ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥১২॥
প্রেম? তুমি কি আমাতে এসেছো? আমি যে সাড় পাইনা
পেরো
কটা রাত কেটেছে এখানে পেরো বুঝতেই পারেনা। পাঁচ সাত দশচাঁদ? মনে পড়ে,যখন জেরকার জন্যে মধুমদ আঁজলা ভরে নিয়ে আসছিল, তখন আকাশ জুড়ে ছিল পুরন্ত গোল চাঁদের বলয়। আর এখন একটা পাতলা নখের মতন হয়ে গেছে চাঁদ। চাঁদের মতোই উজ্জ্বল একটি গোল মুখ এখন তার মনোকাশ জুড়ে। কিন্তু চাঁদের মতো সেই মুখছ্ব্টা দিনদিন কমছে না বরং বেড়েই চলছে। পেরো বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। ওরা ময়ূর পালকের নরম পিছল চুল আর কাশফুলের নরম তুলো দিয়ে বিছানা করে দিয়েছে। এত কোমল স্বর্গসুখ তার জীবনে আসবে পেরোর কল্পনাতেও কখনও আসেনি। বুনোরাত হুড়মুড় করে অন্ধকার নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর যেকোনও নির্জন প্রকৃতির রাতের স্বাদ বর্ণ গন্ধ একই রকম। বুনোঝাড় ঘিরে জোনাকীর ঝাঁক যেন আকাশ নেমে এসেছে। শাল মহুয়া বট অশত্থ আর পলাশ ঘিরে আলো আঁধারের খেলা। পেরো চোখ ঘুরিয়ে নিজের বুক পেট তলপেট দেখতে লাগলো। আগে তো সারা গা পদ্ম পাতায় মোড়া থাকত। রোজ নতুন ভেষজ ওষুধ মাখানো পদ্ম পাতার ড্রেসিং। এই তিনদিন হোলো খোলা হয়েছে। বুক থেকে নাভির নিচ অব্দি একটা মোটা রক্তের মতো লাল দড়ি যেন চিপকে রয়েছে। সেলাইয়ের দাগ। ওরা পুরো পেট চিরে চিকিত্সা করেছে। দিন দুই আগে অব্দি সারা দেহে খুব মিষ্টি গন্ধের হলুদ ঔষধির প্রলেপ দিয়ে যেত ওই মেয়েটি। ওর সাথে আসতো আর একটি মেয়ে। বয়েসে তার চেয়ে ছোটো। ওদের দুজনের কথাবার্তাতেই পেরো মেয়েটির নাম জানতে পেরেছে। ওর নাম জোঁহা। ও যখন খুব কাছে ঘেঁষে পেরোর সারা গায়ে ওষুধ মাখাত তখন সত্যিই ওর গা থেকে ওষুধের গন্ধ ছাপিয়ে জুঁই ফুলের গন্ধ পেয়ে আবেশে ভরে যেতো মন প্রাণ। ওষুধ লাগাতো আর মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে গাইতো প্রেমের গান। এক একবার পেরোর চোখের বিব্হল চাউনি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠত আর গাইত
জোঁহা চামেইলি ফুলা তোড়ালি গে/সাওরোঁ সেহ ফুলা আ আ
সেহ ফুলা পিয়াকে রিঝাও গে/ আ রে নসিমা সেহ ফুলা আ আ...
পেরোর মন বোলতো এ গান তো আমার জন্যেই ! আমিই তো ওর প্রেমিক ? প্রাণ আকুলি বিকুলি করতো ওকে জড়িয়ে ধরতে। ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে। মেয়েটি পেরোর কোমর বাদ দিয়ে মুখ হাত পা পিঠ সর্বাংগেই প্রলেপ মাখাত। এখন পেরোর গায়ের রঙ বিস্ময়কর ভাবে ফর্সা হয়ে গেছে। গোরাচাঁদ সাবজীর মতো অতটা ফর্সা নয় কিন্তু চামড়ার রঙ দুধে আলতার ভিতরে একটা হালকা বেগুনী রঙের আভা। পেরো নিজের হাত পা এখন চিনতে পারেনা। পেরো হতবাক। নিশ্চয়ই এখানে এমন কিছু ভেষজ আছে যা কাটা ঘা জোড়া লাগতে পারে আর গায়ের রঙ ফর্সা করে দিতে পারে। পেরোর দেহে কোনও ব্যাথা নেই কিন্তু ও যেন বেশি নড়াচড়া না করে তাই ওরা সবসময় লক্ষ্য রাখে। এখনো ওকে মধু আর ওষুধ পানীয় ছাড়া খাবার খেতে দেয়নি। রোজ চার পাঁচবার ওষুধ লাগানো হয় আর এই কাজটি জোঁহা করে। অবশ্য এখানের অনেকেই এক একবার পেরোকে দেখে গেছে। এই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজনার সংখ্যা কম নয়। এরা সবাই আদিম খেড়িয়া শবর জাতির। প্রত্যেকটি মানুষের হাবভাব চলনবলন শরীরের গঠন কোকড়ানো চুল থ্যাবড়া নাক গর্তে ঢোকা চোখ ছোটো বাইরে ঠেলে আসা কপাল মোটা ঠোঁট সব কিছুর মিল রয়েছে পেরোর সাথে, কিন্তু প্রত্যেকে ফর্সা। ফর্সার রকম ফের।
ওরা এতো ফর্সা কেন, এই প্রশ্নের উত্তর পেরো পেয়ে গেছে। পেরো ধীর পায়ে কুটিরের বাইরে এল। দূরের দুই পাহাড়ের খাঁজ থেকে রক্ত লাল বলের মতো সূর্য উঠছে। পেরোর খালি গায়ে সূর্যের লাল আলো পড়ছে। তিনদিন ধরে ওই মেয়েটির আদেশে এই কাজ করছে। পেরো নিজের শরীরের রঙের পরিবর্তন অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ওই ভেষজ ওষুধের গুণেই এখানের মানুষের গায়ের রঙ এইরকম সুন্দর।ওদের ভাষা পেরোর মাতৃভাষা। কিন্তু কেউই কালো খসখসে চেহারার নয়। বরং উজ্জ্বল কোমল আর চকচকে ফর্সা চামড়ার রঙ।পেরোর সাথে এখনো কারোর বার্তালাপ হয়নি। ওরা সবাই ভদ্র ও মার্জিত রুচির। একে একে পেরোর বিছানার কাছে এসে একটা করে সুগন্ধী ফুল রেখে মিষ্টি হেসে বিদায় নিয়েছে। প্রত্যেকের দেওয়া ভিন্ন ভিন্ন ফুল পেয়ে পেরো অবাক। ওরা মনে মনে চেষ্টা করেছে পেরোকে খুশি করার।
জোঁহার আসার সময় হয়েছে। এই তিনদিন ধরে ও এসে ওকে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে কুটিরের পিছনে নিয়ে যায়। সেখানে গাছপালা নেই। শুধু সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ। ওইখান থেকে পূর্বদিকের সূর্য পরিষ্কার দেখা যায়। মাঠের প্রান্তে অতল খাদ। সেখান থেকে দূরে নীল সবুজ কালোর নানান শেডের পর্বত শৃংখলা। পর্বতশ্রেণী যেন চিত্র বিচিত্র মেঘবায়ু স্রোতে নৌকোর মতো ভাসছে। জোঁহা তার কোমরের অংশটি বাদ দিয়ে মুখ ও পুরো দেহে একটা থকথকে সবুজ লেপ লাগায় আর সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। ওষুধ শুকিয়ে গেলে কিছু যৌগিক ব্যায়াম করায়। পেরোর অদ্ভুদ লাগে। লোকালয় এমনকি যেন পৃথিবীচ্যুত এই অঞ্চলের মানুষ এমন শারিরীক কৌশল শিখলো কী করে? জোহা পেরোর খুব সামনাসামনি দাঁড়ায়। চোখের পলক না ফেলে ওর চোখে চোখ রেখে তাকাতে বলে অনেকক্ষণ। এটাও ওর যৌগিক ক্রিয়ার অঙ্গ। তবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পেরোর গায়ে কাঁটা দেয়। সাবজীর অনেক জ্ঞান বুদ্ধির উপদেশ মাথায় বিদ্যুত্এর মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বুঝে যায় বর্ণ বৈষম্যের জন্যই এতদিন ওরা মানব সমাজে ঘৃণিত উপেক্ষিত। মানুষের এই ঘৃণা আর হেয় এতদিন কেন বয়ে বেড়িয়েছে এখন তার কারণ বুঝতে পারছে পেরো।
জোঁহা এল। পেরোর সামনে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। তারপর তার হাত ধরে আজ নিয়ে এল সেই পদ্মপুকুরের পাড়ে। পেরোকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পুকুরে নেমে পড়ল। মানুষ প্রমাণ পদ্মপাতা সরিয়ে কয়েকটা মোটা মোটা সবুজ পদ্মফল তুলে আনল। সেগুলো ভেঙে সবুজ বীজগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ভেতর থেকে ছোটো সাদা ডিমের মতো শাঁস বের করে পেরোর হাতে দিল। বলল এই অমৃতফল দিয়েই তোমার শক্ত খাবার খাওয়া শুরু হোক। আজ থেকে তুমি কথা বলবে। আমরা জানিনা তোমার নাম কি। কোথায় থাকো। কিন্তু এটা বুঝি তুমি আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারো।
পেরো ওই সুস্বাদু পদ্মবীজ খেতে খেতে একটু কথা বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু জোঁহার দিকে তাকিয়ে কি যে হলো নিজের অজান্তেই গলা কেঁপে উঠল। চোখ থেকে অশ্রুধারা গড়াতে লাগল। পেরোর জ্ঞানত জীবনে কখনো চোখ বেয়ে জল আসেনি। হাত উঠিয়ে মুছতে যেতেই জোঁহা খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। পেরোর চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে ঠোঁট বাড়িয়ে তার চোখের জল চেটে নিল। চোখ নামিয়ে বলল,-পুরুষের চোখে জল আসে আবেগে,ভালবাসায়। এই অমৃত পান করার সৌভাগ্য অনেক কম জনের হয়। আর যে এই অশ্রু পান করে, মৃত্যুর পর ওই অমৃত বৃক্ষ হয়ে জন্ম নেবার সৌভাগ্য লাভ করে।
জোঁহা এই কথা বলে একটা গাছের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখালো। -এই অমৃত গাছের নাম বোঙা। আমাদের গুনিনদের মতে এর আয়ু পাহাড়ের সমান। ফিরতি বছরে যখন পলাশ বনে আগুন রঙ ধরে, সকালে ঘাসে শিশির হীরে মোতির মতো ঝিলিক মারে তখন ওই গাছে নিমফুলের মতো অজস্র সবুজ ফুল আসে। সেইফুল বেঁটে প্রতি বছর আমরা গায়ে মাখি আর আমাদের গায়ের রঙ তাই গোরা। বহু আগে একজন লম্বা বিদেশী লোক এমনিই সময়ে জঙ্গলে রাস্তা ভুল করে এসেছিল। সে কিন্তু আমাদের মতো আদিবাসী ছিল না। আমাদের বড় ভালবাসতো। কয়েকদিন এখানে থেকে ফর্সা সুন্দর হয়ে এখান থেকে গেছে। আমি তখন খুব ছোটো। তবুও আমার মনে আছে। নিয়মমতো ওকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এই অঞ্চলের অনেকদূরে বাইরে রেখে আসা হয়েছিল। আমাদের গুনিন অনেকরকম ওষুধ জানে। বুদ্ধি আর স্মৃতি তেজ হবার ওষুধ জানে আবার স্মৃতি বুদ্ধিহীন হবার ওষুধও জানা আছে। ওই বিদেশী মানুষটি অনেক রকম গাছ গুল্ম ওষুধের ব্যপারে এখান থেকে শিখে গেছে। কিন্তু এখানকার কথা তার আর মনে পড়ার কথা নয়।
0 comments: