2

বইঘর - চয়ন

Posted in

বইঘর
চয়ন


বই : শ্রাবন্তীর জন্য গল্প
লেখক : সৌমিত্র বসু


ছোট গল্প বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার জন্ম সাগরপাড়ের দেশে। ১৮৪২ এ Edgar Allan Poe এর তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেন। মোটামুটি ভাবে এটা সিদ্ধ হয় যে ছোটগল্প হলো কথাসাহিত্যের সেই শাখা যাকে একবারে পড়ে ফেলার পর প্রতীতি সমূহ একীভূত হয়ে পাঠক মনে একটি মাত্র সামূহিক অনুভূতির জন্ম দেয়। এরই নাম unity of effects or impressions। যে কোনও ভাবেই গল্প বলা যেতে পারে। সরল, জটিল, লঘু, গুরু যে ভাবেই বলি না কেন গল্পের কাজ যে impression সৃষ্টি করা সেটা এখনও পর্যন্ত প্রায় সকলেই মেনে চলেন। এখানে দুটো জিনিস মাথায় রাখতে হবে। এক,প্রতীতি ঐক্য কিন্তু পাঠক ভেদে বদলে যাবে। আর দুই, যে কোনও ভাবে যে কোনও বিষয় নিয়ে গল্প বলা যায়। বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণ ভাবে রচয়িতার অধিকারাধীন। পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি না যে একটি বিষয় আরেকটির চেয়ে ভালো। 'To do this is to favour certain kinds of unity over others, whereas the glory of the short story's single minded concision is that it can be put to an infinite number of uses in what it is made to say -- about human experience, about ideas and emotions. A highly self conscious form, the short story can celebrate spontaneity and the instinctual, or the dramatic moment of revelation which brings a character to full consciousness for the first time in his life; it can use its instances to say that life's possibilities are hedged and narrow, or to express a view of life as violent and torn by harsh conflict; deliberate and calculated in aim, it can have the apparent casualness of a snapshot.' ( The Short Story : A Critical Introduction by Valerie Shaw)। আর এগোনোর আগে আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। প্রাচ্যবাসী আমাদের ক্ষেত্রে পঠন কালে গণ্য করতেই হবে রসের বিচার। আমরা প্রতীতি বা অনুভূতি গুলিকে রস বলব। আর অখণ্ড রসানুভূতির আধার হলো সহৃদয় পাঠকের মন। আর এখানেই যত গোল। কারণ, 'মনের ভেতর একশরকম শেকল গড়ার কারখানা/ একটা শেকল ভাঙি যদি গজিয়ে ওঠে চারখানা।' যে যে সাংস্কৃতিক নির্ধারক আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সচেতন প্রয়াস ছাড়া তাদের এড়ানো ভারী মুশকিল।


এতসব কথা মনে এল বইঘরে সৌমিত্র বসুর লেখা 'শ্রাবন্তীর জন্য গল্প' বইটি এসে পৌঁছনোর পর। কী ভাবে পড়ব এ বই? কারণ লেখকের নামটা পড়া মাত্রই একটিই অনুষঙ্গ জেগে উঠল মনের মধ্যে : বেতার। পুরো ছোটবেলাটা আমি সৌমিত্র বসু নামটার সঙ্গে একটা বিশেষ গলার স্বরকে জুড়ে কাটিয়েছি। কত কত চরিত্র হয়ে উঠেছে সেই অবয়বহীন স্বরটি। আজ এই বইয়ের একুশটা গল্প পড়ার সময় কথককন্ঠস্বরে আমি সেই স্বরটাই বারবার শুনছি কেন? এটা কি কালচারাল কন্ডিশনিং? যত এগোচ্ছি ততই যে অনুভূতিটা জন্মাচ্ছে সেটা সেই বেতার নাটক শুনে জন্মানো অনুভূতিরই মতো। এর কারণ কি এই যে ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন বইয়ের ইতিহাস? 


'ফ্রেন্ডস এফ এম-র আমন্ত্রণে বেশ কিছুদিন শ্রাবন্তী মজুমদার শ্রাবন্তীর সরগম বলে রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করতেন। তাতে প্রতিদিন তিনি একটি করে গল্প পড়তেন,আর গল্পগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই একেকটা গান বাজানো হত। গল্পগুলো লিখতাম আমি। গল্প বানানোর নানা রকম শর্ত ছিল, যেমন সোমবার হল সা-এর দিন, সেদিন যে গল্প শোনানো হবে তার নাম দিতে হবে স দিয়ে, মঙ্গলবার রে-র দিন, র দিয়ে দিতে হবে গল্পের নাম...' 


তাহলে ব্যাপারটা কি এমনই দাঁড়ালো যে আমি কোথাও একটা গোত্র বিভাগ করছি? প্রতীতি সংহতি থেকে জন্মানো রসানুভূতিকেও উচ্চ বা নিম্ন ভ্রূ -এর বর্গে ফেলে বিচার করছি তার? মনে করছি যে একরৈখিক কথন ভঙ্গিমা, জটিলতা বর্জিত কাহিনী নির্মাণ, লেখা পড়বার সময় মাথা না ঘামানো এগুলো ঠিক ততটা নান্দনিক নয়? ফরমায়েসি, পপ্ আর্ট বলে গল্পগুলোকে অবজ্ঞা করছি মনে মনে? লেখক তো স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন : 'আমি ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ নই, আম জনতার জন্যে অনুষ্ঠান লিখতে গিয়ে বুদ্ধিজীবি মার্কা কায়দা দেখানোর মতো গোঁড়ামিও আমার নেই। না ভেবে চট করে পড়ে ফেলার মতো মুচমুচে করে লেখার চেষ্টা হয়েছে এদের,...' সত্যিই কোন শেকল যে মনকে কখন বাঁধে তার ঠিক নেই কিছু! কারণ, এভাবে পাঠ করার অর্থই হলো আম আদমিকে ম্যাঙ্গো পিপল্ বলে ডেকে এলিটিসম্-এর আস্ফালন। প্রায় একটা প্রভুত্বকামী ক্ষমতার বয়ানের কাছে আত্মসমর্পণ। শেষ পর্যন্ত, ভূমিকায় বলা তত্ত্বকথাগুলো মনে করে খোলা মনে গল্প শোনায় মন দিলাম। দেখতে দেখতে একটা আলো-আলো ভালোলাগায় ভরে গেল মন।


কলকাতায় ছোটবেলার গন্ধ খুঁজতে আসা অরুময় (গল্প 'গন্ধ'), অভিজিৎ-মন্দিরার মিষ্টি প্রেম (গল্প 'গজদাঁত'), স্বামীর 'সেই ছেলেটা' হতে চেয়ে আগের প্রেমিকা আর এখনকার বউয়ের বুকে মুখ গুঁজে মায়ের ছোঁয়াকে খোঁজা (গল্প 'অরণ্যে'), ননীবালার মা হওয়ার তীব্র ইচ্ছে ( গল্প 'রাক্ষসী') মন ছুঁয়ে গেল। আর পাকাপাকি ভাবে মনে রয়ে গেল দুটো গল্প : 'মাঝখানে' এবং 'প্রেমিকের জন্যে'।


প্রথমটিতে পরমা - প্রিয়তোষের দাম্পত্য প্রিয়তোষের মতোই মুমূর্ষু। হানিমুনে গিয়ে যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আজ সে বিছানায় শোয়া তার কালো ছায়া তাদের সম্পর্কের মধ্যেও এসে পড়েছে। প্রিয়তোষের অসুস্থ মনে নানা সন্দেহ। এদিকে পরমার জীবন নষ্ট হতে দেখে তার শাশুড়ি চান সে একটা সুস্থ জীবন পাক। নতুন করে আবার বাঁচুক মনোচিকিৎসক ডঃ মুখার্জির সঙ্গে। শিউরে ওঠে পরমা। মনগহনের যে ইচ্ছে সে নিজের কাছেই স্বীকার করে না সেটা তাহলে এতটা বেআব্রু? অতি সংযতবাক এই গল্প অস্তিত্বের বিভিন্ন স্তরে বন্দী চরিত্রদের জটিলতা যে ভাবে প্রকাশ করে তার জন্যই এ গল্প বারবার পড়া যায়। 


'প্রেমিকের জন্য' গল্পটি মানুষের দেবতা হওয়ার চেষ্টাকে, ঔদার্যের মোহকে বেনাকাব করে। সোমা আর অপুর যে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয়ে যেত সোমার বর মৃন্ময়ের অতি ঔদার্য তাকেই নতুন করে জিইয়ে তোলে। তারপর, ভালোবাসা, অধিকারবোধ, সম্পর্কের টানাটানির এক জটিল নকশা অতি অল্প কথায় যেভাবে আঁকেন কাহিনীকার তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।


বিদ্যা থেকে বেরোন ৯৬ পাতার বইটি অতি সুন্দর দেখতে। কোনও ছাপার ভুল নেই। দামও খুব কম। মাত্র চল্লিশ টাকা। এই বই সংগ্রহে রাখলে পড়া -শোনা হবেই। মানে পড়া শোনা হয়ে উঠবে। মুখ্যতঃ শোনার জন্যই তো গল্পগুলো লেখা হয়েছিল।

2 comments:

  1. সমালোচনা-সমাচারও একটা অভিনব আর্ট! আপনার "বইঘর"ই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ! কিন্তু ভূমিকাটা বড় লেন্দি মনে হল চয়নদা। আর সব ওকে----------!!!

    ReplyDelete
  2. Boitar ei prothom somalochona, ebong jogyo somalocna. Kintu ek-i sonkhyay tinbar Soumitra Basu? Lojja korchhe je!

    ReplyDelete