2

ছোটগল্প - ঐশী রায়

Posted in


ছোটগল্প


আত্মদীপ
ঐশী রায়



লেবং কার্ট রোডের এই চারতলা বাড়িটায় এসেই সকলে একবার না একবার জ্বরে পড়েছে। অক্টোবরের আবহাওয়ার এত দ্রুত পরিবর্তন সহ্য হয়নি সকলের, কিন্তু এখন অনেকটাই সুস্থ ― ছোট বোনটিকে সেই কথা জানিয়ে আশ্বস্ত করতে চিঠি লিখছিলেন তিনি। বো সেবাযত্নের ত্রুটি করে না। সে সত্যই আজকাল জ্যেষ্ঠা ভগিনী হয়ে উঠেছে। যদিও হিমালয়-সকাশে তাঁর হৃদয় আবার প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে, তবু মাঝে মাঝে নিজের নিষ্ক্রিয়তায় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। জ্ঞান-মুহূর্ত থেকে বিশ্রাম নেওয়ার অভ্যাস নেই; দেশের এই পরিস্থিতিতে তাঁর কি বিশ্রাম সাজে? আর খোকার সেই সাধের মন্দির তৈরীর কাজ? এ কাজে ঐ আত্মভোলা ছেলেটির পাশে তো তাঁকেই থাকতে হবে! আজকের এই প্রেক্ষাপটে ওর মত সাধকেরই তো প্রয়োজন, বিশ্বদরবারে ভারতবর্ষকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার জন্য। স্বাধীনতার অভাবে যে মহা-বিহঙ্গ জরাগ্রস্ত হয়ে পদদলিত হচ্ছে!

স্বাধীনতা ! স্বাধীনতা !! সে কি ভিক্ষামূল্যে হাত পেতে নেওয়ার বস্তু! আশ্চর্য! বিদেশী হয়ে ক্রপটকিন যা বুঝেছিলেন, তা অধিকাংশ ভারতীয় নেতাই আজও বুঝতে চান না! তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন — সেই হল বীর, যে লড়াই করে,লড়তে ভালবাসে। লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই করো―কিন্তু তাতে নীচতা বাতিক্ততা যেন না থাকে... যখন সংগ্রামের ডাক আসবে, যেন ঘুমিয়ে থেকো না।ছাত্রসমাজ ―এই ভগ্নস্বাস্থ্য গ্র্যাজুয়েটের দল ―এরা দেশের কোন উপকারে আসবে?

মরিস কলেজের ক্রিকেট খেলার পুরস্কার বিতরণে গিয়ে ক্ষোভ আর সংযত করতে পারেননি সেদিন। পরদিন দশেরায় তরবারি খেলা, মল্লযুদ্ধের প্রদর্শনী দাবি করেছিলেন। মর্মান্তিক আহত হয়েছিলেন দেশমুখ নামক সেই অস্ত্রচালনা-পারঙ্গম ছেলেটির স্বীকারোক্তিতে— আখড়ায় গিয়ে শরীরচর্চা অস্ত্রচর্চা করা ছেলেগুলিকে ছাত্র-অধ্যাপকেরা নীচু চোখে দেখেন! ঠিক যেমন বড়লাটের নীচতা সমগ্র বিশ্বের সামনে স্বউদ্যোগে বেআব্রু করে দেওয়ার পরেও সেই ইনস্টিটিউট হলে শ্রোতা হয়ে অপমান সহ্য করা ছাত্রসমাজের মৌনতা পীড়া দিয়েছে তাঁকে বহুকাল।

কিন্তু সময় তো থেমে নেই। মায়ের দুরন্ত ছেলেরা একের পর এক বন্দেমাতরম্ বলে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে, আশায় নয়, নিরাশায় নয়, দৃঢ়নিশ্চয় নিষ্কাম কর্মে। মাসখানেক আগেই বন্ধুকে চিঠিতে লিখছিলেন কানাইলালের কথা—কানাইলাল দত্ত—এই তো সেদিনের কথা! আদালতে উঠে স্বকণ্ঠে দাখিল করলে- There shall be no appeal ! কে হত, কে-ই বা সংহারক? প্রশ্ন তুলে দিল—সাক্ষাৎ গীতা-মূর্তি যেন ! স্বামীজীর সর্বকনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ—যুগান্তর মামলার প্রধান অভিযুক্ত, ব্রিটিশ বিচারালয়ের সঙ্গে অসহযোগ করে অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দিল। ইয়েস্, ওয়ান মোর ফর দ্য অল্‌টার— যেমনটি লিখেছিলেন অরবিন্দ। অরবিন্দ! মাকে যখন প্রণাম করতে এলেন, মা বললেন “এইটুকু মানুষ, এঁকেই গভর্ণমেন্টের এত ভয়!” ওশন্‌স্ প্রোটিজি-র পর এঁকেও ব্রিটিশ ভারত ছাড়তে হবে। ব্যবস্থা করতে হল তাঁকেই, পুনর্বার। শামসুল আলম হত্যা মামলার পরেই পুলিশের গ্রেপ্তার পরোয়ানার খবর এল। সতর্ক করেছিলেন তিনি আগেই। শেষে বোন সরোজিনী এসে সংবাদ দেওয়ার পরই সিদ্ধান্তে সহমত হলেন অরবিন্দ। বাসাবাড়ি থেকে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সেদিন গভীর রাতে নৌকায় তুলে দেওয়া...

চিন্তায় ছেদ পড়ল। ডাক্তার সরকার এসেছেন খোঁজ নিতে। প্রায়ই আসেন,মাঝে মাঝে দেখা করে যান কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীবন্ধুও। সন্ধ্যা অবধি কেউই থাকেন না। সকলেই জানেন, ওটুকু সময় একান্তই তাঁর নিজের। ধ্যানে ডুবে থাকবার সময়।

--------------------------------------

অসুস্থতার হেতু যে অনেকাংশে তিনি নিজেই, সে কথা অস্বীকার করা নিরর্থক। অনাহারে, অল্পাহারে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কর্মযোগ-সাধনে শারীরিক ক্ষতির মাত্রাটাই দিনে দিনে বেড়েছে।

এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়— সেই তাঁর পরম গৌরব। অ্যালবার্ট হলের সেই বক্তৃতা থেকেই ওঁর সংগ্রামের সূচনা। শিক্ষার অহংকারে বাঙালী সেদিন বিদ্রূপ করেছিল তাঁর ধর্মচেতনাকে, তাঁর মাতৃস্বরূপাকে। অথচ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন— ধর্মকে যে নামই দেওয়া হোক, তা চিরকালই মৃত্যুপ্রেম! কলমে ভর করেছিল দৈবশক্তি, লিখেছিলেন মায়ের উপাসকদের আহ্বানবাণী, যারা মৃত্যুপ্রেমিক, জীবনলুব্ধ নয়, তারা মাতৃনির্দেশে এখন ঝাঁপ দেবে ত্যাগে, শ্রম, পীড়ন, যন্ত্রণা হবে মধুময়...

মায়ের সেই ডাক তাঁর মাধ্যমে পৌঁছেছিল অভীষ্টে— তিনি নিশ্চিত জানেন, মনে গেঁথে আছে সেই মুখগুলোর ছবি, তাদের চিঠি— তবু সে নাম প্রকাশ করতে বারণ! কৃষ্ণমেঘের অন্তরালে বজ্রের মতো তাদের আত্মগোপন করে থাকতে হয়; অগ্নিমন্ত্রের সার্থকতা যে তার মন্ত্রগুপ্তিতেই!

প্রতিরোধ কিছু কম আসেনি। মঠের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হওয়ায় নানা কুৎসা রটেছে। অবশ্য বিচলিত নন তিনি— যারা বুঝতে চায় না, তারা কখনোই বুঝবে না যে সন্তান স্বাধীন পথ বেছে নিলেও পিতার সঙ্গে তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ থাকে। অসুস্থ হয়ে যখন শয্যাশায়ী অবস্থায়, মঠের অধ্যক্ষই কি সেদিন স্বয়ং ছুটে আসেননি? পিতৃস্নেহের অধিকারে তিরস্কার করেননি নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তাঁর এহেন উদাসীনতাকে?

আবারও মনে পড়ে কবির কথা। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন বলেই, বিপ্লবে সহযোগিতা চেয়ে রূঢ় প্রত্যাখ্যানে বড় আহত হয়েছিলেন। নিগু-র “আইডিয়াল্‌স্”— ভারী পাণ্ডিত্যপূর্ণ কীর্তিতে সেদিন উৎসাহভরা সাহায্য ঢেলে দিলেও তা আজ তাঁর নিজের একটা বড় ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বালিগঞ্জ-গোষ্ঠীর বিষয়ে মোহভঙ্গ আগেই হয়েছিল। সম্প্রতি কবি তাঁর নতুন মহাকাব্যিক উপন্যাসের নায়ক-চরিত্র গড়েছিলেন তাঁরই আদলে। আদর্শগত সংঘাতে নায়কের জীবনে নেমে আসা ট্র্যাজেডি-র অন্তর্নিহিত অর্থটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। তাঁর প্রতিবাদে বিচলিত হয়ে পরিণতিটুকু বদলেছিলেন লেখক, কিন্তু মতপার্থক্যের বিভাজনটুকু আর কোনওদিনই মু্ছে যায়নি। তিনি জানেন, ভাবীকালের এক বড় অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ থেকে যাবে এই অধ্যায়টিতে।

তখন ওঁর যাবতীয় চিঠিপত্রে তল্লাশী চালানো হচ্ছে, পোস্টমাস্টারের অতিরিক্ত কৌতূহলকে বিদ্রূপ করে পত্রাঘাত করলেও বিশেষ সুরাহা হয়নি। কিন্তু ইংল্যাণ্ড রাজপরিবারেও যাঁর ঘনিষ্ঠ কর্মসহযোগী উপস্থিত, তাঁর পক্ষে ছদ্মনামে দেশ ছাড়া কি কঠিন? একটি গ্রীক অক্ষরের অন্তরালে দুটি বছর বিদেশে যাপন করতে আপাতভাবে কোনো সমস্যাই হয়নি। পুলিশ সন্ধান করেছিল বটে, কিন্তু শুভ্রবস্ত্রের মহিমায় চোখে ধাঁধাঁ লেগেছিল। সম্পূর্ণ “সেক্যুলার” বেশে জাহাজ থেকে অবতরণ-কালে কৌতুকবশতঃ তিনি উপযাচক হয়ে কিঞ্চিৎ আলাপচারিতা করলেও দৃক্‌পাতমাত্র করেনি। চার বছর আগের স্মৃতিপট বেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ভেসে ওঠে তাঁর।

এক-এক সময় স্বপ্নের মতো ভেসে আসে আরো কয়েকটা মুখ। কনে-সাজে শিবের সঙ্গে তাঁর ছোট্ট গৌরী, অচিরে বিধবা হয়ে অনাদরে পিতৃগৃহে ফেরা গিরিবালা, মহামারীর কবলে শেষ-নিশ্বাস ত্যাগের আগে গলা-জড়িয়ে-ধরা শিশুটি— এরাই যেন কোনো অন্তর্মুখী মুহূর্তে এই চুয়াল্লিশ বছরের অযত্নলালিত রোগজর্জর শরীরটিকে ঘিরে থাকে।

মৃত্যু আসন্ন। পূর্ণ-আনন্দরূপ মৃত্যু।

--------------------------------------

আজ বড় আনন্দের দিন। আজ তিনি গুরুর হাতে-গড়া প্রতিষ্ঠানে নিজের যথাসর্বস্ব উইল করে দিলেন । তৃপ্ত হয়ে বললেন, এক ব্রত নিয়েছিলাম ব্রহ্মচর্যের; শেষ মুহূর্ত অবধি তা পালন করে যাব।

ওয়াহ্ গুরু কি ফতে— ভারতদর্শনের পাণ্ডুলিপির উৎসর্গপত্রে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিল খোকা...

আজকাল জপমালা হাতে জপ করতেও অক্ষম তিনি। কেবল আপনমনে বারংবার উচ্চারণ করেন “অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মাঽমৃতং গময়...”

মনে পড়ে দীক্ষান্তে গুরুর নির্দেশ “বুদ্ধকে অনুসরণ করো”। সকলেই বলে গুরুর আশীর্বাণী-মতো হীরোজ উইল, স্যুইটনেস অফ দ্য সাদার্ণ ব্রীজ, সেক্রেড চার্ম, স্ট্রেন্থ সবই তো প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এক সংক্ষিপ্ত মহাজীবনে। কেবল তিনিই আজও প্রতিদিনের মতো প্রিয় বন্ধু দীনেশচন্দ্রের দেওয়া প্রজ্ঞাপারমিতা-মূর্তিতে দৃষ্টি রেখে নিজের মনকে অধীর প্রশ্ন করে চলেন, দধীচির মতো অস্থি দিয়ে বজ্রানল প্রজ্জ্বলিত করা কি সম্পূর্ণ হয়েছে? আত্মদীপ হওয়ার স্বপ্ন—

“...আবিরাবীর্ম এধি, ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি...”

--------------------------------------

খোকার উদ্বেগ-ভরা মুখের দিকে চেয়ে – আরও একবার- সর্বগ্রাসী স্নেহ ছেয়ে এল মনে। তিনি নিশ্চিন্ত, তিনি আশ্বস্ত। কিন্তু ওদের সান্ত্বনা কীসে হবে?

প্রভাত আবির্ভূত। ভবিষ্যৎ-ভারতের সন্তানের তরে আগত ঊষা অস্তমিত।

হিমালয়ের শিরশ্চুম্বন করে প্রথম আদিত্যরশ্মি প্রবেশ করল রোগশয্যাগৃহে।

“তরণী ডুবছে, কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখব।”

ওরা শুনেছে। তাঁর কাজে এবার ইতি। আর নয়। গুরুদেবের বাণীতে চিত্ত সংহত করেন তিনি —

সাহসে যে দুঃখ-দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে, কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা...Then come, O mother, come!

চোখের পাতায় অন্ধকার জমে আসে। সেই অন্ধকারের মধ্য থেকে প্রতীয়মান হয় এক কৃষ্ণবর্ণ জ্যোতিঃপুঞ্জ। অবাক বিস্ময়ে তার মুখের পানে চেয়ে থাকেন তিনি।

একি তাঁর মানবী-মা, না দেবী-মা ?

পরিচয়বোধের সংজ্ঞা লুপ্ত হয়েছে। মৃত্যুরূপা মাতা দুই হাত বাড়িয়ে দেন। 

সব-পেয়েছির আনন্দে হাসিতে উছলে উঠে সেই মাতৃমূর্তির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েন চিরকালের অবোধ খুকি নিবেদিতা।

2 comments: