0

ছোটগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


ছোটগল্প


ফুরায় শুধু চোখে
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস



সত্যসুন্দর চোখ মেলেই শুনলেন অনিমার গলা, "ও দাদা, গেটটা খুলুন…।" উঠতে ইচ্ছে করছে না বিছানার আরাম ছেড়ে, তবু গলা তুললেন সত্যসুন্দর, "দাঁড়াও বৌ মা, আসছি।" গায়ের চাদর সরিয়ে উঠে বসতে বসতেই কানে এলো পাশের ঘরের দরজা খোলার শব্দ। বাসন্তী উঠেছেন। চাবির গোছার রিনরিনে আওয়াজ…। সত্যসুন্দর চাদর টেনে আবার শুয়ে পড়তে পড়তে স্বগতোক্তি করলেন, "হুহ্,মহারাণী দরজা খুলছেন! একটু আগে উঠলে আরেকটু ঘুমোতে পারতাম! যত্তসব!" বালিশে মাথা ঠেকাতেই মনে মনে জিভ কাটলেন তিনি। আজ একদম ঝামেলায় জড়াবেন না তিনি! উঁহু!



অনিমা ঘরে ঢুকে হাসি হাসি মুখে ডাকলো, "ও দাদা, মশারিটা খুলে দেবো? একটু চা খাবেন নাকি?" চাদরের তলা থেকে চোখটুকু বার করলেন সত্যসুন্দর, "মশারিটা খুলে দাও। চা পরে খাবো।…তোমার দিদি কই?" মশারির দড়ি খুলতে খুলতে অনিমা উত্তর দিলো, "ও ঘরের বিছানা গোছাচ্ছে।" 'ঘোৎ' ধরনের একটা শব্দ করে সত্যসুন্দর আবার চাদরমুড়ি দিলেন। অনিমা মশারি গুছিয়ে খালি পেটে খাওয়ার ওষুধটা বিছানায় রেখে জল গরম বসাতে গেল। সত্যসুন্দর সারা বছরই প্রায় ঈষদুষ্ণ জল খান সকালবেলায়। তাঁর নাকি গ্যাসের সমস্যা কাটে তাতে।



চাদরের নীচে চোখ বুজে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করেন সত্যসুন্দর। নাহ্,বাসন্তীর মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে! এই বয়সে এসব আবার কি ইচ্ছে! মনে মনে বিব্রত হন তিনি। অনিমা গ্লাসে জল নিয়ে এসেছে। উঠে বসে সেটা হাতে নিতে নিতে সত্যসুন্দর একটু অস্বস্তি নিয়ে বলেন,"বৌমা, তোমার দিদিকে একটু আসতে বোলো তো। আর বড় লাইটটা জ্বেলে দাও।" অনিমা কিছু না বলে কয়েক মুহূর্ত জরিপ করলো তাকে। তারপর টিউব লাইট জ্বেলে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দিদিকে ডাকতে হবে…





বাসন্তী বিছানাটা পরিপাটী করে পুব দিকের জানলায় দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণাম করছিলেন। এ বাড়ির পূর্বদিকে বর্ধনদের বিশাল আমবাগান। বড়ো বড়ো গাছের দাপটে ভোরের আলো ঝাঁপিয়ে আসতে পারে না বাড়িতে।বাতাসের ধুলো-পথ বেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সূর্য উঁকি দেয় বাসন্তীর জানলায়। মনে মনে গুরুনাম জপ করে বাসন্তী পেছন ফেরেন। ঠিক তখনই অনিমা ঘরে ঢোকে, "দিদি, খোকা অফিস যাবে তো?" বাসন্তী মাথা নাড়েন উপর-নীচে, "হ্যাঁ। দু'কৌটো চাল নাও। আর মোচা কেটে রেখেছি কাল রাতে। ওটা সেদ্ধ বসাও। বীন, গাজর, মটরশুঁটি আর কুমড়ো দিও ডালে। একটু লবণ কম দিও। বাচ্চাটা খাবে তো! ও হ্যাঁ,লঙ্কা দিও না ডালে। "অনিমা মাথা নেড়ে ফিরে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, "দিদি, আপনাকে ডাকছেন দাদা।" বাসন্তী অবাক হয়। সক্কাল সক্কাল আবার কি বায়নাক্কা শুনতে হবে কে জানে! মুখে বলেন, "যাই।"



সত্যসুন্দর চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছেন। সামনে আজকের খবরের কাগজ, কিন্তু মন দিতে পারছেন না। বাসন্তী দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন, "ডাকছো?" সত্যসুন্দর মুখ তুললেন। এত কাঠখোট্টা গলায় কথা বলা কবে থেকে শুরু করলো বাসন্তী? মনে করার চেষ্টা করেন তিনি। বাসন্তী আবার বলেন, "কি বলবে বলো। রান্নাঘরের দিকে যাবো। অনিমা একা সামলাতে পারবে না।" সত্যসুন্দর ভাল করে তাকান বাসন্তীর দিকে। এতটা রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা! এতগুলো চুল পাকলো কবে?! মুখে বয়সের রেখা তীব্রতর হয়েছে আগের চেয়ে। নাকের পাশের তিলটা এখনো কি আছে? সত্যসুন্দর কথা খোঁজেন। তারপর অপ্রস্তুত গলায় বলেন, "কি বাজার করবো আজকে?" বাসন্তী বিরক্ত হয়, "যা খাবে, তাই আনবে। আমায় জিগ্যেস করছো কেন?" সত্যসুন্দর রেগে উঠতে গিয়েও সামলে নেন, "না, মানে, তুমি কি খেতে চাও?" বাসন্তী থমকে যান। জীবনে যে লোক জিগ্যেস করলো না তার পছন্দ-অপছন্দের কথা, আজ তাঁর কি হলো! তীব্র কোন শব্দ ছিটকে বেরোতে চায় তার ঠোঁট থেকে। নাঃ, সকালবেলায় কোনো বিবাদ চান না তিনি। শান্তভাবে সত্যসুন্দরের দিকে তাকান বাসন্তী, "দিদিভাইয়ের জন্য একটা জিওল মাছ এনো।" সত্যসুন্দরকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে ঘর ছাড়েন তিনি।



২.

এ বাড়ির সব ঘরে পাঁচ-ছয়টা করে জানলা। তবু আঁধার আঁধার ভাব ছড়িয়ে থাকে গোটা বাড়িটায়। দু'চারটে ছেঁড়া রুটির টুকরোর মতো রোদ আটকে থাকে সবজে দেয়ালে… কার্নিশে… মেঝেতে। সকালে চোখ মেলেই রশ্মি পুবদিকের ঘুলঘুলির দিকে তাকায় প্রতিদিন। অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলির সুড়ঙ্গপথ ধরে আলো প্রবেশ করে এ ঘরে। প্রতিদিনই তার মনে পড়ে সুখেন্দু মাইতির ক্লাস এইটের ফিজিক্যাল সায়েন্স বইয়ের 'আলোকবিদ্যা' চ্যাপ্টারটার কথা। ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর রেখার গায়ে পেন্সিল দিয়ে তীরচিহ্ণ এঁকে দিতে ইচ্ছে করে বইয়ে আঁকা ছবির মতন। ফিক্ করে হেসে ফেলে সে। বিয়ের পর পর একদিন রজত দেখে ফেলেছিল তার এই নিত্যকার খেলা। অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিল, "হাসছো কেন?" রশ্মি উত্তর দেয়নি, রজতের কপালে চুমু খেয়ে বিছানা ছেড়েছিল। রশ্মি বেশ জানে, রজত ভুরু কুঁচকোবে তার এই ছেলেমানুষী খেলায়। কল্পনা, রসিকতা, ভাবালুতার জায়গা রজতের জীবনে নেই। সে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর বড়ো চাকুরে। তার ঝাঁ চকচকে জগতে রশ্মির আটপৌরে হাসি-খেলা বেমানান।



ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতেই রশ্মি টের পেলো অনিমা রান্না চাপিয়েছে। ছ্যাঁকছোঁক শব্দের সাথে মিশেছে গরম তেলে পাঁচফোড়ন-শুকনো লঙ্কার গন্ধ। আজ তার শ্বশুর-শাশুড়ির বিবাহবার্ষিকী। রজতকে মনে করে বলতে হবে ও বেলায় আসার সময় যাতে একটু রসমালাই আনে। সব বিষয়ে বিপরীত মত প্রকাশ করলেও রসমালাইয়ের ব্যাপারে সত্যসুন্দর আর বাসন্তী দু'জনেই সমান দুর্বল, এ কথা রশ্মি আবিষ্কার করেছে। গতকালই সত্যসুন্দরকে খুব করে বুঝিয়েছে সে, "বাবা, কাল কিন্তু আপনাদের বিবাহবার্ষিকী। মায়ের জন্য একটা উপহার আনবেন।" সত্যসুন্দর আড়ষ্ট হয়ে প্রথমে ''না, না'' করলেও শেষে যে মনে মনে রাজী হয়েছেন, এ বিষয়ে রশ্মি নিঃসন্দেহ।



আনন্দীর গলা শোনা যাচ্ছে। তার মানে সে ঘুম থেকে উঠে বাপের সাথে নিত্যদিনের খুনসুটি শুরু করেছে। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকেই রশ্মির কানে এলো মেয়ের গলা, "বাবা, মাকে বলো না আজ আমি স্কুলে যাব না?"

-"কেন মা? আজ যাবে না কেন?"

-"ঐ যে মা কাল ঠাকুদ্দাকে বলছিল আজ নাকি ঠামুই আর ঠাকুদ্দার বিয়ের জন্মদিন। বাড়ির কারো জন্মদিন হলে কি স্কুলে যেতে আছে! তুমিও আজ অফিস যেও না, বাবাআআ।"

রজত চুপ করে গেছে। না তাকিয়েও রশ্মি বুঝতে পারছে রজতের নাকের পাটা ফুলছে, মুখ লাল হতে শুরু করেছে। সাংসারিক কথাবার্তা বাচ্চার কানে যাওয়া একদম পছন্দ করে না রজত। বিছানা গোছাতে গোছাতে রশ্মি আনন্দীকে বললো, "ভুটুই, ব্রাশ করে রেডি হও। স্কুলে যাবে। মাসিদিদা ব্রেকফাস্ট বানিয়ে রেখেছে।" বিমর্ষমুখে আনন্দী বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। রশ্মি তাকায় রজতের দিকে। তীব্র ঘৃণা রজতের মুখের রেখায়। "কতবার বলেছি, এসব কথা বাচ্চার সামনে আলোচনা করবে না। শি ইজ ওনলি ফাইভ," হিসহিস করে ওঠে সে। রশ্মি ওয়ারড্রোব থেকে জামা-প্যান্ট বার করে রজতের সামনে রেখে স্মিত হাসে, "স্নান করে এগুলো পরো। অফিসের দেরী হয়ে যাবে।" রশ্মি বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পায় রজতের পেটেন্ট স্বগতোক্তি, "টিপিক্যাল সিরিয়াল দেখা বাংলা মিডিয়াম!"



৩.

বাসন্তী জানলার ধারে মোড়া পেতে বসেন দুপুরে খাওয়ার পর। হাতে জপমালা নিয়ে ঠাকুরের নাম করতে করতে ঝিমুনি আসে তার। আজ অবশ্য ব্যতিক্রম। সকাল থেকে ভেবে বের করতে পারছেন না সত্যসুন্দরের অন্যরকম ব্যবহারের কারণ। বাজার থেকে চিতলের পেটি আর হাঁসের ডিম নিয়ে এসেছেন। এই দুটোই বাসন্তীর খুব প্রিয় ছিল একসময়। বিয়ের পর পর প্রায়ই সত্যসুন্দর নিয়ে আসতেন এগুলো…বৌয়ের জন্য। তাই নিয়ে শাশুড়ি ননদদের কম টিপ্পনী শোনেননি বাসন্তী। চোখের জল ফেলতেন একা একা। প্রিয় খাবারগুলো গলা দিয়ে নামতে চাইতো না। তারপর একসময় সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন ওগুলো। সেও তো কতবছর হয়ে গেল! বাসন্তী আনমনা হয়ে যান। কুবো পাখি ডেকে চলেছে পাতার আড়ালে। লালচে রোদের জাফরি পায়ের পাতায়। রশ্মি ঘরে ঢোকে মুখশুদ্ধি নিয়ে, "মা,এই নিন।" হাতের তেলো পাততে পাততে বাসন্তী ফিসফিস করে জিগ্যেস করেন, "তোমার বাবার ব্যাপারটা কি বলো তো!" রশ্মি হেসে ফেলে, "কেন?"

-"মোলায়েম গলায় কথা বলছে! আবার ভালোমন্দ বাজার করছে!…বহুবছর পর চিতলের পেটি খেলাম,জানো!"

-"জানি। আপনার জন্যই তো আনা।"

-"কেন?"

-"আজকের তারিখটা কি ভুলে গেলেন?"

না, বাসন্তী ভোলেননি আজকের তারিখ। কিন্তু এতবছর ধরে 'আজকের তারিখ' তো বারবার এসেছে। তখন তো সত্যসুন্দরের কিছু মনে হয়নি! বাসন্তী মুখে বলেন, "না, ভুলিনি। তবে মনে তো কোনোদিন রাখেনি কেউ…না তোমার বাবা, না আমার ছেলে…"গলা বুজে আসে বাসন্তীর। শাশুড়ির হাতে হাত রাখে রশ্মি,"মা, পুরোনোটা থাক না পুরোনোর মতো। আজ আপনাদের শুধু বিবাহবার্ষিকী তো নয়, পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। আজ না পাওয়ার হিসেব না-ই বা করলেন।" শাশুড়ির সামনে থেকে উঠে গেল রশ্মি। নিজের বলা কথাগুলো নিজের কানেই বাজছে "পুরোনোটা থাক না পুরোনোর মতো"…।চোখ কড়কড় করছে…তার নিম্নমধ্যবিত্ত বাপের বাড়ি-বাংলা মিডিয়াম স্কুল-পাশকোর্সে পড়াশুনো-সবকিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়া স্বভাবের প্রতি রজতের তাচ্ছিল্যভরা বাক্যগুলো বড্ড রক্তাক্ত করে। যত রক্ত ঝরে, তত তার মুখের হাসি চওড়া হয়। রজত আরো রেগে যায়। পাশবিক হয়ে ওঠে সঙ্গমকালে…যেন রশ্মির শরীর ছিঁড়ে দেখতে চায় ওর গা জ্বালানো হাসির উৎস! রশ্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলে…"পুরোনোটা থাক না পুরোনোর মতো"…



৪.

অসময়ের বৃষ্টি নেমেছে আজ সন্ধ্যেয়। সত্যসুন্দর কাকভিজে হয়ে বাড়ি ফিরেছেন…হাতে একগোছা রজনীগন্ধা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন,"বৌমা…"। রশ্মি শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো, "এ মা, একদম ভিজে গেছেন তো।" সত্যসুন্দর ফুলের গোছাটা বাড়িয়ে দেন রশ্মির দিকে, "দ্যাখো তো, কোনো ফুলদানী পাও কি না। এগুলো রাখো জল দিয়ে।" একটু থেমে ফিসফিস করে যোগ করেন, "আমার ঘরে জায়গা নেই রাখার। তোমার মায়ের ঘরে রেখো।" বৃষ্টি আর ফুলের গন্ধে বারান্দা ম ম করছে। ফুলগুলো নিয়ে যেতে গিয়ে রশ্মি উঁকি দিলো বাসন্তীর ঘরে,"মা,একটা তোয়ালে দিন্ না বাবাকে। আমি একটু ব্যস্ত।" ফুলগুলো দেখিয়ে ফিক্ করে হেসে পালিয়ে যায় সে। ফুলদানীতে ফুল সাজিয়ে ফিরতে ফিরতে রশ্মি দাঁড়িয়ে পড়ে শাশুড়ির ঘরের দরজায়। বারান্দায় সত্যসুন্দরের মাথা মুছিয়ে দিচ্ছেন বাসন্তী, "ভেজো কেন বৃষ্টিতে? তোমার না ঠাণ্ডার ধাত…।" সত্যসুন্দর গাঢ় গলায় বললেন, "তোমার মনে আছে বাসু আমাদের বিয়ের সন্ধ্যেতেও এরকম বৃষ্টি হয়েছিল? আমার পাঞ্জাবী ভিজে গিয়েছিল। তোমার মা আমার মাথা মুছিয়ে দিচ্ছিলেন আর জানলার ফাঁক দিয়ে কাজলপরা দুটো চোখ আমায় দেখছিলো…।" রশ্মি নিঃশব্দে ফুলদানী নামিয়ে রাখে শাশুড়ির বেডসাইড টেবিলে। তারপর এসে দাঁড়ায় নিজের ঘরের জানলায়। জলের ছাঁটে হারিয়ে যাচ্ছে রশ্মির পুরোনো ক্ষতগুলো। রশ্মি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে জানলায় নিরাময়ের আকাঙ্খায়, যতক্ষণ না আনন্দীর কন্ঠস্বর কানে আসে, "মা"…



0 comments: