0

প্রবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


প্যারীচাঁদ মিত্র, উপন্যাসকার
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য



রায়সাহেব হারাণচন্দ্র রক্ষিত (১৮৬৪-১৯২৬)-এর নাম বললে এখন বোধহয় কেউ চিনবেন না। এককালে কর্ণধার আর বঙ্গবাসী-মতো পত্রিকার ইনি সম্পাদক ছিলেন। ঔপন্যাসিক, জীবনীকার ও শেক্সপিয়র- অনুবাদক বলে তাঁর নাম ছিল। ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা-সাহিত্য নামে একটি বই তিনি লিখেছিলেন (১৩১৮ব.)। তার ‘পূর্ব্বভাগ’ শুরু হয়েছে চণ্ডিদাস (হুবহু) দিয়ে, তারপর কয়েক শতক পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে উনিশ শতকে। সেখানেই আলালের ঘরের দুলাল তথা প্যারিচাঁদ (হুবহু) নিয়ে অল্পকিছু আলোচনা আছে। বাঙলা গদ্য রচনায় প্যারীচাঁদ কীসে বিশিষ্ট সে নিয়ে কিছু মন্তব্যও পাওয়া যায়। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে আলাল-এর দোষগুণ নিয়ে হারাণবাবু নীরব। ঔপন্যাসিক বলতে তিনি বোঝেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, আর একমাত্র বঙ্কিমকেই। দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)-র আগে বেরুনো কোনো রচনার যে বিশিষ্ট দাবি বা মর্যাদা থাকতে পারে – এমনটি তাঁর মনে হয় না।

এই ধারণা শুধু হারাণবাবুর একার নয়। বাঙলা সাহিত্যের বহু ইতিহাসকার ও সমালোচক আলাল-কে উপন্যাসের সম্মান দিতে কেমন যেন কুন্ঠিত। যেমন, সুকুমার সেন লিখেছেনঃ

যদিচ কাহিনীর ধারাবাহিকতা উপন্যাসের মতোই তবু কয়েকটি কারণে বইটিকে রীতিমত উপন্যাস বলা চলে না। প্রথমত, প্লট খাপছাড়া রকমের। দ্বিতীয়ত, মূল কাহিনী প্রায়ই অবান্তর ঘটনায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তৃতীয়ত, অধিকাংশ ভূমিকাই অপরিণত, অস্ফুট অথবা ক্ষণদৃশ্য। চতুর্থত, নারী-ভূমিকাগুলি অত্যন্ত অবহেলিত। পঞ্চমত, রীতিমত উপন্যাসে অপেক্ষিত প্রণয়রসের স্পর্শমাত্র নাই।২

এরপর, যেন খানিক করুণা করে সুকুমার সেন বলেছেনঃ ‘সুতরাং আলালের-ঘরের-দুলালকে কতকটা ডিকেন্সের “পিকউইক পেপারস” (১৮৩৬-৩৭)-এর মতো চিত্রোপন্যাস বলা যাইতে পারে।’

একেবারে গোড়া ধরে টান। আলাল যে উপন্যাস নয় – তা বোঝানোর জন্যে পরপর পাঁচটি গোলা দাগা। ‘চিত্রোপন্যাস’ বলতে সুকুমারবাবু বোধহয় পিকারেস্ক্ নভেল বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু পিকউইক পেপার্স্ আদৌ সে-জাতের উপন্যাস নয়। পিকারেস্ক্ উপন্যাসের নায়ক হয় অশিষ্ট, অসৎ কিন্তু পাঠকদের কাছে আবেদন আছে এমন কোনো চরিত্র । তেমন অসৎ ও শঠ চরিত্র ডিকেন্স –এর উপন্যাসটিতে আছে, ঠিকই। তবে উপন্যাসের নায়ক সে নয়। উপন্যাসের নায়ক আগাপাশতলা ভালোমানুষটি, মিস্টার পিকউইক। পিকারেস্ক্ শব্দটি এসেছে স্পেনীয় পিকারো থেকে, যার মানে বদমাশ।৩

কিন্তু তার চেয়েও বড় কথাঃ ‘রীতিমত উপন্যাস’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? অভিধানে, সাহিত্য বিষয়ক পরিভাষাকোষে নভেল-এর নানান সংজ্ঞার্থ দেওয়া থাকে। সব দিক দিয়ে সেগুলি মেলে না। কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে সবটাই নির্ভর করে তার ওপর। কোনটা বড় গল্প আর কোনটা উপন্যাস, আর কোনটা (বাজারি পত্রিকার বিজ্ঞাপনী বয়ানে) ‘উপন্যাসোপম বড় গল্প’ – এসব বিষয়ে সর্বসম্মত কোনো মত নেই, নিকট ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না।

মার্কসবাদীরা এ বিষয়ে আরলন্ড কেটল (১৯১৬-৮৬)-এর সংজ্ঞার্থ ধরেই চলেন। তাঁর সংজ্ঞার্থ এইঃ ‘উপন্যাস – একটি বাস্তববাদী গদ্য-কল্পপথা (prose-fiction), স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কিঞ্চিৎ দীর্ঘ।’৪ রোমান্স মানে অ-বাস্তাববাদী রচনা, উপন্যাসকে বাস্তববাদী হতেই হয়।৫

এই সংজ্ঞার্থ ও বিচার সকলের না-ও পছন্দ হতে পারে। কিন্তু গদ্য-কল্পকথার ইতিহাস থেকে এই সত্যই বেরিয়ে আসে। ঐতিহাসিক রোমান্স আর ঐতিহাসিক উপন্যাস-এই দু ধরণের রচনাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন ওয়ালটার স্কট (১৭৭১-১৮৩২)। ডক্টর স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-৮৪)-র অভিধান-এ রোমান্স আর নভেল-কে একটি কল্পকথামূলক কাহিনী (fictitious narrative), রোমান্স থেকে আলাদা, কারণ মানবিক ঘটনাবলির সাধারণ ধারা ও সমাজের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে (এর) ঘটনাবলি যুক্ত।৬

কেটল্-এর সংজ্ঞার্থটি তাহলে স্কট-এর সঙ্গেই মেলে। আখেরে ব্যাপারটি অ-বাস্তববাদ (রোমানস) বনাম বাস্তববাদ (নভেল)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আলাল-কে উপন্যাস না বলার কোনো হেতু নেই। সচেতনভাবে, পশ্চিমী ধারার নভেল-এর আদলে আলাল লিখেছিলেন প্যারীচাঁদ। দেশজ ধারা (সংস্কৃত বা বাঙলা) –য় যেসব গল্প, আখ্যান, বৃত্তান্ত ইত্যাদি চালু ছিল সেগুলি থেকে প্যারীচাঁদের কিছুই পাওয়ার ছিল না। এই হলো সহজ সত্যি কথা।

আগেই দেখেছি, আলাল প্রসঙ্গে সুকুমার সেনের মনে পড়েছিল ডিকেনস-এর পিকউইক পেপারস। সবদিক দিয়েই সেটি অবান্তর। বরং ১৮৩১-এ লেখা ভিকতর উগো (১৮০২-৮৫)- পারী- নোতর দাম (ইংরেজি অনুবাদে দ হান্চব্যাক অফ নোতর দাম, নোতর দাম গির্জার কুঁজো)-এর কথা ভাবলে সুবিধে হতো। উপন্যাসের গড়ন ও রচনার বিশিষ্টতায় উগো-র বইটির সঙ্গেই আলাল-র মিল।

এর জন্য প্যারীচাঁদকে নিছক অনুকারক, বা আরও এক পা এগিয়ে, চোর- উঁচু রীতির ভাষায়, কুম্ভীলক –বলে মার্কা মারা অনুচিত। ইওরোপীয় সাহিত্যের সংস্পর্শে এসেই প্যারীচাঁদের নভেল লেখার ইচ্ছে হয়। শখ নয়, ইচ্ছে। তিনি নীতিমূলক একটি উপন্যাস লিখবেন বলে ঠিক করেন। উগো-র বইটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্যারীচাঁদের উপন্যাসের কোনো যোগ নেই; একটি চরিত্রও উগো-র উপন্যাস থেকে তিনি নেন নি। গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে খানিক ঐতিহাসিক তথ্য (যেমন, পারী শহরের ইতিহাস, আইনি ব্যবস্থা) পরিবেশন আর নীতিবাক্য – প্যারীচাঁদ এগুলি নিজের মতো করেই জোগান দিয়েছেন।

উগো, আর হয়তো স্কট, থেকে তিনি পেয়েছিলেন উপন্যাসের রূপ সম্পর্কে ধারণা। তাঁদের রচনার সঙ্গে প্যারীচাঁদের উপন্যাসের আকারগত মিল নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেগুলো অন্তর্গত যোগ (ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি)এর ব্যাপার। প্যারীচাঁদের মৌলিকতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না।



টীকা

১. বইটির একটি ইংরিজি নামপত্রও ছিলঃ

The/History & Gradual Development/of Bengali Literature/In the Victorian Era. মজিলপুর (দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা) ‘কর্ণধার কুটীর হইতে গ্রন্থকার কর্তৃক প্রকাশিত’ এই বইটি ছাপা হয়েছিল হেয়ার প্রেস, ১৬ বেচু চ্যাটার্জী ষ্ট্রীট কলকাতা থেকে। পৃষ্ঠাসংখ্যা (চোদ্দ) + ১৫ – ৩৫৬। পূর্বভাগ ১৫-১৭১, উত্তরভাগ ১৭২-৩৫৬। বইটিতে ‘রাজরাজেশ্বরী বৃটন-লক্ষ্মী, স্বর্গীয়া ভিক্টোরিয়া’র একটি ছবিও আছে।

২. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড ২, ইস্টার্ন পাবলিশার্স, ১৯৭৭ (ষষ্ঠ সং.) পৃ.১৮৯।

৩. David Herman and others (eds.), Routledge Encyclopedia of Nattative Theory, London and New York: Routledge, 2008, pp 430-31 দ্র.। আরও সংক্ষেপে জানার জন্য Concise Oxford English Dictionary, 2011 দ্র.।

৪. Arnold Kettle, An Introduction to the English Novel, Vol. 1, London Arrow Books, 1962, p. 29.

৫. ঐ, পৃ. ২৯-৪২-তে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। রোমানস-এর লক্ষণ হিসেবে অ-বাস্তববাদ ছাড়াও কেটল বলেছেন পলায়নবাদ ও ইচ্ছাময় ভাবনা-র কথা (পৃ. – ২৯)। হেরমান প্রমুখ সম্পা., বিশ্বকোষ (টী.-ত)-এ অবশ্য মিখাইল বাখতিন প্রমুখ আধুনিকোত্তর ভাবুকদের কথাই আছে (পৃ. ৩৯৮-৪০৪)। কেটল তো বটেই, স্কট-এরও নাম নেই। পরের টীকা দ্র.।

৬. Sir Walter Scott, An Essay on Romance [first published in the Supplement to Encyclopedia Britannica 1824] in: The Prose Works of Sir Walter Scott, Bart., Vol 6, Edinburgh, 1834, pp. 129-30. Available on the net.


কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ দেবপ্রিয় পাল, সিদ্ধার্থ দত্ত।

0 comments: