0

ছোটগল্প - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


ছোটগল্প


মাউস মার্কেট 
উত্তম বিশ্বাস 


স্বচ্ছ অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মিতুল। রঙিন পাখনাওয়ালা মাছগুলি ঘুরেফিরে কাঁচের দেওয়ালে একই জায়গায় এসে যেন ঠোক মারতে থাকে। কী পায় ওখানে ওরা? হরেক চিন্তা মিতুলের মনের মধ্যে ঝিম মেরে ওঠে! এসব দিকে মোটেও আগ্রহ নেই অর্পণের। ঘুম থেকে উঠেই চা ব্রেকফাস্ট হোক আর না হোক, আগে তাকে নিউজফিডে যাওয়া চাই! ফেসবুক, হোয়াটসয়া্‌ চ্যাট, নোটিফিকেশানে বেলা খেয়ে নেয় অনেকখানি। মিতুল মুখে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে বাসনের ঝাকা ফেলে দেয় মেঝের ওপর। অর্পণ বুঝতে পারে রান্নাঘরের আগুন হাতের কাছে বাঞ্ছিতকে না পেয়ে গড়িয়ে আসছে বিছানার দিকে। অগত্যা বাজারের থলেটা নিয়ে গোখরো সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে! 

‘মাছ-বাজারের মানুষগুলো কোন গ্রহ থেকে আসে কে জানে! পেট তো নয় যেন এক একটা প্যাঁচানো শামুক। এমনিতেই ওদের গায়ের পাশ দিয়ে সাইড নিতে গেলে ভক করে নাকে এসে লাগে। তারপর আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দর কর, লেজ ধরে টেনে টেনে বরফের ঝুড়ি থেকে বার কর; কানকো খুঁচিয়ে দ্যাখ ফুলকোটা ফ্যাকাশে কি লাল---ধেত্তেরি ডিসগাস্টিং! অফিসপাড়ার পুরুষগুলোও কেমন যেন মেনিমেনি গোছের; দ্যাখ দিব্যি ক্যামন পাজামা চাগিয়ে আঁশটে জল ঠেলতে ঠেলতে একবার এ ঝুড়িতে, একবার ও ঝুড়িতে কেমন সব ছুকছুক করে আঁশটের গন্ধ শুকছে। মুঠোতে মাউস থাকতে এইভাবে কেউ ঘোল ঘেটে মার্কেট করে নাকি?’ খোলাবাজারে কেউ তাকে যেতে বাধ্য করলেই যত প্রকারের বিশেষণ সবই এইসব মানুষদের ওপর ঝাল ঝেড়ে কিছুটা হালকা হবার চেষ্টা করে অর্পণ।এবার সে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল। শর্ট-কাট কিছু একটা উপায় বার করতে হবে এবার। মাংসের দোকানের পাশে দাঁড়ানো যায় না; উটকো চামড়া পচা স্মেল, রুমাল ফুটো হবার উপক্রম। সবজি বাজার সে তুলনায় স্বর্গ; ঢুকলে শেকি ভাবটা কিছুটা হলেও রিমুভ হয়। 
‘‘বেগুন কত?’’
‘‘স্যার কালোটা চল্লিশ, কাঁটা মাকড়া পঞ্চাশ।’’ অভ্যাস নেই। হাতের আন্দাজে পোকা-বেগুন কিভাবে বাছবে অর্পণ?
‘‘স্যার এভাবে বেগুনগুলো টিপছেন? অন্য কাস্টমার এলে ও আর নেবে কেউ?’’ অর্পণ ভেবে অবাক হয়, ‘‘কাঁচা কারবারিদের বহুত তেল বেড়ে গেছে; ভদ্রলোকের সাথে কতটুকু দুরত্ব রেখে কথা বলতেহয় সেটুকুও আর খেয়াল থাকছে না ওদের’’। হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে বেগুন। মাল পছন্দ না হলে খদ্দেরকে দোকানের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে নেই,---এটা একপ্রকার অলিখিত নিয়ম।অর্পণ সরে দাঁড়ায়। পাশের রসুন বিক্রেতার একেবারে ছাড়ানো হাসি উড়ে এল বেগুনওয়ালার ঝুড়িতে,‘‘বুঝলেন নগেন’দা, ওসব হল রাতের ঘাটতি। কচি কুচকুচির স্বাদ সব কি আর বেগুনে পোষায়!’’

বাইরে বেরোলে খানিকটা হাঁটাও হয়; ডাক্তার বলেছেন প্রেসার হাই। তাছড়া অনলাইনে যেদিন থেকে পুঁটে ময়রার রুমালি রুটি আর ছ্যাদোর মায়ের দোকানের ঘন দুধের ধোঁয়া ওঠা চা অর্ডারেই এসে যাবে; সেদিন থেকে অর্পণকে আর বাইরে না বেরুলেও চলবে। 





‘‘এবার একটু ওঠ ডানা। মারাত্মক অ্যাডিকশানে ডুবে যাচ্ছিস কিন্তু। কাল রাতে ট্যাবটা কেড়ে নিল তোর বাপি; আজ সকাল হতে না হতেই অমনি কম্পিউটারে বসেছিস? পাঁচটা বন্ধু বান্ধবের সাথেও তো মেলামেশা করতে পারিস না কী!’’
“সত্যি করে বলো তো মম, তুমি কি কাউকে স্পেস দাও? তাছাড়া বাইরে গেলেও তো বাপির স্ট্যাটাসে আটকে যায়!’’
“আমার কিছু শপিং আছে। ওঠ। এইবার আমি বসব।‘’ মুঠোর মধ্যে মাউসটা চেপে ধরে ডানা তার ভ্রুযুগল সিঁধ-কানহ ভঙ্গিতে খানিকটা খেলিয়ে মিতুলের দিকে তাকাল,--‘‘ওফ মম! ইউ আর সোওওওও--- আরোগ্যাণ্ড! ভাইয়ের পেছনে ত এমন গোয়েন্দা হয়ে ঘোর না? ওয়েট প্লিজ। জাস্ট হাফ আন আওয়ার। কিছু বুক-ফেয়ার ফেস্টিভ্যাল স্পেশাল আপলোড করেছিলাম; প্রচুঊঊঊঊঊ----র কমেন্টস এসছে । আমার শর্ট স্কারটটা দেখে নাক ভাজ করেছিলে তো? এবার দ্যাখ। মম, তুমিও না কেমন ঠাম্মা ঠাম্মা হয়ে যাচ্ছ। দেখি, তোমার পিম্পিলটা----অরিষের নাইট মইসচারাইজারটা অর্ডার দেব?’ কথাটায় আমল দেয় না মিতুল, ডানা সাংঘাতিক ক্লেভার। এক হাত থেকে অন্য হাতের মুঠোয় সুয়িং করে মাউসটা। কাজের মেয়েটা না আসলে অস্থির হয়ে ওঠে ডাইনিং-কিচেন।তখন ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় রাইস-কুকারে দুমুঠো ফোটাতেই হয়; প্রবাসী মনের ঘরে দোটানার সিটি পড়ে ঘন ঘন। মিতুল ঢুকে যায় পরিচিত উইমেন্স মার্কেটে।--শাড়ি, ব্রা হোসিয়ারি,কসমেটিক, সু। কিন্তু মনের ভেতর তার বড্ড খচখচানি, ‘ডানা এতক্ষণ নেটে বসে কোন কোন সাইটগুলো সার্চ করল কে জানে! একালের কাকগুলোও ভীষণ ফেরেব্বাজ; বাটিতে ঠোক মেরেও দিব্যি কেমন পাত্রটা ঝাঁকিয়ে সমান করে যায়। বিরাট বাজার। কিচেনে আভেন জ্বালিয়ে এখানে ঢুকলে কি আর হয়!—‘‘ইস! অ্যাডগুলো কী সব বিশ্রীভাবে দিয়ে রেখেছে। ডানা নিশ্চই এখানেও ঢু মারছে। আজ আসুক ওর বাপি অফিস থেকে; ম্যাট্রিমনিতে ইমিডিয়েট একটা ফাইল খুলতে বলব!’’ 





বাবুর বাড়ির লোক সেধে কথা বললে কাজের লোকেদের কদর বেড়ে যায়। কুটনো কাটতে কাটতে কিভাবে মোক্ষম কূটনৈতিক চালটা দিতে হয়, ওরা ভালোরকম জানে। কথা লাফিয়ে চলে লাউডগার মত। 
‘‘না রে কানন। বহুদিন আর নিউমার্কেটে যাওয়া হয়ে ওঠে না। কোন দোকানে কি পাওয়া যায় তাও ভুলে গেছি।‘‘
‘‘বাজারটা এখন কি দারুণ সাজিয়েছে বৌদি। এই তো আপনাদের বাড়িতে কাজ সেরে, সন্ধ্যায় ওখান থেকেই কেনাকাটি করে বাসায় ফিরি। ফুটব্রিজটাও হেব্বি লাগে। এখন আর চিনতেই পারবে না।‘
‘‘মনে পড়েছে, একজোড়া জুতো কিনেছিলাম ওখান থেকে। দারুণ! জুতোজোড়া এখনও আছে; ফেলিনি। হ্যাঁ রে কানন, ব্রিজিটার মাথায় যে ফুচকার দোকানটা ছিল---লোকটা এখনও আসে রে? কী লংকা’ই না একসময় আমাকে খাইয়েছেন ভদ্দরলোক।’’
‘‘হিহিহি! আমি কিন্তু ফুচকা-ওয়ালাদের তেমন পছন্দ করি নে! রাত নেই দিন নেই কেবল চটকাচটকি!’ মিতুল লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। 

‘‘মম! বাপিকে বলনা আমরাও একদিন ফুটব্রিজটায় ফুচকা খাব।-- যাবে?’’
কাজের লোককে সোফাতে বসতে দিলে যা হয় আর কী! রাইতা-রাজভোগের সমস্ত রুচিটাও একসময় সেই লঙ্কা লেবুতে এসেই গুলিয়ে ফ্যালে মেয়েরা। অর্পণ দূর থেকে ডানাকে চোখে চোখে তড়পাল। কানন সামনে আছে। এ যাত্রা বাপিকে ক্ষমা’ই করে দিল ডানা। এবার কানন কলপাড়ে। একটু ফাঁকা।কিন্তু এখনই মেয়ের কথা পাড়লে যদি খেকিয়ে ওঠে অর্পণ? থাক। খেলাতে হবে। আগে টোপ পরে বঁড়শি,----‘অ্যায় !আজকে একটা সিনেমা দেখবে?’ ঘাড়ের স্নায়ু বেয়ে আলতো আদরটুকু এখন অনেক নিচ অবধি গড়িয়ে নামছে। বেশ আরাম অনুভব করে অর্পণ ---‘সিনেমা? কোথায়?’ 

‘‘কেন? নেটে!’’

‘‘ না। তোমার সাথে নেটে মস্তি নেই।‘’

‘ কেন?’’

‘‘কেন আবার! বসলেই তো খানিকক্ষণ বিসর্জন, নয় তো জেন্স ইনার মলে ঢুকে যাবে তুমি।‘’ 

‘‘ছেলেগুলোর ফিগার কী আট্রাকটিভ তাই না?--একদিন তুমিও অমন ছিলে। ফার্স্টফুড খাওয়া কমাও বুঝলে।’’ দু আঙুলের ফাঁকে অর্পণের নাকটা চাপতে আজও ভুল হয় না মিতুলের। এটা তার কাছে ডেইলি রুটিনের একটা পার্ট।





খেতে বসেও আজকাল আর কেউ কারো দিকে তাকানোর অবকাশ পায় না। মুখোমুখি বসা সংসারের সদস্যগুলিও যেন এক এক জন ভিনগ্রহের বাসিন্দা! পাতের খাবার পড়ে থাকে পাতে; শুধু আঙুল আর আসক্তি ঢু’মারে স্যোস্যাল নেট-ওয়ার্কিং আপডেটে। তবু মাঝে মাঝে সোনা যায় সেই আদি অকৃত্রিম শাশ্বত উচ্ছ্বাস ‘মম ইজ গ্রেট! চিকেন কাটলেটটা দারুউউউউন টেস্টি হয়েছে। থাংস মম!’ পিকলু’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ডানা কখনই ধোঁয়া দেয় না। আজ সেও মোক্ষম একটা সুযোগ পেয়ে গেল,‘দ্যাখ ভাই, আজ বাপি নিশ্চই মমের সামনে অঞ্জলির সাইট খুলে বসবে। মম, একটু মডার্ন ফ্যাশনেবল চুজ করো; পরে আমার কাজেও---।’ 

‘‘ডানা! আমার বয়েস বাড়ছে বুঝলে? রাত জেগে জেগে জুয়েলারি মলে অনেক ঘুরেছি, ব্যাস, আর না। সব ঝুটা! সব ঝুটা! এখন মনে হয় কানাগলির বুড়ো শাঁখারু, কিম্বা স্যাকরাও যদি মন থেকে এই হাতখানা আর একবার ধরত--।’’ চোখ দুটো ভিজে আসে মিতুলের। ডানা পিকলু---- দুজনেই প্লেট চেটেপুটে উঠে গেছে যে যার বেডরুমে। অর্পণ তখনও একপিসও দাঁতে কাটেনি।

‘‘কি হল, খাচ্ছ না কেন? প্যাকেজ খাবার নয় বলে? খাও। ট্রাবল হবে না। বলছি তো---।’’ 

‘‘শপিং করল কে?’’

মিতুল উত্তেজনা দেখাল না,’‘কেন? আমি।’’

অর্পণ আকাশ থেকে পড়ল, ‘‘মানে? খোলাবাজারে ঢুকে তুমি আজকাল নিজে নিজে ---? আমি যে এতগুলো সুরুচিতে অর্ডার দিলাম--?’’

‘‘ঘরে নেট-কানেকশান ছাড়া তুমি তো আর কিছুই ধরতব্যের মধ্যে ফেল না। ডাটাপ্যাক ছাড়াও আরও যে কিছু দরকার হয় সংসারে সে হুঁশ আছে তোমাদের? অলটাইম তোমরা কেউ না কেউ মার্কেটে ঢুকে বোল্ড হয়ে আছ। একদম অন্যকে স্পেস দিতে চাও না। আরও যে চারপাশে কয়েকটা প্রাণী আছে, সে খেয়াল রাখ? ঘরের চৌকাঠে বিকিয়ে দিলাম নিজেকে; দেখলাম ত, কোনও মূল্য নেই!---বাধ্য হয়ে তাই খোলা বাজারেই----!’’ অর্পণ বুঝতে পারল, এতদিনে তার পুরনো ফ্লাটের সার্সিগুলো যেন ঝুরঝুর ঝিরঝির করে ঝরতে শুরু করেছে। কিন্তু সব একসাথে ঝরে গেলে তখন তো মুশকিল; পর্দা ফাঁক হয়ে যাবে। পেছন থেকে মিতুলের মেদবহুল কোমরে কৃত্রিম চাপ দিতে দিতে অর্পণ বলল,--‘আমার সাথে তুমিও তো বসতে পার; আমি কি অপোজ করেছি কখনও?’ 

‘‘না! পর্ণ দেখতে আমার ভালো লাগে না। দিনে দশঘণ্টা জগিং করলেও ওই কোমর ওই ফিগার,--ওইসব নোংরা নোংরা পোজিশান আমি তোমার ঠোঁটের ওপর ঢেলে দিতে পারব না। ওরা তো বাজারি। ওদের সামনে বসিয়ে সুকৌশলে না’ইবা আমাকে হেট করলে।’’ ড্রয়িং রুমটা মাঝে মাঝে দারুণ ফাঁকা থাকে, কিন্তু মিতুলের ম্যাড়মেড়ে কথায়, অর্পণের অজন্তা ইলোরা ইচ্ছাটা আজকাল আর বেশিদূর এগোতে চায় না।



ছুটির দিনগুলিতে কম্পিউটার রুমের দরজাটা খোলাই থাকে। তখন আর প্রাইভেসি নিয়ে কারো মনে কোনও খচখচানি থাকে না। এসব দিনে মনিটর স্ক্রিনটারও একটু বিশ্রাম। বড়জোর লো-ভলিউমে মেলোডি কিম্বা ভক্তিগীতি। কোনকোনও দিন খাওয়ার পরে একত্রে মৃণাল সেন। পুরনো অনেককিছুর ওপরেই আলস্যের ধুলো জমে পুরু হয়ে উঠছে। ঘরদোর খটবিছানা, ফ্রিজ আলমারি না হয় কানন এসে দয়া করল; কিন্তু আমাদের পুরনো সমাজ-সংস্কৃতি এসব তো কিছু কিছু এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শেখাতে হবে। তাই মুড অন থাকলে মাউসে ক্লিক হয়---মৃনাল সেন, সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা---কেটে-ছেটে ওদের মগজে যতটা ঢোকানো যায়, সেটুকুই লাভ।



‘‘বাপি।জিওর সিমটা দাও না প্লিজ!’’

‘‘গেল মাসে সুইমিঙে এডমিশান নিলে। শখ মিটে গেল?’’

‘‘ওফ! তুমি না! আমার কোল্ড অ্যালার্জি, জান ত উল্টোপাল্টা ওয়াটার আমার স্যুট করে না।’’

‘‘দিন-কে দিন কুনোব্যাঙ হয়ে ইয়ঠছ, সে হুশ আছে তোমার?’’

‘‘আমার আর্জেন্ট কিছু চ্যাট আছে। দাও না প্লিজ!’’

‘‘শাট আপ! সামনে এগজাম।--- চ্যাটিং!’’ পাশ থেকে মিতুল অস্থির হয়ে উঠল,‘পিকলু ওর ইউএসএর গাইসদের বেঙ্গলি কোচিং করায়। কতদিন ধরে বলছি, ওর হয়ে পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই কর; আজ না হোক কাল ওর বিদেশ থেকে কল আসবে। ফরেনে কত ফলোয়ার ওর, সে আন্দাজ আছে তোমার? আনলিমিটেড ডাটা প্যাক; জিওর সিমটা কেড়ে নেবার কী আছে? বাপ হয়ে তুমি কি চাও ছেলেটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ুক? তোমারই জন্যে দেখছি ওরা অ্যাবনর্মাল হয়ে পড়বে। ছেলেটাকে একটু স্পেস দাও না, নিজে চব্বিশ ঘণ্টা হাবুডুবু খাচ্ছ, সে বেলায়? বয়স তো তোমার কম হল না।’ মিতুল জানে এই কথাগুলো অত্যন্ত অনৈতিক; শুধু সন্তানগুলোর মুখের দিকে চেয়ে, ঘর-বাইরের সাইক্লোন প্রতিরোধে যেটুকু না বললে নয়, তাকে উচ্চারণ করতেই হয়। কেনন একালের আসুখ মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে মিতুল! হাতের মধ্যে মাউসটা ঘামে চটচটে হয়ে ওঠে। অর্পণ চোয়ালের পেশিগুলো খ্যালাতে থাকে,--- মা হয়ে ছেলেকে এইভাবে ঘাড় ধরে ধ্বংসের পথে যেতে বাধ্য করছে। তবে কি সেও কোনকিছুর প্রতিশোধ নিতে চাইছে? কাদের জন্যে এই ঘর সংসার? কী হচ্ছে এসব! কিছুই প্রতিবাদ করতে পারে না অর্পণ। মাউসটা সুয়িং করে মেয়েলী হাতে।





এভাবেই চোরা বালির মধ্যে মুখ গুজে দিয়ে একসময় দিন ফুরিয়ে যায়, রাত আসে। একত্র হতে গিয়েও আবার কোনও এক অজানা কূহোকে আসক্তির আঠা আলগা হয়ে আসে। 
রসুনের খোলার মত পাতলা একটা নাইট অয়্যার পরেছে মিতুল। কম্পিউটার টেবিলে একগ্লাস গরম দুধ রেখে, অর্পণের গায়ের ওপর একটু ঝুঁকে প্রিয় পদার্থের আলতো ঘষা দিতে দিতে বলল,--‘অ্যানিভারসারি স্পেশাল কিছু সার্চ করছ অপু? একটা বাজে। শুতে এসো। অনেকক্ষণ থেকে ওয়েট করছি।’ দুধ-গ্লাসটা ঢকঢক করে শেষ করে ঠোঁটের দুধের দাগটুকু মিতুলের গলার খাঁজে মুছে নিল অর্পণ। তারপর বাঁ হাতটা গুঁজে দিল কানের পাশে ছড়িয়ে পড়া চুলের মধ্যে। হালকা বিলি দিতে দিতে বলল,--‘হ্যাপি ম্যারেজ অয়ানিভারসারি টু ইউ মিতুল!’ মিতুলের বুকের ভেতর এই মুহূর্তে হাজারটা পিজনের হারটবিট শুরু হয়েছে, খুব টের পাচ্ছে মিতুল।

‘‘মাই সুইট ডার্লিং! রেডি হও; আমি আসছি---জাস্ট অ্যা মিনিট।’’ ডানা পিকলু ঘুমিয়ে ঘ’। ঘরবারান্দা জুড়ে ছড়াতে থাকে কেবল নেশা জড়ানো আমন্ত্রণ। এতক্ষণে নিশ্চই মিতুলের খাট রেডি। এবার শুধু অর্পণের প্ররস্তুতির অপেক্ষা। কিন্তু মধ্য বয়সের আসক্তি, শরীর যে সবসময় সায় দেয়, তাও নয়! কিন্তু নেশাটা যে উত্তরোত্তর আগ্রাসী হতে থাকে! মাউসটা অস্থিরভাবে মুভ করতে থাকে,---গুগুল টু ইউসি ব্রাউজার।---নাহ! অজন্তা ইলোরা বড্ড স্থবির; নো মুভমেন্ট। বাৎস্যায়ন--? এখানেও গুচ্ছগুচ্ছ থিওরি। ওফ শেট! অস্থির মাউসের অ্যারো এশিয়ান থেকে এরাবিয়ান,-- জাঙ্গল টু সুইমিংপুল; ডগি স্টাইল থেকে হর্স---- অ্যানাল---- ‘ইয়েস! ইয়েস! ওরাল! ওরাল! চার্মিং লাগোছে, দারুণ ওয়ারমিং লাগছে!’ রাত গড়িয়ে আড়াইটে। ‘পাঁচ মিনিটের মুভি লোডিং হতে এত সময় লাগে, ডিসগাস্টিং! ওয়াও হট অ্যা হ্যাণ্ডসাম গাই! মিতুল কি ঘুমিয়ে পড়ল?---‘মিতুল -----!----অ্যাই মিতুল----!’
খিদে মাখানো ঘুম নিয়ে হাজির হয় মিতুল। শরীরটা টলছে। তবু এমন দিনে পৃথিবীর সব মেয়েদেরই উর্বশী হতে হয়, ‘খাটে যাবে না? এখনেই?’’

ততক্ষণে শাট ডাউন হয়ে গেছে মনিটর ইউনিট। অন্ধকারে অর্পণের রেসপন্স মিনিংলেস লাগে মিতুলের কাছে। টেবিলের ওপরে রাখা মোটা কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো যুগল ছবিটা মেঝেতে আছাড় মেরে ভেঙে ফ্যালে মিতুল। ককিয়ে কাঁদতে গিয়েও গলা ধরে আসে তার!

‘‘কষ্ট পাচ্ছ মিতুল? কেন এমন হয়ে যাচ্ছি বল ত?’ নিজের কাছে নিজেকেও যেন ঘেন্নার পাত্রী বলে মনে হয় মিতুলের। এই মুহূর্তে পা’ সরাতেও তার দারুণ কুণ্ঠা! অর্পণ অস্থিরভাবে হাত বাড়িয়ে দেয় মিতুলের দিকে। পাথর সরিয়ে মিতুল জানতে চেষ্টা করে, ‘‘কোথায়?’’
‘‘খোলা আকাশের নীচে, ছাদে---যাবে?’’ 


মিতুলের হাতে হাত রেখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে অর্পণ! ছাদের দরজা খোলা। ভোর হয়ে এল বুঝি। এ কী! খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আরও দুটি ছায়ামূর্তি,--- পিকলু আর ডানা?! ওরাও আজ অজ্ঞাত এক আলোক উৎসের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে,----একদম শূন্য হাত!

0 comments: