প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
যাপনকথা
চয়ন
বড় অস্থির সময়। চারিদিকে উচ্চরব। ধর্মঘোষ। ধনতন্ত্রের নির্ঘোষ : এস বিচ্ছিন্ন হও। কারণ, তুমি পৃথক। তুমি কেবল নিজের কাছেই বলি প্রদত্ত। ইংরিজি বলা ক্রিয়াযোগী গীতার নব ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন : সব্যসাচিন্ নিমিত্ত মাত্র তুমি তবে নিষ্কাম কর্ম বলে কিছু নেই। তুমি শত্রু হনন করে সাম্রাজ্যবিস্তারের ব্রতে নিয়োজিত। ঠিক এই সময়ে আমার যাজ্ঞবল্ক্যকে খুব মনে পড়ে। সেই কোনকালে তিনি বুঝেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তাকে বৃহৎ এক সমষ্টি সত্তার অংশ হিসেবে না জানলে জীবনের প্রকৃত রূপ অনুধাবন সম্ভব নয়। এই জানাটা খুব জরুরি। কারণ, বিচ্ছিন্ন এককের বোধ মিথ্যে না হলেও অসম্পূর্ণ। একক ব্যক্তি ভাবে সে না থাকলে কিছুই নেই। ভেতরে ভেতরে সে মৃত্যুর চরম আর্তিতে ক্লিষ্ট। এই আত্মদীর্ণ মানসিকতাকেই এক নকল একীভবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিচ্ছিন্নতাকামীরা অতি সহজে ব্যবহার করতে পারে। তাই তার জানা দরকার যে সে ব্রহ্ম বা এক বৃহৎ অস্তিত্বের অংশ। আত্মন্ জেনে নিক আত্মা অক্ষয়, অমর। কারণ, সমগ্র জনগোষ্ঠীর যা কিছু প্রেয়, যা কিছু শুভ, যা কিছু আনন্দময় তাই হলো আত্মা। অ মৃত সে। তাই সে অমৃত। এই অমর্তের সন্তান হিসেবে নিজেকে জানলে আপনা থেকেই জানা হয়ে যায় যে বাকী মানুষজনও তাইই। আর তাই, হিংসা তার দ্বারা অসম্ভব। আত্মার জ্যোতির উদ্ভাস হলো এই জ্ঞান। নিজেকে জানা। যাজ্ঞবল্ক্য বলেন যে আত্মার জ্যোতিকে চেনার আগে আরেক জ্যোতিকে দেখতে হয়। বস্তত এই উদ্ভাসকে না চিনলে আত্মদীপ হওয়া সম্ভব নয়। সূর্য চন্দ্র অগ্নি নিভে গেলেও এই জ্যোতি জাগরূক থাকে। এই জ্যোতি বাক্ এর। বাগেবস্য জ্যোতির্ভবতীতি। এই বাক্ আরাধনাতেই সত্য জ্ঞানের সাধনা।
টালমাটাল সময়েও ঋতের পথ ছাড়েনি ঋতবাক। ঋত সত্য, ঋত নীতি, ঋত বিশ্বসৃষ্টির অলঙ্ঘ্য নিয়ম। ছাড়েনি কারণ ছাড়তে পারেনি। ঋত ও বাক্-কে নিয়ে তার যাপন আর উদযাপন দুইই। ঋতবাকের সাধনা আলাদা হওয়ার নয়। হাত ধরার। নিজেকে বঙ্গভাষী এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে জানে বলেই ঋতবাক নেমন্তন্ন পায় জগতের আনন্দযজ্ঞে। সেখানে গোঁসাই উল্লিখিত হাত সাফাইয়ের হাত বা চোর, সাধু, ডাকাতকে দেখে না সে। দেখে সমমনস্ক, সহৃদয়, সমানুভূতিসম্পন্ন বহু আত্মজনকে। তাঁরা ঋতব্রতী। তাঁরা আত্মসুখের তোয়াক্কা না করে ভূমার আনন্দে তৃপ্ত। বাঙালি আত্মঘাতী? বাঙালি বাজার নিয়ন্ত্রিত? বাঙালি আমোদগেঁড়ে? হালকা মজায় মজে থাকা মধ্যমেধার কদরদান? সত্য। তবে শেষ সত্য নয়। প্রতি বয়ানেরই প্রতিবয়ান থাকে। থাকে বলেই ৩ আষাঢ়, ১৪২৪ সন বা ২০১৭ সালের ১৮ জুন ঋতবাকের বই উৎসবে শোভাবাজার রাজবাড়ির গোপীনাথ মন্দিরে জড় হন দুশ-এর ওপর মানুষ। তাঁরা সেতারে এক ঘন্টা ভীমপলাশী শোনেন তন্ময় হয়ে; তাঁরা বিভিন্ন রাগে গাওয়া মেঘদূতের শ্লোকের সঙ্গে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্য দেখে পুলকিত হন। সেদিন আবার ভারত - পাকিস্তানের ক্রিকেট যুদ্ধ। খেলার রাজনীতিকরণ আর ধর্মীভবন ঘটিয়ে আস্তিন গুটিয়ে উচ্চনাদে দেশপ্রেম ঘোষণার দিন। তবু, তার মধ্যেও যাঁরা এলেন, শুদ্ধ রসের স্বাদ গ্রহণ করলেন, হাতে তুলে নিলেন ঋতবাক নির্মিত পাঁচটি বই যার একটিও বাজারের দাবি মেনে পাবলিককে 'খাওয়ানো'র জন্য নির্মিত হয়নি, তাঁরা আমার চোখে আগ্রাসী পুঁজিবাদের রচা সাংস্কৃতিক বয়ানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন একটা। 'ভেবেছ কি উদ্ধতের হবে না শাসন?/ জাগেনি কি সুপ্ত হুতাশন?/ বিদ্রোহের বাজেনি সানাই?/শব্দ আছে প্রতিশব্দ নাই?' ধর্ম জনতার আফিম। আবার, সেই তার piece of resistance। সেকারণেই, শোভাবাজার রাজপরিবারের গোপীনাথ সেই মুহূর্তে এক শৈল্পিক প্রতিরোধের রূপক হয়ে উঠলেন। এই মন্দিরে কোনও ধর্মীয় ভেদরেখার শাসন মানা হয় না বহুদিনই। তাই, সেই মানবমিলনক্ষেত্রে সমবেত জ্ঞানীগুণীজন বিগ্রহের মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন ভাস্কর্যের সুষমা, তাজমহলের রূপকার ওস্তাদ ইশার বংশজ ইশা মুশা খাঁর নকশা থেকে গড়ে ওঠা নাটমন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যে সন্ধান করলেন ইন্দো -ইসলামিক প্রভাবের। আমি দেখলাম প্রাণ আছে -- এখনও প্রাণ আছে।
পূর্বের ঋষিরা ছিলেন ঋতবান। বাণীর আত্মাকে তাঁরা জেনেছিলেন আপন সত্তা বলে। ভাষা- যাপনকে দেহ -মন দিয়ে অনুভব করে তাঁরা বুঝেছিলেন ওঙ্কার আত্মৈব। আত্মনই বাক্। আজকালকার ভাষায় বলতে গেলে ভাষা দিয়ে গড়া আমার Self-hood। কথায় কথায় গড়া যাপন। যাপনকথাই আত্মকথা। আঁত ও কথা যখন এক হয় তখনই আলো ফোটে। চারপাশে যদি তখন ঘন অন্ধকারও থাকে তবুও আমরা বলতে পারি ক্রমে আলো আসিতেছে। ঋতবাকের আখরযাপন উৎসবে দাঁড়িয়ে আমি দেখে এলাম এক শাশ্বতী মহা উষার উদ্ভাস। বাইরে তখন রাত নেমেছে।
0 comments: