ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
৭)
ভরত-মিলাপ
পরের দিন। ব্যাংক খুলতেই দুই ট্রেনি অফিসারকে রিলিভিং লেটার ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওরা আজই সন্ধ্যেয় বিলাসপুর ফিরে যাবে। কাল হেড অফিসে রিপোর্ট করে নিজেদের নতুন পোস্টিং এর অর্ডার হাতে হাতে পেয়ে যাবে।
অর্ডার পেয়ে চমকে ওঠে শ্রীরাম; আশা করেছিল ম্যানেজার ওকে আরও একমাস রেখে দেবে। তার জন্যে হেড অফিসে রেকমেন্ড করবে। কিছু একটা বলবে বলে মুখ খুলতে গিয়েও বুজিয়ে ফেলে। জল খায়। ডোঙ্গরে কিছু বলে না।
লাঞ্চ এর পর ওরা চলে যায়। যাওয়ার আগে রূপেশের সামনে মাথা নীচু করে বলে- জানে অনজানে অগর কিসীকো কুছ দুখ পঁহুচায়া তো মাফ কর দেঙ্গে।
জেনে-না জেনে যদি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তার জন্যে মাপ চাইছি।
বিকেলে ক্যাশ ক্লোজ হবার পর রাজন ঠুল্লুকে কফি বানাতে বলে। রূপেশের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে বলে –স্যার, ওরা চলে যাওয়ায় একটু হালকা লাগছে। ঠিক যেন তেলে জলে মিশছিল না।
রূপেশ এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বলে – আরে দু’মাসের ডেপুটেশন, পুরো হয়ে গেছে। এক্সটেন্ড করলে এক্সট্রা ডেপুটেশন অ্যালাউন্স পে করার ব্যাপারে আমাকে জাস্টিফিকেশন দিতে হবে,তাই।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রাজন অনুরোধ করে একটা অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে।
মানে?
চুড়ৈল অউর দারু পীনে কী কহানী তো হো গয়ী। কিন্তু আপ আপকে ঘরওয়ালে কে বারে মেঁ মনে মনে যে কী গিঁট বেঁধে রেখেছেন তা বলতে বলতে থেমে গেছেন। আমাকে বলুন, বলে ফেলুন। বুকের ভার হালকা হবে, সত্যি বলছি।
রূপেশ কি এই অনুরোধের জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করছিল? নইলে কেন এত কথা হটাৎ কল কল করে জলের ট্যাপ খোলার মত বেরিয়ে এল?
রূপেশ জানে না।
‘তখন ভিলাইয়ের ছেলেমেয়ে সবাই সায়েন্স পড়তে ১৪ কিলোমিটার দূরে জেলাসদর দুর্গ শহরের সরকারি কলেজে ভর্তি হত। আর্টস আর কমার্সের ছাত্ররা যেত ভিলাই সেক্টর সেভেনের কল্যাণ সমিতির প্রাইভেট কলেজে। আমার অংক ভাল লাগত। স্কুলে স্যারেরা বলতেন আমার নাকি অংকের মাথা ভাল। এ নিয়ে বাবা,বড়ে ভাইয়া বেশ গর্ব করতেন। বলতেন আমাদের ছোটু একদিন বড়ো হয়ে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের চিফ ইঞ্জিনিয়র হবে।
‘আমি ভাবতাম অংকের প্রফেসর হব, রিয়েল নাম্বার বা স্ফেরিক্যাল ট্রিগনোমেট্রি নিয়ে রিসার্চ করব। আমাদের এইচ ও ডি প্রফেসর বর্মার প্রিয় ছাত্র ছিলাম। ওঁর গণিত নিয়ে প্রবন্ধ একটি দেশি জার্নালে বেরোত। এই ভাবেই দুটো ইয়ার পেরিয়ে এলাম। ইচ্ছে এখান থেকেই গণিতে এম এস সি করব। তারপর?
‘আমার ফাইনাল ইয়ার। বর্মাজী ট্রান্সফার হয়ে সাগর ইউনিভার্সিটি চলে গেলেন। বললেন ফাইনাল ইয়ারে ভাল রেজাল্ট করলে খড়গপুর বা কোন আই আই টিতে ম্যাথস এ পছন্দের টপিক নিয়ে এম ফিল করতে। ভর্তির ব্যাপারে উনি রেকমেন্ডেশন লেটার দেবেন। বিএস সি ফাইনালের রেজাল্ট বেরোলে ওঁর সঙ্গে সাগর ইউনিভার্সিটিতে চিঠি লিখে যোগাযোগ করতে। ব্যস, ম্যাঁয় তো হাওয়া মেঁ উড়নে লগা। মেরা দিলো-দিমাগ সব সাতওয়াঁ আসমান পর।
‘হাওয়ায় উড়ছিলাম, মন মেজাজ সব খুশির সপ্তম স্বর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত সুখ কপালে সইল না। আমি কি একটু অহংকারী ও অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম?
ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। সব ভালই চলছিল। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি উতরে গেল। এবার ম্যাথস। প্রথম পেপারে ক্যালকুলাস, অ্যাডভান্স অ্যালজেব্রা ও ভেক্টর অ্যালজেব্রা মেরা বাঁয়া হাত কা খেল থা। উসকে বাদ সেকন্ড পেপার। স্ট্যাটিস্টিক্স অউর প্রোবাবিলিটি। মজেদার পেপার। তিন সওয়াল বন গয়া থা। অব এক লার্জ স্যাম্পল কে সওয়াল হলো কর রহে থে কি পিছে সে এক লড়কা কোচ নে লগে।
ইয়ার, টি অউর জেড ফাংশন কা টেস্টিং ফর্মূলা বতা দো। প্লীজ, ইয়ার!
‘বলে দিতাম। কিন্তু তখন আমার মাথা গরম। বাই লিঙ্গুয়াল কোশ্চেন পেপারে ওই লার্জ স্যাম্পলের অংকটার ডেটা দুই ভাষায় দু’রকম দেখাচ্ছে। আমি ইংরেজি ভার্সনের ডেটা নিয়ে কষতে গিয়ে দেখি উটপটাং রেজাল্ট আসছে। তবে কি প্রশ্নটা ভুল! ইংরেজি ভার্সন নাকি হিন্দি? কোনটা ? এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। আর একবার চেক করি, কষে দেখি; আমারও ভুল হতে পারে।
‘কিন্তু মনঃসংযোগ যে কী কঠিন! কারণ সামনে পেছনে ছেলেগুলো কথা বলেই চলেছে। আর ইনভিজিলেটর যেন দেখেও দেখছেন না,মাঝে মাঝে হুমকি দিচ্ছেন বটে, -- আপস মেঁ বাতচিত নহীঁ, -- কিন্তু সেগুলো যে গিদড়-ভপকি বা নকল ধমক, তা সবাই বুঝছে।
এমন সময় একটি অচেনা গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম।
--হোয়াট আর ইউ ডুইং মাই বয়? কিছুই লিখছ না,গালে হাত দিয়ে বসে আছ? আজকের পেপার কি খুব কঠিন? প্রশ্নগুলো কি আউট অফ কোর্স?
আমি গণিতশাস্ত্রের সমস্যার ভুবন থেকে কঠিন বাস্তবের দুনিয়ায় ফিরে এলাম। তাও ঝাঁকুনি খেয়ে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়েসি সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক, মুখে এক চিলতে হাসি, কিন্তু চশমার ফাঁকে চোখজোড়া হাসছে না।
গোটা ক্লাসরুমে সন্নাটা।
‘আমি উঠে দাঁড়াই। আমাকে উনি কী বলছেন, কেন বলছেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমার মাথার ওপর দিয়ে উনি ক্লাসরুমের পেছন দিকে কাউকে কিছু যেন আদেশ দিলেন। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই ব্যাপারটা বুঝলাম। নকল রোখার ফ্লাইং স্কোয়াড!
তিনজনের একটি দল কখন যেন আমাদের রুমে ঢুকে পড়েছে। দু’জন পেছনের ও দরজার দিকের বেঞ্চগুলোতে সবার পকেট চেক করছে ডেক্সের ভেতর চেয়ারের তলা সব খুঁটিয়ে দেখছে। কিন্তু এই ভদ্রলোক আমাকে জেরা করছে কেন?
একটু পরে আওয়াজ আসতে লাগল—পেয়েছি স্যার, ফর্মূলা লেখা চিটগুলো শার্টের কলারের মধ্যে গুটিয়ে রাখা।
আর একে দেখুন, এই গরমে জুতো মোজা পরে এসেছে, মোজার ভেতরে। আর এই চিকলমুন্ডি ন্যাড়ামাথা শ্রীমান, ইনি ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছেন।
‘এই ভদ্রলোক সম্ভবতঃ দলের নেতা। সবজান্তা মোডে মাথা নেড়ে বললেন—জানতাম। ঠিকই খবর পেয়েছিলাম যে এখানে মাস লেভেলে চিট চলছে। এটা গভর্ণমেন্ট কলেজ, তার এই হাল? এমন রিপোর্ট দেব যে ইনভজিলেটর অধ্যাপকটির ইনক্রিমেন্ট আটকে যাবে।
এরপর উনি আমাকে বললেন—আমি কারও পকেটে হাত দিই না,যা আছে বের করে দাও।
উনি যে আমাকেও চিট চালাচ্ছি বলে সন্দেহ করছেন এটা বুঝতে খানিকক্ষণ লাগল। ধমক খেয়ে পকেট উলটে দেখালাম যে রুমাল ছাড়া কিছু নেই। উনি আমাকে একনজর দেখে ধমকে উঠলেন—হাত দুটো ডেস্কের উপর রাখ।
তারপর আচমকা নীচু হয়ে আমার পায়ের কাছ থেকে একটা দোমড়ানো কাগজের দলা তুলে নিলেন। এটা কি? দেখ, দেখে বল।
আমার গলা শুকিয়ে গেছে। স্যার, এটা আমার না।
বেশ, তাহলে কোনটা তোমার সেটাই বলে দাও।
স্যার, আমি চিটিং করি না। সাক্সেনা স্যারকে জিজ্ঞেস করুন।
আমার কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এই চিট তোমার কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এই যথেষ্ট।
স্যার, এটার ফর্মূলা কার্ল পিয়ার্সন কো-এফিশিয়েন্ট আর মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ প্রোব্যাবিলিটির। এর কোন সওয়াল আজকের পেপারে আসে নি।
ও হো, তাই তুমি এটা মাটিতে ফেলে দিয়েছ।
না স্যার, আমি এটা বানাইনি, ফেলিওনি।
তাহলে কি করে জানলে এই চিটে কিসের ফর্মূলা লেখা আছে।
জানতাম না,তখন আপনি দেখতে দিলেন, তাই।
আচ্ছা? ওই খুদে খুদে লেখা একনজর দেখেই তুমি ওটা কার্ল না আর্ল সব বুঝে গেলে! স্ট্রেঞ্জ!
বিশ্বাস করুন, আমি সিরিয়াস স্টুডেন্ট; কখনও চিট বানাইনি।
বল, কখনও ধরা পড়নি।
হ্যাঁ স্যার।
এই তো সুবোধ ছেলের মত কথা বললে।
এবার এই কাগজে দস্তখত করে বাড়ি যাও। তোমাকে হাতেনাতে ধরেছি। এই হলের চারজনকে বুক করলাম। তোমরা চাইলে যদি কিছু পেপার বাকি থাকে তাতে বসতে পার। কিন্তু রেজাল্ট উইথহেল্ড থাকবে। এরপর ইউনিভার্সিটি যা ভাল বুঝবে।
‘কীভাবে যে বাড়ি ফিরেছিলাম মনে করতে পারি না। তারপর যা হলো সেটাকে আজও ভুলতে পারি নি। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে নি; বাবা, মা,দাদা,পাড়া-প্রতিবেশি—কেউ নয়। সবার এক কথা; হলে বেয়াল্লিশ জন পরীক্ষা দিচ্ছিল, বাকি তিনজনের সঙ্গে তোকে কেন ধরল! দাদা বললেন--তোর সঙ্গে কি ওদের জাতি –দুশমনি ছিল ? ওরা তো বোধহয় তোকে চিনতই না। ছি-ছি-ছি! আমাদের মুখ হাসালি!
বন্ধুরাও বাঁকা হাসি হেসে বলল—চিট পেয়েছে তবেই তো বুক করেছে। খামখা চেঁচিয়ে কী লাভ? তারচেয়ে ভাল করে তৈরি কর, তিনমাস পরে সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা দিয়ে দে, বছর নষ্ট হবে না।
এরাই আমার বন্ধু! স্কুলের দিন থেকে?
বাবা সাতদিন বাড়ি থেকে বের হলেন না। সবাই জানত ওর ছোট ছেলে অংকে ভাল। এখন সবাই জানতে চায় কেন এমন হলো? রূপু কি ইদানীং বখে যাচ্ছিল? নইলে চিট নিয়ে হলে যায়! আরে চিট তো ওর পায়ের কাছেই পাওয়া গেছল, তবে?
‘কী বলব, এই তবে’র উত্তর পেয়েছিলাম অনেকদিন পরে। পেছনের বেঞ্চের ছেলেটি,যাকে অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও ফর্মূলা বলে দিই নি। সেই গুরবানী এল আমাদের বাড়িতে ওদের গাড়ি নিয়ে। আমার মায়ের প্রেসার বেড়ে মাইল্ড অ্যাটাক মত হয়েছিল। দাদা অফিসের কাজে আউট অফ স্টেশন। বাবা ঘাবড়ে গিয়ে কি করবেন কিছু বুঝতে পারছিলেন না। শিগগির মাকে নিয়ে সেক্টর নাইনের মেইন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমাদের গাড়ি নেই,ভরদুপুরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স খালি পেলাম না। সেই সময় কী করে খবর পেয়ে গুরবানী এল গাড়ি নিয়ে। ওদের লোহার ছড়ের ব্যবসা, পেল্লায় বাড়ি; তিনটে গাড়ি।
এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে গিয়ে ওই চেনা ডাক্তার বের করে সাততাড়াতাড়ি মাকে ভর্তি করিয়ে দিল। আমাকে বলল –টেনশন মত লেনা। পতা কিয়া, মামলা উতনা সিরিয়াস নহীঁ হ্যাঁয়। দো দিন অবজার্ভেশন কে বাদ শায়দ পরশুদিন বাড়ি যেতে দেবে। আমি জানতে চাই গাড়ি পেট্রল বাবদ কত দেব?
ও আমার পিঠে হাত রেখে মাথা নাড়ে। ওয়ার্ডের বাইরে গার্ডেনে নিয়ে গিয়ে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আমাকে একটা দেয়। বলে শোন, কিছু দিতে হবে না। আজ বলে নয়, যখনই দরকার পড়বে,বলবি। আমি গাড়ি নিয়ে আসব।
এটা দেখি ক্যালকুলাসের চেয়েও জটিল ব্যাপার।
ও হাসে; বলে এটা ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কয়েক বছর আগে পরীক্ষার হলে ফ্লাইং স্কোয়াডের রেইডের সময় ও ভয় পেয়ে ওর চিট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। সেটা গিয়ে সামনে বসা আমার পায়ের সামনে পড়ে। জলারামের কসম খেয়ে বলে –বিশ্বাস কর, তোকে ফাঁসাব ভেবে কিছু করি নি; কিন্তু তুই বুক হলি। তোর বছর নষ্ট হলো। আমি জানি ইস গুনাহ কী মাফি হো নেহী সকতা; পর--।
আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি। রাগ, ঘেন্না কিছু নয়, একটা শুকনো বোদা ভাব। খালি একটা বছর নষ্ট! না,তিন-তিনটে বছর।
‘আমি সাপ্লিমেন্টারী না দিয়ে কলেজ বদলে নিলাম। সায়েন্স ছেড়ে কমার্স নিয়ে তিন বছর প্রাইভেট কলেজে পড়ে গ্র্যাজুয়েট হলাম। আগের একজন বাদে সব বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেছিলাম। সেই দোস্ত আর তার বাবা আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন।
তাই বাড়ি থেকে একটাও পয়সা নিই নি। অংকের টিউশনি করে পড়ার খরচা চালিয়েছি। বড়ে ভাইয়া ব্যঙ্গ করলেন, গাল দিলেন। কিন্তু আমি জেদ ছাড়ি নি।
এভাবেই একদিন এমার্জেন্সির সময় গ্রামীণ ব্যাংক খুলল, বিজ্ঞাপন বেরোল। বাড়িতে না জানিয়ে বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে অ্যাপ্লাই করলাম, পরীক্ষা দিলাম। ইন্টারভিউ হলো। বাকিটা তো আগেই তোমায় বলেছি। ব্যস’।‘
রাজন এক গেলাস জল খেল। মুখ মুছল, গলা খাঁকরি দিল।
--স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আমায় যে প্রথম দিন দাদার থেকে টাকা আনতে হবে শুনে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে সিকিউরিটির টাকা দিয়েছিলেন সেটা --?
--ঠিকই বুঝেছিস। সেই ‘দাদা’ ফ্যাক্টর।
রূপেশ হাসে, রাজন উশখুশ করে। খাবার সময় হয়েছে। ঠুল্লু এসে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে টেবিলে থালা সাজাচ্ছে।
--স্যার, আই উড লাইক টু সে সামথিং। আই হ্যাভ অলসো ওয়ান স্টোরি,নট আন-ইউজুয়াল লাইক ইয়োর্স, বাট ইয়েস, এ স্টোরি অল রাইট।
‘স্যার, হয়েছিল কি জয়েন্ট ক্লিয়ার করতে পারি নি। আসলে আমার মন লাগত না অংকে, ঠিক আপনার উলটো কেস। তবু, বাবা ভর্তি করে দিলেন এক কম্পিউটার ইন্সটিট্যুটে জেলা সদরে। এক ব্যাটা অ্যাপল না কিসের ফ্রাঞ্চাইজি নিয়ে ফেঁদে বসেছে একটা ঝকাস স্মার্ট কম্পু-ক্লার্ক বানাবার দোকান। অথচ সাইনবোর্ডে এবং প্রস্পেক্টাসে বড়ো বড়ো করে লেখা এখান থেকে পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। সাউথ আফ্রিকার কোন ইউনিভার্সিটির অ্যাফিলিয়েশন। এত সহজে ফরেন ডিগ্রি! কম্প্যু ইঞ্জিনিয়র! ব্যস, আমার বাবা ও ওঁর মত অনেক মাঝারি চাষি জমি বেচে পয়সা লাগিয়ে দিল। হোস্টেলে থেকে পড়তে হবে, ভালো পোষাক চাই। পার্সোনাল কম্পিউটার চাই, ডেস্কটপ। তখন ল্যাপটপ দেড় লাখের নিচে পাওয়া যেত না।
‘প্রথম প্রথম বেশ লাগছিল, কিন্তু ওই দুটো সেমিস্টার পর্য্যন্ত। অ্যালগোরিদম ও অংক গুলো কঠিন হতে হতে আমার ক্যাপাবিলিটির বাইরে চলে গেল। আমি ক্লাস বাংক করতে শুরু করলাম।
আমি একা নই, বেশ ক’জন সঙ্গী জুটে গেল। বেশিরভাগ শহরের, আমিই শুধু গ্রামের। তবে সবারই এক প্রবলেম—এইসব ছাইছাতার অংক আর অ্যালগোরিদম ! কাজ নেই বিদেশি ইঞ্জিনিয়র হয়ে। আস্তে আস্তে দীক্ষা হলো, সিগ্রেট থেকে মদ ও গাঁজা। না,ব্রাউন সুগার বা কোন ড্রাগস নয়। কিন্তু দুপুরের শো’তে সিনেমা দেখা সব চেয়ে বড়ো নেশা হয়ে দাঁড়াল। আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে কারও টিভি ছিল না। কলেজের ফীস বাকি পড়তে লাগল। আজ দেব, কাল দেব করেও লোড বেড়ে যাচ্ছিল। এক বন্ধু ধার দেবে বলেও আজ- নয়- কাল করতে লাগল। শেষে বাড়িতে চিঠি গেল। প্রাইভেট কলেজ বলে কথা। বাবা এল। প্রিন্সিপালের রুমে আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। বাবা জানলেন যে আমি দিনের পর দিন ক্লাসে যাইনি, মাসের পর মাস মাইনে দিই নি। বাবা বললেন যে উনি তো নিয়মিত আমার নামে মানি অর্ডার করেছেন।
বাবা হাতজোড় করে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে মাপ চাইলেন, আমার হয়েও। তারপর আমাকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। সাতদিন কোন কথা বলেন নি। গুম হয়ে বসে থাকতেন আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করতেন—আমার ছেলে চোর! ছিঃ।
সাতদিন পরে এক সকালে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বললেন—তৈরি হও। আমার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে যাবে।
মাকে বললেন—আমার সঙ্গে ওর খাবারও বেঁধে থলিতে ভরে দাও। দুপুরে ওখানেই খাবে। চাষার ছেলে চাষাই হোক, আমারই ভুল।
‘সাতটা দিন গেল না,আমি হাঁফিয়ে উঠলাম। জমিতে কাদার মধ্যে মই দেওয়া, হাল ধরা, আগাছা নিড়ানো—এ যে কি পরিশ্রমের কাজ যে করেছে সে জানে। রাত্তিরে ঘুমুতে পারি নে, সারা শরীরে ব্যথা। বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বললাম –অন্যায় করেছি। আর একটা চান্স দাও, ভাল করে পড়াশুনো করব। চাষের কাজ আমার দ্বারা হবে না।
বাবা অবিচল।
পাশের বাড়ির জ্যাকব আংকল বাবার বন্ধু। উনি বললেন –অনুশোচনায় সব পাপ, অনেক বড়ো বড়ো পাপ ধুয়ে যায়। আর এ তো তোমার ছেলে, কীই বা বয়েস!
শেষে সব কথা খুলে জানিয়ে জ্যাঠতুতো দাদাকে চিঠি লিখলাম। উনি ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের চার্জম্যান, উইনাদের আইটি আই থেকে পাশ, মেশিনিস্ট কাম মিলার।
‘তারপর দাদার চিঠি এল। উনি আমাকে ভিলাইয়ে নিজের কাছে রাখবেন, একটা আর্টস কলেজে ভর্তি করে দেবেন। আমি যাতে ভালভাবে গ্র্যাজুয়েট হই সেটার দায়িত্ব উনি নেবেন। বাকিটা বুঝতেই পারছেন। এখন আমাকে নিয়ে বাবা বেশ গর্বিত। উইনাদের চাষার ছেলে ব্যাংকের মত কঠিন কাজের লায়েক হয়েছে। লাখ লাখ টাকা নাড়াচাড়া করে। ভারত সরকার ওকে বিশ্বাস করে’।
রূপেশ বলল খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নে।
খাবার পর হাত ধুয়ে বসে রাজনকে বলল যে ওর কাছে সিগ্রেট থাকলে একটা দিতে।
রাজন কোন কথা না বলে একটা বাড়িয়ে দিল।
একটু পরে বলল—এই যে আপনি শুধু দিওয়ালির সময় বাড়ি যান, গিয়ে কী করেন? বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেন না ?
যা বলি তা না বলারই মত। মানে মা বা বৌদি চায়ের কাপ ধরিয়ে বলল দিয়ে আসতে। আমি নিয়ে গিয়ে ঠক করে ওঁদের সামনে রেখে দিয়ে বলি—চায় লীজিয়ে, ব্যস।
রাজন দু’দিকে মাথা দোলায়। আচ্ছা, ওঁরা কিছু বলেন না ? ধরুন, বোস, আমাদের সঙ্গে বসে চা খাও।
--আগে বলতেন, আমি উত্তর না দিয়ে উঠে চলে যেতাম। এখন আর কিছু বলেন না।
-- আপনি বয়সে ও পোস্টে বড়ো। আপনাকে অ্যাডভাইস দেব সে অধিকার নেই। আপনাকে ভাল লাগে, বুঝতে পারি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, তাই বলি—সারাজীবন ওই একটি ঘটনার ব্যাগেজ বয়ে বেড়াবেন? আজকে আপনার নতুন করে কাউকে কিছু প্রমাণ করার নেই। কিসীকো দিখানে কী কোই জরুরত নহী হ্যাঁয়; ঘরওয়ালে মুহল্লেওয়ালে-- কিসীকো নহী। ইসীলিয়ে কহতা হুঁ, বাতচিত শুরু কীজিয়ে। পিতাজীসে, বড়ে ভাইয়া সে। জিদ ছোড়িয়ে, ঘর জাইয়ে। খুদ পহল কীজিয়ে, করকে দেখিয়ে।
রুপেশ সিগ্রেট নিভিয়ে ওকে শুতে যেতে বলে।
পরের শনিবার। দিনের শুরু, বেলা দশটা। ঝাঁট-পাট হয়ে টেবিলে লেজার সাজানো হচ্ছে, কাস্টমারের জন্যে গেট খুলবে আরো আধঘন্টা পরে।
রূপেশের টেবিলের পাশে একটি এয়ারব্যাগ দেখে রাজন বলল—এটা কার?
--আমার রে। আর কার! আজ আমিও হাফ ডে’র পর ব্যাংক বন্ধ করে তোর সাথে ভিলাই যাব; হ্যাঁ, ‘বন্দে মাতরম’ বাস ধরে। ফিরব সোমবার সকালে, তোর সাথে। কণ্ডাকটারকে বলে একটা ভাল সিট জোগাড় করিস তো, সামনের দিকে।
রাজনের চোখ বড়ো বড়ো, কথা ফোটে না। রূপেশের মুখে হাসি, কিন্তু চেহারায় একটা লজ্জা লজ্জা ভাব।
--তোকে বলা হয় নি। কাল ছিল বড়ে ভাইয়ার জন্মদিন। কী মনে হলো, সকালবেলা ব্যাংকের ল্যান্ডলাইন থেকেই ফোন করে ‘হ্যাপি বার্থ ডে ভাইয়া’ বললাম।
খানিকক্ষণ সন্নাটা। ভাবছিলাম লাইন ছেড়ে দেব কি না। এমন সময় একটা কাঁপা কাঁপা আওয়াজ শোনা গেল—কৌন?
ভাইয়া, আমি রূপেশ; আজ আপ কা জন্মদিন হ্যাঁয় না,ইসীলিয়ে।
আবার সন্নাটা। তারপর এল এক হুঙ্কারঃ বেওকুফ, জানবর, উল্লু কঁহিকে! এতদিন পরে আমাকে মনে পড়ল? তোর বড়ে ভাইয়াকে?
৮)
আহিরণের পূবপাড়ে আজ সন্ধ্যেয় গাছগাছালি আবার চৌপালে বসেছে। বৃদ্ধবটের শরীর খারাপ, সভায় অনুপস্থিত। ওর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে অশত্থ। আসলে বনবিভাগ থেকে কয়েকদিন আগে কিছু মুখ্যু কর্মচারি এসেছিল। তারা কুড়ুল দিয়ে বটের গায়ে বাকল তুলে একটা চৌকো মত আকার বানিয়েছে। তাতে গরম আলকাতরা দিয়ে একটা নম্বর লিখে দিয়েছে—৫৫৭।
মানে এই জঙ্গলে এই বটগাছটির সংখ্যা হলো ওই ৫৫৭। গুণতি হচ্ছে, রেকর্ড দুরুস্তি হচ্ছে। কিন্তু বটের যে লেগেছে, ঘা শুকুতে যে সাতদিন লাগছে—তার বেলা?
সে কথা উঠতেই পাকুড় বলে উঠল—মানুষেরা এ’রকমই হয়।
কোসম সেবারের অভিজ্ঞতা ভোলে নি, তাই মানুষের কথা উঠতেই মাথা নেড়ে সায় দেয় ,-- সে আশকথা পাশকথা যাই হোক। মানুষ নামের দু’পেয়ে জন্তুর ব্যাভার নিয়ে তার মনে কোন সন্দ নেই। বলল সেবার যখন ছুরিখুর্দ গাঁয়ের আমোল সিং বৈগা আমার বোঁটা ছিঁড়ে ফুল-পাতা নিতে এল অষুধ বানাবে বলে, তখন তো আমি তোমাদের পূজ্য পঞ্চায়েতে নালিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যথা নিয়ে তোমরা কেউ কিছু কর নি। খালি আমার বন্ধু কাঁকড়াবিছে ওকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল।
পরে যখন কোরবা থেকে ওষুধ কোম্পানির আড়কাঠি এসে জোর করে আমায় তছনছ করে সব নিয়ে গেল, তোমরা বললে কেঁদে লাভ নেই,যা হবার তা তো হয়ে গেছে। বনইমলি আমার হয়ে বলতে এলে বুড়োর দল ওকে চুপ করিয়ে দিল। উলটে বটদাদু আমাকে বোঝাচ্ছিলেন যে আমাদের নাকি মানুষজন ছাড়া চলে না। ওদের বিরুদ্ধাচরণ করে নাকি জঙ্গলে টেকা দায়। এখন হলো তো? নিজের গায়ে না লাগলে অন্যের কষ্ট কেউ বোঝে না।
পলাশ শিমূল যমজ ভাইয়ের মত। একসঙ্গে বৈঠকে আসে, একসঙ্গে যায়। যা বলে তা যেন আগে থেকে মহড়া দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে। কখনও দাঁড়ি কমা আলাদা হয় না। পলাশ বলল এই সব নাকে কান্না বন্ধ করে কাজের কথায় এস। আহিরণের ওপারে কোশ চারেক ওপাশে বিজলি কারখানা খুলছে; দিল্লি সরকারের। পাশেই আগারখার, দুরপা, কোসমন্দা, মনগাঁও, গেওরা –এসব জায়গায় দু’বছর আগেই জরিপ হয়ে কয়লা খাদানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মাটির তলায় নয়, মাটির ওপরে। এবার সেই কয়লায় এপারে বিজলি তৈরি হবে। এর জন্যে অনেক কাঠ চাই,-- বরগা, খুঁটি, বল্লী, বাতা এসবের জন্যে। তাই অনেক গাছকে মরতে হবে। এই যে গায়ে আলকাতরা দিয়ে নম্বর লেখা হচ্ছে তা আর কিছুই নয়, বলির আগে পাঁঠাদের দড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা।
যত্ত গাঁজাখুরি কথা। আগারখার, দুরপা বা কোসমন্দায় বিজলির কল বসবে তো এখানে গাছ কাটবে কেন? কে এই সব আতংক ছড়াচ্ছে? নামটা বল! তুই এই জঙ্গলের গাছ। এর বাইরে কোনদিন পা বাড়াস নি। তুই কোত্থেকে এত সব খবর পেলি?
গলা তুলল শিমূল।
ওকে ধমকাচ্ছ কেন? তোমাদের সাবধান করতে এল, তো খেরে উঠলে! জেগে ঘুমুতে চাও, তো ঘুমোও। কে মানা কচ্ছে ? সেই যে বলে না –‘ভাল রে ভাল করে গেলাম কেলোর মার কাছে, কেলোর মা বলল আমার ছেলের সঙ্গে আছে’। তোমাদের হলো সেই দশা।
একটা সিড়িঙ্গে তেঁতুল গাছ আগ বাড়িয়ে বলতে গেল—এসব খবর দিল কে?
ঝাঁঝিয়ে উঠল শিমুল। ‘তুই চুপ কর! তিনদিনের এঁড়ে, এল শিং নেড়ে’! খবর দিয়েছে শালিক, ময়না আর টিয়েপাখির ঝাঁক। ওদিকে গাছকাটা শুরু হলো, তো ওদের পুরনো বাসা ভেঙে গেল। তখন সবাই দলবেঁধে এদিকের জংগলে চলে এসে কুটোকাটা দিয়ে ঘর বানানো শুরু করেছে। কিন্তু সে আর ক’দিন? এখানে দাগ পড়া শুরু হয়েছে। এর পর কুড়ুল করাত আর মস্ত মস্ত ট্রাক নিয়ে চলে আসবে ঠেকেদারের দল।
আচ্ছা, এই দলের পান্ডা কেটা? তাকে কিছু করা যায় না ? পটিয়ে পাটিয়ে কাজটা যদি একটু ঢিলে করা যায়! তাহলে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
বড়ো দেশি আমগাছ আর বাবুল মুখ খুলল--একটা নতুন আস্তানা খুঁজে পেতে একটু সময় তো লাগবেই। এমন ওঠ- ছুঁড়ি-তোর-বিয়ে ধম্মে সইবে? নদীর ওপারে কোসগাই পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। কোসগাই দেবী খুব জাগ্রত। উনি এমন অন্যায়ের কোন প্রতিবিধান করবেন না ?
পলাশ বলল –আছে, লোক আছে। সরকারি কোম্পানির পাটোয়ারি ঝাড়ু সিং আর ঠিকেদার সমেলাল দেবাঙ্গন, ছুরি গাঁয়েরকাশ্যপ ডাক্তারের গিন্নি যার নাম দিয়েছে নারদমুনি। কিন্তু এদের খাঁই মেটানো তোমার আমার কম্মো নয়। আমাদের দু’একজন চেষ্টা করেছিল। তো ব্যাটা ঝাড়ু সিং হাঁকিয়ে দিল। বলল যে এসবের অর্ডার এয়েছে উপর থেকে, মানে দিল্লি থেকে। ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
ব্যাটা নচ্ছার! এদিকে ওর মাটির ঘর পাকা হচ্ছে, ছাদের টালি-খাপরা ফেলে ছাত ঢালাই হয়ে গেছে। মেজেতে নাকি সাদা-কালো দাবাখেলার ছকের মত টাইলস বসবে
আচ্ছা, ঝাড়ু সিং আবার একটা নাম হলো নাকি! মানুষদের যে দিন দিন কি পিবিত্তি হচ্ছে? কোথায় আগের দিনের মত মহেশ, সুরেশ, গণেশ,,রমেশ বা অন্য কোন
ঠাকুর-দেবতার নাম রাখবে, অন্ততঃ রাকেশ, নরেশ, দেবেশ—তা না কিসব অলুক্ষুণে ঝাড়ু, মেথর, চামার এইসব।
অলুক্ষুণে কথাটা ঠিকই ধরেছ। আসলে ওর আগে তিন ভাইবোন জন্মেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যমরাজ টেনে নেয়। তাই এর পরে ওর দিদির নাম হলো মহেতরীন বাঈ ( মেথরানী), ওর নাম ঝাড়ু আর ছোট ভায়ের নাম চামার সিং। তারপর দেখ হাতে হাতে ফল। এমন সব যমের অরুচি বিচ্ছিরি নাম রাখায় যমরাজ আর ফিরেও তাকায় নি।
একপাশে কখন এসে চুপটি করে বসেছিল ঠিকরে বাজ। দেখতে ছোট, কিন্তু বাঁকানো ঠোঁটে আর নখে তরোয়ালের ধার। সে ডানা ঝাপটে বলে উঠল—ফের বাজে মেয়েলি গাল-গল্প! এদিকে যে অমঙ্গল নেবে এসেছে ছুরি গাঁয়ে তার কোন খবর রাখ তোমরা?
সবার চোখ এখন ঠিকরে বাজের দিকে। হয়েছেটা কি? আহিরণের জঙ্গলে এমন কোন খবর তো আসে নি!
বাজের চেহারায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব, ভাও খেয়ে সে আরও গম্ভীর। একটা কৃত্রিম মোটা ফ্যাসফেসে আওয়াজে ও বলতে শুরু করল।
তবে শোনঃ কাঠঘোরা –ছুরি বাসরাস্তা-- প্রায় নব্বই কিলোমিটার -- এখন পাকা হচ্ছে। এতদিন কোরবা থেকে দশ কিলোমিটার আর কাঠঘোরা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পাকা ছিল। মাঝের পঁচাত্তর কিলোমিটার খোয়াওঠা মোরাম ঢালা কাঁচা রাস্তা যা বর্ষায় গাড়ি চলার মত নয়। কিন্তু বিজলি কারখানা তৈরি হচ্ছে, ট্রাক চলবে, সাহেব-মেমদের গাড়ি আসবে যাবে; ওদিকের গাঁয়ে কোয়ার্টার, বাজার-হাট, ইস্কুল, দোকানপাট সব বসানো হবে। তাই রাস্তা পাকা হবে।
নবযুবক বনইমলি বিরক্ত হয়ে বলে –কাজের কথায় এস। এর মধ্যে ছুরিগাঁয়ে অমঙ্গলের ছায়া কোথায় দেখলে?
ঠিকরে বাজ জবাব না দিয়ে এমনভাবে তাকালো যে মুরুব্বিরা চেঁচিয়ে উঠল—ভাইগে ভাইগে, খামোশ! খামোশ! কেউ মাঝখানে কথা বলবে না।
একটু কেশে ঠিকরে বাজ আবার শুরু করল।
পঁচাত্তর কিমি রাস্তায় পিচ ঢালার কাজ চারজন ঠিকেদারকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড়ো টুকরো, প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার,পেয়েছে কোরবার ঠিকেদার মহেন্দ্রপাল শর্মা। এর মধ্যে ধনরাস-ছুরি গাঁয়ের সামনে গতকাল কাজ চলার সময় একটা ট্রাক থেকে মজদুর নামার সময় ট্রাকের চাকা সিলিপ মারে আর পালটি খাওয়া ট্রাক একটা গরম প্রায় ফুটন্ত পিচের ড্রামে ধাক্কা মেরে কাত করে দেয়। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে গাঢ় দলা দলা পিচ কাত হওয়া ট্রাকের নীচে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকতে থাকে। পাঁচজন মজদুর, তিনজন মর্দ অউর দো জন অঊরত, আটকা পড়ে ছটফট করতে থাকে; বাঁচাও বাঁচাও চেঁচাতে থাকে। কিন্তু ঠিকেদারের বাকি লোকেরা ভেবে পায় নি কী করা উচিত। ট্রাকের নীচের থেকে ওদের টেনে হিঁচড়ে বার করতে গেলে নিজেরা গরম গলা গলা পিচে ঝুলসে যাবে।
কয়েক ঘন্টা ধরে এই নাটক চলল, মানে যতক্ষণ ওদের প্রাণ ছিল,জল চাইছিল। ছুরিগাঁয়ের মেয়ে-মদ্দ ভীড় করে করুণ মুখে এই তামাশা দেখল। এখানেই শেষ নয়।
ঠিকেদার শর্মা সরপঞ্চ সঝলা কুমারকে পটিয়ে ফেলল, উনি যেন পুলিশের এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দিব্যি গেলে বলেন যে খালি ট্রাক পালটে গেছল। তাতে কোন মানুষ ছিল না। কেউ মারা যায় নি, শুধু ড্রাইভার আহত হয়ে হাসপাতালে। শর্মা ডেডবডিগুলোকে লোপাট করে দেয় আর তাদের আত্মীয়দের বলে ওরা কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেছে ভিনগাঁয়ে, বেশি টাকার লোভে আর কি! কোথায় গেছে? তা শর্মা জানে না।
এবার দেখ দেবীর কোপে গাঁ যদি ছারখার না হয়ে যায়!
অমঙ্গলের লক্ষণ দেখা যেতে লাগল ক’দিন পর থেকে।
ব্যাংকের কাজকম্মের মাঝে রূপেশের নজরে এল একটা খুব ফর্সা জোয়ান ছেলে আলোয়ান জড়িয়ে একটা বেঞ্চে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। দু’ঘন্টা কেটে গেল, ভিড়ের লোকজন চলে গেছে। ছেলেটা একই ভাবে বসে আছে। অসুস্থ? জ্বরজারি নাকি? রূপেশের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। একটু পরে ঠুল্লুকে বলল—যা তো, ওকে ডেকে নিয়ে আয়, কী চাই ওর?
ও জানাল যে একটু পরে ও ম্যানেজার সাহাবের সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু একলা।
রূপেশের ভ্রূ ওপরে উঠল। কী কেস? কোন কমপ্লেন? লোন পাস করানোর নাম করে ঘুস চাওয়া? এখন তো স্টাফ মাত্র দু’জন। ফিল্ড অফিসার নতুন রিক্রুট থেকে আগামী মাসে পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে ঘরশত্রু বিভীষণটি কে? রাজন নাকি ঠুল্লু? তবে লোনের কাগজপত্রে ঠুল্লুর হাত পৌঁছয় না। রাজনের সুযোগ বেশি। ও ডকুমেন্ট ফিল আপ করে। তাহলে তো রাজনকে এখান থেকে সরাতে হবে। দু’পক্ষের স্টেটমেন্ট নিয়ে প্রাইমা ফেসি কেস মেঁ দম হ্যাঁয় মনে হলে ওকে সাস্পেন্ড করিয়ে ডিপার্টমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন করার রেকমেন্ডেশন পাঠাতে হবে হেড অফিসকে। দু’মাস আগেই ও বিলাসপুরের স্টেট ব্যাংক ট্রেনিং সেন্টারে ফ্রড, ইনভেস্টিগেশন ও ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি নিয়ে একটা সাতদিনের ক্যাপসুল কোর্স করে এসেছে। এর মধ্যেই সে নতুন শেখা বিদ্যেটি কাজে লাগানোর সুযোগ এসে গেল! হে ভগবান!
রাজনকে যে ও খুব পছন্দ করে। কিন্তু তাবলে কি চোখ বুঁজে থাকবে? মাই স্টাফ, রাইট অর রং ! তাহলে ন্যাচারাল জাস্টিসের কী হবে? প্রাকৃতিক ন্যায়?
ও হ্যাঁ, প্রাকৃতিক ন্যায় তো বলে কাউকেই তার পক্ষ না শুনে সাজা দেওয়া উচিত নয়। দ্যাট উইল বি এ ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস। ঠিক, নালিশটা শোনার পর রাজনের কী বলার আছে তা ও শুনতে হবে। আগে থেকেই কেন ওকে দোষী মনে করছি? নাঃ, এই বায়াসড এই পূর্বাগ্রহ ঠিক নয়। আমার মনটাকে ক্লিন শ্লেটের মত রাখতে হবে।
এই যে শোন, এদিকে এসে আমার সামনের চেয়ারটাতে বস। এবার বল। কী কমপ্লেন তোমার? আমার ব্যাংকে কী অসুবিধে হচ্ছে?
সাহেব, আমার লোন চাই।
আচ্ছা, কত টাকা?
সাহেব দশ হাজার।
কবে অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছ? কার হাতে? আমার ব্যাংকে কিসী কে সাথ বাত কিয়া?
না না,আজই প্রথম আপনার ব্যাংকে এলাম। কেউ জানে না,আমার বাড়িতেও না।
কী নাম তোমার? দশ হাজার অনেক টাকা। কী বিজনেস করতে চাও?
মুন্নালাল দেবাঙ্গন, আমরা তাঁতি। বিজনেস নয়, এই টাকাটা আমার চিকিৎসায় খরচা হবে।
মানে? কী হয়েছে তোমার?
আমি দিন প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। শরীরে রক্ত কমে যাচ্ছে। কোন কাজ করতে পারি না। ঘরে দুটো খটখটা (পিট লুম), তাতে দুই হাতের সঙ্গে দুই পা’ও চালাতে হয়। পেরে উঠছি না। রাত্রে জ্বর আসে।
রূপেশ ভাল করে ওর অস্বাভাবিক হলদেটে চেহারা, নিস্তেজ চোখ ও ফিসফিস করে কথাবার্তা খেয়াল করে। --শোন, তুমি কোরবায় সরকারি হাসপাতালে যাও। রক্ত পরীক্ষা করাও। বিনে পয়সায় হয়ে যাবে। তখন ধরা পড়বে কী হয়েছে।
মুন্নালাল আরও এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে—না মালিক, আমি জানি আমার কী হয়েছে। আসল হল আমার বৌ। ও হলো টোনহী, আমার রক্ত শুষে নিচ্ছে। তাই দিন দিন কমজোর হো রহা হুঁ। চেহরা পীলা পড় গয়া হ্যাঁয়।
এ কোন দুনিয়া! রূপেশ চেনে না।
ও দুর্বল গলায় বলে—আমি কী করতে পারি? কোন ধান্ধা অথবা রোজগারের জন্যে ছাড়া কী করে লোন দেব?
ছেলেটা রূপেশের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মালিক, আপনি আমায় বাঁচান। এই টাকা নিয়ে আমি যাব রায়পুরে মীরা দাতারের দরবারে। সেই দরগায় এইসব কালাজাদুর চিকিৎসা হয়। একমাস থেকে ইলাজ করিয়ে তবে ফিরব। তাই টাকাটা চাইছি, হুজুর, ফিরিয়ে দেবেন না।
জোশী মহারাজ বলেছিলেন – বিপদা অকেলে নহী আতী। আপদ-বিপদ কখনও একা আসে না। আরও বলেছিলেন যে বুরে ওয়ক্ত সাবধানে মাথা নীচু করে পার করতে হয়। গোঁয়ার্তুমি করে লাভ হয় না। যব ওয়ক্ত পর গয়ে বাঁকা, তো গধে কো বোলো কাকা! সময় খারাপ হলে, লোকে গাধাকেও কাকা বলে।
উনি পাঠিয়েছিলেন ভগতরাম রামায়ণীকে ওর পাঠশালার জন্যে লোন চাইতে। তা ব্যাংক ম্যানেজার ওকে বেয়ারিং চিঠির মত ফেরত পাঠিয়েছে। বিকেল বেলা পেতলের গেলাসে কালো গরুর দুধ চুমুক দিয়ে খেতে খেতে উনি ভগতরামের দুঃখের কথা শুনলেন। এও শুনলেন যে উনি জামিন হবেন জেনেও ব্যাংক ম্যানেজার টস-সে-মস নহীঁ হুয়ে। এবম্বিধ ব্যবহারে কি গুরু মহারাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয় নাই? উনি যে এই এলাকার মারোয়াড়ি সমাজের গুরু।
দু’সপ্তাহ পরে রূপেশ বিলাসপুরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের অফিস থেকে একটি চিঠি পেল। তাতে রামায়ণীর নালিশের উল্লেখ করে বলা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ছুরি শাখা কি সত্যিই ন্যায়প্রার্থী ভগতরামের স্কুলের জন্যে লোন দিতে অস্বীকার করেছে? করে থাকলে তার কারণ জানিয়ে সাতদিনের মধ্যে উত্তর দিক।
রূপেশ সেই দিনেই উত্তর দিনে জানিয়ে দেয় যে ওর ব্যাংকের বর্তমান ঋণনীতি অনুযায়ী পাঠশালার জন্যে ঋণ দেবার কোন বাজেট নেই। আর ওই পাঠশালাটি ইতিমধ্যেই সরকারের ‘বালবাড়ি’ প্রজেক্টের অন্তর্গত অনুদান পেয়েছে। ফলে ওদের আর কোন ফান্ডের দরকার নেই। এবং ঋণ আবেদনে ক্যাশ চাওয়া হয়েছে, অথচ সেই টাকা কী কাজে খরচ হবে তার কোন স্পষ্ট প্রপোজাল নেই।
এর দুদিন পরে জোশী মহারাজ ওকে ডেকে ঘরে বসিয়ে চা খাইয়ে বুরে দিন কেমন করে কাটাতে হয় তার উপদেশ দিলেন। রূপেশ ভেবে পেল না কাকে ‘কাকা’ ডাকতে হবে। তার ঠিক একদিন পরে রামায়ণী এসে হাজির। সঙ্গে এক মহিলা। ওর পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা। রামায়ণী পান চিবুতে চিবুতে বলল – সেই তো ফজিহত হলো। আগেই আমার কথা শুনলে এই ‘বুরে দিন’ দেখতে হত নয়া।
--বুঝলাম না।
--কেন? কালেক্টরের অফিস থেকে আপনার কাছে আমাকে লোন দেওয়ার আদেশ আসে নি?
-- না তো!
-কিঁউ ঝুট বোল রহে হো, সাব? আমি বিলাসপুরে ওদের অফিসের ডেসপ্যাচ রেজিস্টার দেখে এসেছি। ওরা তো বেশ কয়েকদিন আগেই আপনাকে চিঠি দিয়েছে। আমাকে কপিও দিয়েছে।
--ও হ্যাঁ; চিঠি তো এসেছিল। তার জবাব ও পাঠিয়ে দিয়েছি।
--তার কপি? কী লিখেছেন?
-- ওখান থেকেই নিয়ে নিন। তবে আপনাকে লোন দেব বলি নি।
বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকে রামায়ণী। তার পর করুণ স্বরে বলে—কেন রাগ করছেন সাহাব? কুছ লে দে কর মামলা খতম কীজিয়ে না ! দোনো কা ভলা হো জায়ে।
- রাগ করি নি তো। আসলে আমি খুব ছোটা আদমী। মামলা এখন কালেক্টরের কোর্টে; আমার হাতের বাইরে। এবার আপনাকে ওনার অফিস থেকেই লোন নিতে হবে।
সেদিন বিকেলে খবর এল যে মুন্নালাল দেবাঙ্গন ‘রক্তাল্পতায়’ ভুগছিল, মারা গেছে। ঠুল্লু বিকেলের চা দেওয়ার সময় বলল—সাহাব, এটা আপনার ভুল। ওকে মীরা দাতারের দরগায় চিকিচ্ছের জন্যে দশ হাজার টাকা লোন দিলে ও সেরে উঠত। ওর বৌ সত্যি সত্যি ওর রক্ত শুষে নিচ্ছিল। আসলী চুড়েল। পাক্কা ডাইনী।
রূপেশের মন খারাপ হয়ে গেল। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার সময় মুন্নার হলদেটে চোখের হতাশ চাউনি ওর স্বপ্নে বারবার ফিরে আসবে।
কিন্তু খারাপ সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না। তিনদিন পরেই কাঠঘোরা থানা থেকে কালো গাড়ি ভরে সাতজন সেপাই আর জিপে করে থানেদার হাজির। বাজারের কাছে বুড়ো সীতারাম আগরওয়ালকে আজ সকালে নিজের ঘরের আঙিনায় কুয়োর বাঁধানো পাড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ধুতি-বানিয়ান পরা নিঃসন্তান বিপত্নীক বৃদ্ধ কুয়োর মধ্যে গলা বাড়িয়ে কিছু দেখার অবস্থায় পড়ে আছেন। গলায় কালশিটে। দুপুর নাগাদ দারোগা সদলবলে হাজির হলো ব্যাংকে। এই ব্যাংকে বুড়োর কোন টাকাপয়সা জমা আছে কি না,থাকলে কত, তাতে কোন নমিনির নাম আছে কি না !
ঠুল্লু জনান্তিকে বলল—সাহাবের এখন সাড়ে সাতি’র দশা চলছে।
0 comments: