ছোটগল্প - কৃষ্ণেন্দু মুখার্জ্জী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
মন খারাপের সময়
কৃষ্ণেন্দু মুখার্জ্জী
১
অন্ধকারের মধ্যেই সিঁড়ির ধাপ খুঁজে খুঁজে চুপচাপ উঠে এলুম চিলেকোঠার ঘরে। এইবারে নিশ্চিন্দি। এখানে আর কেউ খুঁজে পাবে না আপাতত। এতখানি কষ্টের দরকার ছিল না যদিও। এ বাড়ির লোকজন এমনিতেই যা অন্ধ, একেবারে চোখের সামনেটিতে না থাকলে কিচ্ছুটি খুঁজে পায় না মোটে। তাই রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেও চলত। কিন্তু ওখানে যা বদ গন্ধ! বাপস! আমি মিনিট দশেকের বেশি থাকতেই পারতুম না। তাই এ জায়গাটাই বেশি সুবিধের। আচ্ছা, খাটের তলায় লুকিয়ে গেলে কীরকম হতো। এই খাটের কথাটা খেয়াল হওয়ায় হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে গেল। মনে পড়লো, এখানে বেশ কয়েকদিন আগে একবার ঘুমুতে ঘুমুতে পড়ে গিয়েছিলুম খাট থেকে। এতে আমার কোনও দোষ ছিল না কিন্তু, খাট আর দেওয়ালের মাঝে অনেকখানি ফাঁক – সেটার মধ্যে দিয়েই গিয়েছিলুম গলে। আমার বলে তখন কত ছোট শরীর! বেড়ালের চেয়েও খুদে।
তাপ্পর আমি তো গলে চলে গেছি খাটের নিচে। কিন্তু ঘুমটি ভাঙেনি সে অবস্থাতেও। লোকজনের খেয়াল হল ঘণ্টাখানেক পর – ‘বুড়ো কই।’ ব্যাস! সারা বাড়ি জুড়ে সবার খালি, ‘কই’ ‘কই’ ‘কই’। কই বাদে আর কারোর কোনও কথাই নেই। বর্ষাকালেওএত কই মাছ পাওয়া যায় না এদিকে। তাপ্পর শুরু হল খোঁজাখুঁজি। বড় নর্দমা, ছোট নর্দমা, রান্নাঘরের হাঁড়ি-কলসি-ডেকচি সবকিছুর ভেতর চলল তল্লাশ। কোনও জায়গাই আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে আর বাকি রাখলে না কেউ – খালি ওই খাটের তলাটা বাদে। ঐ ভরদুপুরে আমি টো-টো করে না ঘুরে যে বাড়িতেও সুস্থির হয়ে ঘুমুতে পারি দুএকদিন – এটা কারোর খেয়ালেও এলো না। কী বেয়াড়া মানসিকতা সবার!
এসব জায়গায় খুঁজে না পেয়ে তারপর সবার সে কি হাউমাউ আর ভেউভেউ! একজন পরামর্শ দিলে সামনের পুকুরটায় জাল ফেলার। হয়তো পুকুরেই পড়ে গেছে ছেলেটা! কী নৃশংস চিন্তাভাবনা দেখেছো! পুকুরটা বলে আমার খুব প্রিয়। প্রায় বিকেলবেলা বসে থাকতুম পাড়ে – আর গাছ থেকে টুপটাপ পাতা পড়তে দেখতুম। কী সুন্দর নীলতিমির মতো টলটলে জল! সেই জলের উপর সারাক্ষণ উড়ে বেড়ায় মাছরাঙা, টুনটুনি ও আরো এক রকমের নাম না জানা পাখি। অপু বলে ওগুলো পানকৌড়ি। আমি পানকৌড়ি আর মাছরাঙার তফাত করতে পারি নে। সে নিয়ে কি হাসাহাসি সবার! পিসেমশাই যখন আসে এদিকে, মাঝেমধ্যে পুকুরে যায় মাছ ধরতে। আমিও যাই সাথে। আমার উপর মাছের চার-টার সামলানোর দায়িত্ব থাকে। একদিন একটুখানি খেয়ে দেখেছিলুম লুকিয়ে লুকিয়ে। ওয়াক! কী অখাদ্য! অথচ বানানোর সময় দেখেছি দিব্বি পাউরুটি দিচ্ছে। পাউরুটি দিয়ে বানানো কোনও জিনিস কী করে এত অখাদ্য হতে পারে! আমি তো ভেবেই অবাক। আর এই অখাদ্যের লোভে মাছগুলো এসে ছিপে ধরাও দেয়! কী বোকা সব মাছ! আর এই বোকাবোকা মাছগুলো খেয়ে এখানকার লোকগুলোও বেবাক নিরেট হয়ে গেল। খুবই আফসোসের কথা।
নিরেট তো বটেই। তা না হলে খাটের তলাটা একবার খুঁজে না দেখেই কেউ পুকুরে জাল ফেলার কথা বলে! আর পরামর্শটা বোধহয় সবার মনে ধরেও গিয়েছিল। তাই দলবেঁধে সবাই চলে গেল পুকুরে তামাশা দেখতে।
আমার ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে। উঠতে গিয়েই মাথায় ঠক্! উরিবাবারে! বুঝলুম খাটের নিচে আছি। সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে এলুম বেরিয়ে। দেখি বাড়ি ভোঁ-ভাঁ। কেউ নেই। এদিকে পুকুরের দিক থেকে বিশাল হাঁইমাই শব্দ। আমার তো সবেতেই বেশি কৌতূহল। দৌড়ে চলে গেলুম।
আমার চেহারা যে তখন কাঠবিড়ালের চেয়েও ছোট ছিল সে কথা তো আগেই বলা। তাই কেউ খেয়ালও করেনি যে আমি ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে কখন দিব্যি সামনে পৌঁছে গেছি। আমি তো জানি না তখনও কী খোঁজা হচ্ছে জাল ফেলে। পাশে দেখি জেঠু দাড়িয়ে।
“বোয়াল মাছ ধরছে বুঝি?”, আমি জিজ্ঞাসা করলুম। সরল প্রশ্ন। বোয়াল ছাড়া অন্য কোনও মাছ ধরতেএত লোক লাগে না বলেই আমার বিশ্বাস। জেঠু দেখি ভুত দেখার মতো চমকে গেল, ‘ঘ্যাং’ করে একটা আওয়াজ বেরুলো মুখ দিয়ে! এই শব্দে ছোড়দা পাশ ফিরে তাকালো। তারপর বড়দা, মেজপিসে, ভুতোকাকা একে একে সবার চোখ পড়লো আমার দিকে। আরেকপ্রস্থ হাউমাউ আর ভেউভেউ। আমি এতক্ষণে জানলুম যে মাছ নয়, আমায় ধরতেই নাকি জাল ফেলা হয়েছিল। কী আজব কথা! আরও তাজ্জব হয়ে গেলুম যখন দেখি যে উল্টে আমাকেই সবাই বকতে লেগেছে। কী আপদ! আমি তো বাড়িতেই ছিলুম। কিন্তু সে কথা কেউ শুনলে তো! যত সব বেগুনখোর শেয়াল লোকজন! কিছু খুঁজে পাবে না, আর বাচ্চাদের উপর চোটপাট! কী অন্যায়! কখনও শুনিনি বাপু কেউ হারানো চাবি বা বইপত্তর খুঁজে পাওয়ার পর সেগুলোকে আচ্ছা করে বকে দিয়েছে। যত বিপদ আমার বেলায়! আমি মিউমিউ শব্দে একটু প্রতিবাদ করেছি এই বকাবকির, তো ছোড়দা আবার তেড়ে এলো - ‘খালি মুখে মুখে তক্ক’! কান মুলে দিত ধরতে পেলেই। আমি সাঁইসাঁই করে লাগালুম দৌড়। তারপরে চলে এলুম এইখানে। কোথায়। না এই চিলেকোঠাতে। সেদিন বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরেও আমায় আর কেউ খুঁজে পায়নি। তারপর থেকেই আমার এই ঘরটা খুব পছন্দ হয়ে গেল, লোকানোর জায়গা হিসেবে।
২
এহেন মর্কট লোকজন আপাতত আমায় চিলেকোঠার ঘরে খুঁজতে আসবে না আমি নিশ্চিত। ওরা হয়তো জানেও না যে এইরকম একটা ঘর আছে এই বাড়িতে। আগেই তো বলেছি অন্ধ লোক। নির্ঘাৎ গোয়ালঘর-টর খুঁজবে কিছুক্ষণ, তারপর দমকল ডাকবে বা আবার বসবে জাল ফেলতে। জাল ফেললেও এবার আমি আর তামাশা দেখতে যাচ্ছি না। ভারি মজা আর কি! এবার বুঝবে ঠ্যালা।
কী মশা রে বাবা এখানে! তার উপর সেরকম অন্ধকার। নিকষ কালো যাকে বলে। মশা হাতে বসছে না পায়ে সেটা অন্ধকারে টের পাচ্ছি না। পিনপিন করে শব্দ হচ্ছে কানের কাছে। চটাস করে একখানা চাঁটি মারলুম বটে, কিন্তু সেটা কোথায় গিয়ে লাগলো ঠিক বোঝা গেল না। একটা টর্চ নিয়ে এলে হতো, কিন্তু অত সময় ছিল কই। মেজদাদা যেরকম অলম্বুষের মত তেড়ে এল, যেন ধরতে পেলেই টিপিন করে নেবে আমায়। অথচ আমিষ খাওয়া বারন ওর। ডাক্তারে বলেছে। কিন্তু যা সেয়ানা লোক! ডাক্তারের কোনও কথা শোনে না। আমি ভালো ছেলে খুব। সব কথা শুনি। ডাক্তারকাকু আমায় বলেছিল গোরুর কাছ থেকে দূরে থাকতে, অ্যালার্জি হবে। আমি তাই ছোড়দার ঘরে যাই না আর। ও তো আজকাল সারাদিন ব্যায়াম করে করে একটা গলকম্বল বাগিয়ে নিয়ছে দিব্বি, আর যা খায় তাতে করে মনে হয় চারটে কেন, তার চেয়েও বেশি পাকস্থলি। গোরু ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। আর লোকটি যে বদ সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বাড়ির সব লোকের সম্বন্ধেই এ কথা খাটে। সারাক্ষণ আমার উপর নিপীড়ণ।
হ্যাঁ যা বলছিলুম, মেজদা তাড়া করতেই আমি সাঁই করে চলে প্রথমে এলুম দালানঘরে। এদিকটা একটু অন্ধকার। বড় বড় অনেকগুলো থাম রয়েছে। একটার পেছনে লুকিয়ে পড়লে কেউ আর দেখতেও পাবে না আমায়। সেটাই করলুম। থামের আড়াল থেকেও শুনতে পাচ্ছিলুম মেজদার ষাঁড়ের মতো গর্জন। আওয়াজটা এগিয়ে আসছিল এদিকেই। মেজদার হাতে একটা বল্লম বা শাবলের মতো কিছু ছিল, জলবিছুটিও হতে পারে। আমি গুটিসুটি মেরে কুণ্ডলীর মত পড়ে আছি, মাঝে হঠাৎ শুনি গর্জন বন্ধ! থামের আড়াল থেকে মুখ বের করে দেখলুম, পেটে হাত দিয়ে বসে পড়েছে মেজদা। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে – তারপরেই আবার পাঁইপাঁই শব্দে উল্টোদিকে দৌড়। ওর হাতখানি তখনও রয়েছে পেটের উপরেই। বুঝলুম আবার বেগ এসেছে।
এই যে গোটা ঘটনাটার জন্যে লোকে আমাকেই দায়ি করছে – এটা কিন্তু অনুচিত। আমি কেবল যেচে অন্যের উপকার করতে গিয়েছিলাম। সেটার এরকম ভয়ানক ফল হবে আমি কী করে জানবো!
মেজদাকে সকাল সকাল চিরতার জল করে দিতে হতো। পেটের না জানি কী একটা ব্যামো ছিল ওর। তাই প্রতি সকালে ওটা না খাওয়া অব্ধি ওর মনে ফুর্তি আসতো না। সময়মত এক গেলাস সেই চিরতার জল না পেলে মুখ বেঁকিয়ে, মাথার চুল খাড়া করে, চোখ লাল-লাল আর গোলগোল করে, তারপর চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় করতো মেজদা - বদ লোকেদের স্বভাব যেরকম হয় আর কি। আজ আবার ওর আপিসের পরীক্ষা ছিল খুব সকাল সকাল। কিন্তু অত ভোরে কেউ ওঠেই নি। আমি ছাড়া। ভোরভোর না উঠলে আবার শোলার মাঠে কোকিলগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় না। জুতোখানা গলিয়ে বেরুতে যাবো, দেখি মেজদাদা ব্যাজার মুখে চেয়ারে বসে। বোঝা গেল কেউ চিরতার জল করে দেয়নি এখনো, তাইএত বিরক্তি। বলেছি আগেই, আমি স্বভাবে খুবই ভালো মানুষ। ভাবলুম কেউ যখন ওঠেনি, আমিই না হয় আজকে করে দিই চিরতার জলটা। রান্নাঘরের ঘাঁতঘোঁত আমার নখদর্পণে। গেলাস, চামচ প্রভৃতি কোথায় রাখা হয় আমি সবকিছুই জানি। প্রায়ই গুঁড়ো দুধ চুরি করে খেতে হয় তো, তাই এগুলো জেনে রাখতেই হয়েছে।
এক গেলাস ঠাণ্ডা জলে বানিয়ে আনলুম চিরতার সরবত। অন্য কেউ হলে আমার এমনি পরোপকারী মনোভাব দেখে এক টাকা বখসিশই দিয়ে দিত নির্ঘাৎ, ঘুড়ি কেনার জন্য। সেই হলদে-সবুজ চাঁদিয়ালগুলোর উপর আমার কতদিনের লোভ! আহা! কিন্তু মেজদাদা অতীব বাদুড় – এই বাড়ির নিয়মরীতি মেনেই। তাই গোমড়া মুখ করে ঢকঢক করে গোটাটা খেয়ে নিল, তারপর বুটজুতো পরে বেরিয়ে পড়লো পরীক্ষা দিতে। এতটুকু ধন্যবাদ অব্দি না জানিয়েই।
আমি গেলাস ধুয়েটুয়ে রান্নাঘরে রাখতে এসে দেখি, ও মা! সব্বোনেশে কাণ্ড! চিরতার কৌটো আর ইসবগুলের কৌটো পাল্টাপালটি হয়ে গিয়েছে যে! তবে আমি মেজদাকে চিরতার জায়গায় কী দিলাম! ওটা খেয়ে ও পরীক্ষা দিতে গেল! গেল গেল গেল! আজ আমি আর আস্ত থাকবো না! এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এলে আমায় সবাই কামড়ে মেরেই ফেলবে হয়তো! ভেউ।
মেজদা বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরল বিকেলের দিকে। সে মুখের দিকে তাকানো যায় না। হাঁসফাঁস করতে করতে যা বলল, তার মর্মার্থ হল এইরকম – পরীক্ষার রুমে টানা পাঁচ মিনিটও নাকি বসে থাকা যায়নি। ঘনঘন বাথরুমে খালি যাওয়া আর আসা! সে কি অস্বস্তিকর ব্যাপার! গার্ডকে একবার বলেও দেখেছিল যদি বাথরুমে বসেই পরীক্ষার ব্যবস্থাটা করা যায়। কিন্তু রাজি হয়নি। অবশেষে একঘণ্টার মধ্যেই খাতাপত্র জমা দিয়ে পালিয়ে আসতে হয়। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে আরেক সংকট। সব খুচরো টাকা সুলভ শৌচালয়েই খতম। অগত্যা সারা পথ বাস ভাড়ার অভাবে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়েছে – সবটা হেঁটে নয় অবশ্য, কিছুটা বসে বসেও। সেটা না বললেও সবাই বুঝতে পারছিল। তারপরেই –
“বুড়ো কোথায়! ব্যাটাকে আজ...”
এই প্রতিহিংসাপরায়ন গর্জন শুনে আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিনি। দৌড়ে সোজা দালানঘর। পিছু পিছু ছুটে আসছিল মেজদাও...
আপাতত মেজদা কাতরাতে কাতরাতে চলে গেছে বাথরুমে। আমি ভেবে দেখলুম এই জায়গাটা সেরকম নিরাপদ নয়। সন্ধ্যের দিকে সাপ-খোপ বেরোয় শুনেছি। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে, সোজা চলে এলুম এই অন্ধকার চিলেকোঠায়। চুপিচুপি, সিঁড়ি বেয়ে।
৩
শাঁখ বেজে উঠলো বারকয়েক। সন্ধ্যে নেমে গেল। চিলেকোঠার ঘরটায় অন্ধকার আরও জমাট হয়ে উঠেছে। আমার এবার ভয় করতে শুরু করলো। অন্ধকার খুব খারাপ জিনিষ। সবকিছুকে জমিয়ে দেয়। আমি জানি। বাড়িতে দেখেছি বাজার করে এনেই ফ্রিজের ভেতর সবকিছু ঢুকিয়ে দেয়। তারপর ওগুলো অন্ধকারে থেকে থেকে জমে কাঠ হয়ে যায়। আর একটা খুব কালো ঘর আছে ওই ফ্রিজের মধ্যেই, এই চিলেকোঠাটার মতোই অন্ধকার। সেখানে জল অব্ধি অন্ধকারে জমে বরফ হয়। তারপরে যেই ফ্রিজ খোলে – একটা আলো জ্বলে দপ্ করে – তারপর আর কিচ্ছুটি জমতে পায় না। এখানে কোনও আলোই নেই, বেশিক্ষণ থাকলে আমি সেইরকম বরফ হয়ে যাবো নির্ঘাৎ। এদিকে বাইরে থেকে তো আওয়াজও আসছে না সেরকম। আমায় খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দিয়েছে কি।
আচ্ছা, এখানে এসেছি কতক্ষণ হলো। একঘণ্টার বেশি তো হবেই। তবে দুঘণ্টা নিশ্চয় হয়নি, প্রতি দুঘণ্টায় আমার জল তেষ্টা পায় – একেবারে ঘড়ি ধরে মেলানো আছে। এদিকে মশাগুলোরও রক্ত খেয়ে খেয়ে পেট ভরে গেছে, ওরা আর আসছেও না। বা হয়তো আসছে, আমার হাত-পাগুলো নিঃসাড় হয়ে গেছে বলে টের পাচ্ছি নে । আরেকটা দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। যদি ওরা আমায় খুঁজে না পায়, তবে তো আজকে রাত্রে খাওয়াও হবে না! কী মুশকিল! আমি তো নিজে বেরুতেও পারবো না, মেজদা নিশ্চয় বাইরে মুগুর নিয়ে বসে আছে। নিজে না পেটাতে পারলেও অন্য কাউকে দিয়ে পিটিয়ে নেবে নির্ঘাৎ, আর আমাকে পেটাতে হলে সবাই তো এক পায়ে খাড়া। একবার হুকুম পেলেই হয়।
এইসব ভেবে বেশ আতঙ্ক বোধ হলো। রাতে না খেলে তো আমি দুর্বল হয়ে যাবো! এদিকে সামনের মাসে আমার ক্যারাটের ক্লাসে ভর্তি হওয়ার কথা। দুর্বল শরীরে তো ভর্তিই নেবে না। তাইলে কী হবে।
‘ছ্যাঁক’ করে একটা শব্দ এল বাইরে থেকে। রান্না শুরু হয়ে গেছে। কী রান্না হচ্ছে আজকে। আমার বড় কৌতূহল। প্রতিদিন কী রান্না হচ্ছে আগের থেকে না জানলে আমার অস্বস্তি হয় খুব। আজকে অস্বস্তি আরও চরমে উঠেছে, কারণ বুঝে গেছি রাত্রে আমার উপোষ আজ।
ছ্যাঁকছোঁক শব্দের তীব্রতা বাড়তে লাগলো, সাথে একটা মনমাতানো সুগন্ধ। খানিকক্ষণ পরে বুঝলুম আজ খিচুড়ি হচ্ছে। সাথে সাথেই আমার চোখ দিয়ে জল চলে এল। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয়। এই প্রিয় বস্তু থেকে আজ আমায় বঞ্চিত করে রাখা হবে! কী নিষ্ঠুর সবাই! আমি খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়লুম। এই জন্যেই কারোর উপকার করতে নেই। দিব্বি সকালে পাখি দেখতে চলে গেলেই হতো, কী দরকার ছিল আগবাড়িয়ে চিরতার জল করতে যাওয়ার! ওখান থেকেই তো যত বিপত্তি।
আমার কান্না পেয়ে গেল খুব। ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে যাবো... অমনি শুনি সিঁড়ি দিয়ে কচমচ শব্দ। কেউ উঠে আসছে। সব্বোনাশ, শত্রুপক্ষ খোঁজ পেয়ে গেল নাকি! আমি সিঁটিয়ে গেলুম। একজনেরই পায়ের শব্দ। তাও ভালো, মারটা কম পড়বে। আমি পিঠ শক্ত করে নিলুম। হে ভগবান, আমায় পিটুনি সইবার শক্তি দিও। আরও প্রার্থনা করলুম যেন পেটানোর মাঝেই খেতে ডেকে দেয়, তাইলে কম সময় ধরে মারবে।
কচমচ শব্দটা এগিয়ে এগিয়ে ঠিক চিলেকোঠার সামনে এসে থামলো। আমি গুটিসুটি মেরে পড়ে আছি।
-‘বুড়োদাদা, শুনতে পাচ্ছ।’
আরে। এটা তো অপু, বড় জেঠুর ছেলে। ঠিক খোঁজ পেয়ে গেছে আমার। কী মজা! ও জানে দেখছি এই ঘরটার সন্ধান। নিজেও হয়তো এখানেই লুকিয়ে পড়ে সবাই বকাবকি করলে! নিশ্চয় তাই হবে। আমায় ডেকে আনতে পাঠিয়েছে বুঝি সবাই। যাক তাও ভালো। রাত্রের খাওয়াটা হবে। কিন্তু অপু বলল –
“তুমি এখন বেরিয়ো না মোটেও। বাইরে খুব বিপদ”
আমি আঁতকে উঠলুম - “ক্-ক্-ক্যানো। কী হয়েছে।”
“ বিশেখ্যাপা এসেছে বাড়িতে। আজ এখানেই খাবে রাত্রে ”
এর চেয়ে বিপদের কিছু হতেই পারে না। বিশেখ্যাপাকে আমি দেখিনি যদিও একবারও, কিন্তু অপুর মুখে ওরা বীভৎসতার কথা শুনেছি অনেকবার। খুবই দানবপ্রকৃতির লোক। সবাইকে খালি ভয় দেখিয়ে বেড়ায়। বড় বড় চোখ, সবসময় লাল-লাল করে থাকে, মাথায় একটা শিংও নাকি আছে। বাচ্চা পেলেই গুঁতিয়ে দেয়। অপুকে নাকি অনেকবার ভয় দেখিয়েছে। তাই ভয়ে ও একা ঘুমুতে পারে না রাত্রে। আমায় আরও বলল –
“আমি তো ওর গলা শোনার পর থেকেই ভয়ে রান্নাঘর থেকে বেরুচ্ছি না। মা খিচুড়ি রাঁধছে, আমি পাশে বসে ছিলুম সারাক্ষণ। কী মিষ্টি গন্ধ! যাই এতক্ষণে হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। একটু টেস্ করে আসি গে। তুমি বেরিয়ো না কিন্তু। ধরতে পেলেই কামড়ে দেবে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়িগে”
কচমচ শব্দটা দূরে চলে যেতে লাগলো। সিঁড়ির ধাপ দিয়ে নেমে নেমে একসময় সেটা বাইরে মিলিয়েই গেল। আমার রান্নাঘরে না লোকানোর জন্যে আফশোস হতে লাগলো এইবার। রাত্রে আর খাওয়া লেখা নেই কপালে। যা পরিস্থিতি শুনলাম, এখন বাইরে বেরোনো অসম্ভব। আর অপুটাই বা কী বদ! আমার জন্যে এক বাটি আনতেও পারলে না! ও তো জানে আমি খিচুড়ি কীরম ভালোবাসি। আরও কী কী ভালোমন্দ রাঁধা হচ্ছে কে জানে! আমাকে পেটানোর জন্যেই কি বিশেখ্যাপাকে বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছে আজ? টা হিংস্র লোকজন!
ডিমভাজার গন্ধ আসতে লাগলো এইবার। আমার জিভ থেকে জল পড়ে পড়ে চিলেকোঠার মেঝেটাই গেল ভিজে। মায়ের জন্যে মন খারাপ করতে লাগলো খুব। মা এখানে থাকলে কি এরম ভেউভেউ অবস্থা হয় আমার! মা নেই এখানে, ম্যাও ও নেই। ম্যাও আমার পোষা বিড়াল। ও থাকলে আমি যেখানেই লুকিয়ে থাকি, গায়ের গন্ধে ঠিক খুঁজে পেত আমায়। দৌড়ে দৌড়ে চলে আসতো আমার কাছে। আর ওর পিছুপিছু চলে আসতো মা। তাপ্পর মায়ের কোলে আমি, আমার কোলে ম্যাও। মা আমায় কোলে করে খেতে নিয়ে যেত। খিচুড়ি, ডিমভাজা আরও কত কী। পাশে বসে ম্যাওও খেত গপগপ করে। ভাবতেও আনন্দ।
আর বাবাও কী ভালো। চিরতার জলও খায় না, ইসবগুলও নাই ঘরে। ফলে আমায় বকুনিও শুনতে হয় না। একটা ভারি মজার ব্যাপার হয়েছিল। আমি তখন খুব ছোট। খুব দৌরাত্ম্য করায় বাবা একবার বলেছিল, আমায় নদীতে ফেলে দেবে। আমি তখন জানতুম না মোটে নদীতে ফেলা কী রকম জিনিস হয়। তাই সে কথা শুনে আমার কি উৎসাহ! খালি বলি, ‘কখন ফেলতে যাবে?’ ‘কখন।’ কিন্তু দেখি কেউ পাত্তা দিচ্ছে না প্রশ্নে। আমি ভ্যা করে কেঁদেই ফেললুম। জেদ ধরলুম খুব- একবার বলা হয়েছে যখন, তখন আমায় ফেলতে যেতেই হবে! বাবা বেগতিক দেখে বলে, পরদিন সকালে নিয়ে যাবে ফেলতে। আমার তো উত্তেজনায় আর আনন্দে সারা রাত্তির ঘুম নেই। সকাল সকাল উঠে জামাপ্যান্ট পরে রেডি। বাবার চা শেষ হওয়া মাত্রই ঠেলে ঠেলে বাইরে নিয়ে এলুম। নদীতে ফেলতে যাচ্ছে আমায়। কী আনন্দ! আমি আগে আগে যাচ্ছি, লাফাতে লাফাতে। অবশেষে বাবা বাজারে এসে আমায় একটা বড় চকোলেট কিনে দিল। আমি ভাবলুম এটাকেই বুঝি নদীতে ফেলে দেওয়া বলে। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলুম। সেদিন থেকে প্রায় রোজই বাড়িতে আবদার করতুম নদীতে ফেলে দিয়ে আসার। দিয়ে একসময় বই পড়তে শিখে এটার আসল মানে জানলুম। তারপর থেকে আবদার বন্ধ।
চকোলেটের কথায় খিদেটা বেড়ে গেল আরও। আর খিদের ভাবনায় দুঃখ হতে লাগলো খুব। খালি মনে হতে লাগলো ডাক ছেড়ে কাঁদি। ওগো মেজদা গো, আমি আর কখনও এরম করবো না গো,আমায় নিয়ে যাও। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরও হবে না বুঝলুম। বিশেখ্যাপা আছে নিচে। শুনতে পেলেই খুব বিপদ। আমার খিদের চোটে ঘুম আসতে লাগলো। দেখি মাথাটাও এলিয়ে পড়ছে নিচে।
কিন্তু ঘুমঘুম ভাবটা কেটে গেল কিছুক্ষণ পরেই। খুব অন্ধকার। কটা বাজছে এখন। রাত বারোটা। একটা। সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছে তো। আমায় ডাকেওনি কেও। অপুও না। আমি মায়ের কাছে যাবো। খুব জোরে কান্না পেয়ে গেল। আমি ফুঁপিয়ে উঠলুম। হঠাৎ...
আবার একটা ধুপধাপ! আমি সচকিত হয়ে গেলুম। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে উঠে আসছে কেউ। ছোট ছোট পা। কে আসছে। সিঁড়ি ডিঙানোর শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ যেই আসুক, সে উপরে উঠে পড়েছে। ঝুপ্ করে একটা লাফ দেওয়ার আওয়াজ ...
তারপরেই অনুভব করলুম আমার কোলে নরম পালকের মতো কিছু একটা এসে পড়েছে। আর সেটা আমার গাল চেটে দিচ্ছে ছোট্ট জিভ দিয়ে।
-‘মিউ’
এটা তো ম্যাও! আমি চমকে উঠলুম! এখানে এলো কী করে! তবে কি... তবে কি...
ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি দিয়ে আরেকটা পায়ের শব্দ, একটা খুব পরিচিত মিষ্টি গলায় ‘বুড়োওও’ ডাক।
খট্। সুইচ টেপার আওয়াজ। চিলেকোঠা আলোয় আলো। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। চোখ বুজে ফেললুম।
৪
চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় খালি মনে হচ্ছিল চারপাশটা যেন ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় স্থির হয়ে এলো সবকিছু। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুললুম এইবার। গোটা ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেছেএতক্ষণে। দেখি কোলের উপর ম্যাও আছে শুয়ে। সামনে মা দাঁড়িয়ে। আমি ঝাঁপ দিয়ে চলে গেলুম মায়ের কোলে। ম্যাও এখন লাফ দিয়ে আমার কাঁধে। মা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিতে লাগলো। আনন্দে আমার মুখে হাসি চোখে জল।
আর কোনও ভয় নেই। অবশ্য মাথা ঘোরাটা যখন কেটে গিয়েছিল, তখন বুঝেছি আগেও ভয়ের কিছুই ছিল না। মেজদা – ছোড়দা – জেঠু এদের ভয় পাব কেন শুধুশুধু! ওদের কেউই তো এখানে থাকে না। বেশ কয়েকদিন আগেই তো ওরা আলাদা হয়ে গেল। তারপর আমরা চলে এলুম এখানে থাকতে, ওরা রয়ে গেল ঐ বাড়িতে। অবশ্য কোর্টে নাকি এখনো মামলা চলছে। ঐ বাড়িটার কিছু অংশও নাকি আমরা পাবো - বাবা বলে সারাক্ষণ। আরও বলে ঐ বাড়ির লোকজন সবাই খুব সেয়ানা। বদ লোক সকলে। তাই ওই বাড়িতে যাইও না কক্ষনো। গেলেই নাকি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে বাচ্চা ছেলে পেয়ে – মায়ের খালি ঐ ভয়। আমার তো ওদের মুখগুলোও মনে পড়ে না; আসলে ওখানকার সেই পুকুরটা বাদে কিছুই মনে নেই আমার আর। তবে বাবা তো কখনও ভুল বলে না। ওরা নিশ্চয় খুব খারাপ লোক।
আমার মাঝেমধ্যে খুব মনখারাপ হয়। জানি না কেন, কিন্তু হয়ে যায়। কে জানে, সবারই এরকম হয় বোধহয়! তখন চলে আসি এই চিলেকোঠায়। একা একা বসে থাকি চুপটি করে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হয়, ঐ মেজদা-ছোড়দা- জেঠু ওদের জন্যেই আমার এই মনখারাপ। ওদের জন্যে বাড়ির কেউই ভালো নেই আর। মা সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকে, বাবার মেজাজ বিগড়ে যায় প্রায়ই। একটা অশান্তির পরিবেশ গোটা বাড়িতে। লুকিয়ে শুনেছি বাবা উকিলকাকুকে বলে মাঝে মাঝে, ‘এবার ওদের জব্দ করতেই হবে, ওদের জন্যেই অ্যাতো ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হচ্ছে রোজ রোজ’। আমি ভাবি, বাবার বদলে নিজেই জব্দ করে দেবো ওদের এইবার। খুব করে জব্দ করে দিতে পারলেই আমার মন ভালো হয়ে যাবে। তাই মনে মনে চলে যাই ওখানে, ওদের সায়েস্তা করতে।
তারপর খুব মজা! কখনও খাটের তলায় পড়ে গিয়ে ওদের ব্যতিব্যস্ত করে দিই, আবার আজকেই যেমন ইসবগুলের সরবত দিয়ে কেমন জব্দটা করলুম! পাছে আমার উপর দোষ না পড়ে, সেজন্যে সবসময় নিরীহ সেজে থাকি। কিন্তু ওরা তো খুব বাজে লোক। দুষ্টু লোকে দুষ্টু কাজ সহজেই ধরে ফেলে। তাই শেষ অবধি সবকিছুর দোষ পড়ে আমার উপরেই। আর ওরা বাচ্চাদের বকে তো খুব – মা বলেছে। আমাকেই বা অ্যাতো সহজে ছাড়বে কেন! ফলে তাড়া করে আমায় খালি, হাতে পেলেই মেরে ফেলার ভয় দেখায়। কখনও মেজদা ধরতে আসে, কখনও ছোড়দা। না জানি পরেরবার মনখারাপের সময় হয়তো বা জেঠুই তেড়ে আসবে! আমি ছুটতে ছুটতে চলে আসি চিলেকোঠায়। ভয় হয় খুব। কান্না পেয়ে যায় তারপর। অনেকটা সময় কেটে যায়, নিজেরও মনে থাকে না কতক্ষণ।
আস্তে আস্তে দুই চিলেকোঠা এক হয়ে যায়। ম্যাও খুঁজে খুঁজে চলে আসে আমার কাছে। কিছু পরে আসে মা। আমি সব বুঝে যাই। বুঝি ওগুলো সব মনে মনে ভাবছিলুম। আসলে কেউ আমায় তাড়া করছে না, কেউ আসছে না মারতে। মেজদা, ছোড়দা কেউ না। ওরা খুব বদ লোক ঠিকই। কিন্তু এখানে কেন আসতে যাবে ওরা! ওরা তো থাকে সেইইই দূরে। এখানে এলেই বাবা ওদের ঠ্যাং ভেঙে দেবে না! যত আবোলতাবোল ভাবনা আমার!
তারপর মা আমায় কোলে নিয়ে নেয়। আমার মন ভালো হয়ে যায় আবার।
আমি আদুরে গলায় জিজ্ঞাসা করলুম, “কটা বাজে এখন।”
মা বললে, ‘ সওয়া ন’টা। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে সে কখন। অথচ ছেলে আমার লুকিয়ে বসে আছে চিলেকোঠায়! আমি তো ভেবেই মরি।‘
‘কী রান্না হয়েছে আজ।’
‘বাঁধাকপির ঝাল’
আমি মুখ বেঁকিয়ে উঠলুম। অ্যা! বাঁধাকপি! ওখানে তো দিব্বি খিচুড়ি হচ্ছিল! আরে! খালি ‘ওখানে-ওখানে’ ভাবছি কেন! আমার নিজের উপরই হাসি পেল। ‘ওখানে’ বলে তো কিছুই নেই।
মা আমার মুখ বেঁকানো ঠিক ধরতে পেরেছে। বলে উঠলো,’ অমনি মুখ বাঁকানো চলবে না। সবজি খেতেই হবে সপ্তাহে অন্তত তিনদিন। সবজি খেলে চোখের জোর বাড়ে।‘
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলুম। পাশের ঘরে উকিলকাকু আর বাবা বসে। সেই কেসটা নিয়ে কথা হচ্ছে নিশ্চয়। সারাক্ষণ খালি ওই নিয়েই কথা চলে বাড়িতে! উকিলকাকুর গলা ভেসে আসছে –
“আজকেই ফয়সালা হয়ে যেত, বুঝলেন। কিন্তু ওদের উকিল, ঐ বিশ্বেশ্বর; শালা সবেতেই বাগড়া দেয়। হিয়ারিংয়ের ডেটটা পিছিয়ে দিল আজকে আবার। মহা সেয়ানা আর ধড়িবাজ চিজ একটা, বুঝলেন তো!”
বিশ্বেশ্বর – ওদের উকিল। অপুর বিশেখ্যাপা। আচ্ছা অপু কি সত্যিই ভয় পায় বিশেখ্যাপাকে। না আমার কল্পনা যে ও পায়। পাবে নাই বা কেন! সেয়ানা লোককে সবারই ভয় পাওয়া উচিত। আচ্ছা, ওখানে কি আদৌ চিলেকোঠা আছে কোনও? অপুও কি মনখারাপ হলে সেই চিলেকোঠায় চলে যায়। তারপর চুপটি করে বসে আমাদের জব্দ করে দেওয়ার কথা ভাবে। ও কি মনে মনে আমাদের বাড়ির সবাইকে বদমায়েশ ভাবে, আমি যেমন ভাবি ওদের।
জানি না কিছুই। এখন আর এসব নিয়ে ভেবে কি লাভ? পরের বার যখন মনখারাপ হবে, তখন না হয় জিজ্ঞেস করে নেব।
বসলুম খাবার টেবিলে। মা ভাত আনতে গেছে। একপাশের চেয়ারে ম্যাও বসে আছে রাজার মত, গোঁফ বাগিয়ে। আর ঐ পাশের চেয়ারে আজকের আনন্দবাজার পত্রিকা। সকাল থেকে ওটা পড়ে আছে ওখানেই। সামনের পাতাটা খোলা। তাতে দেখি একটা ইসবগুলের বিজ্ঞাপন।
আমার আবার খুব হাসি পেয়ে গেল।
মারাত্মক অসাধারণ সুন্দর
ReplyDeletekhub bhalo laglo
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteFantastic
ReplyDeleteDarun Krishnendu Da... Fatafati..
ReplyDeleteমনে হচ্ছে নিজের গল্প পড়লাম।
ReplyDelete:* নিও
ReplyDeleteকি যে বলি ভাই! আপনার সোনার কলম দীর্ঘজীবী হোক।
ReplyDeleteবহুদিন এত ভালো লেখা পড়ি নি।
কি যে বলি ভাই! আপনার সোনার কলম দীর্ঘজীবী হোক।
ReplyDeleteবহুদিন এত ভালো লেখা পড়ি নি।
খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDelete