প্রবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
সিঁদুরে মেঘ ও হরিপদ কেরানি
শিবাংশু দে
ছোটোবেলায় প্রতি রথযাত্রায় নতুন পালার নতুন চমক সিরিজে 'সিঁদুর দিওনা লেপে', টাইপ নামের ছড়াছড়ি থাকতো। ‘নামভূমিকা’য় লাস্যময়ী নায়িকা। অন্যদিকে কোনও মিহিগুম্ফ নায়ক। তৎসহ কিশোরকুমার, "...হাটবাজারে শাঁখাসিঁদুর অনেক পাওয়া যায়/ কপালে থাকলে পরে তবেই পরা যায়...." শাঁখা ও সিঁদুরের এই দ্বৈত বাদ্যবাদন থেকেই মেয়েদের প্রোফাইল নির্ধারিত হয়ে যেতো সেকালে। এখনও হয় অনেক জায়গায়।
আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সংস্কৃতিতে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক রং, যাদের earth colours বলা হয়, তার বিশেষ তাৎপর্য আছে। হলুদ, লাল ও দুটির মিশ্রণে, গৈরিক। সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকে আমাদের 'ধর্ম'সংস্কৃতিতে এই রংগুলি 'পবিত্রতা'র চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হরিদ্রা ও সিন্দূর, এই দুটি ভেষজ রঞ্জক ব্যতিরেকে কোনও 'ধর্মীয়' অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হতোনা সেকালে। একালেও সেই ট্র্যাডিশন অচল হয়ে যায়নি। 'বিবাহ' নামক অনুষ্ঠানটিতে হলুদ ও সিঁদুরের ব্যবহার অন্য সমস্ত সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো'ই সুলভ। এদেশে লাল রংটি আবহমান কাল ধরেই প্রেয় ও পবিত্র মনে করা হয়। লক্ষ্য করার বিষয়, টোটেমভিত্তিক যেসব প্রধান দেবতা আমাদের দেশের সর্বত্র বিশেষভাবে পূজিত হ'ন, যেমন গণপতি বিনায়ক বা পবনপুত্র মারুতি, তাঁরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সিঁদুরে আলিপ্ত থাকেন। অন্যপক্ষে শাক্ত সাধনপদ্ধতি ও দেবীপূজার যাবতীয় অনুষ্ঠানে সিঁদুরের ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। বৈদিক ঐতিহ্যে লাল রঙের সমূহ ব্যবহার থেকে স্বতন্ত্র হবার জন্য শাক্যমুনি শুদ্ধ লাল ছেড়ে ভিক্ষুদের হলুদ বা কাষায় রঙের উর্দি ব্যবহার করতে বলেছিলেন। কারণ তাঁর কালে যোগী বা যাজকরা রক্তিম চীবর পরিধান করতেন। কিন্তু তাঁর ভক্তরাও শেষ পর্যন্ত হলুদ রঙে টিকে থাকতে পারেননি। হলুদের সঙ্গে লাল মিশিয়ে গৈরিক বা জাফরানি রঙে নিজেদের রাঙিয়েছিলেন মহাযান পদ্ধতি বিকশিত হবার পর। অতএব বিবাহ অনুষ্ঠানের সঙ্গে রক্তিম রঞ্জক বা সিঁদুরের যোগাযোগ মানেই বিজয়ী ধর্ষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্ত্রীধনকে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রচলিত মিথটির সত্যতা বিশেষভাবেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে ।
এই মিথটির উল্লেখ অনেকেই করে থাকেন। সিঁদুর আসলে , বিজয়ী পুরুষের অধিকৃত নারীর শরীরে এঁকে দেওয়া রক্তনিশান। সিলমোহর। এই তত্ত্ব একথাও বলে যে নারীর যাবতীয় অলঙ্কারও তাকে বেঁধে রাখার জন্য পুরুষের আবিষ্কৃত বেড়িশৃঙ্খলের নব্যরূপ। এই তত্ত্বটির উৎস প্রাগৈতিহাসিক কিছু সামাজিক নিয়ম। বৈদিক যুগে আটরকম বিবাহপদ্ধতির কথা আমরা জানতে পারি। এইসব বিচিত্র বিবাহপদ্ধতিকে যখন সামাজিক স্বীকৃতি দেবার কাজ শুরু হয়, তখন বলপূর্বক নারীহরণ ও বিবাহকে 'রাক্ষস' বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। এই বিবাহ সচরাচর অনার্য-আর্য, অনার্য-অনার্য বা কোনও স্থলে আর্য-আর্য বিবাহের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হতো। অর্জুনের সুভদ্রাহরণ এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু রাক্ষসবিবাহের নথিভুক্ত সারণীতে যদিও আর্যসভ্যতা সিঁদুর বা পরাজিতের রক্ত ব্যবহারের কোনও উল্লেখ করেনি তবুও ধরা যেতে পারে এই প্রথা আর্যসভ্যতার বাইরের লোকসমাজে হয়তো প্রচলিত ছিলো । উত্তর-পশ্চিম থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা বেয়ে আর্যাবর্তের যে সভ্যতা মগধ পর্যন্ত আসে সেখানে মূলত গান্ধর্ববিবাহেরই প্রচলন ছিলো । আজকের গাঙ্গেয় অববাহিকা, অর্থাৎ পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, ওড়িশা এবং অসমসহ সমগ্র অঞ্চলে মূলত গান্ধর্ববিবাহেরই প্রচলন আছে। তৎসহ এই অঞ্চলের বিবাহিতা নারীদের মধ্যেই সিঁদুরের ব্যবহার সর্বাধিক দেখা যায়। অন্যপক্ষে দ্রাবিড় ও পৈশাচ অঞ্চল, অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত, যেখানে রাক্ষসবিবাহের প্রচলন গান্ধর্ববিবাহের থেকে অনেক বেশি ছিলো সেকালে, সেখানে কিন্তু সিঁদুরের কোনও ব্যবহার নেই। যৎসামান্য কুমকুমের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাই এতো সহজ সমীকরণে সিঁদুরকে খলনায়ক বানানোর প্রক্রিয়াটি আজকের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়না। বস্তুত এই বিজিতের রক্ত নিশান তত্ত্বটি ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে য়ুরোপীয় মিশনারি পণ্ডিতদের প্রচারিত ব্যাখ্যা। অথচ যে পাশ্চাত্য সভ্যতা বিভিন্ন ভারতীয় কুপ্রথা নিয়ে সর্বাধিক সরব, তাদের সমাজেই chastity বা heresy নিয়ে তুমুল হিংস্রতা লক্ষ্য করা যায়। তবে একথা অনস্বীকার্য সিঁদুরপ্রথার প্রাথমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের পিছনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের যোগদান ছিলো। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হচ্ছে নারীর 'সতীত্ব' এবং সেই অনিবার্যতায় ভার্যাকে শুধুমাত্র পুত্রার্থে ব্যবহার করাই গরিমান্বিত প্রথা মনে করা হতো। তাই দেশজাতি নির্বিচার, নারীর প্রতি মনোভাব নিয়ে গর্ব করার মতো ইতিহাস পৃথিবীর কোনও দেশেই নেই।
অনূঢ়া বা পুরুষসংসর্গরহিত কুমারী নারীর জন্য বৈদিকসমাজে কিছু অন্যধরণের নিয়মকানুন ছিলো। তা শুধু আমাদের দেশে নয়। তৎকালীন প্রতীচীতেও তার ব্যাপক সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু বিবাহসংস্কারের (লক্ষণীয় 'সংস্কার' শব্দটি। যেমন বিপ্রের উপবীতসংস্কার) পর নারীর সামাজিক পরিচয়টি আমূল পরিবর্তিত হয়ে যেতো। শুধু গোত্রান্তর নয়, প্রায় জন্মান্তরের সমান তার অভিঘাত। গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব ও ফলিত জ্যোতিষচর্চার প্রতি অতিবিশ্বস্ত এদেশী জনতা সিঁদুরের লালরং'কে মঙ্গলগ্রহের প্রতি আনুগত্য হিসেবেও প্রচার করে থাকতো। পুরুষত্বের সঙ্গে রক্তিমবর্ণ মঙ্গলগ্রহের যোগাযোগ সারা বিশ্বে চিরকাল আছে। পশ্য, এন অরে ফ্রোম অর্স' জাতীয় পশ্চিমি পণ্য আজকেও মানুষ নির্বিকার ভোজন করে থাকে। কুমারীকন্যার যৌনজীবনে প্রবেশ করার সময় মঙ্গলগ্রহের আশীর্বাদ প্রয়োজন। তাই এই রক্তিম চিহ্ন ধারণ করলে ঐ গ্রহটি নারীকে প্রয়োজনীয় প্রজনন শক্তি দেবে এমত বিশ্বাস ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো। যেসব লোকজন সিঁদুরের প্রতি 'বৈজ্ঞানিক' বা 'ঐতিহাসিক' কারণে বিমুখ, তাঁরা হয়তো বহু সময়েই কুপিত মঙ্গলকে তুষ্ট করতে আঙুলে রক্তবর্ণ প্রবাল ধারণ করে থাকেন। আজও।
আমাদের শক্তিদেবীপূজার ঐতিহ্যের সঙ্গে বিজড়িত যতো ডিসকোর্স রয়েছে, সেখানে দুজন মূলদেবী রয়েছেন। এই দুই দেবী পরে মিলেমিশে একজন মহাদেবী হয়ে গিয়েছিলেন। এঁরা হলেন পার্বতী ও সতী। পরবর্তীকালের দুর্গা বা আরো পরের কালী নামের মহাদেবীর সঙ্গে সিঁদুর নামক রঞ্জকটি অতিমাত্রায় জড়িত। কারণ আগম বা তন্ত্র অনুযায়ী পার্বতী এবং সতীর শক্তির উৎস এই রক্তবর্ণ প্রতীকটি। এর পিছনে রয়েছে প্রজননতত্ত্ব বা fertility cult, যার উৎস আবার নারীর প্রজনন ক্ষমতার দর্প । মনে করা হয় রক্তবর্ণ স্ত্রীরজ বিশ্বের সকল সৃষ্টির আকর। পুরুষের পেশীশক্তির অহংকার থাকতে পারে। কিন্তু নারীর প্রজননশক্তির গরিমা জীবনধারা তথা প্রকৃতিকে ধরে রাখতে অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই স্ত্রীরজের অনুকারক রক্তবর্ণ সিঁদুর নারীর প্রজনন ক্ষমতার সূচক। নারীর শিরোদেশের ঠিক মধ্যবিন্দুতে সিঁদুর প্রয়োগের কিছু আয়ুর্বেদিক বা যৌগিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সিঁদুর তৈরি হতো কিছু ভেষজ পদার্থের সংমিশ্রণে। যেমন হলুদ, চুন, নানা পুষ্পনির্যাস ও প্রকৃতিজ রঞ্জকসমূহ। এগুলির নিজস্ব ভেষজ নিরাময় বা শক্তিবর্ধক ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হতো। সম্মুখশিরোদেশে, যেখানে আজ্ঞাচক্রের উপস্থিতি রয়েছে এমত ধারণায়, এই দ্রব্যগুণ আজ্ঞাচক্রকে উদ্দীপ্ত করে নারীর যৌন ও প্রজননক্ষমতাকে নাকি সমৃদ্ধ করতে পারে। এই বিশ্বাসের কথা নানা স্থানে দেখা যায়। ভর্তৃহারা নারীর যেহেতু 'বৈধ' সন্তান ধারণের সম্ভাবনা নেই, তাই তাঁর জন্য এই চিহ্ন অপ্রাসঙ্গিক। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর সিঁদুর মুছে দেওয়ার যে প্রথাটি সারা দেশে দেখতে পাওয়া যায় তার পিছনে আপাতকারণ হয়তো পতিশোক। কিন্তু নিহিত কারণটি হলো পিতৃতন্ত্রের ভেটোতে সেই নারীর সন্তানধারণের সামাজিক অধিকারটি কেড়ে নেওয়া। Female powerয়ের এই অবমাননাই নারীর মৌলিক অধিকারকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
বালুচিস্তানের মেহরগড়ে সিন্ধুসভ্যতার কিছু অবশেষ থেকে জানা গিয়েছে যে তৎকালে সেদেশে নারীদের মধ্যে সিঁদুরজাতীয় রঞ্জক ব্যবহারের রীতি ছিলো। সেক্ষেত্রে আমাদের সভ্যতায় অন্তত তিন-চার হাজার বছর ধরে এই দ্রব্যটির প্রচলন রয়েছে। আমাদের সব মহাকাব্যেই সিঁদুরকুংকুমের উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতীকী ব্যঞ্জনাও রয়েছে পুরোমাত্রায়। যেমন শ্রীরাধা, শ্রীকৃষ্ণের বিবাহিতা স্ত্রী ন'ন। কিন্তু তাঁর শক্তি হিসেবে রাধা সিঁদুরকুংকুম ধারণ করেন। আবার পাণ্ডবদের নপুংসকতায় ক্ষিপ্ত যাজ্ঞসেনী তাঁর সিঁদুর মুছে ফেলেন প্রতিবাদে। বিভিন্ন অন্য পুরাণেও বারম্বার সিঁদুর সংক্রান্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষত শক্তিদেবী বিজড়িত আখ্যানগুলিতে। খোদ আদিশংকর 'সৌন্দর্যলহরী'তে সিঁদুরের মাহাত্ম্য নিয়ে লম্বা শ্লোকও লিখে ফেলেছিলেন। হয়তো অনেকেই মনে রাখেন না, সারাদেশে বহু পুরুষরাও নানা 'ধর্মীয়' ও অন্যান্য কারণে সারাজীবন সিঁদুরের টিপ পরে থাকেন। বেশ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের সময় পুরুষকেও সিঁদুর ধারণ করতে হয়। ওয়াহাবি ইসলামে শুনেছি টিপ পরা অধর্মীয়। কিন্তু সুফি ইসলামে সিঁদুরের টিপ একসময় প্রচলিত ছিলো।
এবার একটু অন্যদিক থেকে দেখা যাক। সিঁদুর নামক একটি নিরীহ প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে সামন্ততান্ত্রিক রাজনীতি বেশ পুরোনো ব্যাপার।এই প্রসাধনটির যাথার্থ্য নন্দনতত্ত্বের এলাকার মধ্যেই বিচার করলে ভালো হয়। কারণ দ্রব্যটির এর থেকে অধিক কোনও মাহাত্ম্য নেই। বঙ্গীয় হিন্দু বিবাহ আচার, যা আর্য, অনার্য ও লৌকিক পদ্ধতির এক মিশ্র রূপ, সেখানে ধর্ম ও জিরাফের বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখা যায়। এই সব মধ্যযুগীয় লৌকিক অনুষ্ঠানকে সকৌতুকে উপভোগ করাই শ্রেয়। তার প্রতি অকারণ মাহাত্ম্য আরোপ নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। প্রশ্ন হলো, সব রকম 'ধর্মবাদী', 'নারীবাদী', 'প্রতিবাদী', 'নীতিবাদী', 'স্বাস্থ্যবাদী', 'হিন্দুত্ববাদী' ইত্যাদি দৃষ্টিকোণকে আমল না দিয়ে যদি আমরা শুধু সৌন্দর্যবাদী চোখে দেখতে চাই তবে হয়তো এর চেয়ে বড়ো 'রাজনৈতিক ভুল' আর কিছুই হতে পারেনা। কারণ ইতিহাস কিছু জেনে, অনেকটাই হয়তো না জেনে সিঁদুরবিরোধী জনতা এই মূহুর্তে বেশ জঙ্গি মুডে থাকেন। যেহেতু এই অধমের শৃংখল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই, তাই সে নির্ভয়। সিঁদুর রাজনীতি আরও অনেক অকর্মক মূঢ়তার মতই স্বাধীনচিত্ততার বিরোধী বলে অনেকে প্রচার করেন। সমাজতত্ত্ব বা ধর্মতত্ত্বের কূটকচালের সঙ্গে যদি একে নাই মেলাই, তবে খুব একটা অপরাধ হবে না হয়তো। বিদেশপ্রবাসী মেয়েরা, যারা বাঙালি জীবনের মূল স্রোত থেকে অসম্ভব দূরত্বে বসবাস করে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে সিঁদুরের কোনও তাৎপর্যই নেই। কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের দেখেছি প্রসাধন হিসেবে সিঁদুরের সৌন্দর্যের প্রতি আন্তরিক থাকতে চায়। তখন মনে হয় যে রূপতত্ত্বের ফল্গুধারা বিজ্ঞাপনে ঢাকা পরিচয়হীন কোটি কোটি মুখের ভিড়ে কোথাও অন্তসলিলা হয়ে থেকে গেছে ঠিক। 'ঠোঁটের সিঁদুর' যদি এতো গ্ল্যামারদ্যোতক হয় তবে কপালের সিঁদুরকে কেন এতো 'গেঁয়ো' বলে ভাবা হবে? সত্যিকথা বলতে কি, সম্প্রতি কিছু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখলুম মহানগরগুলিতে শুধু বিবাহিতা ন'ন, অবিবাহিত মেয়েরাও পার্লারে সাজার সময় সিঁদুরটিপের নানা বৈচিত্র্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছেন। সিঁদুরের কোনও ধর্মীয় তাৎপর্য নেই। যা আছে তা নিতান্ত লোকাচার ও সামাজিক অভ্যেস। নারীর বিপন্নতাবোধকে নিরাপত্তাবোধের উষ্ণতায় উত্তীর্ণ করার জন্য পুরুষ অভিভাবকের থেকে ধার করা সিলমোহর। আজকের নারী নিজেই অর্জন করেছে ঐ সিলমোহর, তাকে আর ওটা কারুর থেকে ধার করতে হয়না। মেয়েরা নিজেদের শক্তি সম্ভবত এখনও পুরো ঠাওর করে উঠতে পারেনি এবং এ ব্যাপারে দিশি-বিলিতি কোনও ভেদাভেদ নেই। বিবাহিতা মেয়েদের অবশ্যপালনীয় চিহ্ন হিসেবে সিঁদুরের ব্যবহার বিষয়ক ফতোয়া এই মূহুর্তে সময়ের ঘড়িকে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাবার অপপ্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। দিনের শেষে সিঁদুর একটি প্রসাধন সামগ্রী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি বিষাক্ত সীসক যৌগ। কিন্তু কোনও 'ধর্মীয়' চিহ্ন নয়। তার মাহাত্ম্য বাঙালি মেয়ের সামগ্রিক সাজের সঙ্গে সমানুপাতিক হলে চোখে ভালো লাগে। একজন বাঙালি মেয়ে যখন পাশ্চাত্য বা অন্যতর 'অ-বাঙালি' পোষাকে সজ্জিত হবে, তখন তার সঙ্গে একটি সিঁদুর টিপ নিশ্চয় মানাবে না। সাজসজ্জা বা পোষাক তো একটা স্টেটমেন্ট এবং প্রসাধনও তার অঙ্গ। সিঁদুরও তার বাইরে নয়। বাংলায় বলতে গেলে 'টেক ইট ইজি'। দাস ফার, নো ফার্দার।
আমার জন্য কিন্তু প্রিয় নারীর ( সে যেই হোকনা কেন, স্ত্রী বা বান্ধবী, বিবাহিতা-অবিবাহিতা) সিঁদুর টিপ একটি নান্দনিক প্রসাধন। সিঁদুর টিপ মেয়েদের মুখশ্রীতে একটা 'অলৌকিক' আভা এনে দেয়। তা সে মেয়ে গৌরী হোক বা শ্যামা। আমরা যখন ছবি আঁকতুম একটা ব্যাপার শিখতে হতো, পটের কেন্দ্রটা কোথায় থাকবে। চোখটা প্রথম পড়বে কোথায়? সেখানের রংটা যদি লাল হয়, তবে তার পরিমাপ নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে । কারণ লাল সব থেকে উজ্জ্বল আর দৃষ্টিআকর্ষক earth colour। কম হলেও অসম্পূর্ণ আর বেশি হলে জবরজং। একালে যাঁরা 'বাঙালি' মেয়ের ছবি এঁকে খ্যাতি পেয়েছেন, বিকাশ বা সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অথবা প্রকাশ কর্মকার বা যোগেন চৌধুরি,আরও অনেকে, সবাই বাঙালি মেয়ের কপালের সিঁদুর টিপটিকে সযত্নে সম্মান জানিয়েছেন। এই 'সম্মান' আজকের বহু মেয়েরাও জানান দেন সব পুজোকেন্দ্রিক মোচ্ছবে অবিরল সিঁদুর মাখামাখির চঞ্চল উদ্দামতায়। কিছুদিন আগেও এই প্রদর্শনকামী প্রবণতাটি এত প্রকট ছিলোনা।
আমার এক বন্ধু বেশ বিষয়ী মানুষ, আমার মতো পাগল নয়। পদ্য-টদ্যের ধার ধারেনা , নিরীহ টাইপ। কদাপি সুকুমারী ভট্টাচার্য পড়ে স্ত্রীর সামাজিক অবস্থান বিষয়ে কোনও ধারণা তৈরি করেনি। কী ভেবে না জানি, তার স্ত্রীকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো। যেদিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে সে তার স্ত্রীকে শাড়ি ও সিঁদুরে দেখবে সেদিন তাঁর জন্য কুড়ি টাকা নগদ বিদায়, পাক্কা ( এ গল্প বছর পঁচিশ আগের এবং এই কুড়ি টাকার সাম্মানিক পাঁচ টাকা থেকে দরদাম করতে করতে বেড়েছিলো)। মিথ্যে বলবো না, তার স্ত্রী কয়েকদিন চেষ্টা করে ঐ রূপে পতিদেবকে দর্শনও দিয়েছিলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে প্রচেষ্টা ভঙ্গ করে তিনি বললেন, কুড়ি টাকার জন্য এতো ঝামেলা পোষায় না। ব্যাক টু সলওয়ার বা বাংলার জাতীয় পোষাক, ম্যাক্সি।
হরিপদ কেরানির স্বপ্নেই থেকে যায় সেই মেয়ে, যার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে.....
Love this -- very informed, well-expressed, all that one has come to expect from Sibanshu, but the mystery of Haripada Keranee dragged me through the discourse. -- Sumit Roy
ReplyDeleteগৌহাটি হাইকোর্ট রায় পরবর্তী সময়ে এই লেখাটির পুনঃপ্রচার দরকার ছিল। এখানে সিঁদূরকে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করেও যেমন ভাবে তার মায়ায় বাঁধা থাকার কথা বলা হয়েছে ( মেয়েদের জন্য নয়) তা নিয়ে তুমুল বাদানুবাদের দরকার ছিল। 😃
ReplyDelete