গল্প - শুভম চৌধুরি
Posted in গল্প
ঠিক আটটা নাগাদ দার্জিলিং মেলটা এন.জি.পি স্টেশনে এসে দাঁড়ালো| প্ল্যাটফর্মের লাগোয়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন সূর্যশেখর, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী|
'হাঁপিয়ে গেলে নাকি?" স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন ষাট ছুঁই ছুঁই সূর্যশেখর|
"বললাম একটা কুলি করে নাও" ব্রিজের রেলিঙে হাত রেখে জিরিয়ে নিলেন মিসেস সূর্যশেখর|
সূর্যশেখর উত্তর দিলেন না, স্ত্রীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলতে শুরু করলেন| দুটো ব্যাগ বইবার মতো শারীরিক শক্তি তাঁর আছে|
ফুটব্রিজের ওপর থেকে অনেক দূর অব্দি দেখা যায় রেল লাইনগুলো এঁকে বেঁকে চলে গেছে| শিলিগুড়ি সেই অর্থে শৈল শহর নয়, কিন্তু ফুটব্রিজটায় দাঁড়ালে বেশ একটা হালকা হাওয়ার স্পর্শ লাগে, মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়|
ষাটের দশকে তৈরী হওয়া নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে পা রাখলেন যাদবপুর দম্পতি, প্রফেসর সূর্যশেখর এবং তাঁর সহধর্মিনী| সূর্যশেখর বরাবরের পাহাড় প্রেমী, কলকাতায় পি.এইচ.ডি করার সময় দু তিন মাস অন্তর অন্তর উত্তরবঙ্গ ভ্ৰমণ একরকম অভ্যেস মতোই ছিল| মাঝে বেশ কয়েকটা বছর বাইরে চলে যাওয়ার কারণে এদিকটা আর আসা হয়ে ওঠে নি| এখন চাকরি জীবনের শেষ লগ্নে ফিরে এসেছেন কলকাতায় , তাই উত্তরবঙ্গ প্রেম আবার চাগার দিয়ে উঠেছে|
লাল রঙের স্করপিওটা অপেক্ষা করছিলো স্টেশনের বাইরে সাজানো স্টিম ইঞ্জিনটার সামনে| ড্রাইভার বিনোদ কুশল বিনিময় করে মালপত্তর তুলে নিলো গাড়িতে|
"বিক্রমপুর পহুঁচনে মে কিতনা ওয়াক্ত লাগেগা? সূর্যশেখর প্রশ্ন করলেন বিনোদকে|
"তিন ঘন্টা মানকে চালিয়ে স্যার, বিচ মে ব্রেকফাস্ট কর লেঙ্গে|"
গাড়ির সামনের সিটে একটি যুবক বসে আছে, মনে হয় একেও সূর্যশেখর ট্রেন থেকে নামতে দেখেছিলেন| বোধ হয় এই ছেলেটিও যাবে তাঁদের সঙ্গে বিক্রমপুর|
"জায়গাটা ভালোই হবে কি বল?" সূর্যশেখরের স্ত্রী হাতের ব্যাগ থেকে একটা গরম জামা গাড়ির সিটের ওপর রেখে দিয়ে জানতে চাইলেন|
"বিক্রমপুর একদম হেভেন আছে",অ্যাক্স্যিলেটারে পা চেপে বিনোদ তার গ্রামের গুনগান করতে শুরু করলো|
শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে,সুকনার মিলিটারি বেস ক্যাম্পের পাশ দিয়ে গাড়ি ছুটতে শুরু করলো মসৃন রাস্তার বুকের ওপর দিয়ে| রোহিনী টোল প্লাজা পেরোনোর পর শুরু হলো আঁকা বাঁকা পাহাড়ী রাস্তা| অনামী একটা দোকানে দাঁড়িয়ে প্রাতরাশ সেরে নিলেন দম্পতি| গাড়ির অন্য ছেলেটা খুব একটা কথা বার্তা বলে না, এক প্লেট মোমো কোনো রকমে খেয়েই রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিলো ফটাফট| তারপর অন্যমনস্কের মতো একজায়গায় বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো চুপচাপ| সূর্যশেখরেরও ছবি তোলার নেশা আছে, তবে এই জায়গার ওপর দিয়ে আগেও অনেকবার গেছেন, তাই নতুন করে ছবি তোলার উৎসাহ পেলেন না|
গাড়ি আস্তে আস্তে সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ওপরে উঠছে| দূরে শিলিগুড়ি শহরের সমতল যেমন চোখে পড়ে, আবার অন্য দিকে পাহাড়|
"হেয়ার পিন টার্ন গুলো কি দারুন লাগছে না?" সূর্যশেখর আঁকা বাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে মনেই বললেন|
"ওটা কি তিস্তা?" অনেক দূরে বয়ে চলা একটা নদীর দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো ভাস্কর|
"নেহি, ও বালাসুন রিভার, তিস্তা ইধার সে নেহি দিখেগা" বিনোদ গাড়ি চালাতে চালাতে জবাব দিলো|
"তুমিও ক্যানন ইউস কর দেখছি" সূর্যশেখর নিজেই যেচে আলাপ করতে চাইলেন ছেলেটির সাথে|
"হ্যাঁ, আপনারাও কি তাই?" ছেলেটি একবার পেছনে তাকিয়ে উত্তর দিলো|
"ইনফ্যাক্ট সেম মডেল" হেসে বললেন সূর্যশেখর|
"বাহ্" সংক্ষিপ্ত জবাব ছেলেটির|
"কলকাতা থেকে নাকি?"
"হাওড়ায় থাকি, আপনারা?"
"আমরা তো যাদবপুর, এই আমার স্ত্রী সুনয়না, আর আমি সূর্যশেখর"| সুনয়না নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত তুলে অল্প হাসলেন|
"আমি ভাস্কর" ছেলেটির নাম জানা গেলো এতক্ষনে|
"বিনোদ জি ইধার কই মেডিসিন শপ হোগা?" ভাস্কর চারিদিকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল বিনোদকে|
"কার্শিয়াংমে মিলেগা, তাবিয়াত খারাব হ্যায় কেয়া ?"
"ট্যাবলেট টা ভুলে গেলাম.." নিজের মনে মনে বলে উঠলো ভাস্কর|
কার্শিয়াঙে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দু তিনটে মেডিসিন শপ ঘুরেও মনে হলো না ভাস্কর ওষুধের খোঁজ পেলো| সূর্যশেখর আগে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন না কিছু, কিন্তু বুঝতে পারলেন ছেলেটা ওষুধ আনতে ভুলে গেছে বলে বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে|
কার্শিয়াং এর পর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় হেয়ার পিন টার্ন| ছোট ছোট জনপদের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা, এখান থেকেই দেখা মেলে বিখ্যাত টয় ট্রেনের লাইনের| "টুং,সোনাডা, ঘুম পেরিয়ে..." না অতদূর যেতে হবে না, সোনাডা ছাড়িয়ে একটু গিয়েই ডান দিকের একটা ছোট্ট রাস্তায় ঢুকে পড়লো গাড়িটা| প্রায় মিনিট চল্লিশ পাথুরে রাস্তার ঝাঁকুনি পেরিয়ে অবশেষে গাড়িটা এসে দাঁড়ালো একটা গেটের সামনে|গেটের ওপর বড় বড় করে লেখা "বিক্রমপুর ইকো রিসর্ট"|
"গরম জল দিয়ে গেছে, চানটা সেরে নাও তুমি" কটেজের বারান্দায় চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন সূর্যশেখর| পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট গ্রাম, বিক্রমপুর| বড়জোর কুড়ি ঘর লোকের বাস, একটু দূরে দেখা যায় টাইগার হিল| কটেজের গা ঘেঁষে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা, সেখান থেকে শুরু হয়েছে জঙ্গল| আকাশ পরিষ্কার থাকলে নাকি একটু ওপরে উঠলেই দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা|
"লাঞ্চ রেডি হ্যায়" - বছর পনেরোর কিশোরী যোগিতা সামনের রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সূর্যশেখরের উদ্দেশ্যে বলে| বিনোদের বড় ভাই প্রসাদ, তারই মেয়ে যোগিতা| এই গ্রামের প্রায় সকলেই কোনো না কোনো ভাবে পর্যটন ব্যবসার সাথে যুক্ত| কেউ গাড়ি চালায়, কেউ কটেজে বা হোম স্টে গুলোতে রান্না করে| অল্প কিছু চাষ বাস, গবাদি পশু পালন আর সিজনের সময় ট্যুরিস্টদের দেখভাল, এক কথায় সোজা সাপ্টা জীবন|
সুনয়না বাথরুমে ঢুকলে আধঘন্টার আগে বেরোবে না, এদিকে খিদেটাও বেড়েছে| সূর্যশেখর দোনামোনা করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন রান্নাঘর লাগোয়া ডাইনিং রুমের দিকে|
"অউর কোই টুরিস্ট লোগ আয়েগা আজ?" স্কোয়াশের তরকারি ভাতে মাখতে মাখতে যোগিতাকে প্রশ্নটা করলেন সূর্যশেখর|
"আয়েগা, ট্রেন লেট্ হ্যায় উন্কা, বড়া গ্রুপ হ্যায়"।
সূর্যশেখর বড়া গ্রুপ এর কথা জানতে পেরে বেশ বিরক্ত হলেন | কোথাকার এক পলিটিকাল দাদা নাকি আসছে তার পরিবার নিয়ে, সব মিলিয়ে প্রায় সাত আট জন| এই সুন্দর জায়গায় এরকম একটা গ্রুপ না আসলেই কি নয়? ব্যাজার মুখে ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করলেন সূর্যশেখর |
সুনয়না খাবার খেয়ে বিছানায় একটা বই নিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়লেন| জানুয়ারিতে বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে, ট্রেনে আর গাড়ির জার্নি, সাথে গরম গরম ভাত, ঘুমোবার জন্য একদম আদর্শ পরিবেশ| সূর্যশেখর কটেজ থেকে বেরিয়ে একটা ছোট মাঠের মতো জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে বসলেন| বেশ লাগে এরকম চুপটি করে নিজের মতো থাকতে| সেই বড় গ্রূপ এর লোকজন কিছুক্ষন আগেই এসে পৌঁছেছে| এসেই গরম জল, চা, কফি, মাছের ঝোল আর আলু পোস্তর ডিমান্ড শুরু হয়েছে| বেড়াতে এসে সূর্যশেখর এতো বায়নাক্কা পছন্দ করেন না, তাই বেছে নিয়েছেন এই নির্জনবাস|
"কটা বাজছে বলুন তো এক্সাক্টলি? আমার মোবাইলটায় মনে হয় প্রবলেম হয়েছে" ভাস্কর একটু দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে জিজ্ঞেস করল|
"এই তো চারটে দশ" সূর্যশেখর ভাত খাবার সময় ছেলেটাকে দেখতে পাননি|
"তুমি কি চাকরি করো নাকি পড়াশোনা?" সূর্যশেখর ভালো করে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলেন|
"চাকরি করতাম তিন বছর, ছেড়ে দিয়েছি, এখন বরানগর থেকে পি.এইচ,ডি করছি |" ভাস্কর নরম ঘাসের ওপর আরাম করে প্রায় শুয়েই পড়লো|
"বাহ্, কি সাবজেক্ট?"
"স্ট্যাটিসটিক্স"।
"হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স, আমারও তো তাই, আমি বারাসাতে পড়াচ্ছি এখন" সূর্যশেখরের সাথে ভাস্করের আড্ডা জমে গেল|
না চাইতেও সন্ধ্যে নাগাদ কটেজের বাইরে সেই বড় গ্রুপের একজনের মুখোমুখি হতেই হল|
"বাঙালি তো ? মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে" লুঙ্গি আর লাল রঙের টাইট টি শার্ট পরে বেঁটে খাঁটো একজন এসে দাঁড়ালো সূর্যশেখরের সামনে|
"হ্যাঁ, বাঙালি তো বটেই" সূর্যশেখর অল্প কোথায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন|
"উফফ, আমরা তো ভাবছিলাম এতো দূরে বনে বাদাড়ে যাচ্ছি, কারা সব থাকবে| আমাদের দাদা তো আবার টিকিট পাচ্ছেন নেক্সট বিধানসভা ইলেকশন এর, জানেন তো?" কান চুলকোতে চুলকোতে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলে লোকটা|
"আপনাদের দাদাকে আমি চিনি না| আর এটা তো এমন কিছু দূর নয়, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই" সূর্যশেখর ঘরের দিকে পা বাড়ালেন|
"হেঁ হেঁ, ডিনারে দেখা হচ্ছে তাহলে" লোকটা কান ছেড়ে নাকে মনোনিবেশ করল|
"ঘোরাঘুরি হলো?" সূর্যশেখর ঘরে ঢুকতে বই থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্ন করলেন সুনয়না|
"ওই বসেছিলাম মাঠটার ওখানে| ভাস্করের সাথে গল্প করছিলাম, আমার সাথে বেশ মিল আছে ছেলেটার| আচ্ছা এরা কিন্তু ছটা নাগাদ চা দিয়ে যাবে" সূর্যশেখর গায়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে নিলেন|
"দিয়ে গেছে তো" সুনয়না বই পড়তে পড়তে জবাব দিলেন|
"সে কি ছটার আগেই?"
"ধ্যাৎ সোয়া ছটা বাজছে, এই তো দিয়ে গেল "
“দেখেছো আমার মোবাইলে পৌনে ছটা দেখাচ্ছে" সূর্যশেখর মোবাইলের টাইম সেটিং চেঞ্জ করতে লাগলেন|
ডিনার টেবিলে নেতা এলেন ছেলে পুলে বৌ বাচ্চা নিয়ে| বিক্রমপুরের নাইট লাইফ পুত্র-কন্যাদের মনের মতো হয় নি| নেতা বেশি কথা বলছেন না, দু একবার "স্কচের বোতলটা কই?" বলে থেমে গেছেন| ওই বেঁটে মতো লোকটা বোধহয় নেতার শালা গোছের কেউ হবে| কখনো জামাইবাবু বলছে, কখনো দাদা| সুনয়না আজ ডিনারটা স্কিপ করেছেন| সূর্যশেখর তাড়াতাড়ি দুটো রুটি আর কয়েক টুকরো চিকেন খেয়ে উঠে পড়লেন| ভাস্করটা থাকলে তবু একটু কথা বলা যেত, কিন্তু ও বোধহয় সন্ধ্যে থেকে নিজের ঘরে রয়েছে|
ছটা বাজতে দশ নাগাদ সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়লো কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে| কটেজের পেছন দিক দিয়ে একটা চড়াই রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে| সেটা ধরে একটু ওপরে উঠলেই পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে| যতই পাহাড় দেখা হোক না কেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সোনালী আভার কোনো তুলনা হয় না কি?
"অ্যামেজিং না? যত বার দেখি মন ভরে যায়" ভাস্কর একটু দূরে দাঁড়িয়ে সানরাইজের ফটো তুলতে তুলতে বললো|
"হ্যাঁ, এ দৃশ্য ভোলা যায় না" সূর্যশেখর ক্যামেরার লেন্স চেঞ্জ করে নিলেন|
সুনয়নার হাঁটুতে যন্ত্রণা হয় বেশি ওপর নিচ করলে| তাই সানরাইজ দেখেই নিচে ফিরে গেছেন| নেতার দল বোধ হয় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে অভ্যস্ত নন, তাঁদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না আসে পাশে| গ্রামের লোকেরা যথারীতি দিনের কাজ শুরু করে দিয়েছে| যোগিতা ওদের বাড়ির বারান্দাটা পরিষ্কার করছে, পরনে স্কুল ড্রেস| সূর্যশেখরের দেখে খুব ভালো লাগলো, ছোট বয়স থেকে এইসব শিক্ষা হওয়াটা খুব জরুরি| যোগিতার মা পোষা মুরগি গুলোর খাবারের ব্যবস্থা করছেন|
ভাস্কর আর সূর্যশেখর মিলে গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন| কী সুন্দর ছিমছাম সব কিছু, ব্যস্ততা আছে কম বেশি, কিন্তু সেটাও যেন ছবির মতো| পাকদন্ডী বেয়ে ওপরে উঠে এলেন দুজনে|
"আরে বাহ্, এখানে তো বেশ ভালো একটা ভিউ পয়েন্ট বানিয়ে দিয়েছে এরা" সূর্যশেখর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন একতলা রেলিং ঘেরা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে| গ্রামের রাস্তা ধরে একদম ওপরের দিকে চলে আসলে তবে জায়গাটা চোখে পড়বে।
"আচ্ছা কটেজে যে নেতা এসেছেন একজন, তাকে দেখেছেন?" রেলিঙে পিঠটা ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল ভাস্কর|
"হ্যাঁ ওই তো কাল ডিনার টেবিলে দেখলাম"
"আচ্ছা.." ভাস্করকে একটু অন্যমনস্ক দেখালো|
"কিছু হয়েছে নাকি?"
"নাঃ সেরকম কিছু না...লোকটাকে দেখলেই ...., ছাড়ুন আমার না মাঝে মধ্যে এরকম হয়..., কি যে করি.." ভাস্করকে বেশ চিন্তিত লাগলো|
জলখাবার খেয়ে সূর্যশেখর আর সুনয়না কটেজের পাশের জঙ্গলটায় ঘুরতে গেলেন| যোগিতা স্কুলে গেছে বলে ওর ছোট ভাই দিপুর ওপর আজ ভার পড়েছে অতিথিদের দেখভাল করবার| ভাই বোন পালা করে স্কুলে যায়, না হলে কটেজের ট্যুরিস্টদের ফাই ফরমাশ খাটবে কে? গ্রামে একটা স্কুল বাড়ি আছে বটে, কিন্তু তাতে তালা বন্ধ| সর্বশিক্ষা অভিযানের বোর্ড টাঙানো আছে, যদিও অভিযান অসফল হয়ে রয়েছে| তাই ছেলে মেয়েদের সোনাডার স্কুলের পড়তে যেতে হয় হেঁটে হেঁটে|
ভাস্করও ঘুরছে সবার সাথে, কিন্তু সেই সকাল থেকেই কি যেন ভেবে চলেছে এক নাগাড়ে| দিপু ঘুরে ঘুরে সবাইকে জঙ্গল দেখাতে লাগলো| নেতার সেই শালা আর দু চারজন জোরে জোরে মোবাইলে গান বাজানো শুরু করল জঙ্গলে| বেশি দূর অব্দি যাওয়া যায় না, শেষ সীমানা একটা জলাশয় বা স্থানীয় ভাষায় পোখরি| তার পাড়ে কিছু ঠাকুরের ছবি রাখা, নিয়মিত পুজো হয় বোঝা গেল| দিপু জানালো পোখরির ওপাশে আরও গভীর জঙ্গল, সেখানে গ্রামের লোকেরা মাঝে মধ্যে যায় কোনো শেকড় বাকড়ের দরকার হলে| এই জলের ধারে মাঝে মধ্যে বিকেল বেলার দিকে লেপার্ড আসে জল খেতে, দু চার জন ট্যুরিস্ট নাকি দেখেওছে| নেতার দলবল এই কথাটা শোনার পর ফেরার সময় আর গান টান চালায়নি|
"দার্জিলিং যাবে না?" গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সূর্যশেখর প্রশ্ন করল ভাস্করকে|
"নাঃ, এই তো ছ মাস আগেই এসেছিলাম"|
"ওহ হ্যাঁ, তুমি তো আবার এদিকটায় ঘুরে টুরে বেড়াও আমারই মতো...ভালোই করেছো না গিয়ে, আর তো একটা দিন আছো, এখানে নিজের মতো আরাম করে নাও" হেসে উত্তর দিলেন সূর্যশেখর|
"সেই" ভাস্কর সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো|
"আচ্ছা তোমার ডাক নাম কি রুদ্র?" সূর্যশেখর প্রশ্ন করলেন ভাস্করকে|
"আপনি কি করে জানলেন?" ভাস্কর চলতে চলতে একটু থমকে দাঁড়ালো, "ওঃ আচ্ছা, ক্যামেরার ব্যাগের ওপর লেখা থেকে বুঝলেন...হ্যাঁ বন্ধুরা আমাকে ওই নামেই ডাকে"|
"সেই নেতাদের ফ্যামিলি তো একটা গাড়ি করে বেরোলো দেখলাম, বোধহয় দার্জিলিং ঘুরতে গেল, এখানে তো বোর হচ্ছিলো" সূর্যশেখর কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে বললেন|
"দেখলাম.."ভাস্করকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছে|
"কিছু ভাবছো?" সূর্যশেখর বুঝতে পারলেন ভাস্কর কিছু একটা চিন্তা করে চলেছে নিজের মনে|
"কিছু জিনিস মিলছে না, আবার কিছু জিনিস এতো কমন...,কিছু মুখ একটু পরিষ্কার হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে" ভাস্কর আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল|
সূর্যশেখর বুঝতে পারলেন ভাস্কর এখন একটু একা থাকতে চায়| তাছাড়া মাত্র একদিনের আলাপে বেশি গভীরে না ঢোকাই ভালো| সূর্যশেখর আস্তে আস্তে কটেজের দিকে পা বাড়াতে শুরু করলেন|
দুপুরে খাওয়ার পর সূর্যশেখর একটু সুকুমার সমগ্র নিয়ে বসলেন| সুনয়না এমনিতে ঘরে খুব একটা বিশ্রাম পান না, তাই আজ ভাতঘুম দেওয়াই প্রেফার করছেন| বেশ রোদ ঝলমলে দিন আজ, এতো পরিষ্কার আকাশ চট করে দেখা যায় না| ঝালাপালা নাটকটা অনেক বাদে আবার পড়তে বসেছেন| ভাস্করের সাথে কথা বলেই হোক বা অন্য কোনো কারণে সূর্যশেখর নিজেও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন বার বার| বই পড়তে পড়তে হঠাৎই বাইরের দিকে নজর চলে গেল| জঙ্গলের দিকটায় দুজনকে যেতে দেখলেন, চেনা চেনা মনে হলো...নেতাদের কেউ কি?
সূর্যশেখর বইটা চেয়ারে রেখে আস্তে আস্তে কটেজের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলেন| এখান থেকে জঙ্গলের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে| হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, ওই তো নেতার সেই শালা , আর তার পাশে কে হাঁটছে? সূর্যশেখর একটু সামনে এগিয়ে গেলেন| নেতাই চলেছেন শালার সাথে, শালার পিঠে একটা ছোট ব্যাগ| তার মানে এই দুজনেই দার্জিলিঙ যায় নি|
আচ্ছা, জঙ্গলের মধ্যে ওদের কি কাজ থাকতে পারে? ক্যাসুয়াল ওয়াক করতে জঙ্গলের মধ্যে বেড়ানোর পাবলিক তো এরা নয়| সূর্যশেখর বুঝে উঠতে পারলেন না কি করবেন| নেতার প্রসঙ্গ উঠলেই ভাস্করের অন্যমনস্ক মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে| আচ্ছা ফলো করলে কেমন হয়? ভাস্করকে ডাকবেন নাকি? না থাক, নিজেই যাবেন|
দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না, চুপচাপ হেঁটে চলেছে জঙ্গলের রাস্তা ধরে|
"আপনি ফিরে যেতে পারেন..আমি ফলো করছি" হঠাৎ পেছন থেকে খুব ফিসফিস করে ভাস্করের গলা শুনতে পেলেন সূর্যশেখর|
"কখন এলে তুমি?" সূর্যশেখর একটু বিস্মিত হলেন|
ভাস্কর ইশারা করে সূর্যশেখর কে চুপ করতে বললো|
"আমি আছি তোমার সাথে, অসুবিধা নেই" খুব আস্তে আস্তে কথা গুলো বললেন সূর্যশেখর|
দুজন আর কথা না বাড়িয়ে ফলো করা শুরু করল, সামনে ভাস্কর, পেছনে সূর্যশেখর|
মিনিট পনেরো পর পোখরির ধারে এসে নেতা আর তাঁর শালা হাঁটা শেষ করল| দশ বারো হাত দূরে সূর্যশেখর আর ভাস্কর দুজনই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো চট করে, সামনে থেকে কেউ আসলেও ওদের দেখতে পাবে না|
মিনিট তিনেক পর নেতা বুক পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরালেন লাইটার থেকে| ঠিক তখনই সামনের একটা ঝোপের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এলো, এর পিঠেও অনেকটা একই রকম দেখতে একটা ব্যাগ|
"মাল লায়া প্রধান?" নেতার শালা চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটাকে।
প্রধান পিঠের ব্যাগটা নিচে নামিয়ে রাখলো, "পয়সা লায়া তুম লোগ?"
দুটো ব্যাগ এর পর অদল বদল হলো|
"পিছলি বার পুলিশকো ইনফর্ম কিসনে কিয়া থা প্রধান? কলকাতাকে গোডাউনমে রেড হতে হতে বাঁচ গয়া" নেতা এতক্ষনে মুখ খুললেন|
"হামে কেয়া পাতা দাদা.. অউর ই সব রেড বেড সামভাল না তো আপকা বাঁয়ে হাতকা খেল হ্যায়" প্রধান একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো|
"হাস মত্ প্রধান, দশ সালসে কোকেনকে কারোবাড়ি হ্যায় মেরা, শালা তু মুঝে বুরবক বানায়গা?" কথা বলতে বলতে জ্বলন্ত সিগারেটটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নেতা|
"হা হা হা হা...দশ সাল সে কোকেনকে বিজনেস অউর একবার রেড কে নাম সে ইতনা ডর লগ গয়া কে খুদ চলে আয়ে ডেলিভারি করনে?" প্রধান হেসে উঠলো জোরে|
"বোকাচোদা হাস মত" নেতার শালা হঠাৎ মাথা গরম করে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে|
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে একটা টানটান নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরী হলো জঙ্গলের ভেতরে| প্রধান আর নেতা দুজনেই দুজনের দিকে পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে আছে|
"হামসে পাঙ্গা বহুত ভারী পড়েগা নেতাজি" দাঁতে দাঁত চিপে নেতা আর তাঁর শালার উদ্দেশ্যে কথা গুলো বললো প্রধান|
ভাস্কর আর সূর্যশেখর এতক্ষন প্রায় নিঃশ্বাস চেপে পুরো ঘটনাটা দূর থেকে দেখছিলো| কিন্তু সূর্যশেখর মৌনতা ভাঙলেন "ভাস্কর কি হবে?"
"এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে আমাকে" ভাস্কর খুব আস্তে কথা গুলো বললো|
হঠাৎই একটা বাচ্ছা ছেলের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল পোখরির ধার থেকে, আর সেদিকে তাকাতেই ভাস্কর আর সূর্যশেখরের গলা শুকিয়ে এলো| এতক্ষন কেউ দেখতে পায়নি, দিপু দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, পুরো ঘটনাটায় বেচারা ভয়ে প্রায় আধমরা|
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রধান প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দিপুর দিকে চলে গেল, ওর মাথায় পিস্তলটা ঠেকিয়ে নিষ্ঠূর গলায় বললো "শালা তুমলোগ মাল ওয়াপাস কারো, নেহি তো ইসকো মার্ দেঙ্গে"
"হামে কই ফারাক নেহি পারতা, মার দে উসে, গান্ডু তুঝে মারকে হাম পয়সা লে জায়েঙ্গে" নেতার শালা উত্তেজিত হয়ে উঠছে ক্রমশ|
"ফালতু বকিস না, গ্রামের কেউ মারা গেলে পুলিশ কটেজের লোকজনকেও ছাড়বে না" নেতা তাঁর শালার এই বোকামিতে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন|
"বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে ভাস্কর" সূর্যশেখর খুব ভয় পেয়ে গেছেন বোঝা গেল|
"তিন তক্ গিনুঙ্গা, মাল রাখকে চলা যা ,নেহি তো...." প্রধান পিস্তলটা জোরে চেপে ধরলো দিপুর কপালে, দিপু প্রচন্ড ভয়ে কথা বলতে পারছে না|
"তুমি এগিয়ে যাও ভাস্কর, ভয় পেয়ো না" সূর্যশেখর ভাস্করের পিঠে হাত রাখলেন|
"আমি পারবো না" ভাস্কর এর মনে ভয়ের চাপ স্পষ্ট |
"পারবে, তোমার কিছু হবে না, আমাকে দেখেও বুঝছো না?" সূর্যশেখর অল্প হাসলেন|
"এক....দো..."
ভাস্কর পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে হঠাৎ তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করল প্রধানের দিকে লক্ষ্য করে, প্রধান কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাফিয়ে পড়লো ওর ওপর| প্রধানের হাতের পিস্তলের ট্রিগারে চাপ পড়ে গুলি বেরিয়ে এলো সামনের দিকে, পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নেতার শালার পায়ে এসে লাগলো গুলিটা| এরপরে যা যা হলো শুধুমাত্র সিনেমাতেই দেখা যায়| নেতা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে গুলি চালিয়ে দিলেন সামনে, অল্পের জন্য ভাস্করকে না ছুঁয়ে গুলি লাগলো প্রধান এর বুকে|ভাস্কর ততক্ষনে দিপুকে নিয়ে উল্টো দিকে দৌড়ানো শুরু করে দিয়েছে| নেতা দৌড় লাগালো ভাস্করের পেছনে, যেভাবেই হোক ভাস্করকে আটকাতে হবে|
বেশি দূর যেতে হলো না, ভাস্কর হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ পেয়ে পেছন দিকে তাকালো| নেতা মাটিতে পড়ে আছেন, সূর্যশেখর হাতে বেশ বড় সড় একটা পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন| ভাস্কর বুঝলো আঘাতটা সূর্যশেখর করেছেন|
সন্ধ্যে বেলার দিকে জ্ঞান এলো ভাস্করের| ও নাকি জঙ্গলের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলো| দিপু ভয় পেয়েও পুরোটা রাস্তা ছুটে এসে গ্রামের লোকেদের সব কিছু জানায়, তারাই পরে গিয়ে ভাস্করকে উদ্ধার করে| পুলিশ এসে বাকি তিনজনকেই গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে| যদিও নেতা এখন কোমাতে, আর প্রধান এর অবস্থা আশঙ্কাজনক| ভাস্কর উঠে বসতে গ্রামের লোকেরা তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল, ও না থাকলে দিপুকে হয়তো আজ হারাতে হতো| ভাস্কর শুধু দিপুকে বাঁচায় নি, গোটা বিক্রমপুরকেই বদনামের হাত থেকে বাঁচিয়েছে|
সেদিন রাতটা ঘোরের মধ্যেই কাটলো, পরদিন সকালে ভাস্কর কটেজের ব্যালকনিতে চা খেতে খেতে পুরো ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করল| আচ্ছা সবাইকেই দেখা গেল, কিন্তু সূর্যশেখর কোথায় গেলেন? ওনাদের কিছু হয়নি তো? ভাস্কর প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে কটেজের চারিদিকে ওদের খুঁজতে লাগলো, আশ্চর্য, কোথায় গেলেন স্বামী স্ত্রী?
"যোগিতা, হামারে কটেজ মে অউর দো গেস্ট থা ও লোগ কাঁহা গয়া?" হাঁপাতে হাঁপাতে যোগিতার বাড়ির সামনে এসে কথা গুলো বললো ভাস্কর|
"অউর দো গেস্ট? নেহি তো, অউর তো কই থা নেহি উধার" যোগিতা বারান্দা ঝাঁট দিতে দিতে কথাগুলো বললো|
"এক বুড্ঢা থা না, উনকে ওয়াইফ ভি থি, আরে মেরে সাথ আয়া স্টেশন সে গাড়ি মে, বিনোদ ভাইয়া কো পুছো না" ভাস্কর চেঁচিয়ে উঠলো|
"নেহি স্যার, গাড়ি মে তো আপ আকেলে আয়ে" ভাস্করের চিৎকার শুনে বিনোদ বাইরে বেরিয়ে এসে বললো|
ভাস্কর অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো বিনোদের দিকে|
"আপ ঠিক তো হো না? উসদিন গাড়ি মে ভি আপ মন হি মন মে বাত কার রাহে থে " বিনোদ উদ্বিগ্ন হয়ে বললো |
দার্জিলিঙ মেলটা ঠিক রাত নটার সময়ে ছাড়লো| ভাস্কর এখন অনেকটাই সুস্থ| সূর্যশেখর বা সুনয়না কাউকেই ও আর দেখতে পায়নি, তবে তার জন্য ওর টেনশন নেই| আসলে চেনা মুখগুলো আবছা ছিল, এখন সব পরিষ্কার| আর পরিষ্কার বলেই ভাস্কর বুঝতে পেরেছে সূর্যশেখর এবং সুনয়না এরা দুজনেই ওর সামনে ফিরবে না| এটা সমস্যা নাকি ক্ষমতা, ভাস্কর বুঝতে উঠতে পারে না মাঝে মাঝে| কিন্তু পুরো ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমাদেরকে একটু পিছিয়ে আসতে হবে|
মানুষের মন বড় আশ্চর্য একটা জিনিস| কল্পনার ওপর ভিত্তি করে যেমন সৃষ্টি হয় নতুন আবিষ্কার ঠিক তেমনি অতি কল্পনাপ্রবন মন সাধারণ জীবনকে কখনো কখনো অতিষ্ঠ করে তোলে| ভাস্করের মনে হ্যালুসিনেশনের সূত্রপাত কয়েক মাস হলো শুরু হয়েছে| কর্পোরেট চাকরিতে হাঁপিয়ে ওঠা ভাস্কর বাধ্য হয় চাকরি ছাড়তে| এদিকে পি-এইচ-ডিতেও কয়েক মাস হলো গাইডের সাথে ছোটোখাটো ব্যাপারে ওর ঝামেলা বেড়েই চলেছে| বান্ধবী তিস্তার সাথে সম্পর্কটা এসবের মাঝে একটু ঢিলে হয়ে গেছে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর হঠাৎ মনে হল বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ওর মতোই দেখতে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে| আবার কখনো কখনো অচেনা অজানা কাউকে দেখে ওর মধ্যে একটা তীব্র অনুভূতি জন্ম নেয় যে লোকটার সাথে ভবিষ্যতে এমন কিছু একটা ঘটবে যার সাথে ও নিজেও জড়িত থাকবে| মাস তিনেক আগে এক নিউরোলোজিস্টকে দেখালে ভাস্কর জানতে পারে নিজেকে নিজের চোখের সামনে দেখবার এই আশ্চর্য সমস্যায় ও একা ভুগছে না| জীবনের নানা ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত অবসাদ, অথবা দুঃখ থেকে মানুষের মন এমন কিছু কল্পনা করে যার সাধারণ কোনো ব্যাখ্যা মেলে না| বিখ্যাত ব্রিটিশ নিউরোলজিস্ট অলিভার স্যাক্স তাঁর বইতে লিখেও গেছেন এরকম অনেক মানুষের কথা, তাঁর ভাষায় এর পোশাকি নাম "অটোস্কোপিক ডাবলস"|
সূর্যশেখর কোনো আলাদা মানুষ নন, ভাস্করের কল্পিত চরিত্র| বলা ভালো, ভাস্করের ভবিষ্যৎ| ভাস্কর যেমন সূর্যের এক নাম, ঠিক তেমনি শেখর আর রুদ্র দুই নামেরই অর্থ শিব| ভাস্কর সূর্যশেখর আর সুনয়নাকে কল্পনা করে গেছে কদিন ধরে| কলকাতার একঘেয়েমি থেকে বাঁচতে মাঝে মাঝেই পাহাড় ঘুরতে আসে ভাস্কর| যদিও এই সময়টা কাউন্সিলিংএ থাকার জন্য ডাক্তার বারণ করেছিল একা একা কোথাও ঘুরতে যেতে| ভাস্করের বাবা মা কেউ এই সমস্যাটার কথা জানেন না, কারণ তাঁরা থাকেন বর্ধমানের গ্রামের বাড়িতে| ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও একরকম জোর করে ভাস্কর এবারে ঘুরতে আসে| কিন্তু শেষ মুহূর্তে নার্ভ শান্ত রাখার জন্য প্রেসক্রাইবড করা ওষুধটা ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে যায় অন্যমনস্কতায়| আর তাই এন.জি.পি স্টেশনে নেমেই নিজেকে সূর্যশেখর আর বান্ধবী তিস্তাকে নিয়ে শুরু হয় ওর এই হ্যালুসিনেশন|
কল্পনার ওপর ভিত্তি করেই ভাস্করের মনে হয় সূর্যশেখর আর সুনয়না জীবন্ত, বাস্তব| ড্রাইভার বিনোদ ওকে রাস্তায় জানায় ওখান থেকে তিস্তা দেখা যায় না, কিন্তু বালাসুন নদী দেখা যায়| তিস্তার বদলে তাই সূর্যশেখরের স্ত্রী এর নাম হয়ে ওঠে সুনয়না| এদিকে নেতাকে দেখেই ওর মনে হয় একটা কিছু ঘটবেই লোকটার সাথে| সেই কল্পনার ওপর ভিত্তি করে ভাস্কর ওদের পিছু নেয় জঙ্গলের মধ্যে, কখনো সূর্যশেখর হিসেবে, কখনো বা ভাস্কর হিসেবে|
ট্রেন আস্তে আস্তে স্পিড নিতে শুরু করে, ভাস্কর জানলার কাছে আবছা ঘর বাড়ির দৃশ্য দেখতে থাকে এক মনে| কিছু হিসেবে মেলে, কিছু হিসেবে মেলে না| গ্রামের লোকজন ভাস্করকে জানায় নেতা নাকি হোঁচট খেয়ে পাথরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়| যদিও ভাস্করের এখনো মনে হয় সূর্যশেখর যেন নিজেই নেতার মাথার পেছনে পাথর দিয়ে আঘাত করেন| সে যাই হোক, ভাস্কর না মেলা হিসেবে জোর করে মনে রাখতে চায় না| মানুষের হাজার হাজার কল্পনা, আর তার ভিত্তিতেই তো বেঁচে থাকা| কল্পনার শেষ মানে তো জীবনের শেষ| সূর্যশেখরের শেষ কথা গুলো ভাস্করের চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বপ্নের মতো - "তোমার কিছু হবে না, আমাকে দেখেও বুঝছো না?"
0 comments: