1

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক 
মিথিল ভট্টাচার্য্য


(ষষ্ঠ পর্ব)

একটা অদ্ভুত মিষ্টি তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ যেন এই আতঙ্কের পরিবেশ কে বিদীর্ণ করে স্তম্ভিত করে দেয় প্রত্যেক ব্যক্তিকে। অক্রুর স্তব্ধ হয়ে দেখেন মথুরার কিশোর রাজকুমার এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কিনারায় নিয়ে মায়াবীদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার গজরাজের দিকে। আর অদ্ভুত ভাবে তার সামনে এসে এইসাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার ও থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন স্বয়ং মৃত্যু দেব মৃত্যু দানের আগের মুহূর্তে অযাচিত ভাবে পরে গেছেন কোনও অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের সামনে। তার দুই চোখে মিশে আছে এক অদ্ভুত সংশয় আর অবিশ্বাস। কৃষ্ণ এক এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে। প্রচণ্ড আতঙ্কে মহাসামন্ত প্রায় চীৎকার করে বারণ করে উঠতে গেলেন, "কি করছেন রাজকুমার? দাঁড়ান।"

কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা দৃঢ় মুষ্টি তাকে স্তব্ধ করে দিলো। তার সামনে পর্বতের মতন এসে দাঁড়ালেন, কৃষ্ণের ইস্পাতকঠিন অগ্রজ স্বল্পভাষী বলরাম। মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে তিনি বলে উঠলেন "দাঁড়ান মহাসামন্ত, কানু যা করছে ওকেকরতে দিন। ও জানে ও কি করছে।"

কিছু মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন অক্রুর, তারপর কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটু একটু করে গজরাজের দিকে আরও এগিয়ে গেছেন মথুরার ভবিষ্যৎ নায়ক। দিশেহারার মতো তিনি আবার বলে উঠতে গেলেন "কিন্তু কুমার।"

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বলরামের উদ্যত তর্জনী তাকে স্তব্ধ করে দিলো , "এখন আর একটাও কথা নয় মহাসামন্ত, আপনিশুধু কানুর উপর ভরসা রাখুন।"

আতঙ্কে নীল হয়ে মহাসামন্ত অক্রুর দেখলেন কৃষ্ণকে ওই অদ্ভুত সুমধুর শিস দিতে দিতে গজরাজের আরও কাছে এগিয়ে যেতে, গজরাজের দৃষ্টিতে এখনও যেন লেগে রয়েছে এক অজানা সংশয়। আগের মতন ক্ষিপ্ত হয়তো সে আরনেই, কিন্তু এখনো মাঝে মাঝেই এক গম্ভীর স্বরে সে দিয়ে উঠছে প্রচণ্ড হুঙ্কার। 

আতঙ্কে রুদ্ধবাক দর্শক হয়ে অক্রুর দেখলেন হাসি মুখে নিয়ে গজরাজের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো ষোলোবছরের এই কিশোর। মধুর শিস দিতে দিতে সে তার হাত এগিয়ে দিচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূতের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য যেন আবার হিংস্র হয়ে উঠতে গেলো গজরাজ। যেন মুহূর্তের মধ্যে পিষে ফেলতে চায় সে এই তুচ্ছ মানব সন্তানকে। গলা দিয়ে একটা অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো অক্রূরের ,কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি দেখলেন এক মুখ হাসি নিয়েতার অদ্ভুত শিস ধ্বনির সামান্য কিছু বদল করলেন কৃষ্ণ।এই অদ্ভুত ধ্বনি যেন আরো বেশি মোহময় হয়ে উঠলো, আর তার সাথে ধীরে ধীরে আবার শান্ত হয়ে উঠলো ক্ষিপ্ত গজরাজ।

বিনা কোনো দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে গজরাজের বিশাল শরীরে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত বোলাতে লাগলেন কৃষ্ণ। কিছু খণ্ড মুহূর্তের জন্য হৃদধ্বনি যেন থেমে গেলো মহাসামন্তের। আর গজরাজও যেন এক প্রচণ্ড বিস্ময়ে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে। তারপর হতবাক মহাসামন্তের বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে ওই কালরূপী প্রকাণ্ড দানবাকৃতি পশুও যেন এক অবোধ প্রাণীর মতো শুঁড় তুলে অভিবাদন জানালো এই তরুণ মানব সন্তানকে।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেননা মহাসামন্ত অক্রুর। একোন মায়া দেখাচ্ছে এই অদ্ভুত কিশোর ! কোন মহামন্ত্রে সে বশ করলো এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতারকে ?

শুধু এখানেই অবসান হলোনা তার বিস্ময়ের। স্তব্ধ হয়ে তিনি দেখলেন, নিজের পেছনের পা কৃষ্ণের চোখের সামনেনিয়ে এলো এই মূক প্রাণী, একটা অব্যক্ত স্বরে সে যেন কিছু বলতে চাইছে এই কিশোরকে। কৃষ্ণ কি দেখতে পেলেন, বুঝতে পারলেননা অক্রুর। কিন্তু দেখলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ওই মধুর হাসি মুছে গিয়ে একটা তীব্র ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠতে ওই তরুণ মুখে।

আলতো করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে গজরাজের পেছনের পা থেকে একটা তীক্ষ্ণ কিছু যেন চোখের পলকে বার করে নিয়ে আসলো কৃষ্ণ। একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গজরাজের কণ্ঠ থেকে, কিন্তু সেই আর্তনাদে আর মিশে নেই কোনক্রোধ বা হিংস্রতা, বরং ফুটে উঠেছে এক তীব্র যন্ত্রণা আর অসহায়তার ছাপ।

আরেকবার ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি করে উঠলো কৃষ্ণ আর তারসাথে আলতো করে তার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ওইবিশাল প্রাণীর দেহে। এই অদ্ভুত স্নেহের পরশে ওই দানবাকৃতি প্রাণীটিও যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে সরে সরে দাঁড়ালো রাজপথের এক ধারে। আর তারপর পিছন ফিরে রাজপথ থেকে ফিরে যেতে লাগলো অজানাপথে তার পিলখানার দিকে। কৃষ্ণ তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ওই দানবাকৃতি প্রকাণ্ড প্রাণীটির দিকে। পথের প্রায় অন্যপ্রান্তরে পৌঁছে গিয়ে সে একবার পিছন ফিরে তাকালো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে, শংকিত হয়েউঠলেন অক্রুর "আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলোনা তো ওই চলমান বিভীষিকা?" কিন্তু না, তার আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করে কৃষ্ণের দিকে ফিরে নিজের শুঁড় তুলে একটা অদ্ভুত বৃংহন করে উঠলো গজরাজ। না জানি নিজের ভাষায় কি বোঝাতে চাইলো এই মূক প্রাণী? কৃতজ্ঞতা না কোনও অজানা প্রতিশ্রুতি? আর তারপরেই ধীরগতিতে সে হারিয়ে গেলো নগরের পথের বাঁকে।

কৃষ্ণ অবশেষে এইবার তাদের দিকে ফিরে তাকালেন, অক্রুর এতক্ষণে দেখতে পেলেন কৃষ্ণ গজরাজের পা থেকে কিবার করে নিয়েছিলেন? কৃষ্ণ তার ডান হাতে ধরে রয়েছে একটি সুতীক্ষ্ণ রক্তাক্ত অঙ্কুশ, কেউ যেন ইচ্ছে করেই বিদ্ধ করেছিল ওই মহাকায় প্রাণীটিকে এই ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে, আর সেই যন্ত্রণাতেই এতক্ষণ পাগলের মতো হয়ে গিয়ে একচলমান মৃত্যু দূতে পরিণত হয়েছিল ওই অবোলা প্রাণীটি।

অক্রুর নিজের স্তব্ধ দশা থেকে অবশেষে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসেন, কি হলো এতক্ষণ? তার নিজের চোখের সামনে একি অদ্ভুত মায়া ঘটে গেলো গেলো এই কয়েক মুহূর্তে? কে এই ষোলো বছরের বালক? একি সত্যি মথুরারএতো দিনের প্রতীক্ষার ফল? না কি কোনও ছদ্মবেশী মায়াবী! কিভাবে বশ করলো ও ওই সাক্ষাৎ কালকে?

আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননা মহাসামন্ত। ব্যাকুল স্বরে তিনি বলে ওঠেন "এত ক্ষণ এখানে একি ঘটে গেলো রাজকুমার? ক্ষিপ্ত গজরাজ, তারপর আপনি এগিয়ে গেলেন ওর দিকে, গজরাজ অদ্ভুত ভাবে শান্ত হয়ে নিজের পথে ফিরে গেলো।...আর এখন আপনার হাতে এই ধারালো অঙ্কুশ, এসবের অর্থ কি?”

মধুর হাসিটি মুছে গিয়ে একটা চাপা ক্রোধ যেন ফুটে উঠলো কৃষ্ণের মুখে কয়েক মুহূর্তের জন্য, একটা দৃঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "কিছু মানুষ নিজেদের পাশবিক ইচ্ছায়, যন্ত্রণা দিয়ে পাগল করে দেওয়ার প্রয়াস করেছিল ওই নিরীহ অবোলা প্রাণীটিকে, আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে ছুটে এসেছিলো বেচারা আমাদের রথের দিকে। না পারছিলো কাউকে বোঝাতে ওর কষ্টটা আর না কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলো ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির।"

অক্রুর ব্যগ্র স্বরে বলে ওঠে "সে না হয় বুঝলাম রাজকুমার, কিন্তু আপনি কিভাবে শান্ত করলেন ওই সাক্ষাৎ মৃত্যু দূতকে? এ কোন মায়া দেখালেন আজ আপনি?"

কৃষ্ণ হাসি মুখে বলে উঠলেন "এ কোন মায়া নয় মহাসামন্ত। এ শুধু হলো ভালোবাসার পরশে এই অবোধ প্রাণীগুলিরযন্ত্রণার সহভাগী হয়ে ওঠার কিছু গোপন কৌশল। একটা কথা জেনে রাখবেন এই সমস্ত প্রাণীই কখনো অকারণে কাউকেই আঘাত করতে চায়না।যখন সে কাউকে, বিশেষ করে মানুষ কে আঘাত করে তখন তার পেছনে একটাই কারণ থাকে, তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম। সে সংগ্রাম নিজের খিদে মেটানোর জন্য হোক কি আত্মরক্ষার জন্য। তাই এই প্রাণীটিকে এই রকম দিশেহারা হয়ে ছুটে আসতে দেখে আমিও বুঝতে পেরেছিলাম, যে কোনও কিছু থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যই অক্ষম চেষ্টা করে যাচ্ছে বেচারা, কিন্তু ওই অবোধ প্রাণী বুঝে উঠতে পারছিলোনা যেকিভাবে মুক্তি পাবে ওই প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে, আর সেই কারণেই এক অজানা আক্রোশে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।"

অক্রুর ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে "কিন্তু রাজকুমার আপনি এখনোও আমাকে বললেননা যে কিভাবে আপনি শান্ত করলেন ওকে, আর ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি কোথায় শিখলেন আপনি ওই অদ্ভুত ধ্বনি?"

কৃষ্ণের মুখে আবার ফিরে আসে তার চিরপরিচিত ওই মোহময় হাসিটা, মধুর স্বরে সে বলে ওঠে "এ আমার একগুরুর শিক্ষা মহাসামন্ত। তিনি আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন এই সমস্ত অবলা প্রাণীদের ভালোবাসায় ছোঁয়ার ভাষা, সে কাহিনী না হয় অন্য আরেকদিন শোনাবো আপনাকে, এবার চলুন যাওয়া যাক"

মথুরার রাজপ্রাসাদের দিকে কিছু সময়ের জন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মথুরার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক, তারপর একটা গাঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "মাতুল নিশ্চয়ই খুব অধীর আগ্রহে অনেক সময় ধরে প্রতীক্ষা করছেন আমাদের, আর তাকে অপেক্ষায় রাখা সঠিক হবেনা, চলুন মথুরার রাজপ্রাসাদ অপেক্ষা করছে আমাদের।"

হতভম্ব অক্রুর অবশেষে কোনওমতে ফিরে আসেন বাস্তবের মাটিতে, স্তম্ভিত ভাবে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ করে তার হাতদুটি জড়ো করে তিনি বলে ওঠেন "যেমন আপনার ইচ্ছা রাজকুমার, আসুন বহু বছর ধরে এই প্রাসাদ রয়েছে আপনার প্রতীক্ষায়।"

মহাসামন্তের রথের চাকা বহু চেষ্টায় অবশেষে তুলে নিতে সক্ষম হন তার সারথি। রথে উঠে আসেন কৃষ্ণ। তাকে, বলরামকে আর মহাসামন্ত অক্রুরকে নিয়ে অবশেষে রথ আবার এগিয়ে চলে মথুরার শ্বেত পাথরে নির্মিত রাজপ্রাসাদের দিকে। 

(ক্রমশ)

1 comment:

  1. এটা পঞ্চম পর্বেই তো দিয়েছো...

    ReplyDelete