0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



২০ 

...‘দেখ রে, যা বললাম পাঁচ কান যেন করিসনি নিরূপ!’ সুনয়না হাঁপাতে থাকেন। নিরূপ হাসে... ‘আচ্ছা, সে নাহয় কাউকে বলব না, কিন্তু কাকিমা, তুমিই বা রাতদুপুরে ছাতে দাঁড়িয়ে আছ কেন? জানো আমি আরেকটু হলে তোমাকে শাঁকচুন্নি ভাবছিলাম।’ 

---‘হুঃ সে রকম চেহারা নাকি আমার? এই বিশাল চেহারা দেখলে সব ভূতপ্রেত পালিয়ে যাবে। কি করব বল, যা গরম পড়েছে এবার। এমনিতেই আমার ঘুমের সমস্যা, আজকাল ওষুধ খেলেও কাজ হয়না। ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাঝেমাঝেই রাতে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করি, তারপর আবার বিছানায় যাই। তাতে অনেক সময় কাজ হয়।’ 

--‘হুমম, কিন্তু কাকিমা, তুমি আমাকে যেকথাগুলো বলেছ, এগুলো যে ভারি তুচ্ছ কথা। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা যে মা এইজন্য কেন বাড়ি ছেড়ে হুগলীতে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো?’ নিরূপ মাথা চুলকায়। সুনয়নাও মাথা ঝাঁকান,... ‘সেটাই ত! সেজন্যই বলছি, আমাকে একটিবার নিয়ে চল রে হুগলীতে। তোর কাকা নিয়ে যাবেনা সেটা বুঝে গেছি। আমার পেটের ছেলেও নিয়ে যাবেনা। নয়ন ভয়ে মরে ইচ্ছে থাকলেও। একমাত্র তুই নিয়ে গেলে হবে। তোর কাকার আমার যাওয়া না-পসন্দ, তবুও তুই সাথে থাকলে কিছু বলতে পারবেনা। আমি একটিবার দিদির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিরে আসার কথা বলব। দরকার হলে পায়ে পড়ব। যখন বাড়িতে এসব ঘটে, আমি ছিলাম না। আমি বিয়েশাদী নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আমার বাপের বাড়ি নাগপুরে। ফিরে এসে দেখি ওরা চলে গেছে। দিদি ছাড়া কীভাবে আমি আছি এবাড়িতে কাউকে বোঝাতে পারব না। একটা মনের কথা বলার লোক নেই। শুধু দেবলা আর ঠাকুরঘর। দিদি চলে যাওয়াতেই আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি রে। আর তোর কাকার টেম্পার দিন দিন বাড়ছে। আমাকে একটিবার নিয়ে চল নিরূপ।’ সুনয়না ফুঁপিয়ে ওঠেন।

নিরূপ ভেবে পায়না এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবে সে। দেবলা এবং কাকিমা দুজনেই তার সঙ্গে হুগলী যেতে চাইছে। এছাড়া কাকিমা যা যা বলছে সেসব যদি সত্যি হয়... তাহলে সেইসব কারণে কেউ বাড়ি ছেড়ে যায়না। কিন্তু মা আর বাবা গেল কেন? দেবলার কথা শোনা হলনা তার। কাকারও নাকি কিসব কথা আছে। নাহ দুদিনের জন্য দেখা করতে এসে সে বেকার সাংসারিক কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে। নিজের উপরে কিরকম রাগ হয় তার। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করেনা সে। সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে সুনয়নাকে বলে, ‘আচ্ছা বেশ, দেখি কি করা যায়! এখন নাহয় তুমি একটু শুয়ে পড় কাকিমা!’

‘আচ্ছা, বেশ, যাচ্ছি। কিন্তু নিয়ে আমাকে যাবিই তুই।’... বেশ জোরের সঙ্গে কথাকটি বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে যান সুনয়না। 

নিরূপ দাঁড়িয়ে থাকে একা ছাতের মাঝে। গভীর রাতের আকাশে দিকে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে সব প্রশ্নের উত্তর। সে কি নিজেই প্রকারান্তরে দায়ী এসবের জন্য? সে যদি ঠিকঠাক গুছিয়ে আইয়মের সঙ্গে সংসার করতে পারত, যদি একটা অদ্ভুত ইনসিক্যুরিটিতে ভুগতে ভুগতে ওরকম ইম্পালসিভ একটা কাণ্ড করে ছোট্ট নীরুকে তার মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে না আনত, তাহলে হয়ত এসব কিছুই ঘটত না। কি এমন হয়েছিল? যার সঙ্গে ছোটবেলায় ঠিক ছিল আইয়মের বিয়ে হবার, সেই ছেলেটা ফিরে এসেছিল পাড়ায়। এসেছিল, কিন্তু আইয়ম কি তাতে উতলা হয়েছিল? না, তা ত নয়। ছেলেটা এসে বিশ্রী ঠাট্টা করেছিল নিরূপের সাথে, বলেছিল তাকে আর আইয়মকে পাশাপাশি দেখে মনে হচ্ছে একটা ছুঁচো আর রাজহংসী। বলা বাহুল্য আইয়ম রাজহংসী আর নিরূপ ছুঁচো। নিরূপ হেসে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেও পারছিলনা। ছেলেটা এসে নিরূপকেই বোঝাবার চেষ্টা করছিল যে ওরা, মানে পাহাড়ের লোকেরা, সমতলের মানুষদের কতটা ঘেন্না করে এবং কেন করে। সমতলের মানুষরা শঠ এবং সুযোগসন্ধানী, বারে বারে বলছিল আইয়মের ছোটবেলার বন্ধু লিংডো। আইয়ম একটু গম্ভীর হয়ে তারপর চেঁচিয়ে কি যেন বলেছিল ছেলেটিকে ওদের ভাষায়, পুরোটা বোঝেনি নিরূপ। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিল যে আইয়ম ওর বন্ধুর কথায় খুশি নয়। কেন তাও নিরূপের মনের মধ্যে কাঁটা খচখচ করছিল? সে কি আইয়মকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না? সেটা কি ওর ভাষা বোঝেনি বলে? নাকি সে নিজেও ভাবছিল যে আইয়মের ঐ অদ্ভুত অলীক সৌন্দর্যের পাশে তাকে ঠিক মানায়না! হয়ত ওদের প্রেমপূর্ণ দাম্পত্যের মধ্যে প্রথম অসুখের বীজ আইয়মের ঐ ছোটবেলার বন্ধুটি বয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর একদিন আইয়ম নিজেই বলেছিল যে সে নিরূপের সাথে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু নিরূপ তখন আইয়মকে নিয়ে কলকাতাতেও আসতে পারছিল না, কারণ তখনো অরূপের মৃত্যুর একবছরও পূর্ণ হয়নি। দাদা-বউদি ওরকম একটা এক্সিডেন্টে মারা গেলো আর সে নিজে বছর না ঘুরতেই বিয়ে করে বসলো? লোকে কি বলবে? এই ভাবনাতেই সে আসতে পারছিলনা কলকাতায়। মা-বাবাকে জানিয়েছিল বিয়ের কথা। মা প্রথমে এই তাড়াহুড়োতে একটু অসন্তুষ্ট হলেও দুদিন পরেই আবার বলেছিলেন বউমাকে নিয়ে যেতে, কারণ তিনি আশীর্বাদ করতে চান। কিন্তু সে নিজেই চাইছিল অন্তত একবছর যাক, তারপরে যাবে। ব্যস, তার মধ্যেই আইয়ম সন্তানসম্ভবা হল এবং নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিল সে। কি করে নিরূপ তখন নিয়ে আসতো আইয়মকে? আইয়মের আত্মীয়রা তার অসুস্থতার জন্য ঠারেঠোরে যেন নিরূপকেই দায়ী করছিল। এমনকি এই কথাও বলেছিল যে পাহাড় আর সমতলের মিলন ভারি মুস্কিল কাজ, এই মুস্কিল কাজ করার চেষ্টা তারা করেছে বলে ভগবান ভারি রুষ্ট। সেজন্যই আইয়মকে অত ভুগতে হচ্ছে। নইলে তাদের গ্রামের বউরা কত বাচ্চা বিয়োয়, কারও কোনও জটিলতা হয়না ত! নিরূপ বাইরে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল রাগে। আইয়ম একদিন অনেক করে বুঝিয়েছিল তাকে যে এরকম বোকা বোকা কথা অনেকেই বলে, কারণ তাদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই রূপ-গুণ-বিদ্যা-বুদ্ধি এসবের জন্য আইয়মকে হিংসে করে। তাছাড়া আইয়মের মা মারা গেছে অনেকদিন এবং আইয়ম পরিবারের একমাত্র মেয়ে বলে তার মায়ের একটা বিরাট সম্পত্তির মালকিন হতে চলেছে, সেজন্য মানুষের হিংসে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, নিরূপ যেন এগুলো নিয়ে মাথা না ঘামায়। আর কিইবা বলতে পারত সে? আসলে নিরূপ নিজেই মানিয়ে নিতে পারছিলনা। প্রতি পদে পদে লোকে কি ভাববে, এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সে সমাজের সব লোকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল, তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। এসবের মধ্যেই নিরূপের ট্রান্সফারের অর্ডারটা এসেছিল। 





0 comments: