0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















ইউনিফর্ম সিভিল কোড  - বিতর্ক-বিমর্শ-বিতণ্ডা ইত্যাদি

গৌরচন্দ্রিকা

সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) একটি স্পর্শকাতর বিতর্কিত বিষয়। আজকের বদলে যাওয়া পরিবেশে হিন্দু সমাজের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকজনের একাংশ বলছেন—এটা একটা দরকারি আইন যা দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের বিভেদ ভুলিয়ে সবাইকে সমান অধিকার এবং সুযোগ দেবে। এটাও বলা হচ্ছে যে এর ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে মেয়েদের মুখ বুঁজে থাকা অংশটি পুরুষের সঙ্গে সমতার দিকে অনেকখানি এগিয়ে যাবেন।যেমন তিন তালাক নিরোধক আইন পাস হওয়ায় মেয়েদের উপর অন্যায় অত্যাচার খানিকটা কমেছে।

এই বিতর্কের ফ্রেমে রয়েছে মুখ ফুটে না বলা একটি প্রেমিস- হিন্দুসমাজের আইনে মেয়েরা অনেক বেশি জেন্ডার ইকুয়ালিটি এবং স্বাধিকারের স্বাদ পায়, তাই সমাজের বাকি অংশ ওদের অনুসরণ করবে –এটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই হওয়া উচিত।

এর প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভাবছেন যে রাষ্ট্র তাঁদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে খামোকা নাক গলাচ্ছে যা হওয়া উচিত নয়।

এ নিয়ে দু’একটি ফোরাম এবং ইনফর্মাল আলোচনায় যা শুনেছি এবং যে ধরণের বিতর্কে জড়িয়েছি—সেসব সংক্ষেপে দুটো কিস্তিতে লিখছি। আমার আশা, পাঠকেরা এর ভিত্তিতে আরও তলিয়ে দেখে নিজস্ব মতামত দাঁড় করাতে পারবেন। এবং চাইলে আমার ভুল শুধরে দেবেন। আমার উদ্দেশ্য ভারতীয় পরম্পরায় সুস্থ বিতর্কের মুখ খুলে দেওয়া, এইটুকুই।

গত ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ বিজেপি সাংসদ কিরোড়ী লাল মীণা রাজ্যসভায় একটি প্রাইভেট মেম্বার্স বিলে পেশ করেছেন যার সার কথা হল দেশে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান আচার সংহিতা জারি করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হোক।

নিন্দুকে বলল —বিজেপি গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ের পর একজন সাংসদকে দিয়ে একটি ব্যক্তিগত বিল পেশ করে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে জল মাপছে।

কারণ, তার আগে একবছর ধরে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, মিজোরাম, তেলেঙ্গানার মত ৯ টি বিধানসভা নির্বাচন এবং একগাদা পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে।


বিজেপির নেতারা মুখ ভার করে বলছেন—এসব কী? সংবিধান সভা দেশকে যে কথা দিয়েছিলেন – যা এতদিন কেউ রাখে নি— আমরা তো সেটাকেই আইনের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।

আর এস এসের লোকেরা ব্যক্তিগত স্তরে বলছেন—আমরা তো কবে থেকে বলছি যে এক জাতি, এক রাষ্ট্রভাষা, এক আচার সংহিতা দেশ এবং রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করে, সুদৃঢ় করে।

এই শব্দকল্পদ্রুমের পরিবেশে বর্তমান প্রবন্ধে নিচের বিন্দুগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। মোদ্দা কথা-- ইউনিফর্ম সিভিল কোড ব্যাপারটা কী- খায় না মাথায় দেয়? সংবিধান সভা এ নিয়ে ৩ নভেম্বর ১৯৪৮ এবং ১৯৪৯ সালে কী বলেছিল?

এবং এটা যদি সবার জন্যে উইন -উইন গেম হয় তাহলে আপত্তির কারণ কী? এ নিয়ে কতদূর চেষ্টা করা হয়েছে এবং কোথায় আটকাচ্ছে?

একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি—এই আলোচনার জন্যে আমি ঠিক যোগ্য ব্যক্তি নই। আমি খালি বিতর্কের মুখ খুলে দিচ্ছি, সুস্থ তথ্যসমৃদ্ধ বিতর্ক চলুক।

আমার একটাই যোগ্যতা—যখন ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ২১তম ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস বলবন্ত সিং চৌহান ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ব্যাপারে আম জনতার মতামত জানতে চেয়ে মিডিয়ায় এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ১৬ পয়েন্ট প্রশ্নাবলী জারি করেছিলেন এবং নভেম্বর মাসের মধ্যেই প্রায় ১০,০০০ উত্তর পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটা সেট আমারও ছিল। স্বল্পবুদ্ধিতে যা মনে হয়েছিল তাই উত্তরের খোপে ভরে দিয়েছিলাম।

সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড

যে কোন দেশের আইনকানুনকে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

এক, ক্রিমিনাল কোড –যা রাষ্ট্র এবং সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ; এর আওতায় আসবে চুরি-ডাকাতি, খুনজখম, শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণ ইত্যাদি।

দুই, সিভিল কোড—যা্র ভিত্তি হল এক দেশ বা সমাজে বাস করার আচরণ বিধির সামাজিক কন্ট্র্যাক্ট। এতে রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি, বিচ্ছেদ, এবং সম্পত্তির কেনাবেচা, ব্যবসার নিয়ম, উত্তরাধিকার এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন ইত্যদি।

ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান নাগরিক আচার সংহিতাঃ

কিন্তু এইখানে এসে কি একটু গুলিয়ে যাচ্ছে?

অনেক লিব্যারাল আধুনিক ভাবনা-চিন্তার লোকজন বলছেন যে ক্রিমিনাল কোড তো জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশের সমস্ত নাগরিকের জন্যে সমান। খুন-চুরি-ডাকাতির অপরাধে শাস্তি দেবার সময় আইন বা রাষ্ট্র নাগরিকের জাতধর্ম দেখে না, একই আইনে একই শাস্তি দেয়। তাহলে একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রে সিভিল কোড এক হবে না কেন?

--ভাল কথা; কিন্তু সিভিল কোডের অন্তর্গত অনেকগুলো আইন তো মূলতঃ সবার জন্যেই সমান!

ব্যবসা করতে কন্ট্র্যাক্টের নিয়ম ও আইন, সেলস্‌ অফ গুডস অ্যাক্টের আইন, জি এস টি, ইনকাম ট্যাক্স, রেজিস্ট্রির নিয়ম, জমি বাড়ি সম্পত্তি কেনাবেচার আইন, মর্টগেজ বা সম্পত্তি বন্ধক রাখার আইন –সবই তো হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানী সবার জন্যে এক। তাহলে?

--আছে, তফাৎ আছে। ভারতবর্ষে সিভিল কোডের অন্তর্গত কিছু বিষয় বিভিন্ন ধার্মিক এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্যে আলাদা। সেগুলো হল মুখ্যতঃ তিনটি-- বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি এবং বিচ্ছেদ; সম্পত্তির উত্তরাধিকার, এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন।

সমান নাগরিক আচার সংহিতার সমর্থকেরা চাইছেন- ওই তিনটে ব্যাপারেও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্যে আলাদা আলাদা নিয়ম বন্ধ হোক। সব ধুয়ে মুছে এক হয়ে যাক, ঠিক স্কুল ইউনিফর্মের মত।

এখানে কর্ণাটকের স্কুলের হিজাব-বিতর্ক মনে পড়া স্বাভাবিক।

আমরা সংক্ষেপে আলোচনার সুবিধের জন্যে দেশের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের (হিন্দু ও মুসলিম) কোড বিল নিয়ে আলোচনা করব।

হিন্দু কোড বিল এবং মুসলিম পার্সোনাল ল’

হিন্দু ল’ এবং মুসলিম ল’এর গোড়ার কাঠামোটি তৈরি হয়েছে কোম্পানির আমলে ক্রমশঃ ১৭৮৩ এবং ১৭৮৫ সালে, অর্থাৎ প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহে এবং প্রাচ্যবিদ্‌ উইলিয়াম জোন্সের অধীনে কিছু টুলো পণ্ডিত এবং মৌলবীদের ডেকে বিভিন্ন স্মৃতি বা সংহিতা (মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি) এবং কুরানশরীফ ও হাদিস্‌ ঘেঁটে।

স্বাধীন ভারতে প্রণীত হিন্দু কোড বিলের (১৯৫৫-৫৬) অন্তর্গত রয়েছে চারটে আইন—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৫; হিন্দু সাকসেসন অ্যাক্ট; হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট এবং হিন্দু অ্যাডপশন (দত্তক নেয়া) এবং মেইন্টেন্যান্স (খোরপোষ) অ্যাক্ট।

তেমনই ভারতের মুসলিমদের রয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাক্ট ১৯৩৭। এতে বিয়ে, তালাক, খোরপোষ, দান-দক্ষিণা সব কিছুর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে মুসলিম জীবনযাপন পদ্ধতির নির্দেশের ব্যাপারে চারটি উৎসকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

সেগুলো হলঃ কুরআন, সুন্না বা অহল -এ- হাদিস (হজরত মহম্মদের নিজের আচরণে যা সিদ্ধ), কিয়াস (ব্যখ্যা টীকা ভাষ্য ইত্যাদি) এবং ইজমা ( বিদ্বানদের সর্বসম্মত ব্যাখ্যা)।

এছাড়া রয়েছে পলিগ্যামি অ্যাক্ট ১৯৫৬; যার মাধ্যমে ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হলেও মুসলিমদের (অধিকতম চারজন স্ত্রী পর্য্যন্ত) এবং গোয়া ও পশ্চিম উপকূলের কিছু অঞ্চলে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী আইনসম্মত।

বলে রাখা ভাল বর্তমান বিশ্বে (২০২২ পর্য্যন্ত) ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৫৮টি দেশে বহুবিবাহ আইনসম্মত; এর অধিকাংশই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের।

এখানে একটা ডিস্‌ক্লেমার দিয়ে রাখি। আইন যাই হোক, এখন বিশ্বের সর্বত্র, এমনকি ভারতের আদিবাসী এবং মুসলিম সমাজেও একপত্নীই দস্তুর।

তার দুটো কারণ।

এক, এই ধরণের সিভিল আইনগুলো প্রেস্ক্রিপটিভ, ডিটারেন্ট নয়। যেমন হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন মানে এই নয় যে সমস্ত বিধবাকেই ফের বিয়ে করতে হবে বা সব পুরুষকে বিধবাকেই বিয়ে করতে হবে বা তাদের শাস্তির ভয় দেখিয়ে বাধ্য করতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দকে স্থান দেওয়া হয়েছে, করলে কোন বাধা নেই—এই আর কি!

তেমনই মুসলিম সমাজে দুই বা চার বিয়ের অনুমোদন মানে এই নয় যে সবাইকেই বেশি বেশি করে বিয়ে করতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতে মুসলিম সমাজেও প্রথম স্ত্রীর বর্তমানে তাঁর অনুমতি বিনা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের নিয়ম নেই।

দুই, আর্থিক, সামাজিক এবং চেতনার বিকাশ।

এখন মেয়েরা বেশি বেশি করে চাকরি বা আর্থিক রোজগারের জীবিকার দিকে ঝুঁকছেন, শিক্ষার প্রসার হচ্ছে। তাঁরা পড়াশুনো করে স্বতন্ত্র রোজগারের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। নিজেদের স্বাস্থ্য এবং শরীরের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন।

ইউনিফর্ম সিভিল কোড মানে—ওইসব বিভিন্ন আইন বাতিল করে সবার জন্য কোন ধার্মিক রেফারেন্স ছাড়া একটাই আইন চালু করা।

আচ্ছা, তাতে অসুবিধা কী? বেশ আধুনিক এবং প্রগতিশীল শোনাচ্ছে তো। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারতে এরকমটা হওয়ারই কথা তো! অসুবিধেটা কোথায়?

সংবিধান সভার আর্টিকল ৪৪ এ নেহরুজি এমনই কিছু বলেছিলেন কিনা?

--বলেছিলেন বটে, কিন্তু অসুবিধেটাও তখনই স্পষ্ট হয়েছিল। কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান প্রণয়ন সভার ২৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ এর বিতর্কটি দেখলেই বোঝা যাবে।

বোম্বাই থেকে কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধি স্বাধীন দেশের জন্যে ধর্মের অনুশাসনের উর্দ্ধে উঠে একটি সমান নাগরিকতার পক্ষে যুক্তি দেন। বিরুদ্ধে মাদ্রাজ এবং বিহারের প্রতিনিধিরা বলেন –এতে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বিবিধতা নষ্ট হবে। ঐক্য এবং একরূপতা এক কথা নয়।

ওঁরা উদাহরণ দিয়ে বললেন—বিশাল দেশ ভারতবর্ষে ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। পূবে আসামে এত বৃষ্টি হয়, কিন্তু পশ্চিমে রাজস্থানে খটখটে মরুভূমি। উত্তরে বরফ পড়ে , হাড়কাঁপানো শীত। কিন্তু দক্ষিণে শীত সেভাবে টের পাওয়া যায় না।

শেষে একবছর পরে ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৯ সালে সংবিধান সভার এই বিষয়ে বিতর্ক সমাপ্ত করে নেহরু বললেন—তাড়াহুড়ো না করে এই প্রগতি জনতার উপর চাপিয়ে না দিয়ে ধীরে ধীরে জনতার মধ্যে চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ওদের সম্মতি নিয়ে ট্র্যাডিশনে পরিবর্তন আনতে হবে। এবং ওঁর পরামর্শ মত ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ধারণাটিকে সংবিধানের ডায়রেক্টিভ প্রিন্সিপলের (মার্গদর্শী সিদ্ধান্ত) অধীনে আর্টিকল ৪৪ এ নিচের শব্দে বাঁধা হলঃ

Article 44. Uniform civil code for the citizens.

The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India.

ঠিক আছে, কিন্তু করে ফেলতে কিসের অসুবিধে? সত্তর বছর হয়ে গেল যে!

হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে

--দেখুন, হিন্দুদের স্মৃতিশাস্ত্রে বিহিত আটরকমের বিয়ের মধ্যে শুধু ‘প্রাজাপত্য’ই আজকাল চলছে। এতে বাবা বা তাঁর অবর্তমানে পরিবারের কোন গুরুজন ‘কন্যাদান’ করে আর বিয়ের কার্ডে প্রজাপতির ছবির নীচে ‘প্রজাপতয়ে নমঃ’ লেখা থাকে। প্রজাপতির নির্বন্ধে ডিভোর্সের কথাই ওঠে না, জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে হাঁসফাস করলেও।

অবশ্য আজকাল যেটাকে লাভ ম্যারেজ বলা হয় সেটা মনু’র গান্ধর্ব বিবাহের (বর কনে নিজেদের সম্মতি বা পছন্দের হিসেবে) আধুনিক রূপ মাত্র।

তবে ইদানীং হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে কিছু সংশোধন হয়েছে। তাই সময়ের দাবিতে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ডিভোর্সের সুযোগ রয়েছে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে সপ্তপদী গমন এবং যজ্ঞ একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান। আর রয়েছে (হিন্দি বলয়ে) সাতটি শপথ (সাতোঁ বচন) নেওয়ার কথা, যেমন পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা- ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়া, ইত্যাদি।

মুসলিম বিয়ে

কিন্তু মুসলিম বিয়ে হল পিওর কন্ট্র্যাক্ট। বিয়ে মসজিদে না হয়ে কারও বাড়িতে (কন্যার ঘরে) হয়। পুরোহিতের স্থানে কাজি বসেন বটে, তবে পাঁচ জন সাক্ষী রেখে কন্যাকে বসিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়—আপনি কি অমুককে কবুলনামায় লেখা শর্ত অনুযায়ী জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করতে রাজি?

কন্যা তিনবার ‘কবুল’ বললে একই কন্ট্র্যাক্টের পাঁচ কপিতে ওরা দুজন, কাজি এবং সাক্ষীদের সইসাবুদ হয়ে গেলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ওদের দুজন এবং সাক্ষীদের কাছেও একটি করে ওই নিকাহ্‌নামা বা চুক্তির কপি থাকে। তাতে কন্যার সিকিউরিটি হিসেবে পূর্বনির্ধারিত ‘দেনমোহর’ কত টাকা তার উল্লেখ থাকে। বিয়ের সময় ওই টাকা মেয়ের হাতে দিতে হয়।

যদি কিছু বকেয়া থাকে সেটা ডিভোর্স বা তালাক দিলে তখন দিতে হয়। একেবারে কন্ট্র্যাক্ট ও তার কনসিডারেশন! তবে বাস্তবে কী হয় সেটা অন্য প্রসংগ।

আমি এক মুসলিম কলীগের ছোট ভাইয়ের বিয়েতে সাক্ষী একজন কম পড়ে যাওয়ায় এন্ট্রি পেয়েছিলাম এবং সই করার পরে এক কপি (বেশ রঙীন কাগজে) পেয়েছিলাম।

চুক্তি বলেই মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্টে তিন রকমের তালাকের প্রথা রয়েছে—আহসান, হাসান, এবং বিদ্যৎ। ভাববার সময় না দিয়ে যখন মর্জি তখন তিনবার ‘তালাক’ বলে স্ত্রীকে ঘরের বাইরে করে দিলাম-এটাই ওই বিদ্যৎ তালাক। এটা প্রথাসিদ্ধ কিন্তু শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাই অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই রকম তালাক উঠে গেছে।

ভারতেও সুপ্রীম কোর্টের রায় মেনে আইন করে শুধু ওই তালাক-এ-বিদ্যৎ নিষিদ্ধ হয়েছে, বাকি নিয়ম যথাবৎ আছে।

একটা কথা; ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মুসলিম মেয়ে কোন অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না। তবে মুসলিম ছেলে একেশ্বরবাদী ধর্মের (ক্রিশ্চান ও ইহুদী) মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু কোন বহুদেববাদী ধর্মের ( হিন্দু) মেয়েকে নয়। (কুর্‌আন, সুরা ৫.৫)।

ক্রীশ্চান ম্যারেজ অ্যান্ড ডিভোর্স অ্যাক্টের (১৮৭২) অনুষ্ঠান চার্চে হতেই হবে। কিন্তু ইসলাম ও ক্রিশ্চানিটি দুটোই আব্রাহামিক ধর্ম, তাই অনুষ্ঠানে কিছুটা মিল রয়েছে। পাদ্রী সবার সামনে ব্রাইডকে তিনবার জিজ্ঞেস করে সম্মতি পেলে পরমপিতা পরমেশ্বরের আশীর্বাদে বা দৈব ইচ্ছায় ওই জোড়াকে তখন বিধিসম্মত স্বামী-স্ত্রী বলে ঘোষণা করেন। তারপর বলেন –এখন তোমরা একে অপরকে চুমো খেতে পার।

তখন ওরা সবার সামনে একে অপরকে চুমো খায়, ব্যস্‌।

হিন্দুদে্র শুধু মালাবদল হয়, সবার সামনে চুমো-টুমো খাওয়ার সুযোগ নেই। এবার বলুন, এই তিনরকমের বিয়ের আইন তুলে দিয়ে কী করতে চান? কেমন কোড আনতে চান?

চুমো খাওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ভবিষ্যতে আইন মেনে চুমো খেতে হবে?

সাক্ষীসাবুদ-দেনমোহর করে রীতিমত চুক্তিপত্রে সই করে বিয়ে দেওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ওইরকম করতে হবে?

সপ্তপদী, যজ্ঞ, অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই তাই করতে হবে?

আরও আছে। হিন্দু তেলুগু সম্প্রদায়ে মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে সবচেয়ে উত্তম সম্বন্ধ ধরা হয়। আমার এক কলীগ তিনভাই। ওরা ওদের আপন মামার মেয়েদের বিয়ে করেছে।

এটা কি বাদ যাবে? নাকি সবাইকে মামাতো পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করতে হবে?

মুসলমানদের মধ্যেও তুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করার চল আছে।ওদের হয়তো অসুবিধে হবে না? কিন্তু আমাদের?

মৈত্রী কড়ার (Friendship Contract):

সত্তরের দশকের গুজরাতে কোন এক প্রাচীন ট্র্যাডিশনের ধুয়ো তুলে ঊচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে শুরু হল মৈত্রী কড়ার । এর মানে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে এগ্রিমেন্ট বানিয়ে একসঙ্গে লিভ টুগেদার করতে পারে—আশা এই যে ওরা কিছুদিন পরে বিয়ে করবে।

হিন্দু কোডে কোথাও এমন কোন টেম্পোরারি বিয়ের কথা বলা নেই। কিন্তু আইন এর প্রতিবন্ধক নয়। শুধু ছ’বছর আগে দুই ছোটবেলার সাথী (ছেলে মুসলিম, মেয়ে হিন্দু) ওই কড়ার করে বাধা পেয়ে শেষে গুজরাতের হাইকোর্টে গিয়ে ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ রায়ে অনুমোদন আদায় করায় গুজরাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের টনক নড়ল। শেষে কি আমাদের ঘরের মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মাছ-মাংস রান্না করতে বাধ্য হবে?

আজকে সমান আচার সংহিতা শুরু হলে মৈত্রী কড়ার বন্ধ হবে নাকি?

তারপর অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হিসেবে ভারতে ৪৬০০ আদিবাসী সম্প্রদায় আছে যাদের পূজার্চনা এবং বিবাহ সংস্কারের নিয়ম আমাদের থেকে ভিন্ন। ওদের সংস্কৃতিকেও কি দুরমুশ করে আমাদের মত করতে হবে?

--ভাল জ্বালা! তার চেয়ে বিয়ের জন্যে এমন একটা আইন করা যায় না যাতে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে , নিজেদের জাত ধর্ম বাবা-মার অনুমতির তোয়াক্কা না করে ধর্মের দোহাই না দিয়ে বিয়ে করতে পারে? তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

সে আইন তো কবেই হয়ে গেছে—স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪। অর্থাৎ হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের (১৯৫৫) একবছর আগে। তাতে শুধু ছেলের বয়েস ২১ হতে হবে, আর মেয়ের ১৮।। তবে প্রধানমন্ত্রী বলছেন শিগগিরই মেয়েদের বয়েসও আইন করে বাড়িয়ে ২১ করে দেওয়া হবে, ভাল কথা।

তফাৎ হল—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে আগে বিয়ে, পরে রেজিস্ট্রি। স্পেশ্যাল অ্যাক্টে আগে দরখাস্ত দিলে রেজিস্ট্রার দেবে একমাসের নোটিস, তারপরও যদি মিয়া-বিবি রাজি থাকে, তবে একই সঙ্গে রেজিস্ট্রি এবং বিয়ে।

তাহলে আর হৈ চৈ কিসের?

কারণটা রাজনৈতিক, পরে আসছি। আগে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বলি।

হিন্দু ও মুসলিম কোডে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার

হিন্দু কোড বিলে আগো মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে কোন অধিকার ছিল না। প্রথমে সংশোধিত হয়ে মেয়েদের বসবাসের অধিকার স্বীকৃত হল, কিন্তু মালিকানা হক নয়। পরে ২০০৫ সালের সংশোধনে ভাই এবং বোনের সমান অধিকার স্বীকৃত হল। তারপর ২০২২ সালের একটি রায়ে সুপ্রীম কোর্ট বললেন যে বিবাহিত মেয়েরাও ভাইয়ের সমান অংশীদার, সমান ভাগ পাবে।

মুসলিম কোডে কিন্তু প্রাচীন কাল থেকেই সম্পত্তিতে বাবা-মায়ের পৈতৃক এবং স্বোপার্জিত সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত, সে বিবাহিত হলেও। তবে সবসময় সেটা ছেলেদের সমান ভাগ নয়, কখনও ১/২, কখনও ১/৪।

ব্যাপারটা বেশ জটিল। যখন আইনের স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় বসেছিলাম তখন আমরা সবাই ভয় পেতাম মুসলিম সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নকে। তাতে খেয়াল করে ভগ্নাংশের অংক কষতে হত।

--যাকগে, এসব জটিল ব্যাপারে আপনার আমার মত হরিদাস পালেদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এর জন্যে উপযুক্ত সংস্থা হল ল’ কমিশন। ওদের দিয়েই এসব আইন ও ট্র্যাডিশনের প্যাঁচ খুলে একটি আধুনিক সিভিল কোডের খসড়া বানানো হোক। মিঃ আম্বেদকর, নেহেরুজী, প্যাটেলজী –সবার আত্মা শান্তি পাক। অসমাপ্ত কাজ পুরো করা হোক।

ল’ কমিশন

গোড়াতেই বলা দরকার যে ল’ কমিশন কোন সাংবিধানিক(constitutional) অথবা বৈধানিক (statutory) সংস্থা (body) নয়। এটি বিশুদ্ধ প্রশাসনিক (executive) সংস্থা যা ভারত সরকারের নির্দেশে কোন নিশ্চিত ইস্যুতে এবং নির্ধারিত সময়ের (tenure) জন্য গঠিত হয়।

এর দায়িত্ব হল আইনের সংস্কারের ব্যাপারে রিসার্চ করে সরকার চাইলে বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ( Suo moto) পরামর্শ দেওয়া।

বর্তমান ভারত সরকার ইউ সি সি’র বিষয়ে ২০১৬ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাস্টিস বি এস চৌহানের অধ্যক্ষতায় ২১ তম ল’ কমিশন গঠন করে।

উনি এ’ব্যাপারে আম নাগরিক এবং সিভিল সোসাইটির অভিমত এবং পরামর্শ জানতে চেয়ে ৩/১০/২০১৬ তারিখে এক ১৬ বিন্দু প্রশ্নাবলী সম্প্রচারিত করেন। নভেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় দশ হাজার উত্তর এবং মতামত পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে প্রেসকে জানিয়েও দেন।

এতে গুজরাতের হিন্দুদের ‘মৈত্রী কড়ার’ প্রথা চালু রাখার নিয়েও প্রশ্ন ছিল।

কিন্তু বুঝতে পারছিলেন যে ব্যাপারটা এত সোজা হবে না। অতঃপর জাস্টিস চৌহান ২০১৮ তে কোন রিপোর্ট পেশ না করেই অবসর নেন।

তারপর গত চার বছর ধরে কমিশনের কোন চেয়ারম্যান না থাকায় ব্যাপারটা ন যৌ ন তস্থৌ হয়ে থেমে ছিল।

অবশেষে ভারত সরকার গত ৮/১১/২২ তারিখে কর্ণাটক হাইকোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চিফ জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থীর অধ্যক্ষতায় ২২তম ল’ কমিশন গঠন করেছে। জাস্টিস অবস্থী কর্ণাটকের বিবাদিত হিজাব মামলার রায়দাতা যা কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের নীতিতেই সীলমোহর লাগিয়েছে।

আশা করা যাচ্ছে আগামী মার্চ ২০২৩ নাগাদ ল’ কমিশন ইউ সি সি ইস্যুতে তাঁদের রেকমেন্ডেশন বা সুপারিশ ভারত সরকারকে জানিয়ে দেবেন।

কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে আমরা মার্চ অব্দি অপেক্ষা না করে এখন থেকেই চেঁচামেচি করছি কেন? উত্তরটাও সহজ, রাজনীতি।

সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) ও রাজনীতি

আসলে সমান আচার সংহিতা নিয়ে এত আগ্রহের পেছনে রয়েছে আরেকটি ইস্যু – মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।

মোদীজি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিজেপি ও আর এস এসের ঘোষিত তিনটে এজেন্ডা ছিল –রাম মন্দির নির্মাণ, সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড। এর জন্যে দরকার ছিল বড় মাপের সংখ্যাগরিষ্ঠতার। সেটা পাওয়া গেল ২০১৯ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে।

ব্যস্‌ ব্রুট মেজরিটির জোরে ৫ অগাস্ট ২০১৯ সালে বাতিল হল আর্টিকল ৩৭০, অবশ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ইত্যাদির আলাদা আইন, আলাদা পতাকার অনুমতি নিয়ে আর্টিকল ৩৭১ আগের মতই রয়ে গেল।

তারপর ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে অযোধ্যা মামলার রায় বেরোল। ৫ অগাস্ট ২০২০তে সংসদে মন্দির নির্মাণের জন্য বিশেষ ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা হল।

বাকি রইল একটাই—সমান নাগরিক আচার সংহিতা, ইউনিফর্ম সিভিল কোড।

এতসব চেঁচামেচির একটাই লক্ষ্য—মুসলিম আইনে যে চারটে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে সেটা বাতিল করে সবাইকে এক পত্নীব্রতে থাকতে বাধ্য করা। বাকি সম্পত্তির অধিকার-টার যাক চুলোয়।

ওদের যুক্তিঃ বেশি পত্নী মানেই বেশি সন্তান; এর মানে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তার মানে কোন এক ভবিষ্যতে ওরা মেজরিটি হবে এবং আমাদের দেশকে ফের ভাগ করবে।

এটা খোলাখুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতারা এটাকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মোড়কে গম্ভীর মুখে বলে থাকেন।

বিজেপি সাংসদ এবং আর এস এসের তাত্ত্বিক নেতা রাকেশ সিনহা সংসদে জুলাই ২০১৯ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পেশ করলেন।

প্রধানমন্ত্রী সে’ বছর স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের কথা বলে এটাকে ‘a form of patriotism’ আখ্যা দেন। অর্থাৎ যাদের সন্তান বেশি তারা দেশকে ভালবাসে না।

উনি সেটা বলতেই পারেন।

মোদীজির ভাষণের একই দিনে ১৫ই অগাস্ট, ২০১৯শের স্বাধীনতা দিবসে আসাম সরকার ঘোষণা করে দিল যে যাদের দুটোর বেশি সন্তান রয়েছে তারা সরকারি চাকরি পাবে না এবং স্থানীয় স্তরে কোন নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না।

অবশ্য এন ডি এ জোট থেকে বেরিয়ে এসে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে বলেছেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নতুন আইনের দরকার নেই। ওঁর একটিই সন্তান।

এদিকে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং ইউপির মুজফফরনগর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ সঞ্জীব বালিয়ান সেই ২০১৯ থেকে নিয়মিত সংসদে বলছেন ভারতে জনসংখ্যা যে হারে বেড়ে চলেছে যে রিসোর্সে টান পড়ছে, করদাতাদের উপর বোঝা বাড়ছে, এখনই ১৩৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে, ভবিষ্যতে কী হবে? ওঁর আবেদনে ১২৫ জন সাংসদের সই ছিল।

তবে ডঃ রাকেশ সিনহার (আর এস এস বুদ্ধিজীবি এবং রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য) তিনবছর আগে পেশ করা বিলটিকে এ’বছর এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মনসুখ মণ্ডাভিয়া অপ্রয়োজনীর বলে মতপ্রকাশ করে খারিজ করে দেন।

ওনার মতে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর আশংকাজনক নয়। জোর করে প্রতি পরিবার দুই সন্তানের লক্ষণরেখা টেনে দেওয়ার দরকার নেই। সরকারের প্রচেষ্টায় জনতা এখন অনেক জাগরুক, বাকিটুকু শিক্ষার আরও প্রসার হলেই হয়ে যাবে।

তখন রাকেশ সিনহা বিলটি প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু উত্তর প্রদেশ সরকার দুই সন্তানকে বাধ্যতামূলক করার খসড়া বিল জুলাই ২০২১ শে বিধানসভায় পেশ করে।

তবে গত বছর জুলাই মাসে সংসদে দুই বিজেপি এম পির প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে NFHS III(2005-06) সার্ভে হিসেবে TFR 2.7 ছিল, তারপর NFHS IV (2015-16) অনুযায়ী কমে 2. 2 হয়ে গেছে। কাজেই আইন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই।

তারপর এ’বছর জুন মাসে এক সাংবাদিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে জানানো হয় যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মণ্ডাভিয়া কোনরকম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল আনার কথা ভাবছেন না যেহেতু NFHS V অনুযায়ী ভারতের টোটাল ফার্টিলিটি রেশিও স্থায়িত্ব দর ২.১ থেকে কমে ২.০ হয়ে গেছে।

অথচ এ’বছর গত ৯ ডিসেম্বর তারিখে দু’জন বিজেপি এম পি নিশিকান্ত দুবে এবং রবিকিষণ লোকসভায় প্রাইভেট মেম্বার্স পপুলেশন কন্ট্রোল বিল পেশ করেছেন। রবিকিষণ, ভোজপুরি লোকগায়ক এবং গোরখপুরের বিজেপি এমপি, ওঁর তিন মেয়ে এক ছেলে।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উনি বলছেন এর জন্যে কংগ্রেস দায়ি। ওরা যদি আগেই এই বিল আনত তাহলে নাকি রবিকিষণ আগের থেকে সতর্ক হয়ে যেতেন।

মুশকিলে পড়লাম, কে ঠিক বলছেন?

প্রধানমন্ত্রী না স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কে ঠিক?

দুই বিপরীত মেরুর বক্তব্য বুঝতে হলে কিছু সরকারী ডেটা দেখুন। প্রথমে বিগত ২০১১ সালের সেন্সাস অনুয়ায়ী আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক নাগরিকদের সংখ্যা ও অনুপাতঃ

তালিকা -১

সম্প্রদায় জনসংখ্যার প্রতিশত

হিন্দু ৭৯.৮০

ইসলাম ১৪.২৩

খ্রীস্টান ২.৩০

শিখ ১.৭২

অন্যান্য ১.৯৫

মোট ১০০.০০


National Family Health Survey (NFHS-5) অনুযায়ী ভারতের গড় ফার্টিলিটি রেশিও ২.২ থেকে কমে ২.০ হয়েছে। আন্তর্জাতিক রিপ্লেসমেন্ট রেশিও হল ২.১। অর্থাৎ যে অনুপাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (নতুন জন্ম-নতুন মৃত্যুর সংখ্যা কাটাকুটি করে যা পাওয়া যায়) স্থির থাকে। তার মানে এখন ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশংকাজনক নয়।

মাত্র পাঁচটি স্টেটের টি এফ আর ন্যাশনাল অ্যাভারেজের এবং রিপ্লেসমেন্ট রেশিওর থেকে বেশি। তারা হল—

বিহার (২.৯৮), মেঘালয় (২.৯১), উত্তর প্রদেশ (২.৩৫), ঝারখণ্ড(২.২৬) এবং মনিপুর (২.১৭)। এর কোনটিই মুসলিম বহুল রাজ্য নয়। অথচ, মুসলিম প্রধান জম্মু-কাশ্মীর(১.৩) এবং বঙ্গে (১.৬) টি এফ আর ন্যাশনাল গড়ের থেকে অনেক কম।

তার মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর ধর্ম নির্ভর নয়, বরং শিক্ষার হার এবং জীবনযাপনের স্তরের উপর নির্ভরশীল।

এবার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমস্ত জনগোষ্ঠীতে সন্তানোৎপাদনক্ষম বয়সের মহিলার সন্তান সংখ্যা কত নিচের তালিকায় দেখুন।

তালিকা-২

Total Fertility Rate (TFR) by Religion, average number of children by woman of reproductive age

Hindu 1.94 children

Muslim 2.36

Christian 1.88

Sikh 1.61

Buddhist 1.39

Jain 1.66

Others 2.15

সূত্রঃ National Family Health Survey (NFHS-5)

আমি অংকে কাঁচা, তাই সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। তালিকা একের জনসংখ্যাকে মূলধন এবং TFR কে সূদের হার ধরে কম্পাউণ্ড ইন্টারেস্টের ফর্মূলা লাগিয়ে আঁক কষে বলুন তো এভাবে চললে কত বছর পরে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে?

শেষপাতেঃ

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বসে নেই।বিশেষ করে যেখানে একের পর এক নির্বাচন। উত্তরাখণ্ডে রিটায়ার্ড জাস্টিস রঞ্জনা দেশাইকে অধ্যক্ষ করে রাজ্য ল’ কমিশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। হিমাচলের বিজেপি সরকার নির্বাচনের আগে বলেছিল – জিতলে ওরা রাজ্যে ইউ সি সি চালু করবে। চিঁড়ে ভেজে নি।একই হাল হল কর্ণাটকে, সাধারণ মানুষ ক্রমশঃ মূল্যবৃদ্ধি ও রোজগার সৃষ্টির ইস্যুকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। মহারাস্ট্রে মধ্যপ্রদেশে এবং গুজরাতে শোনা যাচ্ছে ইউ সি সি নিয়ে কমিটির কথা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেরও।

কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের প্রখ্যাত অ্যাডভোকেট সঞ্জয় হেগড়ে বলছেন—ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন সংস্কৃতি। তাহলে তো কোন প্রথা, ধরুন বিয়ে এক রাজ্যে বৈধ হবে তো অন্য রাজ্যে অবৈধ। কিন্তু এটি তো গোটা দেশের জন্যে ‘ইউনিফর্ম’ হওয়ার কথা।

নিন্দুকে বলছে—আরে এগুলো ইলেকশনের আগে জিগির তোলা। কিন্তু গত মার্চে ২২ তম কেন্দ্রীয় ল’ কমিশনের রিপোর্ট এল না। গত মাসে জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থী যে রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেছেন, শোনা যাচ্ছে তাতে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের বদলে এসেছে সিডিশন ল’, মানে আই পি সি ১২৪ (এ) বাতিল করার বদলে আরও কড়া করার পরামর্শ।

তাহলে কি বর্তমান সরকারের চোখে ইউসিসির বিল আনার চেয়ে একটি আরও কড়া দমনমূলক আইন প্রণয়নটাই আজ বেশি জরুরি?

দিন গুণছি।


....................................

 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬।

 সুপ্রীম কোর্ট,অরুণাচল গৌন্ডার বনাম পন্নুস্বামী, জানুয়ারি ২০২২।

দি স্টেটস্‌ম্যান, ১৬ অগাস্ট, ২০১৯।  

 দি হিন্দু, ১৬ অগাস্ট, ২০১৯।

 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২ এপ্রিল, ২০২২। 

হিন্দুস্থান টাইমস্‌ ২৪ জুলাই, ২০২১।
 টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৯ জুন, ২০২২।
ঐ, ৯ ডিসেম্বর, ২০২২।

ঐ, ৬ মে, ২০২২।


0 comments: