0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in


ভোর সাতটা চুয়ালিশ, ফ্ল্যাট লগ্ন রাস্তায় হেঁকে যাচ্ছে মাছওয়ালা - হেই মাইছ, মাইছ, মাইছ, দেশি রুই, ভেটকি, পদ্মার ইলিশ, বাগদা চিংড়িইইই---

দু’পাত্তার মাস্ক পরে দাঁত কিড়মিড় করে গালি দেয় ফ্ল্যাটবাড়ির কোর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারক – শালা লুম্পেনের জাত - সকাল না হতেই বেরিয়ে পড়েছে - কারও মুখে মাস্ক নেই - করোনা কি সহজে ছাড়বে বাংলাদেশ! নুইসেন্স পিপলকে ব্রাশ ফায়ার করা উচিত ।

বিচারকের বিরক্তি ব্রহ্মতালুতে দপদপ করছে। অযথা গে্টম্যানকে ডেকে কভিড১৯ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছে, এসময় পুরানো কাজের বুয়া দিনুর মা ধাই করে লিফট থেকে বেরিয়ে আসে। পলকে একবার তাকিয়ে হনহন্‌করে চলে গেল সামনে দিয়ে। ব্যাজার মুখ। মশার কামড়ে ডোগা ডোগা হয়ে ফুলে উঠেছে হাত কপাল। মশারি কিনবে বলে গেল কাল বিকেলে টাকা চেয়েছিল। তিনি দেননি। তার বিচার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। দিনুর মা তার বাসায় অল্প মাইনের ঠেকা কাজ করে। তাও একবেলায়। সুতরাং মশারি কিনে দেওয়ার দায় তার নয়। দিনুর মা যে বাসায় বেশি টাকার কাজ করে, রাতে থাকে - এ দায় তাদের।

এরমধ্যে ঢুকে পড়েছে জুতা সেলাই, ছাইওয়ালি। ছাইওয়ালির গলা যেন ছর্‌রা কার্তুজের গোলা। তাদের বারো তলা বিল্ডিংএর সব ক’টা ফ্ল্যাটের জানালায় এসে ছাইয়া ছাইয়া, নে ছাই নে, ছাই নে করে ধাক্কা মারে।

সাতটা পঞ্চান্ন। নয় তলার ইঞ্জিনীয়ার বউটা বারমুডা ফতুয়ার সাথে ম্যাচিং মাস্ক পরে নেমে এসেছে। বিশাল লম্বা চুল। হিপের নিচে বেণীটা দুলছে। তাকে দেখে ‘হাই আঙ্কল, সালাম’ বলে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি পিতৃসুখ অনুভব করবেন নাকি পুরুষসুখে চাগিয়ে উঠবেন এটা ভাবতে ভাবতে পাড়ার মসজিদ থেকে মাইক বেজে ওঠে।

বেওক্তে মাইকে ঘোষণা এলেই তার বুক কাঁপে।

আবার মৃত্যু সংবাদ। সাদা হয়ে যায় বিচারকের মুখ। যিনি মারা গেলেন তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার স্বল্প পরিচিত। তবে সদ্য মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী বরং বেশি চেনাজানা ছিল সবার কাছে। রেগুলার ইয়োগা করতেন ভাবি। ঝড় বৃষ্টি কারফিউ-টারফিউ কিছুই মর্নিং ওয়াক থেকে ঠেকাতে পারেনি তাঁকে। সেই তিনি করোনার শিকার হয়ে গেল সপ্তাহে মারা গেছেন হাসপাতালে। আজ মৃত্যু হলো স্বামীর। এদের ছেলেমেয়ে দুজনেই প্রবাসি। ডান বাম ইনকামের কোন কিছুই এরা স্বদেশে রাখেনি একটি ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া। শেষকৃত্যে এখন ফ্ল্যাট সমিতি শেষ ভরসা।

থুম হয়ে বসে থাকেন বিচারক। কভিড১৯ কি সোস্যাল ক্লাশ বোঝে! বেছে বেছে বড়লোক, স্বচ্ছল লোকদের ফুসফুসে থাবা বসাচ্ছে! কেড়ে নিচ্ছে নিঃশ্বাস নেওয়ার শেষ শক্তিটুকু! এ কারণেই তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এ ভাইরাস চিনা হারামখোরদের কাজ। গবেষণাগারে কভিড১৯ এর স্টেইনগুলোকে শ্রেণী সচেতনতার মন্ত্রণা দিয়ে চুপসে ছেড়ে দিয়েছে বাতাসে। মানুষের সংস্পর্শে এলেই সে মন্ত্র বেজে ওঠে, চুইং চ্যায়াঙ ঝুইং ঝ্রান, ঝাড়বংশে ধনীদের মার!

এত যে রিকশাওয়ালা, কাজের বুয়া, জুতা সেলাইকারি, সিলভারের হাঁড়িপাতিল, প্লাস্টিকের বালতি মগ বদনাওয়ালা, ছাইওয়ালি, মাছওয়ালা, সব্জী বিক্রেতারা মাস্ক ছাড়া দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কই এদের কেউ কী মরছে? এরা কবার সাবান মেখে হাত ধুচ্ছে, গরম জলের ভাপ নিচ্ছে নিয়ম মেনে? এত কি প্রোটিন খাচ্ছে শালারা কই কাউকে ত মরতে দেখছি না! বিরস মনে তিনি লাল লিফটের ভেতর ঢুকে প্লাস্টিক স্টিক দিয়ে চার নম্বর বাটনে চাপ দিয়ে মাস্ক টাইট আছে কিনা চেক্‌করে নেন।

অন লাইন পরীক্ষা হবে। করোনার কাছে কিছুতেই হেরে যাওয়া নয়। সতর্ক সুরক্ষার মধ্যে অফিস, আদালত, শপিংমল, বাজার ঘাট চালু হয়ে গেছে মে মাস থেকেই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিদের একাংশ দাবি তুলেছে ইশকুল কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হোক। লক ডাউন শেষে মৃত্যু ও আক্রান্তদের সংখ্যা কম দেখে কিছু কিছু ফরেন কান্ট্রি ইশকুল কলেজ খুলে দিলেও সেকেন্ড ওয়েভের ধাক্কায় ফের বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ শ্যেন দৃষ্টি রাখছে। কারও চাপাচাপিতে সরকার কর্ণপাত করছে না।

দুঃখজনক হল, ব্যবসা বাণিজ্য চাকরিক্ষেত্রের মত শিক্ষা অঙ্গনের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ড্রপ আউট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি বা একেবারে প্রাইভেট ইশকুল, কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের প্রায় এক অবস্থা। দেশের কোথাও ত বিনা বেতনে পড়াশুনা করার ব্যবস্থা নেই।

আজকাল কিছু কিছু কাজে কলেজে যেতে হয়। এপার ওপার চলাচলের একটি ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে আমরা যাই। কয়েকদিন ধরে মেয়েটাকে দেখছি। গুছিয়ে সংসার পেতেছে ব্রিজের উপর। সংসার বলতে দুটো বড় পলিথিনের ব্যাগে ঠাসা জামাকাপড়। ঝকঝকে বোতলে পরিষ্কার সাদা পানি। ভিক্ষার থালাটাও নিটোল সাদা। বুক জুড়ে ক’মাসের একটি ছেলে শিশু। এখনও ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠেনি। পরিচ্ছন্ন মায়ের পরিচ্ছন্ন সুস্থ শিশু।

পায়ের উপর ছেলেটাকে বিছিয়ে মাঝে মাঝে এক হাত পেতে দেয় ভিক্ষের জন্যে। অন্য হাতটি শিশুটিকে ছুঁয়ে থাকে। চোখ তোলে না কখনও। কেউ ভিক্ষে দেয়। কেউ দেয় না। কেউ কেউ দিয়ে চকিতে চেয়ে দেখে মেয়েটির দুধ স্ফীত ভরা বুক। পুরুষদের চোখে জ্বলে ছুঁয়ে ধরে নেড়ে চেড়ে আদরে চটকে খুবলানোর লোলুপ জিগীষা। আর অপুষ্ট স্তনবতী নারীরা জ্বলে ঈর্ষার আগুনে। মনে মনে গালি দেয় ঈশ্বরের বেফিকির বেকুবপানায়। যার পেটে নাই ভাত তার এমন ভরভরান্ত স্তন দিয়ে কী লাভ হল রে খচ্চর ঈশ্বর! দেহ খাঁচায় খালি প্রাণদান করতে পারা ছাড়া বাদবাকি সব কিছুতে তোর বৈষম্য রে গুরু!

আমাদের হিসাববিজ্ঞানের আপা সবজান্তা বলে পরিচিত। হিসেবি মুখ করে জানায় - বাচ্চাটা সিওর ইললিগ্যাল। আর এ অকামটা কোনো আলাম শুয়োরের বাচ্চা করেছে বুঝলে। কিন্তু এভাবে কি বাঁচবে মেয়েটা? ও তো আবার---

আমরাও কিন্তু করে থেমে যাই। মেয়েটি কি বাঁচবে রাত পুরুষদের হাত থেকে? নারীর বীজক্ষেত্র সঙ্গমের মায়া খেলার জন্যে ওৎ পেতে বসে থাকে। বীজ খসে পড়তেই কোল পেতে দেয়। সে তো হিসেব বোঝে না লিগ্যাল ইললিগ্যালের প্যাঁচ ঘোঁচ!

হঠাৎ হিসাববিজ্ঞানী আপার চোখে টলটল করে ওঠে মায়া। মাস্কের বাঁধন খুলে বলে - চলো মেয়েটাকে বলে আসি প্রোটেকশন নেওয়ার কথা। ওর দেহটা ত ওর অফিস। সেটা যেন সুস্থ থাকে----

২০২০ চলে গেল পরাজিত মুখে। একবার যে শুধু মুখ খুলে বলবে - বিদায় মানুষ, বিদায় পৃথিবী - সে উপায়ও নেই বেচারা কুড়ির। ভিলেন মরে গেলে যেমন খুশি হয়ে হাঁফ ছাড়ে সবাই, সেভাবে ‘বিদায়’ বলে সরে গেছে মানুষ। একুশ নেমেছে পৃথিবীকে রোগমুক্তির শুভাশিস নিয়ে।

তিনদিন ধরে টুনি বাল্বে সেজেছে আমাদের বিল্ডিং। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কোন তলার এক মেয়ের বিয়ে। ঘরোয়া ভাবে এখন বিয়ে সেরে ফেলা হচ্ছে। হই চই আনন্দ উৎসব করতে পারবে না বলে মেয়ে আবদার ধরেছে, অন্তত লাইট জ্বলুক। আলো হচ্ছে শুভ আর কল্যাণের প্রতীক।

প্রথম দিকে অনেকে সমালোচনা করলেও, পরে তাদের মন নরম হয়ে যায়। কেবল দু’একজন মুখফোড় বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়, এদের সখ কত! মানুষ বাঁচে না মানুষের জ্বালায়, কুট্টি একখান তাবিজ গলায়। এ দুঃসময়ে কেউ আলোক জ্বেলে বিয়ে করে!

দূর থেকে গান ভেসে আসছে। অনেকটা হামদ্‌নাত গজলের সুরে। মাস্ক পরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। কে গাইছে? বোঝা যাচ্ছে না। এক সময় একটি জীর্ণ ভ্যানগাড়ি বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়ায়। রেকর্ড করা গান বাজছে - কই গেলা গো প্রাণের বাবা, কই গেলা গো মা, আমি কারে কই আমার দুঃখ থমকিয়া থমকিয়া—

চটের মত শক্ত কাঁথায় মোড়ানো একটি খিন্ন শরীর। নিচের দিকে বাঁকানো গাছের ডালের মত বের হয়ে আছে একটি মনুষ্য পা। কেউ হয়ত দয়া করে গানটি গেয়ে রেকর্ড করে দিয়েছে। ভ্যান টেনে নিচ্ছে এক গরীব বৃদ্ধ। সে কী জানে দুঃখ কখনও থমকিয়া থমকিয়া আসে না। দুঃখ আসে স্রোতের মত। অবিরল ধারা বৃষ্টির মত। বাঁধভাঙ্গা বন্যার মত। না ফুরানো রাত্রির মত। বৃদ্ধ লোকটি মুখ তুলে উপরে তাকায়। চমকে উঠি থাই কামিনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমি। এত চেনা মুখ ! কে? কে ইনি?

স্মৃতির সড়কে গেঁথে থাকা ছবিগুলো মনে করতে চেষ্টা করি। সস্তা চশমা। সেই মুখ তুলে তাকানো। ঝলসে ওঠা কাঁচ। অপারগতায় বিব্রত। বিরক্ত মুখ। খুব চেনা। চেনাই ত! কে তবে?

চলে যাচ্ছে ভ্যান গাড়ি। আমাদের ফ্ল্যাট বিল্ডিং পেরুলেই অন্য রাস্তা। গানটা শোনা যাচ্ছে। যদিও ক্রমশ সরে যাচ্ছে দূরে। আর আমি চেনা মানূষের খোঁজে স্মৃতি পুকুরে জাল ফেলেছি।

0 comments: