0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৫

এবার আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করি নয় জন কবিকে যাঁরা বিষয়বৈচিত্রে ও মেজাজে বিভিন্ন মেরুর অধিবাসী। একজন নোবেলজয়ী, আরেকজনের এখনো সম্ভাবনা রয়েছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের।

মায়া অ্যাঞ্জেলু কালো আমেরিকার এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব -- শিল্প ও সাহিত্যের নানান প্রান্তে তাঁর আনাগোনা। কালো মানুষের সমানাধিকার তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তিনি শিল্পিত করে তুলতে পারেন প্রতিবাদের প্রকাশকে।

ডোনাল্ড হল সিরিয়াস কবিতা লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু সমসাময়িক বাঙালি কবি তারাপদ রায়ের মতন তাঁর রচনাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কৌতুক আর হাস্যরসের উপাদান।

জয়েস মনসুর ফরাসি সাহিত্যের এক দিকচিহ্ন, কিন্তু ইংরেজী ভাষার কবিতার পাঠক তাঁর সঙ্গে পরিচিত নন। তাঁর এক ডজনের বেশি কাব্যগ্রন্থের একটিও অনূদিত হয়নি ইংরেজিতে। তাঁর কবিতা পড়তে হলে ফরাসি কবিতার কয়েকটি ইংরেজি সংকলনই আমাদের ভরসা। পরাবাস্তববাদী কবিতা আন্দোলনের তিনি এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

এড্রিয়েন রিচ বাস করতেন আমাদের শহর থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে। তাঁর কবিতা পাঠ শুনতে গিয়েছি কয়েকবার, তবে মুখোমুখি পরিচয় হয়নি। ফোনে কথা বলে অনুমতি নিয়েছিলাম কবিতা অনুবাদের।

ইউরোপের কবিতার নিবিষ্ট পাঠকপাঠিকার কাছেও ওলন্দাজ ভাষার কবিতা অপরিচিত। হিউগো ক্লাউস সেই ভাষার এক মহীরুহ সাহিত্যিক। হাজার হাজার পৃষ্ঠার কবিতা, ষাটটি নাটক, কুড়িটি উপন্যাস, চিত্রনাট্য, অপেরা: কী আর লেখেন নি তিনি? আর রোমান-ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে দ্বন্দ্বে মেতেছেন নিয়মিত। খুব সম্ভবতঃ বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব।

আদনিস মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের এক প্রধান স্তম্ভ। তিনি আরবি ভাষাকে নতুন রূপ দিয়েছেন এবং তার কবিতাকে টেনে হিঁচড়ে এনে হাজির করেছেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতায়। নব্বই বছর বয়েসে এখনো তিনি সক্রিয়, প্রতিবাদী।

ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা দীর্ঘ, জটিল, দুরূহ এবং আদায় করে নেয় পাঠকের সমীহ ও অনুধাবন। তাঁর প্রেমের কবিতা কিন্তু সরাসরি আঘাত করতে সমর্থ হয় হৃদয়ে, সেখানে তীব্র অনুভূতির প্রকাশ।

টেড হিউজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজি ভাষার এক প্রধান কবি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর আচরণ নিয়ে অভিযোগ তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে, অসমাপ্ত রাখতে হয়েছে কবিতার কাজ।

চিনুয়া আচেবে আফ্রিকার কালজয়ী কথাকার -- সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর। তাঁর শীর্ণকায় “কবিতা সমগ্র” এর মধ্যেও রয়েছে কিছু শক্তিশালী কবিতা।

সাহিত্যে ও জীবনযাপনে, জীবনদর্শনে ও রাজনৈতিক ভাবনায় যতই তফাৎ থাক, এই কবিদের ভেতর একটাই মিল -- তাঁরা প্রেমের কবিতা লিখেছেন।

আসুন, আজকের পৃথিবীজোড়া হিংসা, জাতিভেদ, বর্ণভেদ আর হাড়হিমকরা ফ্যাসিবাদের দিনগুলিতে বাস করেও নতুন বছরকে স্বাগত জানাই কয়েকটি অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা পড়ে: 

মায়া অ্যাঞ্জেলু: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৮-২০১৪)

অনেকে এবং আরো 


অনেকে এবং আরো যারা আছে
চুম্বন করবে আমার আঙুলের প্রান্ত,
চেখে দেখবে আমার ঠোঁট,
আর আমার একাকিত্ব ঘোচাতে 
মেলে ধরবে তাদের উষ্ণ শরীর।

কিন্তু আমার চাই পরম বান্ধব। 

আরো, খুব কম দুয়েকজন রয়েছে,
যারা আমায় নিজের বংশমর্যাদা দেবে,
দেবে তাদের অর্থসম্পদ,
আমি অসুস্থ হলে শয্যাপ্রান্তে 
পাঠাবে তাদের প্রথম সন্তানকে।

কিন্তু আমার প্রয়োজন পরম বান্ধব।

পৃথিবীতে একজন, কেবল একজনই আছে 
যে তার নিভে আসা ফুসফুস থেকে 
বিনা দ্বিধায় অক্সিজেন ধার দেবে 
আমার ছিন্নভিন্ন বুকের জ্বালা মেটাতে।

এবং সে হল আমার প্রেম।

[কবির প্রকৃত নাম মার্গারিট অ্যান জনসন। কবি, নাট্যকার, মঞ্চশিল্পী, অভিনেত্রী, গায়িকা, চিত্রপরিচালক। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পৃথিবীখ্যাত কবিতার বই “আমি জানি খাঁচার পাখি কেন গান গায়?”। ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারী তিনি রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন স্বরচিত কবিতা “সকালের স্পন্দন”। আত্মজীবনী লিখেছেন সাত খণ্ডে। সংকলিত কবিতাটি ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “আমি নড়বো না” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

ডোনাল্ড হল: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৮-২০১৮)

ভ্যালেনটাইন 

কাঠবেড়ালি লাফায় ডালে,
পিছলে চলে সাপ।
তোমায় ছেড়ে যাবার কথা 
মনে ভাবাও পাপ।

ঝগড়া করে নীলপাখিরা,
ভালুক দেখায় পেশি।
তোমার সঙ্গে চিরজীবন 
অথবা তার বেশি।

লাফিয়ে চলে ব্যাঙ-ব্যাঙাচি 
শূকর গুরুভোজন।
কান দিই না কারুর কথায় 
দুজন মিলে কূজন।

[মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাহিত্য সমালোচক, শিশু-সাহিত্যিক। “দি প্যারিস রিভিউ” পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করেছেন প্রায় এক দশক। প্রকাশিত গ্রন্হের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি, তার মধ্যে বাইশটি কবিতার বই। সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার নানান নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে; কবিতাটি “দি নিউ ইয়র্কার” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।] 

জয়েস মনসুর: (মিশর ও ফ্রান্স, ১৯২৮-১৯৮৬)

উপগত 

তোমার সঙ্গে শুতে চাই পাশাপাশি
চুলোচুলি করবে আমাদের কেশগুচ্ছ 
আমাদের যৌনাঙ্গ সংঘবদ্ধ 
তোমার ঠোঁট আমার বালিশ।

তোমার পিঠে পিঠ রেখে শুতে চাই 
কোনো নি:শ্বাসও বিচ্ছিন্ন করবে না আমাদের 
ভালোবাসায় বাগড়া দেবে না কোনো কথা 
মিথ্যে বলবে না চোখের দৃষ্টি 
গায়ে থাকবে না একটি সুতো।

তোমার বুকে স্তন রেখে শুতে চাই 
উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত 
হাজার কাঁপুনিতেও ঝকমকে 
পুলকিত পাগলামির আবেশে নি:শেষ 

তোমার ছায়াতে আমি ছড়ানো 
তোমার জিভের আঘাতে আমি ব্যাকুল 
খরগোশের পোকাধরা দাঁতের কামড়ে 
মরলেও আমি সুখী।

[কবির জন্ম ইংল্যান্ডে, মা-বাবা মিশর থেকে আসা অভিবাসী ইহুদি; লিখতেন ফরাসি ভাষায়। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরাবাস্তববাদী শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলনে। ষোলোটি কাব্যগ্রন্থ, তার সঙ্গে প্রবন্ধ ও নাটক। প্যারিস শহরে তাঁর এপার্টমেন্ট হয়ে উঠেছিল পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। মাত্র আটান্ন বছর বয়েসে কর্কটরোগে মৃত্যু। কবিতাটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত “কান্না” কাব্যগ্রন্থ থেকে। ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ মেরি অ্যান ক’স।] 

এড্রিয়েন রিচ: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯২৯-২০১২)

তোমার স্তনের ওপর উড়ন্ত আমার মুখ 

তোমার স্তনের ওপর উড়ন্ত আমার মুখ 
শীতের ছোট্ট ধূসর বিকেল 
এই শয্যায় আমাদের একহারা তনু 
স্পর্শে বিহ্বল উত্তেজনার আনন্দময় তাপে হতবাক 
দৃঢ় অথচ কোমল একে অপরকে ঘিরে 
বাহুবন্ধনে খেলি আমরা দিবসের মোমবাতি 
অদ্ভুত আলো জ্বেলে যদি বাইরে ধরায় 
তুষার পড়তে শুরু করে গাছের ডালপালা সরিয়ে
দিন ফুরিয়ে রাত আসে জানান না দিয়ে 
চলবে আমাদের শীতের প্রমোদ 
হঠাৎ উদ্দাম ও কোমল তোমার অঙ্গুলি 
যেখানে থাকা উচিত আমার জিভের যা করা উচিত 
এক মুহূর্ত থেমে তোমার রসিকতায় হাসি 
হে প্রেম তোমার উষ্ণ সুগন্ধ শীতের কামনায় 

[নারীবাদী কবি ও সাহিত্যিক। শিকাগোর “পোয়েট্রি” পত্রিকা এক লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের “রুথ লিলি কবিতা পুরস্কার“ প্রদান শুরু করে ১৯৮৬ সালে; প্রথমবার পুরস্কারটি পান তিনি। ১৯৫৩ সালে তার বিবাহ এবং তারপর তিনটি পুত্রসন্তান। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় নারীবাদী ভাবনার গ্রন্থ “বৌমার তোলা ছবিগুলি”। পরবর্তী জীবনে নিজেকে লেসবিয়ান বলে ঘোষণা করেন; কথাসাহিত্যক মিশেল ক্লিফের সঙ্গে তাঁর ছত্রিশ বছরের দাম্পত্যজীবন ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুস শহরে। কবিতাটি ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “এজমালি ভাষার স্বপ্ন” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

হিউগো ক্লাউস: (বেলজিয়াম, ১৯২৯-২০০৮)

গ্রীষ্ম 

হঠাৎ অই তিন মাস ধরে 
খরা খরা খরা।

সাইপ্রেস ঝোপ রোদে পুড়ে লালচে, 
শাদা বিষহীন কাঁকড়াবিছে।

চারিদিকে কাগজ পোড়ে।
বকবক করে যায় প্রকৃতি 
আমি পচি।

তারপর, তোমার সঙ্গে দেখা 
এবং তখন থেকেই 
হাত ও চোখের মনোযোগ এলোমেলো 
আর কথা বলতে চায় না আমার জিভ।


ভালোবাসো অথবা ছেড়ে যাও 


যার বীজমন্ত্র: “ভালোবাসো অথবা ছেড়ে যাও”,

যার যোনি উপচে পড়ে 
সেমুই, দুধের দাঁত আর পাকা টসটসে ফলে,
যার এক পা পৃথিবীতে আলতো করে রাখা,
ঠুনকো, অস্বচ্ছ পাগলামির কামনায়,
যার মানসিকতায় পশ্চিমের ফেলে দেওয়া জঞ্জাল,
যার এক পা কম্পমান, ওঃ, ওঃ, 
আমার কপালে টোকা দেয় ছেনালের মতন, আর 
মাটির আশ্রয় খোঁজে,
সব সমেত ধসে ভেঙে ছিটকে পড়ে,
তার সেই নাগর ফোন করতে ভুলে যায় তাকে;

(বুঝতে পারি যখন প্রতিশোধকামী সঙ্গম শেষে 
মৃতের মতন নেতিয়ে পড়ে সে) 

(তার অপরূপ বুটিওয়ালা তিলবসানো মিশরী শরীর)

চুনের জলে ডেলা ও পোকার মতন 
ঘোরে তার বাসনা 
স্বাধীন জীবনযাপনের আকাঙ্খায়,
সঙ্গে থাকে বিষাদ,

ভাবতে পারো 
আমার অভিলাষের সব নারীর ভেতর 
তাকেও মনে রাখি সবচেয়ে বেশি,
যে ছেড়ে গেছে আমায়।

[বেলজিয়ামের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক, সেই সঙ্গে চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ওলন্দাজ এবং ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লিখতেন। তাঁর নাটকগুলি মঞ্চসফল ও নন্দিত; তাঁর একটি নাটক অশ্লীলতার দায়ে জড়িয়ে পড়লে তাঁর চার মাসের কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। পরে তা মকুব করা হয় গণপ্রতিবাদে। আলৎসাইমারে আক্রান্ত কবির স্বেচ্ছামৃত্যু গভীর ধর্মীয় ও নীতিগত বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল ইয়োরোপে। কবিতাগুলি ২০০৪ সালে প্রকাশিত “অভিবাদন” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। তাদের ওলন্দাজ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জন আয়রনস (১৯৪২- )।] 

আদনিস: (সিরিয়া ও ফ্রান্স, ১৯৩০- )

সূত্রপাত কবিতাগুচ্ছ 

।।১।। 

কেস

কেস বলতেন 
লায়লাকে দিয়ে আমি পোশাক বানিয়েছি আমার 
আর ঢেকেছি মানবতার শরীর।

আমি তাকে আগুনের পেছনে 
মুখ লুকোতে দেখি 
অরণ্যের নৈশ সখ্যে তিনি বিরাজমান 
অথচ ছেনালির শেষ নেই।

আমি তাকে 
অনিদ্রার সৈকত থেকে 
মুঠো মুঠো চাঁদ 
তুলে আনতে দেখেছি। 

টীকা: কেস: মধ্যপ্রাচ্যের পুরাণের প্রাচীন চরিত্র, লায়লার প্রেমিক। আমরা তাঁকে অন্য নামে জানি: মজনুন অথবা মজনু।

।।২।।

শূন্যতার সূত্রপাত

পৃথিবীর শরীর আগুন এবং 
জলকে ডাকে; দিন গোনে ভবিতব্যের।

এজন্যেই কি বাতাস পরিণত হয় তালবনে 
আর শূন্যতা হয়ে দাঁড়ায় নারী? 

।।৩।।

সাক্ষাতের সূত্রপাত

নারী ও পুরুষ: তাদের অভ্যন্তরে 
কাশবনের দেখা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে 
বৃষ্টির সঙ্গে ধুলোর 
ধসে যায় ঢিপি আর 
আগুন জ্বলে শ্বাসরুদ্ধ ভাষায়।


আমি শুধাই: আমাদের কোনজন কালবোশেখির 
মেঘ আর কোনজন দু:খের হালখাতা?
তোমার চোখে প্রাচীন বন্যতা 
তোমার মুখ কোনো প্রশ্ন শোনে না।


রাতের শেষ প্রহর আমি। আমি প্রেমে পড়ি যাতে 
রাত এসে পড়তে পারে দিনের শেষে 
আর বলতে পারি 
নারী ও পুরুষের 
দেখা 
নারী ও পুরুষের সঙ্গে। 


।।৪।।

নামের সূত্রপাত

আমার দিনগুলি তার নাম 
স্বপ্নেরা, যখন আমার বিরহের কথা শোনে 
ঘুম নেই আকাশের, তার নাম 
দুশ্চিন্তাও তার নাম 
আর বিবাহ, যেখানে আলিঙ্গন করে জল্লাদ 
ও কোরবানি, তার নাম।

গান গেয়েছিলাম একদিন, প্রতিটি 
ক্লান্ত গোলাপ, তার নাম 
পথযাত্রার শেষেও, তার নাম 
পথ কি শেষ হলো, বদলালো তার নাম?


।।৫।।

পথের সূত্রপাত

রাত হলো সাদা কাগজ -- আমরা 
কালি:

“কী আঁকলে তুমি মুখচ্ছবি, পুরুষ অথবা পাথর?”
“কী আঁকলে তুমি মুখচ্ছবি, নারী অথবা পাথর?”

উত্তর দিই না প্রেম করি 

আমাদের নীরবতার পথ নেই কোনো 
আমাদের প্রেমেরও নেই।


।।৬।।

যাত্রার সূত্রপাত

সাক্ষাৎকার শুরু হয়, সেই ফাঁকে অস্ত যায় সূর্য 
সাক্ষাৎকার শেষ হয়, রেখে যায় খোলা ক্ষত 
আমি এই গাছের কোনো শাখাপ্রশাখাকে আর 
চিনতে পারি না, বাতাসও ভুলে গিয়েছে 
আমার পরিচয় এই কি আমার ভবিষ্যৎ?
প্রেমিক প্রশ্ন করে আগুনকে।
নারীর মুখে জাগে প্রবাসযাত্রার অধীরতা 
পুরুষ পাল তুলে দেয় তাতে।

।।৭।। 

প্রেমের সূত্রপাত 

প্রেমিকেরা পাঠ করে ক্ষত আমরা রক্ত দিয়ে ক্ষত লিখি 
অন্য এক যুগে আমরা রাঙিয়েছি 
আমাদের প্রহর:
আমার মুখচ্ছবিতে সন্ধে,
তোমার চোখের পাতায় ভোর।

আমাদের পদক্ষেপে রক্ত ও কামনা।
প্রতিবার তারা মাথা তোলে, ডাল থেকে ছেঁড়ে আমাদের,
ছোঁড়ে তাদের প্রেম, ছোঁড়ে আমাদের,
হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয় গোলাপ।


।।৮।। 

যৌনতার সূত্রপাত -- ১

ঘর বারান্দা অন্ধকার 
হাত বুলোয় ক্ষতে 
ভাঙে শরীর 
ঘুম 

ভবঘুরেমি আর সব হারানোর মাঝামাঝি 

প্রশ্ন আর উত্তরের ফাঁক দিয়ে রক্তস্রোত 
বাকশক্তির গোলকধাঁধায়।


।।৯।।

যৌনতার সূত্রপাত -- ২

দেয়াল বেঁকে যায় বাহুতে, যৌনতা তোলে উঁচু গম্বুজ --
ছুঁড়ে দেয় 
দু:খের স্রোতে 
দু:খ 
তার কোমরের রশিতে বাঁধা -- দরজা খোলে যোনি --
ভেতরে যাই আমরা।

বাড়ছে আগুনের তেজ আর লণ্ঠনের পাশে রাত জড়োসড়ো 
আমরা গড়ে তুলি 
স্তূপ, ভরে দিই পরিখা 
আর মহাশূন্যে ফিসফিস করে বলি 
হাত বাড়াও। 

তিক্ততার আলো নদীর মতন বয়ে যায় 
দুকূল ছাপায়, আমরা জলকে 
আপন করে নিই, পোশাক বানাই 
নিজের দুকূলকে 
নদীর দুকূলের ইচ্ছে অনিচ্ছে মত …...


।।১০।।

শব্দের সূত্রপাত 
আমাদের দুথাক শরীর বজ্রবিদ্যুৎ 
তুমি বলো, আমি শুনি 
আমি বলি, তুমি শোনো, শব্দের টুংটাং 

আমাদের দুথাক শরীর নৈবেদ্য 
তোমার পতন, আমার পতন 
দিবাস্বপ্নের লেলিহান আগুন চারদিকে 
আমার পতন, তোমার পতন।

তোমার আমার মাঝে 
শব্দ জমে জমে 
আগুন জ্বলে।

।।১১।।

হাওয়ার সূত্রপাত

“রাতের শরীরে,” নারীটি বলে যায়, “ফিরে আসে 
রক্তাক্ত ক্ষত ও তাদের দিনগুলি…….”

ভোরবেলা শুরু করি আমরা, ছায়ার মধ্যে প্রবেশ 
গায়ে গায়ে জড়ানো আমাদের স্বপ্নেরা 
আর বোতাম খোলে সূর্য: “ফেনার ছদ্মবেশে সাগর 
এসে পড়বেই ঠিক।” আমরা 
পুঁথিপত্র পাঠ করে যাই দূরত্ব রেখে।

উঠে পড়ি আর হাওয়া মুছে দেয় পায়ের ছাপ 
ফিসফিস 
আমাদের গোপন সভা শুরু হবে 
আর চলে যাবো ……….


।।১২।।

জাদুর সূত্রপাত 

কীভাবে দেখা হলো আমাদের তাই নিয়ে বিস্ময়
ফিরে আসার পথটি খুবজতে হবে গোলকধাঁধায় 
আর বলবো: সৈকত জনশূন্য 
আর জাহাজডুবির খবর আনে 
হালগুলি।

আমরা কুর্নিশ করে বলতে পারি 
পথের শেষ।


।।১৩।।

পাগলামির সূত্রপাত 

যখন তোমার বাতাস বয় তার সীমাহীন অরণ্যকে ছুঁয়ে 
পুরুষটি বলে: মৃত্যুকে প্রজাপতির মতন দেখতে
আর যৌনতার মুখ পাগলামিতে ভরা।

এই তো সে দাঁড়িয়ে, পরনে কোরবানির পোশাক
তার ভবিষ্যৎ 
তার অতীত 
তার দিগন্ত
একটি কুঠার আর ধূলিকণার মতন শব্দেরা 
তার চোখের সামনে। 

[এই সংকলনের প্রথম কবি যিনি এখনো আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে আছেন, ধর্মীয় মৌলবাদের তীব্র বিরোধিতায় এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কঠোর সমালোচনায়;। মধ্যপ্রাচ্যের এই মহান কবি পা দিতে চলেছেন জীবনের দশম দশকে। তিনি বাস করেন ফ্রান্সে, ফরাসি এবং আরবি, দুই ভাষাতেই লেখেন। আরবি ভাষার কবিতায় আধুনিকতার জোয়ার এনেছিলেন তিনি। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন আরবি ভাষার প্রথম আধুনিক কবিতার “মাজাল্লাত শিইর“ কাগজ; আরবি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন খালেদ মাতোয়া।] 

ডেরেক ওয়ালকট: (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩০-২০১৭)


মুঠি 

আমার হৃদয় ঘিরে শক্ত দৃঢ় মুঠি 
ঈষৎ আলগা হলে আমি 
উজ্জ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলি; আবার 
বন্ধ হয় মুঠি। প্রেমের যন্ত্রণার সঙ্গে প্রেম 
সে কি আমার চিরদিনের নয়? কিন্তু একে 

প্রেম বলবো না কি বাতিক? এর মধ্যে আছে 
উন্মাদের দৃঢ় জাপ্টে ধরা, একে বলবো 
চিলচিৎকার করে রসাতলে পতনের আগে,
যুক্তিহীনতার শৈলশিরাকে আঁকড়ে থাকা।

শক্ত করে ধরো হৃদয়! তাহ’লে অন্তত বাঁচবে তুমি।

[মাত্র দেড় লক্ষের একটু বেশি মানুষ বাস করেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট লুসিয়া দেশটিতে -- কিন্তু তার মধ্যেই জন্মেছেন দুজন নোবেলজয়ী কবি -- দ্বিতীয়জন ডেরেক ওয়ালকট। মাতৃভাষা ফরাসি, কিন্তু সাহিত্যরচনা ইংরেজিতে। হোমারের “ইলিয়াড” মহাকাব্যকে তিনি নতুন করে লিখেছেন ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “ওমেরোস“ কাব্যগ্রন্থে। আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিন দশক। সংকলিত কবিতাটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত “সমুদ্র-দ্রাক্ষা” (“Sea-Grapes”) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।] 


টেড হিউজ: (ইংল্যান্ড, ১৯৩০-১৯৯৮)

ছুটে বেড়ায় পুরুষের পা 

যতক্ষণ না তারা জড়িয়ে মড়িয়ে শেষ পর্যন্ত হোঁচট খায় ধপাস
আর নারীর পাদুটো আঁকড়ে ধরে তাদের বাকি জীবনটুকুর জন্যে

পুরুষের বাহু ভারী জিনিস তোলে, অন্ধকারে হাতড়ায়, তারপর
আশ্লেষে ধরে নারীর বাহু
আর শুয়ে পড়ে দ্বৈতসত্তায় অবশেষে অবশেষে

পুরুষের মুখ তার বাক্যজাল চালায় ঢুকতে বেরোতে
আর নারীর মুখ খুঁজে পেয়েই আস্তানা গাড়ে তার ভেতরে

পুরুষের বুক ধাক্কা মেরেই চলে অবিরাম
নারীর স্তনাগ্রে এসে হবে তার বিশ্রাম

এক নাভি অন্য নাভি গায়ে গায়ে এফোঁড় ওফোঁড়
দুই দর্পণের মত সপাট মুখোমুখি

আর এইভাবে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
গাভীর দিকে এগিয়ে যাওয়া ষাঁড়ের মতন, থাকবে না স্থির
যে বাছুর খুঁজছে তার হারানো মাকে 
মরুভূমিতে থমকে দাঁড়ানো পথিক, তার মায়াময় ভ্রমার্তিতে 
খুঁজছে মরুদ্যানের জলাশয় 

তারপর সে পেয়ে যায় তার সাধের বস্তুটি, থামে আর চোখ বোজে 

সত্য আর গরিমা নেমে আসে ধরে আকাশ থেকে 

নতুন খোঁড়া কবরের পাশে, শোকাহতেরা দাঁড়িয়ে নেই আর 
আর তারা জ্বলে আকাশে 
আর পৃথিবী, কাঁচা ও নতুন, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন 
আবার শুরু করে সন্ধান 

অপার বিস্ময়ের পথে তীব্র বেগে।

[ব্রিটেনের কবি, অনুবাদক, শিশু-সাহিত্যিক -- অকালমৃত মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথের স্বামী ( ১৯৫৬-১৯৬২)। তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের কয়েক মাস পরেই আত্মহত্যা করেন সিলভিয়া। ১৯৮৪ সাল থেকে আমৃত্যু ব্রিটেনের জাতীয় কবি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ কবিতার এক প্রধান ব্যক্তিত্ব; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন বিতর্কে আকীর্ণ। শোনা যায় তিনি সিলভিয়াকে নিগ্রহ করতেন নিয়মিত। তাঁর আরেক ঘনিষ্ঠ নারী আসিয়া ওয়েভিল সকন্যা আত্মহত্যা করেন ১৯৬৯ সালে; তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছিল গ্যাসের আভেন থেকে। কবিতাটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত “গুহার পাখি” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

চিনুয়া আচেবে: (নাইজিরিয়া, ১৯৩০-২০১৩)

প্রেমসঙ্গীত (অ্যানার জন্যে)

আমার নি:শব্দ প্রহরে তুমি 
অপেক্ষায় থাকো প্রেমিকা আমার
বাতাসে ভাসে ঘোর অমঙ্গল 
আর পাখিরাও 
দ্বিপ্রহরের শাস্তির ভয়ে 
তাদের গানের কলি 
লুকিয়ে রাখে 
কচুপাতায় মুড়ে …… কী গাব 
কী গান তোমায় শোনাবো আমি 
হে দুর্লভ প্রেম যখন উবু হয়ে বসা 
একদল ব্যাঙের গ্যাঙর গ্যাঙ উল্টে দেয় 
দিনের নাড়িভুঁড়ি -- সঙ্গে থকথকে বিলের 
গুণগান করে গলা ফুলিয়ে আর 
ঘরের ছাদে পাহারা দেয় 
পাটল-মাথা শকুন।

আমি গান গাই নীরব অপেক্ষায় 
তোমার শান্ত চোখের তারায় 
বয়ে বেড়াও আমার সব স্বপ্ন 
আমাদের ফোসকা-পড়া পায়ের ধুলো 
মুছে নিয়ে পরাও সোনালি ঘুঙুর 
ভালো দিন এলে আবার আমরা 
নাচবো নির্বাসিতের নাচ।

[আফ্রিকার আলোকিত হৃদয় চিনুয়া আচেবে -- কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক এবং কবিও। ইয়েটসের কবিতার পংক্তি দিয়ে তাঁর কালজয়ী উপন্যাসের নামকরণ: “সবকিছু ভেঙে যায়” (প্রকাশ ১৯৫৮) -- এখনো পর্যন্ত আফ্রিকার জনপ্রিয়তম উপন্যাস। তিনি নাইজিরিয়ার মানুষ, কিন্তু লেখক হিসেবে আন্তর্জাতিক; মাতৃভাষা ইবো, কিন্তু লিখেছেন মূলতঃ “ঔপনিবেশিকদের ভাষা” ইংরেজিতে। আফ্রিকা মহাদেশের প্রসিদ্ধতম লেখক তিনি; দু দশক অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার বার্ড কলেজে এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতাটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া হয়েছে।]

0 comments: