, তার ওপর এই অবহেলা-অনাদর- সব মিলিয়ে সেই শিশু বয়েস থেকেই মেয়েটি শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে আর সবল হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ না পেয়ে মনে মনে নুয়ে বেঁকে থেকে যায়। 

এই সমাজে মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণেই শিশু শিক্ষার হার খুব কম। যেখানে ছেলেদেরই ইস্কুলে পাঠানো সম্ভব হয় না, মেয়েদের আর কি কথা! ফলে অধিকাংশ মেয়েই সম্পূর্ণ নিরক্ষর। শিক্ষা মানুষকে সচেতন সাহসী করে তোলে। অধিকারবোধ বুঝতে শেখায়-সাবলম্বী হতে সাহায্য করে। 

শিক্ষাদীক্ষাবঞ্চিত দলিত নারীরা এই কারণে মানসিক দিক থেকে ভীষণ কমজোরি। শত অন্যায় অত্যাচার অবিচার বঞ্চনাতেও সে কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। তাকে বেঁচে থাকতে হয় সম্পূর্ণ পরনির্ভয় হয়ে- অপরের দয়া-কৃপা-করুণায়। স্বাবলম্বী নয়, তাই তার কোন স্বাধীনতাও নেই। বলা হয়ে থাকে- সে শিশুকালে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। যে-কারণে অধিকাংশ দরিদ্র দলিত অশিক্ষিত পরিবারে তাদের স্বামী তো বটেই, তুচ্ছাতিতুচ্ছ অপরাধে কখনও কখনও ভাসুর-শ্বশুর-দেবরও তাকে অকথ্য ভাষায় গাল দেয়- ফেলে গরুর মতো পেটায়। যেসব দলিত মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় কিছু উন্নত হয়ে চাকরি বাকরি পেয়ে ভদ্র শিক্ষিত লোকজনের সাথে মিলেমিশে নতুন সংস্কারে পরিশীলিত হয়ে গেছে- তাদের কথা আলাদা। সেই গুটি কয়েক পরিবারকে বাদ দিলে এমন খুব কম পরিবার আছে যেখানে বৌ পেটানো হয় না। কিছু তো এমন আছে যেখানে গর্ভধারিণী মাকে পিটিয়ে দেয় তারই আপন ছেলে। 

আমি দেখেছি- নমঃশূদ্র পরিবারের ছেলে বিবাহ করতে যাবার পূর্বে প্রথা অনুসারে প্রণাম করে মাকে বচন দিয়ে যাচ্ছে-“মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।” এই একটিমাত্র বাক্যে সেই নারীর এই সমাজ সংসারে কোন অবস্থা-অবস্থান তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আর তাই সেই সদ্য বিবাহ করে নিয়ে আসা নববধূ পতিগৃহে পদার্পণ করেই টের পায়- সে যেন পিতৃগৃহ নামক অভয়ারণ্য থেকে নির্বাসিত হয়েছে এক শ্বাপদসংকুল বিজন প্রান্তরে। তার চারদিকে উদ্যত তর্জনী, অসংখ্য নিষেধের বেড়াজাল, শাসানি, রক্তচক্ষু,হিংস্র দাঁত-নখ। 

সে এক দাসী, আর কিছু নয়, হুকুমের চাকরানী। তাই দাসী-বাঁদী মালিকের কাছে যে ব্যবহার পায় সেটাই বরাদ্দ থাকে তার জন্য। থাকে শৃঙ্খলাপরায়ণতা- নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। আর বেচাল বেতাল চলার অপরাধে কঠিন শাস্তির বিধান। না, জোরে হাঁটবে না, এমনভাবে ঘাড় নীচু করে হেঁটে যাও পায়ে যেন কোন শব্দ না হয়। না, জোরে হাসবে না, সতর্ক থেকো যেন হাসিতে শব্দ না হয়। কথা বলবে না, যদি বলো খুব ধীরে- মৃদু মিনমিনে গলায়। কখনও যেন মাথা থেকে ঘোমটা না সরে যায়, ভাসুর-শ্বশুর কেউ যেন মুখ না দেখে ফেলে। এমন ধরনের শতেক নিষেধাজ্ঞার শেকলে বেঁধে নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। পরপুরুষের দিকে তাকানো, হাসা বা কথা বলা- এসব ধরা হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে। যার সাজা চোরের চেয়েও বেশি। 

নমঃ, পোঁদ, কাওরা, বাগদি এই চার প্রকারের জনসমুদায়ের জীবন যাত্রার পথ প্রণালী সব প্রায় একই। অধিকাংশের কোনো জমি জিরেত নেই। মাছ ধরা, চাষের জমিতে জনমজুর খাটা, ঘর ছাওয়া, বেড়া বোনা, মাদুর বোনা- এমন ধরনের কাজকর্মের দ্বারা অতিকষ্টে জীবন নির্বাহন। আগে তাদের সমাজে কোনো বরপণ বলে কিছু ছিল না। এখন উচ্চবর্ণের দেখাদেখি সেই জীবাণু এই সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। এটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় মুশকিল। নিম্নবর্ণ সমাজ, উচ্চ বর্ণের অনেক অবগুণ তো গ্রহণ করে নিয়েছে, কিন্তু একটাও উচ্চগুণ আত্মসাৎ করে উঠতে পারে নি। সেটা পারলে তো আমরাও শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি- সর্বক্ষেত্রে ওদের পরাজিত করে দিতে পারতাম। আমাদের তাহলে আর আজ এমন দশা হত না। মাত্র পনেরো শতাংশ লোক পঁচাশি শতাংশ লোককে ছল-কপটতা দিয়ে হাজার বছর ধরে দলন দমন বশীভূত করে রেখেছে, এমন বক্তব্যে সত্য কম, নিজেদের ব্যর্থতা অনেক বেশি। 

ওদের সমাজে- স্বশ্রেণি-স্বজাতির মধ্যে যে-পারস্পরিক সৌহার্দ্য-দয়া-দরদ, দায়িত্ব-কর্তব্য আমাদের মধ্যে তা কই? 

কালীঘাট অঞ্চলে একদল ছেলে থাকে, কারও বাবা আছে মা নেই, তো কারও মা আছে বাবা নেই। কারও আবার মা-বাবা কেউই নেই। কেউ বা কোনো যৌনকর্মীর পরিত্যক্ত সন্তান। এবং এরা প্রায় সবাই নিম্নবর্ণ পরিবারের সন্তান। সব থাকে ফুটপাতে আর খিদে পেলে খায় ছোটখাটো চুরি ছিনতাই করে। তাই মাঝে মাঝে পুলিশ এদের ধরে নিয়ে যায়। 

একবার এই রকম চার-পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ অফিসার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করার সময় জানতে পারলেন একটি বাচ্চার পদবি চক্রবর্তী। তিনি নিজেও ব্রাহ্মণ। তাই এক ব্রাহ্মণ বালকের এ হেন দুরবস্থা দেখে প্রাণ কেঁদে উঠল তাঁর। তিনি অন্য সব কটাকে তো জেলে পাঠিয়ে দিলেন, শুধু ওই ব্রাহ্মণ বালককে নিজে উদ্যোগ নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সরকারি হোমে। সেখানে বালক থাকবে,খাবে, সরকারি খরচে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে। 

আমাদের জাতিতে পুলিশ অফিসার অনেক আছে। আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, মন্ত্রী, নেতা, আছে ডান হাত, বাঁ হাতে কামানো বড় বড় সরকারি কর্মচারী। বিশাল বাড়ি, দামি গাড়ি, প্রচুর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পোষা কুকুর- সব আছে তার, নেই শুধু স্বজাতের জন্য কোনো মানবিক উদাহরণ। 

আমাদের আছে মায়াবতী- যে ‘দলিত কি বেটি’ থেকে ‘দৌলত কি রানি’ হয়ে যায় দলিত-দরিদ্র সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে। ওদের আছে মহাশ্বেতা দেবী, অরুন্ধতি রায় যাদের একজন ম্যাগসাইসাই আর একজন বুকার পুরষ্কারের সব অর্থ অকাতরে দান করে দেয় আদিবাসী বনবাসী দরিদ্র দলিত কল্যাণে। 

ওদের আছে অমর্ত্য সেন যে নোবেল পুরষ্কারের টাকায় প্রতীচী ট্রাস্টের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেয়, আমাদের আছে লালু যাদব যে গরুর মুখের খাদ্য কেড়ে খেয়ে ফেলে। 

আমাদের মধু কোড়া শিবু সোরেন-“জন সেবা”র দ্বারা জনশত্রু হিসাবে নিন্দিত আর ওদের শংকর গুহ নিয়োগী-বিনায়ক সেন ওই কাজের জন্য জনগণ দ্বারা বন্দিত। আমাদের জেলের মেয়েরানি রাসমনি বহু অর্থ ব্যয় করে- মন্দির গড়ে উচ্চবর্ণ সমাজে সম্মান পাবার চেষ্টায় মরিয়ে আর ওদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- সে চেষ্টা না করে শান্তি নিকেতন গড়েন- শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী হন। 

এইসব কারণেই আমরা ওদের কাছে হেরে যাই, হেরে যাচ্ছি। উচ্চবর্ণ সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রবল দাপটের পরেও সতীদাহ এবং বাল্যবিধবাদের দুর্বিষহ জীবন-যাপনে বাধ্য করার পরেও যেটুকু যা আদর সম্মান, প্রেম-ভালোবাসা নারী জাতির জন্য অবশিষ্ট আছে, দলিত সমাজে তার কিছুমাত্র নেই। এই সমাজে নারীকে সর্বক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হয়, কি জানি কি ভুল করে ফেললাম। কি জানি কখন স্বামী এসে চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেলবে উঠোনে, পিঠে চেলা কাঠ ভাঙবে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। সতীন নিয়ে আসবে। লোকে বলে পেটে খেলে পিঠে সয়। এইসব অভাগী নারীর পেটে নেই ভাত, পরনে নেই কাপড়, মাথায় তেলবিহীন চুলে জটা তার ওপর ওই মার। সতীনসহ বসবাস। সন্তানসহ বিতারণ। 

আমার বাল্যকাল কেটেছে শিরোমণিপুর ক্যাম্পে, কিশোরকাল ঘোলা দোলতলায়, আর কিছু বছর দণ্ডকারণ্যে। এই তিনস্থান নমঃশূদ্র আর পোঁদ জাতির মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ। মাঝে কয়েকবছর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় ছিলাম। সেখানে দেখেছি কাওরা মেয়েদের। আর এখন দেখছি বাগদি নারীদের। এই তিন জায়গার মধ্যে- নমঃ, পোঁদ, কাওরা, বাগদির মধ্যে- সব মিলের মধ্যে আর একটা বড় মিল-কেউ যদি তার বউকে পেটাতে থাকে-মারের চোটে যতই সে বউটা ‘ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে’ বলে চেঁচাক, প্রতিবেশীদের কেউ ঠেকাতে ছুটে যাবেন না। আক্ষেপ করে বলবে-ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, আমরা বাইরের লোক কি বলবো! 

দণ্ডকারণ্যের নমঃ, পোঁদদের মুখে অদ্ভুত একটা বাক্য শুনতাম, বলত তারা- গরু মরে পোড়া কপালের, বউ মরে ভাগ্যবানের। ওই সমাজে বউয়ের মূল্য গরুর চেয়েও কম। তার মৃত্যু তাই কোনো দুখঃদায়ক ঘটনা নয়, সৌভাগ্যের সূচক। সে মরা মাত্র আর একটা আনকোরা বউ পাওয়া যাবে-পাওয়া যাবে বরপণও। 

দণ্ডকারণ্যে যেখানে আমি ছিলাম, পূর্ব পাকিস্থান থেকে আগত পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ওইসব শরণার্থী ভিলেজগুলো ঘিরে আছে ছোট বড় অনেক আদিবাসী গ্রামে। যেখানে গোন্ড জনজাতির মানুষের বসবাস। এই সমাজ এখনও মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বর্জন করে পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে নি। তাই এই সমাজে মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীনচেতা, সাবলীল এবং স্বাবলম্বী। সভ্য সমাজে মেয়ে যেন একটা অভিশাপ, দায়, দুঃসহ, বোঝা। আর এই সমাজে সে হচ্ছে একটা সম্পদ। এই সমাজে কোনো মেয়ের বাপ কোনো ছেলের বাপের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে বলবে না- দয়া করে আমার মেয়েটিকে গ্রহণ করে আমাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করুন। ছেলের বাপকেই আসতে হবে মদ-মুরগি নিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে। বিনয় সহকারে বলতে হবে মেয়ের বাপকে, তার সম্পদটি দান করে যেন এক অন্ধকার গৃহের কোণে আলোক স্থাপনা করেন। যদি সে বিবাহ হয়ে যায়, এমন ভাবনার কোনো অবকাশ নেই যে, বনের পাখি ধরে খাঁচায় পুরে দিলাম। এখন সে আমার অধীন। যদি তার প্রতি কোনো অন্যায়-জুলুম হয়, যদি মনে কষ্ট পায়- পালিয়ে চলে যাবে সোজা বাপের বাড়ি। আর আসবে না। চাইলে বিয়ে করে নেবে অন্য কোথাও। একবার দু’বার নয়-প্রয়োজনে আঠারো বার। সমাজ তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। তাকে গায়ের জোরে নয়, বেঁধে রাখতে হবে আদর সম্মান ভালোবাসা দিয়ে 

আমাদের এই নমঃ- পোঁদ সমাজ, উচ্চবর্ণ সমাজ থেকে নারী জাতির প্রতি নরম, কোমল, মানবিক হবার শিক্ষা তো নিল না। নিতে পারল না- আমরা যাদের জংলা বুনো বলি- সে আদিবাসী সমাজের শিক্ষা, সহমর্মিতার পাঠ- নারীকেও সংসার জীবনে সমকক্ষ ভাবার সংস্কৃতি। 

আমি কয়েক বছর আগে দলিত লেখিকা বেবী কাম্বলের আত্মজীবনী হিন্দি থেকে বাংলায় আনুবাদ করেছিলাম। উনি মহারাষ্ট্রের ডোম জাতির মেয়ে, জীবনের যে বিশ্রী বিড়ম্বনাময় চালচিত্র এঁকেছেন তা পড়ে শিউরে উঠতে হয়। একজন দলিত- যে জানে দলনের কি যন্ত্রণা, সে তারই নিজের সহধর্মিনীর কি ভীষণ যম-যন্ত্রণায় বেঁচে থাকা কঠিন করে তোলে। 

লিখেছেন তিনি-“রোগা, খর্বকায়, রোজগারহীন পতিকে আমরা ‘রাজা’ বলে স্বীকার করেছি। নিজের জীবন মন পতির শ্রীচরণে সমর্পন করেছি, বিনিময়ে সে কি দেয়? এক মাত্র দুঃখ,” কেন দেয়? 

একটি অপ্রিয় কিন্তু কঠোর সত্য যেন পুরুষ পুঙ্গবদের মনের ভিতর থেকে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন সাদা কাগজের পাতায়। যা ডোমদের বেলা যেমন আমাদের বাঙালি দলিতদের বেলায়ও একদম সঠিক। 

“সমাজ আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমরা গোলামরাও মানুষ। আমাদের মনের মধ্যেও সেই ইচ্ছে চাগাড় দেয় যে, আমরাও কারো ওপর হুকুম চালাই, মনিবগিরি ফলাই। কিন্তু কে মানবে আমাদের মতো মানুষের হুকুম? তাই আমরা আমাদের ঘরের লোককে গোলাম বানাবার কথা ভেবেছি। যা খুবই সহজ কাজ। গোলাম বানিয়েছি পরের ঘর থেকে নিয়ে আসা মেয়েটিকে। যার পক্ষে দাঁড়াবার মতো আশেপাশে কেউ নেই। 

এই মহারাষ্ট্রের ডোম সম্প্রদায়ে মেয়ের বয়স আট-দশ বছর হলেই তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। আগে যেমন নমঃশূদ্র মেয়েদের দেওয়া হতো। লিখেছেন তিনি- এইবার বধূর ঘটবে সত্যিকারের বনবাস যাত্রা। একটুখানি মেয়ে...। মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে শ্বশুরালয়ে যাবে। “শ্বশুরালয়” মানে- স্বামীর মানে- সবকিছু অবগত সেই মেয়ে। 

শ্বাশুরবাড়ি আসার পর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়বে নানাবিধ সমস্যা আর কাজের চাপে। সর্বপ্রথমে যে-কাজটি তাকে দেওয়া হবে তা রুটি বানানো। যদি কোনো রুটি সেঁকতে গিয়ে পুড়ে যায়, শুরু হবে বকাঝকা।(দণ্ডকারণ্যের কোনো নমঃ পরিবার হলে গোয়াল সাফ, উঠোন ঝাঁট, তারপর চান করে ভাত-তরকারি রাঁধা।) 

ভোর তিনটের সময় মোরগ ডাকার সাথে সাথে ওই ছোট্ট বউটাকে তার শাশুড়ি মাথার চুল ধরে টেনে ঘুম থেকে জাগায়। তারপর তাকে জাঁতা সাফ করতে বলে। শ্বাশুড়ি একঝুড়ি যব পেষাই করার জন্য বের করেছে। সে বউকে দেকে নিয়েছে নিজের সাথে একটু সহযোগিতা করার জন্য। পেষাইটা প্রথম শুরু করে সে-ই। সামান্য কিছু পেষাই করেই কোনো এক ছল-ছুতোয় বউকে জাঁতায় বসিয়ে দিয়ে সে উঠে যায়। আর আসে না। হয়তো গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। কি আর করে সেই ছোট্ট বউ! সে জাঁতা ঘোরাতে শুরু করে। যব পিষতে পিষতে তার ছোট্ট হাতে ফোস্কা পড়ে যায়। আটা পেষাই হয়ে গেলে কলসি নিয়ে যায় নদীতে। জল আনবার পর বসতে হয় রুটি বানাতে। আর রুটি পুড়ে গেলে- গোল না হলে শাশুড়ি তার গালের চামড়া খামচে ধরে- যা মুখে আসে তা বলে গাল দেয়। আর স্বামী? না সে কিছু বলবে না। দূর থেকে দেখবে। বোঝা যাবে মায়ের কর্মকান্ডে তার সমর্থন আছে। 

নাক বহতা ননদ, অর্ধ উলঙ্গ দেবর সবার গালাগালি খেয়ে কাজ করে যেতে হবে সেই ছোট্ট বউটাকে। কাজ করতে করতে বেলা গড়িয়ে যাবে। ততক্ষণে বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। ওর জন্য পড়ে থাকবে পোড়া ধরা কয়েকটা রুটির কুঁচি। যা খেতে হলে খাবে কি দিয়ে? শাশুড়ি যখন এদিক-সেদিক যায় তখন নুনের ডেলা চুরি করে আঁচলে বেঁধে রাখে- সেই দিয়ে চলে তার রুটি খাওয়া। 

দণ্ডকারণ্যের পারাল কেটে দেখেছি নমঃ পরিবারের বালিকা বা কিশোরী বধূটির ভাগ্যেও জোটে- অধিকাংশ দিন- হাড়ভাঙা খাটুনির পর, হাঁড়ির তলায় পড়ে থাকা- কড়কড়ে-ঠান্ডা, কাঁকরযুক্ত কয়েকটা ভাত। অধিকাংশ দিনই তরকারিবিহীন সেই ভাত নুন আর লঙ্কা দিয়ে খেয়ে খিদেয় দহন নিবৃত্ত করতে হয় তাকে। 

আর কি ডোম কি নমঃ সব পরিবারের সব শাশুড়ির মনে সর্বদা এক আতঙ্ক জেগে বসে থাকে- এই বোধ হয় বউ আমার ছেলেকে বশ করে নিল। ছেলে আমার বুঝি পর হয়ে গেল। আর হয়তো বাধ্য অনুগত রইল না। তাই বউয়ের বিকশিত যৌবন সে সহ্য করতে পারে না। পুরুষকে বশ করার ওটাই তো সর্বনাশা অস্ত্র। তাই বউয়ের ওপর ছেলের মন বিষিয়ে তোলার জন্য ছেলের কানে অনবরত ঢেলে চলে কুতসা-নিন্দা,মন্দ। এর মধ্যে সবচেয়ে মোক্ষম এবং মারাত্মক সেই কুৎসা- তোর বউয়ের স্বভাব ভালো নয়। অমুককে দেখে হাসে। আর যদি গোটা দুয়েক সাক্ষী জোগাড় করে গল্প্টাকে আর একটু এগিয়ে নেওয়া যায়, পুত্রের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে খুব বেশি সময় লাগে না। 

বেবী কাম্বলে লিখেছেন- এই রকম বিরূপ-ক্ষিপ্ত, মাথামোটা সন্দেহপ্রবণ স্বামীর হাতে কত মেয়ের যে নাক কাটা গেছে সমাজে- তার কোনো হিসেব নেই। ক্রোধান্ধ স্বামীর ক্রোধ প্রশমন এবং ‘দুশ্চরিত্র’ স্ত্রীকে উচিৎ শিক্ষা দিতে তার নাক কেটে মুখাবয়ব বিকৃত করে দেওয়া- এটাই নাকি যথার্থ পৌরুষের লক্ষণ। নমঃশূদ্র বা কাওরা বাগদি সমাজে অবশ্য নাক কাটার মতো সাজা দিতে দেখা যায় না। তবে মাথার চুল কেটে দেওয়া-মেরে আধমরা করা, এসব খুব আছে। এতে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কত নিরপরাধ-অসহায় বধূকে যে সারা জীবন কি গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় কে জানে? 

ডোম বা নমঃশূদ্র, কাওরা বা বাগদি- নিম্নবর্ণ, অশক্ষিত মহল্লা-বস্তি-গ্রাম-গঞ্জে, পুরুষেরা বউদের কারণে-অকারণে যখন তখন জন্তুর মতো পেটায়। কারও মাথা ফেটে যায়, কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, হাত-পা-কোমর ভেঙে যায় কারও কারও। 

এত মার খাবার পরেও সেই সব হতভাগীর ওপর কারও কোনো দয়া-দরদের সামান্য প্রকাশ দেখা যায় না। তার প্রতি দয়া দেখাতে গিয়ে প্রতিবেশীকে কেন অসন্তুষ্ট করবে! 

তখন এই পারাপারহীন দুঃখ-অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন বউটা হয়তো পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাবে বা কোথায়? গিয়ে ওঠে বাপের বাড়ি। সেই বাপ-মা’র কাছে মেয়ের নাম ফেলি...। সে তো বহু কষ্টে মেয়েকে এক জায়গায় ফেলে দিয়েছিল। আবার সেই মাথার উকুন মাথায় ফিরে এসেছে। যদি সে হতভাগী নমঃশূদ্র সমাজের মেয়ে হয়-সে বাড়ি গিয়ে পৌঁছানো মাত্র- মা-বাপ শুরু করে দেবে বকাঝকা। আর একবেলা বা একদিন রেখে- পরদিন বাপ ভাই কেউ একজন তাকে নিয়ে রওয়ানা দেবে সেই অগ্নিকুন্ডে ফেলে আসার জন্য। বুঝিয়ে বলে দেওয়া হবে- মরো বাঁচো স্বামীর ঘরই তোমার ঘর। বাপের বাড়ি যেন একা কোনো দিন এসো না। এলে স্বামীর সাথে-। 

এরপর তার সামনে একটা পথই খোলা থাকে-বিষের শিশি না হয় গলায় দড়ি। অত্যাচার অসহ্য হলে এই পথে মুক্তি। 

আর ডোম সমাজের মেয়ে যদি হয়- সে পালিয়ে বাপের বাড়ি পৌঁছবার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে বসে থাকবে স্বামী বা দেওর। সে তো এসেছে পায়ে হেঁটে ঝোপঝাড় বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নদী-নালা পেরিয়ে- জন্তু জানোয়ার এবং বদলোকের নাগাল বাঁচিয়ে-নিজেকে লুকাতে লুকাতে। হয়তো পথে এক দু’দিন লেগে গেছে। স্বামী বা দেওর তো এসেছে সরল সোজা রাস্তা ধরে। শ্বশুর বাড়িতে এত দুঃখ-কষ্ট সয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর মেয়ে পিতৃগৃহে কোনো সহানুভূতি পাবে না। মেয়ে উঠোনে পা রাখামাত্র যে শ্বশুরালয় থেকে এসেছে বেদম পেটাতে শুরু করে দেবে। এরপর আর একপ্রস্থ পেটাবে মেয়ের বাপ-ভাই। তাদের সেই কথা প্রমাণ দেবার দায় রয়েছে-দ্যাখো আমরা আমাদের মেয়েকে কোনো প্রশ্রয় দিচ্ছি না। 

তারপর- সেই অনির্বাণ দুঃখের আগুনে নিত্য দহন হতে তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে শ্বশুর বাড়িতে।আবার সেই বউটি এসে পড়বে একদল কসাইয়ের হাতে। 

দ্বিতীয়বার শ্বশুরালয় আসবার পর অবাধ্য বউকে শায়েস্তা করার জন্য শুরু করা হয় নতুন ধরনের অত্যাচার। পাঁচ কিলো ওজনের একটা কাঠ সুতোর মিস্ত্রির কাছে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে তার মাঝে ছিদ্র করা হয় যেন পায়ের মধ্যে ঢোকে। সেটা জেলখানার কয়েকদির ডান্ডাবেড়ির মতো পরিয়ে দেওয়া হয় বউটির পায়ে। এই ওজনদার কাষ্ঠখন্ড পায়ে নিয়ে নিত্যদিনের সব কাজকর্ম সারতে হবে তাকে। কাঠের গায়ে ঘষায় ঘষায় পা কেটে রক্ত গড়াবে, জখম হয়ে যাবে পা। হাঁটতে পারবে না। অর্থাৎ আর চাইলেও পারবে না। খাঁচায় পোরা বন্য পশুর মতো দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হবে তাকে, যতক্ষণ শ্বশুর বাড়ির লোকের আত্মা শান্ত না হয়। যতক্ষণ না সে বাধ্য-বিনীত-পোষা কুকুর না হয়ে যায়। 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাওরা জাতিগোষ্ঠীর যে-সব মহিলাদের দেখেছি তাদের অধিকাংশের স্বামী সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে ডুবে যায় মদ-তাড়ির নেশায়। কেউ কেউ তো দিনের বেলাতেও ডুবে থাকে। ফলে সংসার জুড়ে তীব্র অনটন। ওইসব মহিলারা সকাল বেলায় ট্রেন বোঝাই হয়ে চলে আসে শহর কলকাতায় বাবু বাড়ির বাসন মাজতে, ঘর ঝাঁট দিতে, কাপড় কাচতে। সংখ্যায় যে তারা কত গুণে শেষ করা যাবে না। সেই ভোর ছটা থেকে আটটা সাড়ে আটটা- সব আপ ট্রেনে গিজগিজ ভিড়- এদের জন্য। এদের জন্য একটা ট্রেনের নামই হয়ে গেছে- ঝি স্পেশাল ঝিয়ের ট্রেন। এরা সকালে এসে ফের ফিরে যায় সন্ধ্যার সময়। মাসান্তে পায় অতি সামান্য গুটি কয়েক টাকা। বলা চলে সেই সামান্য মাইনেয়- সে খায়, খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে তার পুত্র কন্যা এবং নেশারু স্বামীকে। তবুও মাঝে মাঝে জোটে নির্দয় মার। তা সত্ত্বেও এদের পতিভক্তি পতিপ্রেম একটা বলার মতো বিষয়। এরা নিজেদের জন্য নিজেরা একটা ছড়া বানিয়েছে। মাঝে মাঝে সেটা বলে। বিইলে ভাতার জন্মের কুড়ে/ থাকুক আমার বেছন জুড়ে। এই ছড়ার দুটো লাইনে পরকীয়া থেকে নিজেকে সাবধান থাকার উপদেশ দিচ্ছে নিজেই। পরের ভাতার খড়ের নুড়ে/ ফুঁ দিলি সে যায় রে উড়ে। 

শোন রে যা হোক তা হোক আর যেমনই হোক স্বামীই হচ্ছে তোমার আসল আশ্রয়। যদি তাকে ছেড়ে অন্যের প্রেমে মজো সে-সুখ মাত্র দু’দিনের। তাই সে-সুখে দরকার নেই। আর একটি ছড়ায় সেই কথাই বলা আছে- পরের সোনা দিও না কানে/ কেড়ে নেবে হ্যাঁচকা টানে। 

বর্তমানে আমি যে-অঞ্চলে বাস করি-সেখানে বেশ কিছু বাগদি মানুষের বসবাস। বাগদি মহিলাদের খুব কমই ‘ঝি-গিরি’ পছন্দ করে। এদের প্রথম পছন্দ খাল-বিল, নদী-নালা সেচে জাল পেতে মাছ ধরে বেচা। আজকাল আর খাল-বিল খুব একটা নেই। কিছু বুজে গেছে, কিছু নগর সভ্যতার আগ্রাসন বুজিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ দূর বাজার থেকে কিনে এনে সেই মাছ নিজের অঞ্চলে বাজারে বেচে। 

এভাবেই প্রতিপালন করে পরিবার পরিজন। দু’বেলা দুটো দুঃখের অন্ন খেয়ে ‘সুখে’ বেঁচে বর্তে থাকে। বড় কোনো উদ্দেশ্য নেই- চাহিদাও খুব ছোট, সেই নিয়ে তাদের কোনোক্রমে টিকে থাকা। এইভাবে বেঁচে থাকে দলিত সমাজের মহাদলিত মহিলারা। যাদের জানা নেই বিচার ব্যবস্থা তাদের জন্য কি কি রক্ষা কবচ দিয়ে রেখেছে। কিভাবে পেতে পাড়ে তার ওপর ঘটে চলা অন্যায় অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ। 

বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে দুই চব্বিশ পরগণা জুড়ে দলিত-দরিদ্র, কিশোরী-যুবতীদের ওপর আর একটা ভয়াবহ বিপদ শকুনের ডানার ছায়া ফেলেছে। সেটা হচ্ছে পাচার। দুই জেলার হাজার হাজার মেয়ে ‘রাতের অন্ধকারে’ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যের কোন পতিতালয়ে। নানা জায়গা থেকে আড়কাটিরা খোঁজ-খবর নেয় কোন ঘরে কিশোরী বা যুবতী কন্যা আছে। তারপর তার মা-বাপের কাছে টোপ দেয়। একটা ভালো ছেলে আছে। টাকা পয়সা জমি জায়গার কোনো কমতি নেই। কোনো পণ তো নেবেই না, উল্টে কিছু দেবে। যদি বিয়ে দাও মেয়ে রাজরানি হয়ে থাকবে। 

এরপর একটা লোক দেখানো বিয়েও হয়ে যায়। বউ নিয়ে সে চলে যায় ইউ.পি., বিহার। আর তার কোন হদিস মেলে না। কিছু কিছু মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয় কোথাও কোনো উচ্চ বেতনের কাজের লোভ দেখিয়ে, কাউকে ফাঁসানো হয় প্রেমের ফাঁদ পেতে। যেভাবেই হোক একবার সে-মেয়ে ঘরের বাইরে পা রাখে-ফিরে আসার আর পথ পায় না- হারিয়ে যায় অন্ধকারের চোরা বাঁকে। তলিয়ে যায় পুঁতিগন্ধময় অতল বিতলে। 

আরও একটি ভয়ংকর বিপদ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সেটি ধর্ষণ। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো- N C R B-র একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে গত ২০১১-২০১২ এই দুই বছরে যে-ধর্ষণের অভিযোগগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার সংখ্যা ৬০০৭৫। অনুমান করে নিতে অসুবিধা নেই যে, এর বহুগুণ বেশি লিপিবদ্ধ হয় নি, নানা কারণে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে একটি বা দু’টি বাদ দিলে- এই সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে দলিত-দরিদ্র, কিশোরী-যুবতী-মহিলাদের ওপর। কারণ এরাই তো সবচেয়ে দুর্বল আর অরক্ষিত। মাঠে ঘাটে নিরালা পথে- রাতে এদের চলাচল করতে হয় পোড়া পেটের প্রয়োজনে। 

এভাবেই বেঁচে রয়েছে দলিত সমাজের মা-বোন-মেয়ে অনাত্মীয় এক হিংস্র সমাজে।

1 comment:

  1. নমস্কার, এই কটূ সত্যিকথাগুলো বলার জন্য ।

    ReplyDelete