0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





অনাদি কেবিন, বিজলী গ্রিল আর সেলিনা

তখনও কলকাতায় শীতকালের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কিছু বিশেষ ধরণের মজা, যেগুলো এখন বলা যায় হারিয়ে গেছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি যে শীত শীত ভাবটা আসতো, সেটা নানান রূপ আর ছন্দে থেকে যেত অন্তত জানুয়ারী মাসের শেষ অবধি। আর এই কয়েক মাসের জন্য শহরটা কেমন বদলে যেত। মেলা, সার্কাস, খাওয়া-দাওয়া আর এইসঙ্গে একটা ব্যাপার পরে যোগ হয়েছিল – কলকাতা বইমেলা। সেটা সত্তরের মাঝামাঝি। তবে বইমেলাটা হতো শীতের শেষে। সে এক বিশাল মজার ঘটনা। সে কথায় পরে আসছি।

কলকাতায় আসার আগেও, স্মৃতির যতটা গভীরে যাওয়া যায়, ততদূর হাতড়ে দেখতে পাচ্ছি বড়দিনের ভোরবেলায় বাবার সঙ্গে আমরা ট্রেনে করে কলকাতায় আসতাম সারাদিনের জন্য। আমরা মানে আমি আর ইনু। হাওড়া স্টেশন থেকে হলুদ-কালো ট্যাক্সিতে চড়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চিড়িয়াখানার দিকে যাওয়া আজও মনে পড়ে এতদিন পর। কতদিন কলকাতায় তেমন দুধ-সাদা কুয়াশা দেখিনি!

চিড়িয়াখানায় জন্তু-জানোয়ার দেখার আকর্ষণ তো ছিলই কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিল ওখানকার বিজলি গ্রিল রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া। সেখানে আর কিছু খাই না খাই, ফিশ রোল খাওয়া হতোই। ফিশ রোল! এর নানান অবতার পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে আছে কিন্তু কলকাতার এই ফিশ রোলের আবিষ্কর্তা শোনা যায় বিজলি গ্রিলই।

টাটকা ভেটকির ফিলের আলিঙ্গনে চিংড়ি আর ভেটকির পুর যখন ডিমে মাখামাখি হয়ে মুচমুচে ব্রেড ক্রাম্ব এ একটু গড়াগড়ি দিয়ে উঠে ফুটন্ত তেলে ডুব দেয় আর সোনালি-বাদামি চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে রসনা বিলাসীর কাছে সেই দৃশ্য হয়ে ওঠে এককথায় অপ্রতিরোধ্য।

অনেক ইতিহাস ঘেঁটেও এই খাদ্যবস্তুটির পূর্বপুরুষ সম্পর্কে খুব নিশ্চিত হওয়া যায় না। কিছু সূত্র অবশ্যই পাওয়া যায়। যেমন আফ্রিকার কিছু দেশে, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া বা ঘানায় ফিশ রোল বলে যা পাওয়া যায়, সেটা আমাদের অতি পরিচিত প্যাটির সমগোত্রীয়। আমরা যেরকম চিকেন বা অন্য মাংস বা আরও অনেক রকম পুরভরা প্যাটি দেখতে বা খেতে অভ্যস্ত, আফ্রিকার এই দেশগুলিতে সাধারণত সামুদ্রিক মাছের পুরভরা প্যাটির নামই ফিশ রোল।

তাহলে বিজলি গ্রিল কি এমন কেরামতি করলো যে এই বস্তুটি সসাগরা পৃথিবীর বাঙালি নামক এক প্রজাতির হৃদয়ে এমন একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিল?

প্রথমত দুধসাদা তুলতুলে ভেটকি মাছের ফিলে, যার পেটের মধ্যে সেই একই মাছের সঙ্গে টাটকা চিংড়ির যুগলবন্দী। কিন্তু এ তো গেল নিছক উপকরণের কথা। এর পুরমাহাত্ম্য এমনই প্রবল যে প্রথম কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ামিশ্রিত এক অপূর্ব সুন্দর গন্ধ গ্রাস করে মুখগহ্বর। একেবারে বাইরের মুচমুচে আস্তরণ, তারপর ভেটকির স্বাদ আর শেষে নানান মসলা, কিসমিস ইত্যাদির সমাহারে চিংড়ি আর ভেটকির পুর – স্বাদের এই স্তরবিন্যাস একমাত্র প্রকৃত রন্ধনশিল্পীর পক্ষেই করা সম্ভব। যেখানে মুনশিয়ানা আর কল্পনার মিশেল সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায়ের।

আচ্ছা আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার অর্থমূল্য কত ছিল? হ্যাঁ, একহাজার! শোনা যায় মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির কোনও একটি বিশেষ কারণে খুশি হয়ে একহাজার এক স্বর্ণমুদ্রা আর একটি জায়গির উপহার দিয়েছিলেন তাঁর খানসামা আদিল হাফিজ উসমানকে। কি ছিল সেই কারণ? প্রতিদিন একইরকম পরোটা খেয়ে খেয়ে সম্রাট বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই আদিলের ওপর দায়িত্ব বর্তাল দশদিনের মধ্যে এমন এক পরোটা তৈরি করার, সম্রাট যেমনটা কখনও খাননি। নবম দিনে আত্মপ্রকাশ করলো কিমা আর ডিমের পুরভরা চৌকাকৃতি এক পরোটা, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জাবির ফালা’ বা ‘আণ্ডা রোটি’। জাহাঙ্গির তো আহ্লাদে আটখানা! খেয়ে এতই তৃপ্তি পেলেন তিনি যে বাদশাহি পুরস্কারে ভরিয়ে দিলেন এই বঙ্গের বর্ধমানের বাসিন্দা আদিলকে। আদিল কিন্তু শত প্রলোভনেও হাতছাড়া করেননি সেই রেসিপি। পুরুষানুক্রমে যা রয়ে যায় তাঁর বংশধরদের কাছে। এমনও শোনা যায় যে জাহাঙ্গিরনগর (জাহাঙ্গিরের সময়ে ঢাকা এই নামেই পরিচিত ছিল) থেকেই কলকাতায় প্রবেশ ঘটে এই মোগলাই পরোটার। আবার কারও কারও মতে এই মোগলাই শব্দটি ব্রিটিশদের অবদান। কয়েক শতক পিছিয়ে গেলে কিন্তু আমরা পেয়ে যেতে পারি এই মোগলাই পরোটার ঠাকুরদাকে। বখতিয়ার খিলজি তখন বাংলা শাসন করছেন আর সেই তুর্ক-আফগান ঘরানার হাত ধরে আমাদের রান্নাঘরে প্রবেশ ঘটেছিল ‘গ্যোৎস্‌লেমে’র (Goetzleme)। ডিম আর মাংসের মতোই পরোটার পেটের ভিতর কখনও স্পিনাচ আর ফেটা, কখনও বা নানাবিধ মাংসের রকমারি মিশ্রণ। মহারাষ্ট্রের ’ব্যায়দা রোটি’ কিংবা মায়ানমার এর ‘পলোটা’ র সঙ্গেও এর মিল পাওয়া যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোগলাই পরোটা এই শহরেরই। এখানেই রয়েছে এমন এক রেস্তরাঁ যার জন্ম ১৯২৫ সালে আর এই প্রায় একশো বছর ধরে তিনটি পুরুষ জুড়ে যারা বিক্রি করে চলেছেন শুধুই মোগলাই পরোটা। ভাবা যায়? অনাদি কেবিন। অভিজ্ঞমাত্রেই শহরের কেন্দ্রস্থলে এতদিন টিকে থাকা এই বিখ্যাত ঠিকানাটির স্থানাভাবের কথা জানেন। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা ছোট ছোট কাঠের টেবিল আর চেয়ার, যেখানে একজনের ওঠার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে অনেক সময় একটি গোটা পরিবার। তাঁরা সকলেই এখানে কয়েক শতাব্দী আগে কোনও এক সম্রাটের খেয়ালে জন্ম নেওয়া একটি অসামান্য পদ চেখে দেখতে এসেছেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা থেকে তুলে আনা কয়েকটি উপকরণ দিয়ে তৈরি পরোটা আর তার সঙ্গে শুকনো একটা আলুর তরকারি আর তার সঙ্গে শশা-পেঁয়াজের একটা অকিঞ্চিৎকর স্যালাড। এক শতাব্দী হতে চলল, বাঙালি এই প্রেম থেকে বেরোতে পারলো না এখনও পর্যন্ত। এর মধ্যে আমাদের রন্ধন জগতে বিপ্লব ঘটে গেলেও মোগলাই পরোটা আর অনাদি কেবিনের সম্পর্ক আজও অবিছেদ্য।

সেবার চলেছি লন্ডন শহর থেকে অনতিদূরে লি-অন-সি তে বন্ধু মাইক হ্যালির সঙ্গে দেখা করতে। যতদূর মনে পড়ে এই ষ্টেশনটি এই লাইনের প্রায় শেষে, সমুদ্রের ধারে। মাইকের সঙ্গে আলাপ এর কয়েক বছর আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। তা আমি ইংল্যান্ড এ শুনে মাইক বলল ওদের ওখানে চলে আসতে। ওখানে বলতে বিখ্যাত এই পর্যটন কেন্দ্রে। অবশ্য সি বিচ ছাড়াও আরও একটি কারণে এই জায়গাটির নাম লোকের মুখে মুখে ঘোরে। তা হল সমুদ্রের তীর ঘেঁসে সারিবদ্ধ ‘ফিশ এন্ড চিপস’ রেস্টুরেন্ট। যে বস্তুটির সঙ্গে আমার ঠিকঠাক মোলাকাত ঘটবে তার জন্মভূমিতে। এবং আমাদের অতি প্রিয় ‘ফিশ ফ্রাই’ –এর সঙ্গে একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবো এতদিনে! মাইক আগেই সাবধান করেছিল এই বলে যে তার বাসস্থান অতি ছোট এবং আমাকে রাত্রিবাস করতে হবে তার এপার্টমেন্টের সম্মুখভাগে যে দোকান রয়েছে, তারই এক অংশে, টেবিল আর সোফাসেটের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। তা সে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যাথা হয়নি, বরং খুশিই হয়েছিলাম। প্রত্যাশামতোই দ্বিতীয় দিন বিকেলেই মাইক বলল, চলো, আজ ফিশ এন্ড চিপস খাওয়া যাক! সেইমতো একটি রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে আনা হল এই প্রবাদতুল্য খাদ্যটিকে, যার হাত ধরেই একদিন জন্মলাভ করেছিল আমাদের ফিশ ফ্রাই। আর এই ফিশ ফ্রাই এর কথা উঠলেই দক্ষিন কলকাতায় বড় হয়ে ওঠা আমার মতো অনেকেরই হয়ত মনে পড়বে সেলিনার কথা। যে সময়ের কথা বলছি তখন এই লেক মার্কেট এলাকায় অনেক নামকরা রেস্টুরেন্ট ছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল দক্ষিন ভারতীয়। এইরকম একটি পরিবেশে সেলিনা তার যেসব পদের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল এই ফিশ ফ্রাই। দেড়শ বছর আগে লন্ডনের ইস্ট এন্ড এর রাস্তায় এক ইহুদি ছেলের কৃতিত্বে পর্তুগিজ ফ্রায়েড ফিশ আর বেলজিয়ান চিপস এর মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয়েছিল যে ফিশ এন্ড চিপস এর, ঔপনিবেশিক কলকাতায় তাই রূপান্তরিত হয়েছিল আজকের ফিশ ফ্রাই তে। এত গেল ঠিকুজি কুষ্ঠি। কোনও একটি বিশেষ পদকে কলকাতার ফিশ ফ্রাই এর মতো কৌলীন্য অর্জন করতে হলে যে দুর্গম পথ পেরিয়ে আসতে হয়, কলকাতার ভেটকির ফিশ ফ্রাই তা অনেক আগেই করে ফেলেছে আর যে কতিপয় রেস্টুরেন্ট এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি সেরা সময়ের সেলিনা অবশ্যই তাদের মধ্যে পড়বে। স্কাই রুম বা বিজলী গ্রিল (তখনও আপনজনের নাম সেভাবে শুনিনি) এর মতো রেস্টুরেন্টের কথা মাথায় রেখেও একথা বলা যায়। আর ভাল ফিশ ফ্রাই এর উপকরণ? আসল টাটকা ভেটকি, আসল টাটকা ভেটকি, আসল টাটকা ভেটকি… যার বাইরের আবরণটি হবে অসাধারণ একটি বক্তৃতার আগে সংক্ষিপ্ততম ভূমিকার মতো। আরেকটি শর্ত আছে। অনেকদিন আগে এ এ ই আই ক্লাব এর কল্যাণ ভদ্র একটা খুব জরুরি কথা বলেছিলেন। আদর্শ ফিশ ফ্রাই এর জন্য মাছের ওজন হতে হবে আড়াই থেকে তিন কিলোর মধ্যে। পরে নিজে রান্নাবান্না করতে গিয়ে বুঝেছিলাম কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটা। তাই প্রায় চার দশকের ব্যবধানে দক্ষিণ কলকাতার সেলিনা আর পরে খাঁটি ব্রিটিশ ফিশ এন্ড চিপস স্বাদ পরখ করার পর একথা না বলে পারা যাচ্ছে না যে স্বাদে গুণে ব্রিটিশ ফিশ এন্ড চিপস এর চেয়ে অনেক যোজন এগিয়ে আছে আমাদের ফিশ ফ্রাই।

0 comments: