ছোটগল্প - বিশ্বেশ্বর ওঝা
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বেস্ট ফ্রেন্ড
বিশ্বেশ্বর ওঝা
"আচ্ছা দাদু, বেস্ট ফ্রেন্ড কি?"
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মেশিনগানের মতো প্রশ্ন করলো, ক্লাস থ্রি এর তুতুল।
অনিমেষ বাবু একটু থমকালেন। তারপর হেসে বললেন, "কেন রে?"
"আমাদের যে essay লিখতে দিয়েছে, ইওর বেস্ট ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডশিপ ডে আসছে কিনা।"
"ও। তা যে তোমার সবচে প্রিয় বন্ধু হবে, সুখে দুঃখে সবসময় পাশে থাকবে, যার সঙ্গে থাকলে সবসময় আনন্দ থাকে মনে, সেই বেস্ট ফ্রেন্ড।
আচ্ছা দাদুভাই, এবার বলতো, কে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড?"
" একমিনিট দাঁড়াও। বুবাই, নাহ সেদিন তো আমাকে চকলেটটার ছোটো পিসটা দিয়েছিল। তানিয়া? উঁহু ও সেদিন আমার পাশে বসেনি। রকি?নাহ, ওও সেদিন খেলায় রান আউট করে দিয়েছিল। ধুর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নেই। তাহলে, তুমিই আমার বেস্টফ্রেন্ড।"
একটুক্ষণ চুপচাপ, তারপর আবার...
"আচ্ছা দাদু, তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড আছে?"
"হ্যাঁ।"
"কে গো দাদু?"
"দেওয়ালের সাদা কালো ছবিটা দেখিয়ে অনিমেষবাবু বললেন, ইনি।"
"ধুরর। তুমি মিথ্যে বলছো। এ তো রোবিন্দনাথ ঠাকুর। স্কুলে ছবি আছে। এ কবেই মরে গেছে। এ কি করে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড হলো?"
"তুমি ছোটো তো তুতুল। তুমি বুঝবে না।"
"না আমি ছোট নই। কেন বুঝবো না?বোঝাও আমায়।"
অতএব অনিমেষবাবু ১০ মিনিট ধরে রবীন্দ্রনাথের লেখালিখি, তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে ছোট্টো তুতুলকে বোঝালেন। শেষমেশ "মা ডাকছে, যাই.." বলে পালালো সে।
হেসে ফেললেন অনিমেষবাবু, "ছেলেমানুষ!"
.
.
কদিন পর, ছুটতে ছুটতে তুতুল এল, "দাদু, দাদু, তোমার বেস্টফ্রেণ্ডের নাকি কাল মৃত্যুদিন। পাড়ার ক্লাবে ফাংশন হবে। আমাকে কবিতা বলতে বলেছে জানো?"
"তা কি কবিতা বলবে তুমি?"
"জানিনা। তুমিই বলে দাও।"
এরপর সারা বিকেল, সন্ধ্যে জুড়ে দাদু নাতি মিলে বীরপুরুষ মুখস্ত করলো। অতবড় কবিতা, তুতুল যদি ভুলে যায়?ওর মা প্রতিমা একটু আপত্তি করছিলেন। তুতুল পাত্তাই দিল না।
পরদিন, পাড়া জুড়ে প্যান্ডেল, মাইক, স্টেজ সাজানো। সন্ধ্যে থেকে শুরু হলো, অনুষ্ঠান। নিজের ঘরে বসে অনিমেষবাবু শুনলেন, সঞ্চালক ব্যারিটোন গলায় বললেন, " আজ আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী....."
খানিকপরে রিনরিনে গলায়, "মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে....."
কান পেতে রইলেন অনিমেষবাবু।
ভালোই চলছিল সব। কিন্তু, "কি দুর্দশাই হত তা না হলে !!" এর পর তুতুলবাবু বেমালুম ভুলে গেলেন, পরের লাইন। অনেকে মিটিমিটি হাসলেও, সবাই স্বীকার করলো, এত বড় কবিতা, ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বাড়ি ফিরে মায়ের বকা চুপচাপ হজম করলো তুতুল।
তারপর রাত্তিরে, ছাদে শোনা গেল, দুই অসমবয়সী গলা মিলিয়ে উচ্চারণ করছে, "রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না আহা..."
.
.
.
দিনকয়েক পর, অনিমেষবাবুর মেয়াদ ফুরোলো। তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার ফিরলেন, 'আশ্রয়' এর ছোট্ট কামরাটায়। তুতুল অবশ্য খুব কেঁদেছিল। অটোতে বসার সময়, রুমালটা বের করলেন, অনিমেষবাবু, কে জানে হয়তো ধোঁয়া সইতে পারেন না বলেই।
আশ্রয়ের সহআবাসিকরা ওঁকে পেয়ে সবাই খুশি। বারবার জিজ্ঞেস করলো, তুতুলের কথা। অনিমেষবাবু শোনালেন, ওর হলদে রঙের মাছ আঁকার কথা, দাদুর চশমা পরে ছবি তোলার কথা, বীরপুরুষ ভুলে যাওয়ার কথা।
কদিন একটু মনমরা হয়ে থাকলেন অনিমেষবাবু। সবাই জানেন, বাড়ি থেকে ফিরলে অমন একটু হয়। তাই হাসি আড্ডা গল্প করে ভুলিয়ে রাখতে চাইলেন ওনাকে।
সেদিন অনেক রাতে, হঠাৎ আশ্রয়ের ম্যানেজারের ঘরে ফোনটা বেজে উঠলো। একটু পরে অনিমেষবাবুর ঘরে আলো জ্বলতে দেখা গেল। রাতুলের উদভ্রান্ত গলা, "বাবা, তিনদিন ধরে তুতুলের জ্বর। কেবল তোমার কথা বলছে। আজ সন্ধ্যে থেকে হুঁশ নেই। কেবল ভুল বকছে। তুমি সব ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নাও, আমি আসছি।"
" দুদিনের জন্য, আবার ব্যাগ গোছানোর কি আছে রে?"
" না বাবা, আর দুদিন নয়, এবার থেকে তুমি আমাদের সাথেই থাকবে, তুতুলের সাথে। তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই।"
অনিমেষবাবুর বলিরেখাক্লিষ্ট মুখটা আলোয় ভরে উঠলো। ধরা গলায় বললেন, "আমি তৈরী হচ্ছি। তুই আয়।"
.
.
ডায়েরিটা নামিয়ে রাখলেন অতীনবাবু। ২২শের মঞ্চে সামনের শ্রোতামন্ডলীর সবার চোখ চিকচিক। অতীনবাবুরও চোখের কোণে মুক্তোবিন্দু। ধীরেধীরে উঠে গেলেন তিনি। একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো, শ্রোতাদের মধ্যে। জানা গেল, এ আসলে অতীনবাবুরই গল্প। বিপত্নীক অতীন বাবুর একমাত্র ছেলে সুকল্যাণ আজ ৭ বছর আমেরিকায়। ছেলে বউ নিয়ে সুখেই আছে। নিজের বাড়িটা বিক্রি করে, এখন অতীনবাবু একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, আর স্বপ্ন দেখেন ঘরে ফেরার, প্রিয়জনদের কাছে ফেরার।
কেউ লক্ষ করলো না, ধীরে ধীরে পেছনের সারির এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন, আপনমনে বিড়বিড় করলেন,
"রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা,
এমন কেন সত্যি হয় না আহা,
ঠিক যেন এক গল্প হতো তবে,
শুনতো যারা অবাক হতো সবে..."
ইমেল টা আর কদিন পর পাবেন, অতীনবাবু। জানেন তিনি। কি মনে হতে হঠাৎ পকেট থেকে ঘড়ি বার করে দেখলেন, ৯ টা ১০। সর্বনাশ! আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে যে তাঁকে। আরেক বেস্টফ্রেণ্ডের কাছে। রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে শুরু করলেন।
খুব টাচিং! এমন লেখাগুলিই এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য একান্ত জরুরি! কতভাবে ইগনোর করি আমরা আমাদের কাছের মানুষকে----------!
ReplyDelete