0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৯



মিসেস সুজান এখনও অবধি যত খদ্দের দেখেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এই সৈনিকগুলি। আটজন মিলে বেশ কয়েক মাস ধরে থেকেছিল তার সরাইখানায়। ব্রিজ উড়ে যাওয়ার আগে অবধি যা ব্যবসা হয়েছিল তার, তার থেকেও অনেকটা বেশি উসুল হয়ে গিয়েছিল এই সময়ের মধ্যে। সৈনিকদের সম্ভবত হাতে অনেক পয়সা আর সময় ছিল। তারা যে কাজটা করছিল, মিসেস সুজানের কাছে সেটা একদম হাস্যকর মনে হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজনে মিলে কিছুটা রাস্তা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেত, আবার নৌকায় নদী পার হয়ে কিছুটা রাস্তা উল্টোদিকের পাড় ধরে হেঁটে যেত। দু’ঘণ্টা ধরে দু’জনে মিলে এই কাজটা করত। আবার অন্য দু’জন এলে তাদের ছুটি। এদিকে আবার একজন সরাইখানার ছাদে বসে থাকত দূরবীন নিয়ে। চারদিকে নজর রাখত। খুব কম করে হলেও টানা তিন ঘণ্টা বসতে হত একজনকে। সৈনিকেরা নিজেরাই ছাদে বসবার ব্যবস্থা ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল। হেলানো কৌণিক ছাদের গায়ের জানলাটা ছাদের বেশ কয়েকটা টালি সরিয়ে আরেকটু চওড়া করে নিয়েছিল তারা। রাতের বেলা সেই ফাঁকা জায়গাটা টিন দিয়ে ঢেকে রাখত, আর দিনের বেলা সেই জানলার সামনে একটা টেবিল পেতে পুরনো চেয়ারের মধ্যে কুশন সাজিয়ে বসে থাকত তারা। প্রায় সারাদিন একজন থাকত সেখানে দূরবীন আগলে। দূরে পাহাড়ের দিকে, জঙ্গলের দিকে, নদীর তীরে, পাশে টেসার্জি গ্রামের দিকে তাক করে করে কী যে দেখে কে জানে! বাকি সৈনিকেরা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের কি একঘেয়ে লাগে না এই কাজ করতে? কে জানে!

মিসেস সুজানের ভাবতে অবাক লাগে যে শুধু এইসব কাজ করবার জন্য সৈনিকেরা কত পয়সা রোজগার করছে! শুধু তারাই পাচ্ছে এমন তো নয়; দেশে তাদের পরিবার আছে, তারাও ভাতা পাচ্ছে। সৈনিকদের মধ্যে আবার অতীতে একজন ছিল শিক্ষক। সে একদিন হিসেব করছিল যে দেশের বাড়িতে তার বউ ঠিক কত টাকা পাচ্ছে ভাতা হিসেবে। সৈনিকের কাজের কী বহর! তারা এখানে বসে বসে আলুভাজা, স্যালাদ, গুলাশ, রুটি, সসেজ কত কি খাচ্ছে! কফি তো এত খায় যে হিসেব নেই। তার উপরে তামাকের খরচ! রোজই ধোঁয়া উড়ছে। ওই সৈনিক যখন খায় না, তখন সরাইখানার পানশালায় বসে বিয়ারে চুমুক দেয় ধীরে ধীরে, আর সারাক্ষণ বই পড়ে। কত যে পড়তে পারে লোকটা, সে আর বলার নয়। গোটা একটা রুকস্যাক ভর্তি করে বই নিয়ে ঘুরছে বোধহয় এই সৈনিক! যখন খাওয়া কিম্বা পড়াশুনো কিছুই করে না, তখন ছাদের ঘরে গিয়ে দূরবীনে চোখ রাখে। আর কী কাজ লোকটার? চতুর্দিকে বনেবাদাড়ে চেয়ে কী দ্যাখে লোকটা কে জানে! পাহাড়, জঙ্গল, মাঠে চাষারা কাজ করছে, এইসব দেখে কী লাভ! তবে এই সৈনিকের ব্যবহার বেশ ভালো। নাম বেকার। কিন্তু এই লোকটাকে মিসেস সুজানের সেরকম পছন্দ নয়। কারণ লোকটা কাজেও বেকার। হয় বই পড়ছে, নয়তো খানাপিনা করছে, একদম কাজের কাজ কিচ্ছুটি না করে বসে বসে সেনাবাহিনীতে মাইনে নিচ্ছে।

তবে এসব বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। প্রথমে সৈনিকদের যে দলটা এসেছিল, তারা খুব বেশিদিন নয়, প্রায় চার মাসের মত সময় ধরে এখানে ছিল। পরের যে দলটা এলো, তারা প্রায় ছয় মাস ধরে ছিল। তার পরের দলটা প্রায় এক বছর। এর পর থেকে ছয় মাস অন্তর অন্তর লোক পাল্টায় এরা। অনেক সময় প্রথমে যারা ছিল, অনেকেই আবার ফিরে আসে। গত তিন বছর ধরে এই ব্যবস্থা চলছে। এরা এখানে থাকতে আসে। চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, বিয়ার খায়, তাস খেলে কিম্বা ছাদের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে কী দ্যাখে ওরাই জানে! আবার কখনো কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে বনে বাদাড়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সৈনিকদের থাকবার জন্য ঘর ভাড়া দিয়ে আর তাদের খাবার রেঁধে দিয়ে অবশ্য মিসেস সুজানের অনেক টাকাকড়ি হয়েছে। অন্য খদ্দেরও আসে তার সরাইখানায়। সরাইখানার খাবার ঘরটা এখন সৈনিকদের বসার ঘর।

এখন যে সার্জেন্ট গত চার মাস ধরে আছে এই দলটার সঙ্গে, তার নাম পিটার। মিসেস সুজান লোকটার পদবি জানেন না। বেশ ভারিক্কি গোছের চেহারা; চাষাদের মত দোহারা গড়ন, আবার একটা গোঁপ আছে। লোকটাকে দেখে প্রায়ই তার নিজের স্বামী ভেনজেলের কথা মনে পড়ে তার। ভেনজেল সুজান, যুদ্ধে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধটা কবে শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু লোকটা ঘরে ফেরেনি। সেই সময়ের যুদ্ধে যখন সৈনিকরা এই ব্রিজটা পেরত, তাদের সব ধুলোকাদামাখা চেহারা হত। কাউকে চেনা যেত না আলাদা করে। মিসেস সুজানের মনে আছে। পায়ে হেঁটে কিম্বা ঘোড়ার পিঠে কিম্বা ঘোড়ায় টানা মালবাহী গাড়ি সঙ্গে থাকত। এখনকার মত এত বিশাল গাড়ি, ট্রাক এসব কিছুই ছিল না। যে দলটা ব্রিজ পেরিয়ে যেত, তারাই ফিরত কি না, সেসব কিছুই বোঝা যেত না। যারা বহুদিন পরে ফিরত, ধুলোকাদা মাখা চেহারায় খুব কাছ থেকেও ঠাহর করা যেত না যে ঠিক কোন সৈনিক ফিরে এল যুদ্ধ থেকে।

সেই যুদ্ধটার সময়ে তার অল্প বয়স ছিল। বাইশ বছর, সুন্দরী। তাকে ভেনজেল পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল পাহাড়ের গ্রাম থেকে। বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল সমতলের এই সরাইখানায়। মিসেস সুজানের ভারি সুখের সময় ছিল সেটা। সরাইমালিকের বউ সে। পয়সাকড়ির কোনো অভাব নেই। শুধু সরাইখানা নয়, চাষের জমি, ঘোড়া এসবও ছিল ভেনজেলের। ছাব্বিশ বছরের ভেনজেলের হেলেদুলে ধীরপায়ের চলন আর মোটা গোঁপ খুব পছন্দ ছিল মিসেস সুজানের।

ভেনজেলকে প্রেসবুর্গে পাঠানো হল সেনা অফিসার হিসেবে। গায়ে ধুলোমাখা বিদেশী সেনারা তাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে জঙ্গল ভেদ করে পাহাড়ের দিকে যাবার কিছুদিন পরেই প্রেসবুর্গে পাঠানো হয়েছিল তাকে। তারপর সেখান থেকে সোজা পাঠানো হল রোমানিয়া বলে অন্য একটা দেশে। সেখানেও পাহাড়ের দেশ। সেই জায়গাটা থেকে ভেনজেল তিনটে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল কুশল সংবাদ জানিয়ে। শেষ পোস্টকার্ডে লেখা ছিল যে সে সার্জেন্ট হয়ে গিয়েছে। তারপরে চার সপ্তাহ কোনো চিঠি আসেনি। তারপর ভিয়েনা থেকে একটা চিঠি এসেছিল তার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে।



তার কিছুদিনের মধ্যে মারিয়ার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এখন মারিয়া নিজেই গর্ভবতী। এই যে সার্জেন্ট, পিটার, এই লোকটাই, যাকে ভেনজেল সুজানের মত দেখতে, এই লোকটাই মারিয়াকে গর্ভবতী করেছে। মিসেস সুজানের স্মৃতিতে ভেনজেল ছাব্বিশ বছরের যুবক হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এই পিটার, যে ভেনজেলের মত দেখতে হলেও তার বয়স পঁয়তাল্লিশ, ভেনজেল বেঁচে থাকলে কি এরকম বুড়োটে চেহারার হত? লোকটাকে মিসেস সুজানের বেশ বয়স্ক বলে বোধ হয়। মারিয়ার তুলনায় লোকটা বেশ বয়স্ক। মাঝেমাঝেই রাতে মারিয়া ঠিক সময়ে ঘুমোতে আসছিল না। ভোরের দিকে পা টিপে টিপে মোরগ ডাকবার আগে এসে বিছানায় ঢুকছিল। মিসেস সুজান একমনে ঈশ্বরের নাম জপ করছিলেন। মাতা মেরির মূর্তিতে কদিন ধরে বেশি বেশি করে ফুল দিয়েছেন। কিন্তু তবুও মারিয়া পেট বাঁধিয়ে বসল। পিটার একটু অপ্রস্তুত, মুখ ঝুলে যাওয়া অবস্থায় এসেছিল তার কাছে। বলে কিনা যুদ্ধটা থামলেই সে মারিয়াকে বিয়ে করবে।

আচ্ছা বেশ, এখন আর মিসেস সুজান কিছু বদলে ফেলতে পারবেন না। বরঞ্চ প্রতিদিন হলঘরে মাতা মেরির ছবির সামনে অনেক ফুল সাজিয়ে দেবেন, অপেক্ষা করবেন ঐশ্বরিক কৃপার জন্য। বার্কজাবা গ্রামটা হঠাৎ করে বেশ চুপচাপ ঠেকছে তার কাছে, যদিও এই কদিনে সেরকম কিছুই বদলায়নি। সৈনিকেরা সরাইখানার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, বিয়ার খাচ্ছে, চিঠি লিখছে, তাস পেটাচ্ছে। আবার কেউ কেউ এমন সব জিনিস এখানে নিয়ে এসে বিক্রিবাটা শুরু করেছে, যেগুলো আগে এখানকার মানুষজন চোখেও দেখেনি। পকেট ছুরি, সেফটি রেজার, খুব ভালো কাঁচি, মোজা ইত্যাদি। সৈন্যরা এইসব জিনিস বিক্রি করে টাকা রোজগার করে, সেই টাকা দিয়ে মাখন আর ডিম কিনছে গ্রাম থেকে। এরা এখন এইসব কারবার করছে, কারণ এদের পয়সা যত না আছে, তার চেয়েও বেশি আছে সময়। আর সেই সময়ে বিয়ার খাওয়া ছাড়া সেরকম কোনো কাজ নেই।

এখন আবার এক পড়ুয়া সৈনিক এসেছে। যে সারাদিন শুধু পড়াশুনা করে। টেসার্জি স্টেশনে ট্রেনে করে এক ট্রাঙ্ক বই আনিয়েছে লোকটা। লোকটা নাকি প্রফেসর ছিল। দিনের কিছুটা সময় ছাদের ঘরে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে বসে থাকে লোকটা। পাহাড়ে দ্যাখে, জঙ্গলে দ্যাখে আবার কখনো টেসার্জির দিকে চাষারা মাঠে কাজ করছে এইসব দেখতে থাকে দূরবীন দিয়ে। এই লোকটাও বলছিল যে দেশের বাড়িতে লোকটার বউ অনেক টাকা পায়। পাঁচ অঙ্কের ক্রাউন পায় মাসে মাসে। কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা! হতে পারে এরকম? নির্ঘাত মিছে কথা বলছে লোকটা। বর এখানে বসে বসে অর্ধেক দিন, অর্ধেক রাত বই পড়ছে, আর লিখছে কী সব! মাঝে কয়েক ঘণ্টা ছাদে উঠে দূরবিনে চোখ রাখছে, স্রেফ এই কাজের জন্য দেশে বউ এত বিরাট অঙ্কের ভাতা পেতে পারে? সব ফালতু কথা।

এদের মধ্যে আবার একজন ছবি আঁকে। আবহাওয়া ভালো থাকলে নদীর ধারে বসে দূরের পাহাড়গুলোর ছবি আঁকে। নদী, পাহাড়, ব্রিজের ভাঙা টুকরো, যা কিছু দেখছে লোকটা তাইই আঁকছে। এক দু’ বার মিসেস সুজানের ছবিও এঁকে ফেলেছিল। ছবিগুলো বেশ ভালো হয়েছে। তিনি বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছেন কয়েকটা।



তিন বছর হয়ে গেল আটজন করে সৈনিক এসে এখানে থাকছে। থাকছে এবং কাজের কাজ সেরকম কিছুই করছে না। নদীর এ পাড় দিয়ে কিছুটা হেঁটে, তারপর নৌকা করে নদী পেরিয়ে, ওপাড় ধরে আবার কিছুটা হেঁটে টেসার্জি অবধি যাচ্ছে, ব্যস ছুটি। ভালো করে খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, হাতে অঢেল পয়সা। মিসেস সুজানের মাঝে মাঝে মনে হয় যে ভেনজেলকে এরকম কোনো অদ্ভুত কারণে দূরদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়নি তো? ভেনজেলকে তার খুব দরকার ছিল। এই অভাব যে পূর্ণ হবার নয়। তাছাড়া ভেনজেল কাজ করতে ভালবাসত। হয়তো এইরকমভাবে বসিয়ে রেখেছিল তাকে রোমানিয়াতে পাঠিয়ে, তারপর কী ভাবে যেন গুলি লেগে লোকটা মরে গেল। কিন্তু এই যে সৈনিকেরা এখানে রয়েছে এদ্দিন ধরে, সেরকম কোনো গোলাগুলি তো চলেনি! এরা নিজেরাই দু’ তিন বার গুলি চালিয়েছিল। সে একটা ভীষণ উত্তেজনা! কিন্তু প্রতিবার বোঝা গিয়েছে যে এরা ভুলভাল কারণে গুলি চালিয়েছে। বারণ করা সত্ত্বেও জঙ্গলে শিকার করবার জন্য এরা গুলি চালিয়েছে এক দু’ বার। একবার এক মহিলার উপরে চালিয়েছিল। রাত্রিবেলা বিশেষ প্রয়োজনে সে তার বাচ্চাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে জেনকোশিক থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে টেসার্জির দিকে যাচ্ছিল ডাক্তার দেখাতে। বুঝতে না পেরে এরা গুলি চালিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে মহিলার লাগেনি। পরে অবশ্য নিজেরাই নৌকা করে মহিলাকে নিয়ে গিয়েছিল টেসার্জি অবধি। এই যে প্রফেসর, নিষ্কর্মার ঢেঁকি লোকটা, খাবার ঘরে বসে সারাদিন পড়ে আর লেখে, এই লোকটা ওই মহিলার সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু তিন বছরে আজ অবধি এরা একটাও সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করতে পারেনি। পারবে কী ভাবে? আরে, এখানে একটা বাচ্চাও জানে যে শোয়র্টশিক গ্রামের ছেলেগুলো চলে যাবার পর থেকে এই এলাকায় একটাও বিপ্লবী নেই।

(চলবে)

0 comments: