1

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা গাঙ্গুলী

Posted in


প্রাচীন কথা


চক্রব্যূহে একা 
অনিন্দিতা গাঙ্গুলী


শৈশব থেকেই তিনি পিতৃস্নেহবঞ্চিত। মাতাও যে খুব আদর করে বড় করেছেন তাও নয়। যেমন হয় রাজারাজড়ার ঘরে। দাসদাসীদের কাছেই মানুষ। এই স্নেহহীনতার দায় তাঁকে কর্কশ অত্যাচারী করে তুলেছিল। যা চাই তাকে জোর করে আদায় করে নিতে হবে। আর তা যদি রাজসিংহাসন হয় তো কথাই নেই। সমাজে প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে ক্ষমতার শিখরে আরোহণ না করে উপায়? মথুরাধিপতি কংস এই কথাই ভেবেছেন এতকাল। পিতা তাঁকে পালন করেছেন মাত্র। মহারাজ উগ্রসেন কংসকে কখনও ঔরসজাত পুত্রের সম্মান তো দেননি, এমনকি দানবরাজ দ্রুমিল তাঁর মাকে বলাৎকার করেছিলেন, সেই কারণে তাঁর জন্ম বলে মাও স্নেহ দিতে পারেননি। এহেন প্রতিকুল পরিবেশে, যেখানে চারপাশে কোনও আত্মীয় পরিজন বন্ধু স্বজন নেই যে তাঁকে ভালোবাসে, হঠাৎ আত্মীয়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী মগধরাজ জরাসন্ধ। ভারতবর্ষে এমন কোনও নৃপতি নেই যিনি জরাসন্ধের পরাক্রম ও সমৃদ্ধিকে সমঝে চলেননা। উত্তরপশ্চিম ভারতের কুটিল রাজনৈতিক ছক বিনষ্ট করে দেবার শক্তি যদি কারোর থাকে তবে পূর্বভারতের এই রাজা, যাকে বাকী ভারত সম্মান করে। খাতির করে। কিন্তু কংসকে তিনি কন্যাদান করতে চেয়েছেন কেন? কংস দুর্বৃত্ত। কংস অন্ধক, ভোজ, বৃষ্ণি, প্রত্যেক জ্ঞাতিভ্রাতার চক্ষুশূল। তাঁকে কন্যাদান! 

আপাতত মহারাজ উগ্রসেন কারাগারে। রাজ্য জুড়ে হাওয়ায় কথা উড়ছে। কংস তো রাজ্যাভিষেকের জন্য চিহ্নিত ছিলেনই। তবে কেন এই হঠকারী সিদ্ধান্ত? পিতাকে কারাগারে নিক্ষেপ? কিন্তু কেউ জানুক আর না জানুক, পিতা উগ্রসেনের অন্নে প্রতিপালিত, তাঁর মন্ত্রীসভার উল্লেখযোগ্য পদ অলংকৃত করে বসে আছেন যে যাদবকুলপতি বসুদেব, উগ্রসেন যে তাঁকেই রাজা ঘোষণা করবেন সেকথা কংস টের পেয়েছিলেন। ভাবলেই রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। হাজার হোক দানব রক্ত তাঁর গায়ে। দানবের মত শক্তিশালী এবং সরল কংস। ষড়যন্ত্রের আভাস পান কিন্তু নিজে ষড়যন্ত্র কষতে পারেননা। কাউকে উৎকোচ দিয়ে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দল ভারী করতে পারেননা। কিন্তু বসুদেব একাজে দারুন দক্ষ। পিতার সে প্রিয়পাত্র তো বটেই, তলে তলে মন্ত্রীসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যকে দলে টেনেছেন। কংস অবশ্য কোনও সিদ্ধান্ত নেননি এতদিন। তবে কানাঘুষোয় যখন শুনেছিলেন বসুদেব তাঁর পুত্রকে ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে, নেতা হিসেবে প্রস্তুত করবেন, তখন নিজের পিতৃব্যকন্যা দেবকী, বসুদেবের স্ত্রীকে কারাগারে বন্ধ করেছিলেন। সেখানেই সেই পুত্রের জন্ম হয়। কংস ভাবেন কতদূর চক্রান্ত থাকলে কারারক্ষী সহ সকলে বসুদেবের পক্ষ নিতে পারেনযে রাতের অন্ধকারে সদ্যোজাত পুত্রকে বসুদেব গোপগৃহে রেখে আসতে পারেন! ওখানেই তখন প্রতিপালিত হচ্ছে বসুদেবের আরেক পত্নী রোহিণীর গর্ভজাত বলরাম নামের বালকটি। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পুত্রটিকে পাচার করে দিয়েছিলেন। সকলে নাকি পূর্বাহ্ণেই ভেবে নিয়েছিলেন এ শিশুটিকে কংস নিধন করবেন। অদ্ভুত! দুগ্ধপোষ্য শিশু! এখন সেই শিশু বড় হয়েছে। যাদব ও গোপেরা তার নানা কীর্তিকলাপ চারিদিকে প্রচার করছে। সে নাকি অত্যাচারী কংসের হাত থেকে মথুরা উদ্ধার করবে। রাজা উগ্রসেনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মগধরাজের আশ্বাসও মাঝে মাঝে কংসকে নিশ্চিন্ত করতে পারেনা। তিনি যে নিজগৃহে পরবাসী! তাঁর যে কোনও বন্ধু নেই! এত কিছুর মধ্যে তাঁর সান্ত্বনা অক্রুর। সেও মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বৃত। সংঘমুখ্য। যতই রাজা বলে খাতির করা হোক, এই যাদব অন্ধক ভোজ বৃষ্ণিদের রাজ্যগুলি আসলে গণ। গণতান্ত্রিক মতে চলে। সেখানে মন্ত্রীসভার গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই অক্রুর তাঁর পক্ষে বলে কংস তবু একটু ভরসা পান। 

অক্রুর নিজের বংশপরিচয়ে কিছু হীনমন্যতায় ভোগেন। উল্লেখযোগ্য পদে থাকলেও, কংসের বিশ্বাসভাজন হলেও, মনে মনে তিনি নিজপরিচয়ে নিজেকে হীন মনে করেন। চারিদিকে উজ্জ্বল সব ভোজ বৃষ্ণি কুলপতিদের মধ্যে তিনি যেন কিছুটা শ্রীহীন। তবুও রাজানুগত্যে তিনি দিনের আলোর মতো প্রতিভাত এই রাজদ্রোহের ষড়যন্ত্রে নাম লেখাননি। কিন্তু জানেন, কংস একা। কংস নির্বান্ধব। শ্বশ্রূকুল যতই শক্তিশালী হোক, বিপদে ঘরের কাছের মানুষই পাশে দাঁড়ায়। তিনি তাই কিছুটা সহানুভূতিতে কংসের পাশে ছিলেন। এমন সময়ে কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় বন্দী রাজা উগ্রসেনের আরেক পত্নী, কংসের সপত্ন ভগিনী সুতনুর সঙ্গে অক্রুরের পরিণয় হলো। কেউ এর মধ্যে কোনও রাজনীতি দেখতে পেলেননা। বরং কৃষ্ণের এই মহান পদক্ষেপে তাঁকে অন্ধক ভোজ বৃষ্ণিবংশীয়রা বাহবা দিল। আর অক্রুর? সেই অক্রুর, যিনি মনে মনে কংসের দুর্ভাগ্যকে করুণা করতেন, চাইতেন সে যেন বিপন্ন না হয়ে শান্ত সুস্থির জীবনে ফিরে আসে, এই এক চালেই কৃষ্ণের পক্ষে চলে গেলেন। প্রথম প্রথম নিজেই টের পেলেননা। কারণ পত্নী যে কংসের ভগ্নী! কিন্তু অগ্রজ যে পিতাকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন! সারা মথুরায় কেউ কংসের প্রতিপক্ষ হিসেবে বসুদেবকে কল্পনাও করতে পারেননি। সকলে ভেবেছেন কংস দুর্বিনীত। পিতাকে বন্দী করে রেখেছেন। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় যে তিনি ভুগছিলেন! 

মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটভূমিতে বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে। পূর্বভারতীয় প্রভাবকে হারিয়ে উত্তরপশ্চিম ভারত জাগছে। নতুন রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। বাসুদেব তার হোতা। কংস বিষণ্ণ হাসলেন। মথুরায় আজ বাসুদেব কৃষ্ণ আসছেন। সঙ্গে বলরাম। ভালোই হবে। শত্রুপুরীতে তাঁকে আর জীবনধারণ করতে হবেনা। এই জীবনচক্রে তাঁকে যুদ্ধ একাই করতে হলো যে।

1 comment:

  1. বলাৎকার কিন্তু হয় নি। সম্মতি ছিল পদ্মাবতীর

    ReplyDelete