5

ছোটগল্প - বিভাস রায়চৌধুরী

Posted in


ছোটগল্প


অপারেশন টিম্বার ট্রেল
বিভাস রায়চৌধুরী



কদিন ধরেই প্রেস, মিডিয়া, কাগজ আর ফেসবুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে নাচানাচি হচ্ছে। কেউকেউ আবার কবিতা, অনুগল্পও লিখে ফেলেছেন। আমিও তাই ভাবলাম, একটু কিছু লিখি। মুস্কিল হচ্ছে ইমোশন’টা আমার ঠিক আসেনা, তাই কবিতা লিখতে পারিনা। আর বানিয়ে বানিয়ে কিছু কাল্পনিক গল্প লেখাও মুস্কিল।

তারচেয়ে বরং আমার দেখা প্রথম সার্জিক্যাল অপারেশনের ঘটনা শোনাই, যেটাতে এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টার, আর আর্মি’র প্যারা কম্যান্ডো ছিল। আর অবশ্যই অপারেশনটা এমন একটা সার্জারী, যা যে কোনও সার্জেনকে লজ্জা দিতে পারে।

১৯৯২ সাল। আমার পোস্টিং তখন চন্ডিগড় এয়ার ফোর্স স্টেশনে। পাঞ্জাবের খালিস্থানী টেররিস্ট সমস্যা প্রায় মিটে এসেছে। শান্তি’র হাওয়া বইছে চারিদিকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বালির বস্তা দিয়ে বানানো বাঙ্কার উঠে যাচ্ছে,নাইট সার্ভিস বাস চালু হয়েছে, ট্যুরিজম ব্যবসা জমে উঠছে। দলে দলে ভ্রমন পিপাসুরা চণ্ডীগড় বা আম্বালা তে ট্রেন থেকে নেমে কালকা হয়ে সিমলা, কুলু, মানালি, রোটাংচলে যাচ্ছেন।

শিবালিক রেঞ্জে চণ্ডীগড় থেকে ৩৫ কিমি দূরে প্রায় ২০০০ ফিট উচ্চতায় পরওয়ানু নামে একটা ছোট্ট হিল স্টেশন বা হ্যামলেট। তার মধ্যে দিয়ে কালকা সিমলা হাইওয়েপাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে কাসৌলি হয়ে সিমলা’র দিকে। রাস্তার ডান দিকে গভীর খাত।আর সেই খাতে কৌশল্যা নামের ছোটো পাহাড়ী নদী বইছে কুলকুল করে। 

নদীর ওপারে টিম্বার ট্রেল হিল, ৫০০০ ফিট উঁচু, তার মাথায় একটা চমৎকার রিসর্ট। এই পাহাড়ের গা থেকে ঐ পাহাড়ের মাথায় পৌছনর রাস্তা কিন্তু ১.৮ কিমি লম্বারোপওয়ে বা ‘কেবল কার’।হাইওয়ে’র ধারে ‘কেবল কারে’র বেস স্টেশন, সেখানেই নিজেদের গাড়ি পার্ক করে টিকিট কেটে রোপওয়ের ট্রলি তে চেপে পৌছে যাওয়া যায় ওই উঁচু হিল রিসর্টে।

৮ মিনিটের হাড় হিম করা ‘কেবল কারে’৩০০০ ফিট উঁচু ভারচ্যুয়াল ট্রেকিং এর আনন্দ নিতে নিতে ওপরে পৌঁছে যাওয়া,তার পর রিসর্টে সময় কাটিয়ে আবার ফিরে আসা।৯২ সালে ৩৫ টাকার টিকিটেএই ছিল প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণ।

অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখ, মঙ্গল বার। 

সকাল থেকে একের পর এক‘কেবল কার’ ছুটছে পরওয়ানু থেকে টিম্বার ট্রেলে। তখন ৩:৩০, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ১১ জন প্যাসেঞ্জার নিয়ে 'B'কার নিচে থেকে রিসর্টের দিকে যাত্রা শুরু করলো। সঙ্গে রোপওয়ে অ্যাটেনডেন্ট গুলাম হুসেন। 

দম বন্ধ করা পাহাড়, নদী, সুউচ্চ গাছের মাথা ছুঁয়ে তারে ঝোলা ট্রলিতে দোল খেতে খেতে উঠতে থাকা যাত্রীদের উত্তেজনার পারদ চরমে। মাঝ রাস্তায়, ওপর থেকে নেমে আসা ‘A’ কার পাস করে গেল। দুই কারের যাত্রীরা চীৎকার করে হাত নেরে নিজেদের উত্তেজনা ছড়িয়ে দি্লেন একে অপরের দিকে। 

৪৫ ডিগ্রী’তে ক্লাইম্ব করতে গিয়ে ট্রলিতে একটা হাল্কা ঝাঁকুনি লাগলে, দিল্লীর মালিনী ট্যান্ডন তার ভাই দেবাশীষকে জিজ্ঞেস করলেন,

“এখান থেকে তার ছিঁড়ে পড়লে কি হবে?”

কলকাতার উকিল দেবাশীষ এক কথায় জবাব দিল,“সব শেষ”। 

নেহাতই জোকস!

অ্যাটেনডেন্ট গুলাম, দেবাশীষ কে দরজার কাছে বসে দেখতে বললেন আরোও ভালো ভিউ পাওয়ার জন্য। এক মিনিট পরে ট্রলি রিসর্টের দিকে প্ল্যাটফর্ম টাচ করে থামল। স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর অনুযায়ী, তার পর একটু পিছিয়ে এসে, ট্রলির আবার এগিয়ে গিয়ে ফাইনাল স্টপ করার কথা। 

অ্যাটেনডেন্ট গুলাম হুসেন, ততক্ষণে দরজার লক খুলে ফেলেছে।

তারপরেই ‘কেবলকার’ ধীরে ধীরে সামনে না গিয়ে, বিদ্যুৎ বেগে স্লিপ করে নীচে নেমে যেতে লাগল। হুসেন সেই ঝটকা বেগের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে গড়িয়ে পড়ল বাইরে, সঙ্গে তার ওয়াকি টকি সেট’টাও। দেবাশীষ’ও সেই ধাক্কায় ছিটকে গেল ট্রলি থেকে। দুজনেই মিলিয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্যে। আর তার সঙ্গেই ট্রলি’র দরজা ছিটকে এসে বন্ধ হয়ে গেল।

তীব্র বেগে ট্রলি নেমে আসছে নীচে, গতিবেগ তখন প্রায় ২৮০ কিমি প্রতি ঘন্টা। ট্রলি’র হুক মোটা শক্ত স্টীলের তারে’র সঙ্গে একটা পুলি দিয়ে লাগানো থাকে, সেই পুলি এই ভীষন গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে হুকের তলা থেকে বেড়িয়ে গেল। পুলি সরে যেতেই ট্রলির হুক সরাসরি তারের সঙ্গে ঘষতে থাকল, ফলে ধোঁয়াআর আগুনের ফুল্কি বেড়িয়ে এল। দুর্ঘটনা দেখতে পেল বেস কন্ট্রোল রুমের কেবল কার অপারেটর হরিশ। তার মনে হলো, ৭ ফিট হাইটের ষড়ভুজাকৃতি (হেক্সাগনাল) ট্রলি রকেটের বেগে ছুটে এসে কন্ট্রোল রুমে ধাক্কা মারবে।

তার চীৎকার শুনে অনেকেই পালাল। কিন্তু আচমকা মাঝ রাস্তায় ট্রলি’টা পেন্ডুলামের মত সামনে পেছনে দুলেদুলে আটকে গেল।ঝুলতে লাগল কয়েক হাজার ফুট নীচে কৌশল্যা নদীর ওপর। চণ্ডীগড়ের ব্যবসায়ী হরিত বাজাজ ট্রলি’র মধ্যে বসে সেই পেন্ডুলামের দুলুনির কথা এখনও ভোলেননি।

সমুদ্রতল থেকে ৪৬২০ ফীট উচুতে ‘কেবলকার’ ঝুলছে। আসলে যে তিনটে তারের সাহাজ্যে ট্রলি ওঠা নামা করে তার মধ্যে দুটো ছিঁড়ে গেছিল, ওপরের ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনর সময়।তাতেই এই বিপত্তি।কিন্তু সেই ছেঁড়া তারের একটা টুকরো ট্রলির সঙ্গে ঝুলে এসে একটা গাছের সঙ্গে লেগে ব্রেকে’র কাজ করেছে। ফলে ট্রলি আটকে গেছে মাঝ রাস্তায়। 

ঘন্টাখানেক বাদে গুলাম হুসেনের মৃতদেহ উদ্ধার হলো পাহাড়ের গায়ে। হুসেনের মাথা পাথরে লেগে থেঁৎলে গেছে। দেবাশীষ কেও পাওয়া গেল, কোমর আর ঘাড়ভাঙ্গা অবস্থায়।

বেস কন্ট্রোল রুমে তুমুল অরাজকতা। হোটেল মালিক মিঃ গর্গ সন্ধ্যে বেলা জেলা অ্যাডমিনিসট্রেশন এর মাধ্যমে কাসৌলি আর্মি ব্রিগেড হেড-কোয়ার্টার্সে যোগাযোগ করলেন। 

আর্মি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে এসে গেল। 

কসৌলী ব্রিগেড কন্ট্যাক্ট করলো আর্মি’র ‘ওয়েস্টার্ন কম্যান্ড’ হেড কোয়ার্টার্সে, চণ্ডীমন্দিরে(চণ্ডীগড় কালকা‘র মাঝে)। লেফটেন্যান্ট জেনারেল বি কে এন ছিব্বার তখন ‘চিফ অফ স্টাফ’। মানে কম্যান্ডের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড। তিনি দ্বায়িত্ব দিলেন মেজর জেনারেল বলদেভ সিং কেপুরো ব্যাপারটা বুঝে রেস্কিউ প্ল্যান তৈরি করতে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা জানালেন জিওসি-ইন-সি(GOC-in-C) লেফটেন্যান্ট জেনারাল বি সি জোশি কে। তিনি তখন দিল্লীতে।

জিওসি-ইন-সি’র গ্রীন সিগন্যাল পেতেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছ থেকে পার্মিশন চাওয়া হলো। পার্মিশন আসতে আসতে রাত গড়িয়ে সকাল!

ততক্ষনেসাহারানপুরের কাছে সারসাওয়া এয়ার ফোর্স বেস থেকে নং১৫২ হেলিকপ্টার ইউনিটের কম্যান্ডিং অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফালি হোমি মেজর নিজে চলে এসেছেন তার টিম নিয়ে।এই পার্সি জুরাস্ট্রিয়ান পাইলটের নাম’টাই ‘মেজর’। এটা আর্মি’র র‍্যাঙ্ক না।

হিমাচলের নাহান আর্মি মাউন্টেন বেস থেকে এসে গেল নং ১ প্যারা কম্যান্ডো বাহিনী। তাদের নেতা মেজর ইভান জোসেফ কাস্ত্রো। ২৮ বছর বয়সী কাস্ত্রো, স্পেস্যাল কম্যান্ডো ট্রেনিং’ নিয়ে ছিলেন সোভিয়েট রাসিয়া থেকে। দিন কয়েক আগেই, গোয়াতে, তার মা’র শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ফিরেছেন। বাড়িতে স্ত্রী আর দুই পুত্র।

ওদিকে ট্রলির মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা। পেন্ডুলামের দুলুনি বন্ধ হতেই মালিনি’র খোঁজ “আমার ভাই দেবাশীষ কোথায়”? মালিনির স্বামী পঙ্কজ ভয়ে নিজেই মূক হয়ে আছেন।

গুরমীত কাউর তিন দিন আগে বিয়ে করে দেভেন্দরের সাথে হনিমুনে এসেছিলেন পাঞ্জাবের জালালাবাদ থেকে। তার শুরু হল বমি আর ডাইরিয়া। ট্রলির মধ্যে একটা টিনের কৌটো পাওয়া গেল, যেটা গুরমীতের কাজে লাগল। 

ট্রলি’র কাঁচ ভেঙ্গে হরিত বাজাজে’র নাক কেটে রক্ত বইছে। হরিতের স্ত্রী হরমেশ, চার বছরের ছেলে বিশাল আর সঙ্গে ভাইপো জয়দীপ। নিজের রক্তের চেয়েও এদের সুরক্ষা তাকে বেশি ভাবাচ্ছে।

আরেক হনিমুন দম্পত্তি, সোনিয়া আর সঞ্জীবতখনও একটু শক্ত, কিন্তু মুখ রক্ত শূন্য।

প্রথম কয়েক ঘন্টা ট্রলি তার ছিঁড়ে পড়ে যেতে পারে এই ভেবে কেউ নড়াচড়া করেনি।সারা রাত সেই ১০ জন ট্যুরিস্ট ঠাণ্ডা’র মধ্যে ঝুলন্ত কেবল কারে রাত কাটালেন। যোগাযোগের কিছু নেই। ওয়াকি টকিও হুসেনের সঙ্গেই পড়ে গেছে। কারুর চোখের পাতা এক হলো না,এমনকি চার বছরের ওইটুকু বিশাল, সেও সারারাত 'বাহে গুরু, বাহে গুরু' ডাক দিতে থাকল বাবা মা’র সাথে। 

রাম, হনুমান, নানক সবাই জেগে।

জয়দীপ মাউন্টেনীয়রীং এর ট্রেনিং করেছে। তার মনের অবস্থা অন্যদের তুলনায় একটু ভালো। কিন্তু তারও করার কিছু নেই। 

পরদিন সকালে এয়ারফোর্সের একটা ছোটো চেতক(ফ্রেঞ্চ মেক অ্যালিউট)হেলিকপ্টার পৌঁছল।ট্রলির ওপর উড়তে গিয়ে বোঝা গেল, এতে হবে না। কারন পাসের স্টীল কেবল এত কাছে, যে কোনও মুহুর্তে হেলিকপ্টারের ব্লেডে লেগে যেতে পারে। তাই ডাক পড়ল মাঝারী সাইজের রাসিয়ান Mi-17 হেলিকপ্টারের।

ততক্ষনে নাহানের প্যারা কম্যান্ডোরা এসে সিচুয়েশন স্টাডি করতে শুরু করেছে।একজন ক্যাপ্টেন একটা মেগা ফোন নিয়ে চীৎকার করে ঘোষনা করলেন,

“ভয় নেই, হেলিকপ্টার আসছে আপনাদের উদ্ধারে, যদি আপনারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন, তো একটা কাপড় উড়িয়ে আমাদের জানান দিন।” একটা হলুদ ওড়না নাড়তে দেখা গেল।তার মানে মেগা ফোনের আওয়াজ ট্রলি পর্জন্ত পৌছচ্ছে।

সকালের খবরের কাগজে এই খবর পড়ে চণ্ডীগড় থেকে দলে দলে লোক মজা দেখতে এসে গেল। রাস্তায় ভিড় ঠেকাতে আবার এয়ার ফোর্স আর আর্মি কম্যান্ডো নামাতে হলো। সাথে হিমাচল পুলিশ।যাকগে সে কথা।

অপারেশন টিম্বার ট্রেলঃ

প্যারা কম্যান্ডো আর এয়ার ফোর্সের পাইলট মিলে বেস স্টেশনে একটা ট্রলি নিয়ে সব দিক স্টাডি করে তিনটে প্ল্যান তৈরি করলেন।

Plan-A:

হেলিকপ্টারকে ঠিক ট্রলির ওপর হোভার(উড়ন্ত অবস্থায় আকাশে স্থির হয়ে থাকা)করে একজন কম্যান্ডোকে উইঞ্চ* দিয়ে ট্রলি তে নামিয়ে দেবে। তার পর আটকে থাকা যাত্রিদের এক এক করে উইঞ্চ এর মাধ্যমেই বের করে আনা হবে। হেলিকপ্টারের ব্লেডের হাওয়াতে ট্রলি ভীষণ দুলবে, আর তার মধ্যেই উইঞ্চের বাকেট সিট কে ট্রলির মাথায় নামাতে হবে। পাইলটের স্নায়ু আর সক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা।

*উইঞ্চঃ হেলিকপ্টার থেকে একটা সরু তার দিয়ে ঝোলানো চেয়ার বা বাকেট সিট। তাতে বেঁধে লোক নামানো/ওঠানোর ব্যবস্থা করা যায়।টেলিভিশনেবন্যা, ডুবন্ত জাহাজ বা পাহাড়ি ঢলে আটকে পরা লোকদের বাঁচাতে দেখা যায়।

Plan-B:

ট্রলি কে স্টীল কেবল থেকে আলাদা করে হেলিকপ্টারের নীচে আন্ডারস্লিং* করে যাত্রী সমেত ট্রলি কে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত জায়গায় নামানো।

* আন্ডারস্লিং -হেলিকপ্টারের পেটের নীচে একটা শক্ত হুকে গাড়ি, কামান, যুদ্ধ ট্যাঙ্কস্টীলের তার দিয়ে বেঁধে নিয়ে উড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা।

Plan-C:

ট্রলি কে আরোও একটা তারের সাথে বেঁধে, ধীরে ধীরে নীচে নামানো। তার জন্য রাতারাতি দিল্লি থেকে ৩০০ মিটারের তার আনা হয়ে গেছিল।

সব কিছু বিচার করে Plan-A কেই সবচেয়ে স্যুইটেবল মনে হলো।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফালি হোমি মেজর নিজে ‘ক্যাপ্টেন অফ দি হেলিকপ্টার’। সঙ্গে কো-পাইলট পি উপাধ্যায়। এই Mi-17 হেলিকপ্টারে চার জন এয়ার ক্রু থাকেন। ক্যাপ্টেন, কো-পাইলট, ফ্লাইট এঞ্জিনীয়র, আর ফ্লাইট গানার। 

এই অপারেশনে এঞ্জিনীয়র পাইলটদে’র সাহাজ্য করবেন সমস্ত ইন্সট্রুমেন্টের দিকে নজর রেখে তার প্যারামীটার ঠিক রাখতে। আর গানার অপারেট করবেন উইঞ্চ মোটর। উইঞ্চের তার ১২০ ফিট লম্বা। 

তার মানে ট্রলি’র ছাদ থেকে এই উচ্চতাই স্থির হয়ে হেলিকপ্টার’কেউড়তে হবে, ততক্ষণে প্যারা কম্যান্ডোকে নীচে নেমে এক এক করে কাজ গুলো করতে হবে। দুপুর ১১টা থেকে বেশ কয়েকটা বৃত্তাকারে ঘুড়ে হেলিকপ্টার থেকে কম্যান্ডোরা ট্রলির অ্যাকচুয়াল কন্ডিশন দেখে আর মেপে নিল।

আড়াইটে নাগাদ টিম্বার ট্রেলে’র দিক থেকে একটা তারে বেঁধে আটকে থাকা ট্রলিতে খাবার জল আর শুকনো খাবার পৌঁছন গেল। দুর্ঘটনার ২২ ঘন্টা পরে।ততক্ষনে গুরমীত ডিহাইড্রেশনে হলুদ হয়ে গেছেন। জল একটা বিশাল রিলিফ দিল সেই মুহূর্তে।

বিকেল তিনটের পরে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফালি মেজর তার হেলিকপ্টার থেকে কম্যান্ডো’ মেজর কাস্ত্রোকে ট্রলি’র ওপর নামাতে পারলেন। 

মালিনীর মত সবার কাছেই, কাস্ত্রো তখন দেবদূত। একটা দোদুল্যমান ট্রলিতে কাস্ত্রো’র পৌঁছনো মানেই রেসকিউ অপারেশনের সাফল্য প্রায় নিশ্চিত।

ট্রলির দরজা লক। তাই ছাদের ওপরে একটা হ্যাচ দিয়ে মেজর কাস্ত্রো ট্রলীতে ঢুকে পরলেন। প্রত্যেকেই ভীত আর ক্লান্ত। ট্রলি থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার প্রসিডিওর বোঝাতেই কেউ আর সাহস করে বেরতে চাইলেন না। মেজর কাস্ত্রো’র কাছে তাই প্রথম টার্গেট একজন শক্ত সমর্থ যাত্রী। যাকে উইঞ্চ করে পাঠাতে পারলেসেটা দেখে বাকীদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে।

মেজর কাস্ত্রো’র কাছে জয়দীপ ছিলো বেস্ট বেট। তাকে উইঞ্চের চেয়ারে বেঁধে কাস্ত্রো সিগনাল দিলে ধীরে ধীরে চেয়ার সুদ্ধ জয়দীপ উঠে গেল হেলিকপ্টারে। তুমুল হর্ষোল্লাসের মধ্যে প্রথম যাত্রী উদ্ধার। 

সেকেন্ড কে?

গুরমীতকে রেডি করা হলো। সবচেয়ে মুস্কিল, গুরমিত অসুস্থ, দুর্বল। ভয়ে ট্রলি ছেড়ে নড়তে চাইছে না। কি অদ্ভুত! একটু বলপ্রয়োগ করে গুরমীতকে হ্যাচ দিয়ে বের করা গেল। 

নেক্সট!

এবার চার বছরের বিশাল। নাম বিশাল হলে কি হবে। এই পুঁচকেকে কে নিয়ে যাবে? ছোটো বাচ্চাদের সাধারণত কারুর সাথে বেঁধে উইঞ্চ করা হয়ে থাকে। বিশালে’র বাবা হরিত কিছুতেই সেই রিস্ক নিতে পারছেন না। পঙ্কজ সেই দ্বায়িত্ব নিতে রাজি হলেও, বিশালের মা হরমেশ বললেন,

“বাবা হিসেবে তুমি’ই ওকে সবচেয়ে ভালো রক্ষা করতে পারবে”!

হোয়াট অ্যান লজিক(আইডিয়া)সারজী!

মেজর কাস্ত্রো চেয়ারে হরিতকে বেঁধে, তার সঙ্গে বিশালকে স্ট্র্যাপ করে তুলে দিলেন উইঞ্চে। 

সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে দিনের আলো কমে এল। হেলিকপ্টার ফিরে এল বেস’এ। পাঁচ জনকে উদ্ধার করা 

কি ভাবছেন? আরোও পাঁচজন থেকে গেছেন? 

না, আসলে ট্রলিতে এখন ছ’জন। মেজর কাস্ত্রো ট্রলিতেই থেকে গেছেন রাত কাটাতে, যাতে যাত্রীদের মনোবল ঠিক থাকে। 

“ঘড়মে মেরা দো বাচ্চা হ্যায়। অউর ম্যায় আপকে সাথ হু। তার মানে ভয়ের কিছু নেই”।

কত বড়ো কলজে থাকলে এরকম প্রবোধ দেওয়া যায়?

যারা উদ্ধার হলো তাদের মধ্যে কিন্তু আনন্দ নেই। প্রত্যেকের পার্টনার, আত্মীয় একজন করে থেকে গেছে ট্রলিতে।

এদিকে সন্ধ্যে হতেই গুলাম মহম্মদ নামের এক ট্রলি অপারেটর অন্য ট্রলিতে চেপে এই ট্রলিতে কম্বল, খাবার আর জল দড়ি বেঁধে পৌঁছে দিয়ে গেল।

পরদিন, মানে ১৫’ই অক্টোবর, সকালে Mi-17 হেলিকপ্টারে জান্ত্রিক গোলোজোগ দেখা দিলে সারসাওয়া থেকে আরও একটা হেলিকপ্টার উরে আসে। যাই হোক, সকাল দশটার মধ্যে এক এক করে বাকি পাঁচ যাত্রীকে ঐ ঝুলন্ত ট্রলি থেকে তুলে আনা গেল।

সব শেষে উঠে এলেন মেজর কাস্ত্রো।অপারেশন টিম্বার ট্রেল সাফল্যের সাথে সম্পূর্ণ হলো।




স্পেশাল নোটঃ

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফালি হোমি মেজর, এই অপারেশনে তার অদম্য সাহস আর কর্মকুশলতার জন্য ‘শৌর্য চক্র’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তিতে, ২০০৭ সালে, প্রথম হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের সর্বোচ্চ পদে মানে চীফ অফ এয়ারস্টাফ (CAS)হয়েছিলেন। 

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পি উপাধ্যায়কে আমি দেখেছি ২০০৬ সালে,১১৯ নং হেলিকপ্টার ইউনিটে, এয়ার ফোর্স থেকে রিটায়ার করার আগে আমার কম্যান্ডিং অফিসার (তখন উইং কম্যান্ডার) হিসেবে। উনি এই অপারেশনে বায়ু সেনা মেডেল পেয়েছিলেন।

মেজর কাস্ত্রো’পেয়েছিলেন কীর্তি চক্র। শান্তি’র সময়ে মেডেল হিসেবে এটি দ্বিতীয়, প্রথম হচ্ছে আশোক চক্র, আর তৃতীয় নম্বরে শৌর্য চক্র। ২০ বছর আর্মিতে চাকরি করে কর্নেল কাস্ত্রো রিটায়ার করেছেন। এখন অস্ট্রেলীয়া’র সিডনী’তে একটা স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক। কম্যান্ডো’দের খবর বেশি জানাও যায়না। হয়ত বা সেদিনের পাকিস্তান অপারেশনে তার কোনও চেলা ভেল্কি দেখিয়েছে!

জানিনা প্রেস মিডিয়া এই অপারেশনকে সার্জিক্যাল বলবে কিনা। তবে, বেশ কিছুদিন ধরে, দেশে’র কিছু বুদ্ধিজীবী বা সবজান্তা রাজনেতা, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণূতা বা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে, আর্মি তথা সমস্ত সেনা বাহিনীকে অমানবিক,অত্যাচারী, পক্ষপাতদুষ্ট বলে গালাগালি করছেন।অনেকে আবার মিথ্যেবাদী বলে অপারেশনের প্রমাণ চেয়েছেন।

এই টিম্বার ট্রেল অপারেশনে এয়ার ফোর্সের এক‘পার্সি’ পাইলট সঙ্গে এক ‘ব্রাহ্মণ’ তনয়’কে নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে আর্মি’র এক গোয়ানিজ ‘খ্রিষ্টান’ কম্যান্ডো’কে ঝুলন্ত ট্রলিতে নামিয়ে‘গুরু গ্রন্থ সাহেব’ আর ‘হনুমান চাল্লিশা’ পাঠ করা যাত্রীদের উদ্ধার করেছিলেন।

এটাই হচ্ছে আমাদের ভারতীয় সেনা বাহিনীর ধর্ম। মানুষের সেবা আর সুরক্ষা। আর এটাই শ্রেষ্ঠধর্ম।







5 comments:

  1. আগেও পরেছি তখনো গায়ে কাঁটা দিয়েছিল...আজ আবার পরলাম, আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল... সত্যি কাকু আপনার মতো একজন মহান মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করি...

    ReplyDelete
  2. Kichu bolar nai, sudhu onubhob korlam

    ReplyDelete
  3. Bivas Da, it's a matter of sheer delight reading your incredible experiences or knowledge about the Indian Air Force/ Army through your unmatched narration dipped in the sauce of subtle wit!! It's really a privilege to have known you!! All true Indians have great regards for their armed forces but it is your insightful writing that has started making them love and feel their protectors!
    This act of rescue under the then Air Chief Marshall Fali Homi Major is another feather in the lustrous cap of Indian Air Force - the only Air Force in the world which has remained unbeatable till date!! Jai Hind!!!

    ReplyDelete