0

পথে প্রান্তরে - অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

Posted in


পথে প্রান্তরে


মায়াবী ডুয়ার্সের পথে 
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়


সালটা ২০১১। তখন সবে ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে একটা উত্তেজনা কাজ করছিলো। পরীক্ষা শেষ হলে মূলত সবাই আরামে কাটায়, খেলাধুলো চলে দিনরাত। কিন্তু আমার সে উপায় নেই। আমি ব্যস্ত গোছগাছ করতে। আর আমার থেকেও বেশী ব্যস্ত আমার মা। কারণ ছেলে প্রথম বার স্কুল এক্সকারসানে যাচ্ছে যে, চিন্তা তো হবেই। তাই থেকে থেকেই জিজ্ঞেস করে ' কি রে একা একা থাকতে পারবি তো? ভয় পাবি না তো? ' আর আমি ততই রেগে উঠি। ঐ বয়সে কিছু পারবি না বললে যা হয় আর কি।

এক্সকারসান আমাদের স্কুলে শুরু হয় সুব্রত স্যার আসার পর। রণজিৎ স্যারের তত্ত্বাবধানে আর সুব্রত স্যারের ইচ্ছের নৌকায় চেপে ২০১০ সালে প্রথম এক্সকারসান হয় বিশাখাপত্তনমে। কিন্তু আগে থেকে ঘোরা থাকার কারণে সেবার মা আমাকে যেতে দেয় নি। তো তারপর স্কুল যেতেই শুরু হয় বন্ধুদের সেই বিখ্যাত ডায়লগ 'ভাই কি মিস করলি। যা মস্তি করেছি না! গেলে বুঝতিস।' সবাই সর্বক্ষণ বেড়ানোর কথাতেই মত্ত। আর আমি বোবা শ্রোতার মতো শুনে চলেছি। তখন ই ঠিক করলুম পরের যাই হোক না কেন আমি যাবোই।

সেই যাওয়ার দিন কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়েছে। তাই ব্যস্ততার শেষ নেই। স্কুল থেকে একটা লিস্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো কি কি নিতে হবে। সেই কেনাকাটা চলছে। ওষুধপাতি, শীতের জামা, চাদর সব একে একে নেওয়া হলো। আমার দাদা (জেঠুর ছেলে) আর মা দিনরাত খেটে সব আয়োজন করলো। দাদা একটা ওর বিখ্যাত ওম্ফালুস জ্যাকেট দিয়ে বললো ' ভীষণ ঠান্ডা পড়লে তবেই পরিস এটা। নাহলে পরবি না '। অবশেষে যাওয়ার দিন চলে এলো। ৬ জানুয়ারি সন্ধে ৭ টায় ট্রেন ছিলো। আমি, মা, বাবা আর দাদা রেডি হয়ে নিলাম। বিকেল ৫-৩০ টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছানোর কথা ছিলো। ঠিক ছিলো সবাইকে টিকট ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দেওয়া হবে। সেই মতো আমরা ৫ টা নাগাদ ই স্কুলে পৌঁছে গেলাম। প্রথমেই স্যারেরা টিকিট ডিস্ট্রিবিউট করে দিলেন। তারপর আমরা বন্ধুরা আড্ডা গল্পে মেতে উঠলাম। বাকী কিছু কাজ সেরে নিয়ে কিছুক্ষণ পর রনজিৎ স্যার বললেন - 'চল এবার যাওয়া যাক। সবাই লাইন করে আসবি। কেউ লাইন ভাঙবি না। আর সবাইকে একটা বিশেষ স্কুলের নাম লেখা টুপি দেওয়া হবে। সেটা সবার মাথায় যেন থাকে। বোঝা গেছে। এবার লাইন করে আস্তে আস্তে আয় '। ১৬ জন স্যার আর ৬৫জন ছাত্র মিলে আমাদের দল চলতে শুরু করলো। সে এক আলাদা অনুভূতি। পিঠে রুকস্যাক নিয়ে আমরা লাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর গোটা হাওড়াবাসী তাকিয়ে দেখছে। নিজেকে ফেলুদা - ফেলুদা মনে হচ্ছিলো। যেন অভিযানে চলেছি। 

স্টেশনে গিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন ৬-৩০ বাজে।
রাকেন্দু স্যার বললেন -' কারোর কিছু কেনার থাকলে কিনে নে। আর কিছুক্ষণ পরেই আমরা ট্রেনে উঠবো। ' আমার সব কেনাই ছিলো। বলে দেওয়া হয়েছিলো খাবার তো দেওয়া হবে কিন্তু ছোটো খাটো কিছু স্ন্যাক্স আর পরিমাণ মতো টাকা পারলে নিয়ে নিতে। আমার সব ই নেওয়া ছিলো। তাই বাবা, দাদা আর মাকে প্রণাম করে ট্রেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার সময় মায়ের মুখে যে উচ্ছ্বাস টা ছিলো আমি ট্রেনে ওঠার পরেই সেটা হারিয়ে গিয়েছিলো। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম অনেক বার ' কি হলো মা হাসছো না কেন ? ' কিন্তু আজ ভালোই বুঝতে পারি সেই বিষণ্ণতার কারণ। দেখতে দেখতে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো। বাবা , মা কে জানলা দিয়ে টাটা করতে করতে ট্রেন আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। 
কিছুক্ষণ কাটার পর সুব্রত স্যার এসে বললেন ' যে যার টিকিট নাম্বার অনুযায়ী বার্থে বসে পড়। আর ব্যাগ, জুতো সব সাবধানে রাখিস। আমি পাশের বগি থেকে দেখে আসছি। ' আমাদের সবাই তিন টে বগি মিলিয়ে রিসারভেশান পেয়েছিলাম। সেই অনুযায়ী বসা হলো। স্যার রা ভাগ করে প্রতি বগিতে রইলেন। টেন দ্রুত বেগে এগিয়ে চলেছে। রাত ৯-৩০ নাগাদ আমাদের ডিনার দিয়ে দেওয়া হলো। স্যাররা বললেন 'খুব সকালে পৌঁছাবো আমরা। তো খেয়েই শুয়ে পড়বি। নাহলে ট্রেনে রয়ে যেতে হবে। ' কিন্তু আমাদের মতো আড্ডাপ্রিয় রা একসাথে হলে ঘুমও ভয়ে আসতে চায় না। তাই আড্ডা, লুডো খেলা, চোর পুলিশ চলতে লাগলো। আর এসব করতে করতে রাত ২-৩০ টে বেজে গেলো। আমরা হাসছি, হঠাৎ দেখি রনজিৎ স্যার উঠে এলেন। এসে বললেন ' অনেক হলো, এবার তো শুয়ে পড়। নাহলে শরীর খারাপ করবে। ' আমাদের সবার ফেভারিট স্যার উনি। তাই কথা না বাড়িয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লাম। ভোর ৭-৩০ নাগাদ ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছালো। তাপমাত্রার এতটা ফারাক হবে বোঝা যায়নি। তাই কাঁপতে কাঁপতেই ঝপাঝপ শীতের পোশাক গুলো পরে নিলাম। তারপর ওয়েটিং রুমে যাওয়া হলো। ওভারব্রীজ দিয়ে ওয়েটিং রুমে যেতে যেতেপ্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাই ফোটো তুলতে ব্যস্ত তখন। কিন্তু আমার সে ইচ্ছে নেই। প্রাণভরে দেখতেই থাকলাম। সৈকত বললো 'কি রে ছবি তুলবি না?' তখন খেয়াল হলো ক্যামেরাটা এনেছি যখন ফাঁকা নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না তাছাড়া দাদা বলে দিয়েছে 'ভালো ভালো প্রচুর ছবি তুলে আনবি।' তাই লেগে পড়লাম।ক্লিক করতে। কিছু ছবি তুলে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে বুক করা গাড়ি চলে এসেছে। জিপ। আমরা একে একে গাড়িতে ব্যাগ তুলতে লাগলাম। মোট ৮ টি গাড়ি ছিলো। আর প্রতি গাড়িতে আট জন করে ছাত্র আর দুজন করে স্যার। সব ব্যাগ উঠে যাওয়ার পর। গাড়ি চলতে শুরু করলো ডুয়ার্সের উদ্দেশ্যে।

আমরা চারজন বসেছিলাম পিছনের সিটে। আর ঋক রা বসেছিলো মাঝের সিটে। যেতে যেতে চারপাশের সবুজ পরিবেশটা মন টাকে সতেজ করে তুলছিলো। আমি আর আর্পণ রাস্তারটার ভিভিও করতে থাকলাম। মাঝে কিছু স্ন্যাক্স ও চলছিলো। দু ঘণ্টা চলার পর আমরা বুক করা হোটেলে এসে পৌঁছালাম। হোটেলের নাম সোনার বাংলা। গিয়ে সেদিন ঘর অ্যালট হলো। প্রতি রুমে চার জন করে। আমরা - আমি, শিবায়ণ, কিঞ্জল আর অর্ণব একসাথে ছিলাম। রুমে গিয়ে একটু বসে স্নান করে নিলাম। জলে স্পর্শ করা মাত্রই সারা শরীরে কারেন্ট বয়ে গেলো। জানতে পারলাম তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি, রাতে আরও কমে যায়। জানুয়ারি মাস কাজেই এটাই স্বাভাবিক। দুপুরবেলা হোটলের ই রেসুরেন্টে একসাথে খাওয়া হলো। তারপর স্যার রা বলবেন ' এখন একটু রেস্ট নিয়ে নে, বিকেলে সাইড সিনে যাওয়া হবে।' গিয়ে রেস্ট নিয়ে ৩-৩০ নাগাদ আমরা বেরোলাম। কারণ তাড়াতাড়ি সূর্য ডোবে, তার আগে ফিরে আসতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে লাগলাম চারপাশ। ঈশ্বর যেন বড়ো যত্ন করে সাজিয়েছে চারপাশটা। শহরের ঘিঞ্জি আবহাওয়া থেকে দূরে এহেন পরিবেশে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে নিজেকে বেশ বড়ো মনে হচ্ছিলো। ফিরে এলাম তখন ৭-৩০ বাজে। সেদিনকার মতো খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। কারণ সব্বাই খুব টায়ার্ড ছিলো।



পরের দিন সকালবেলা আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুলতানেখোলা আর সামসিং র উদ্দেশ্যে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই মন এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করলো। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে আর সবুজে ঘেরা জায়গায় আমরা বন্ধুরা একসাথে ছবি তুলতে লাগলাম। 

সবাই একে অপরের সাথে ছবি খুনসুটি চলতে লাগলো আর চললো প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে উপভোগ করা। ওখান থেকে আমরা গেলাম তিস্তা নদীর তীরে। কনকনে বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিস্তার বয়ে যাওয়া আপন মনে দেখছিলাম আমি আর পিকরব, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তারপর ২-৩০ নাগাদ ফিরে এলাম হোটেলে। সেদিন রাতে সাঁওতাল নৃত্য পরিবেশনের কথা ছিলো। তো এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমাদের রুমে সবাই এলো আর আড্ডা শুরু হলো। ৭-৩০ নাগাদ শিল্পীরা চলে এলেন। আমাদের নমস্কার জানিয়ে তারা নাচ শুরু করলেন। কি সুন্দর তালের সেই গান আর নাচ না দেখলে বোঝানো যাবে না। দেখতে দেখতে আমরাও নাচতে শুরু করলাম। বাইরে তখন ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। অনুষ্ঠান শেষ হলো তখন রাত ১১-৩০ টা বাজে। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। পরের দিন জলদাপাড়া যাওয়ার পালা। 

পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। জঙ্গলের সামনে পৌঁছানোর পর আলাদা সাফারি ভাড়া করা হলো। প্রত্যেক সাফারিতে এক জন করে স্যার আর ৬ জন ছাত্র। চলতে শুরু করলো গাড়ি। আস্তে আস্তে আমরা জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছালাম। প্রথমেই একটা সুন্দর ময়ূর দেখে প্রাণ টা ভরে গেলো। আমি, পিকরব, অর্পণ, শিবায়ণ, শুভদীপ আর দেবকুমার ছিলাম। আর আমাদের সাথে ছিলেন রণবীর স্যার। বায়োলজির স্যার। কাজেই আমাদের সব বোঝাতে বোঝাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু হঠাৎ ই ঘটলো সেই অঘটন। গাড়ি খারাপ হয়ে গেলো আমাদের। ড্রাইভার বললেন অনেকটা সময় লাগবে। ওদিকে বাকী গাড়ি গুলো অনেক এগিয়ে গেছে। আর জঙ্গলের মধ্যে মোবাইলে টাওয়ার ও পাওয়া যাচ্ছিলো না। স্যার বললেন ' তোরা নেমে আয়। একটু আসে পাশে ঘুরে আসি। এভাবে তো আর বসে থাকা যায় না।' আর ড্রাইভার কে বললেন ' তুমি ঠিক হলে ডেকে নিও। আমরা কাছেই আছি। ' হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যেতেই আমরা দুটো বাইসন দেখতে পেলাম। আর ছবি তুলতে থাকলাম। আর কাছেই নানা গাছপালা দেখতে লাগলাম। ওদিকে স্যারের টেনশান বাড়ছে। গাড়ি ঠিক হচ্ছে না। আমাদের মতো ছয় জন ছাত্র কে নিয়ে তিনি একা। বেলা হয়ে আসছে জঙ্গলের মধ্যে। হঠাৎ রনজিৎ স্যারের ফোন এলো রণবীর স্যারের কাছে ' তোরা কোথায় ? অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে পাচ্ছিলাম না। এখন পেলাম। ' রণবীর স্যার সব ঘটনা বললেন। আমরা ততক্ষণে নানা রকমের পাখি, গাছপালা, পতঙ্গ দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিচ্ছি। এদিকে বেলা হয়ে আসছে। অবশেষে দু - ঘণ্টা পর গাড়ি ঠিক হলো। আস্তে আস্তে আমরা এগোলাম। অনেকটা যাওয়ার পর যেখানে সবাই অপেক্ষা করছিলো সেখানে পৌঁছালাম। সব স্যার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু তখন আমরা বাকীদের কাছে হিরো। অ্যাডভেঞ্চারের নানা গল্প সাতরকম রঙ মিশিয়ে শোনাতে লাগলাম সবাইকে আর সবাই জ্বলতে শুরু করলো। ব্ল্যাক 'প্যান্থার দেখেছি ' এই বিখ্যাত ঢপটাও অনেকে বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। মিলিত হওয়ার পর এক জায়াগায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। ওখানে নাকি গন্ডার জল খেতে আসে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর এলেন তিনি। আমরা দূর থেকে দেখলাম তাকে। তারপর যখন হোটেলে ফিরলাম সবার অবস্থাই খুব খারাপ। কোনো রকমে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম।



অবশেষে যাওয়ার দিন চলে এলো। যথারিথী সবার খুব মন খারাপ। বিকেলের ট্রেন। সকাল বেলা চেক আউট করে বেরিয়ে গেলাম আমরা। যাওয়ার আগে হোটেলের কিছু ছবি তুলে নিলাম। ট্রেনে ওঠার পর থেকে আড্ডা শুরু হলো। স্যার কে বললাম 'স্যার শেষ দিন। আজ আর শুতে জোর করবেন না প্লিজ। ' স্যার রাজি হলেন। সারা রাত উদুম আড্ডা চলল। সবাই আমরা এক ই বগিতে সেদিন। রাতে জানা গেলো ট্রেন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লেট যাচ্ছে। তাই সকালের খাবার কিনেই খেতে হলো। হাওড়া স্টেশন পৌঁছালাম তখন বিকেল ৪-৩০। বাবা নিতে এসেছিলো বাইক নিয়ে। স্যার রা দেখা করার পর ই তবে যেতে দিলেন। সব্বাইকে টাটা করে বাবার বাইকে বসে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। আর নিয়ে ফিরলাম বেঁচে থাকার জন্য কিছু সুন্দর ফুলে মোড়া স্মৃতির কোলাজ।

0 comments: