3

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

   

সবার প্রথমে ওদের সামনে জেনারেলের বিশাল, হলদেটে, বিষণ্ণ মুখটা দেখা গেলো। জেনারেলকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে; চোখের নিচে নীলচে ফোলা ব্যাগ, ম্যালেরিয়া-হলুদ চোখ আর সরু ঝোলা ঠোঁট। ঝড়ের বেগে এলো অপয়া মুখটা। হ্যাঁ, খুব অপয়া। কম করে হলেও হাজারটা মানুষের জন্য অপয়া হতে পারে এই মুখটা। ধূলিধূসর একটা জমিতে ওরা সবাই মোটামুটি একটা বর্গক্ষেত্র তৈরি করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্গক্ষেত্রটার ডান দিকের কোণ থেকে তিনি চলতে শুরু করলেন। বিষণ্ণভাবে সবার মুখের দিকে তাকালেন। কুচকাওয়াজ করার সময় কি একটু খোঁড়াচ্ছিলেন? সবাই লক্ষ্য করলো। লক্ষ্য করলো যে তার গলাটা, কলারের বোতামের কাছের অংশটা খালি। বুকে অনেক পদক ঝুলছে, কিন্তু গলার কাছে কোনও গয়না নেই। যদিও ওরা জানে যে জেনারেলের গলার ক্রস থাকুক বা না থাকুক, এতে ওদের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু ওই গয়নাটা জেনারেলের নেই, এটা দেখে ওরা কেমন স্থবির হয়ে গেলো। গয়না না থাকার নানারকম অর্থ হতে পারে। যুদ্ধে হেরে যাওয়া, পশ্চাদপসরণ বা উচ্চপদস্থ কোনও অফিসারের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়া– এরকম কিছু হতে পারে। ফোনে অর্ডার আসবে, নানা ধমক, বক্রোক্তি ইত্যাদি শুনতে হবে, পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে; লোকটাকে বিষণ্ণ, হতাশ দেখাবে। দিনের শেষে লোকটা ইউনিফর্ম খুলে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বিছানার কিনারায় ম্যালেরিয়ায় ভোগা রোগা শরীরটা ঠেকিয়ে শ্নাপ১ পান করবে। তিনশো তেত্রিশ গুণ তিনটে মানুষ, হ্যাঁ, বর্গক্ষেত্র তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকা এতগুলো মানুষ এই মুখটার দিকে তাকিয়ে এরকমই কিছু ভাবছিলো। মুখটায় দুঃখ, করুণা, ভয় এবং একটা গোপন ক্রোধ মিশে আছে। ক্রোধ এই যুদ্ধটার উপরে। যুদ্ধটা বড্ড বেশি সময় ধরে চলছে; এতটাই বেশি যে জেনারেলের গলার ঠিকঠাক ভালো গয়নাটা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে এই সময়ের মধ্যে। জেনারেল তার জরাজীর্ণ টুপিতে হাতটা সোজা করে দৃঢ়ভঙ্গিতে চেপে ধরেছিলেন। জমিটার বাম কোণ অবধি পৌঁছে তিনি একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে পাশের খোলা জায়গাটায় এসে পৌঁছালেন এবং দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাকে ঘিরে একঝাঁক অফিসার জটলা পাকিয়ে দাঁড়ালো; পরিস্থিতিটা একটু অস্বস্তিকর সবার জন্যেই, কারণ এখন তার গলার গয়নাটা নেই, এদিকে অধস্তন অফিসারদের গলার ক্রস সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। 

প্রথমে সবার মনে হল যে জেনারেল কিছু বলবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে টুপিতে হাত রেখে ঝটিতি মাথা ঘুরিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন তিনি। ভিড়ের জটলাটা তাকে পথ করে দিলো। অফিসাররাও নিজেদের টুপিতে হাত দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সাদা ধুলোর একটা ঘূর্ণিমেঘ তৈরি করে গাড়িটা পশ্চিমদিকে চলে গেলো, যেখানে অস্তাচলগামী সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেইদিকে যুদ্ধের কোনও ফ্রন্ট নেই।

তারপরে সেই পার্ক থেকে একশোএগারো গুণ তিনটে মানুষ দক্ষিণদিকে কুচকাওয়াজ করতে শুরু করলো। শহরের পুরনো কাফের মলিন আভিজাত্য পেরিয়ে, সিনেমাহল এবং গির্জাঘর পেরিয়ে, ঘেটো২-বস্তির ছাউনি পেরিয়ে, যেখানে দরজার কাছে কুকুর আর মুরগি শুয়ে থাকে কিম্বা ঘুরে বেড়ায়, যেখানে সাদাটে স্তনওয়ালা নোংরা এবং সুন্দরী মেয়েরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে অপরিচ্ছন্ন পানশালাগুলো বিশ্রীরকমের একঘেয়ে হয়ে ওঠে, মাতাল পুরুষকণ্ঠের হল্লা আর জড়ানো শব্দের গান ভেসে আসতে থাকে, এসব পেরিয়ে তারা চলতে লাগলো। ট্রামগুলো প্রচণ্ড শব্দে এবং গতিতে চলছিল যেন এখনই কোনও নতুন অভিযানে অংশ নেবে তারা। শহরের কোলাহল পেরিয়ে চলতে চলতে অবশেষে তারা শহরের অপেক্ষাকৃত শান্ত একটা প্রান্তে এসে পৌঁছালো। বেশ সুন্দর কিছু বাড়ি দেখা যাচ্ছে সবুজ বাগানের মধ্যে। পাথরের বিরাট বিরাট ফটক। অনেক ফটকের সামনে মিলিটারির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওরাও এসে একটা পাথরের ফটকের সামনে থামলো। ভেতরে খুব সুন্দর একটা বাগান। ছোট আরেকটা জমি। ওরা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো বর্গক্ষেত্র তৈরি করে। একশোএগারো গুণ তিনটে মানুষ। 

পিঠে বোঝা আর রাইফেল নিয়ে ওরা স্থির দাঁড়ালো। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্রুদ্ধ মানুষগুলো এবং এই অভিশপ্ত যুদ্ধটার বিষয়ে ক্ষুব্ধ মানুষগুলো স্থির হয়ে দাঁড়ালো। আবার ওদের সামনে একটা মুখ দেখা দিল। তীক্ষ্ণ, কাটাকাটা, বিশুদ্ধ আর্য ছাঁদের মুখ। ইনি কর্নেল। বড় চোখ, সরু চাপা ঠোঁট, ধারালো নাসিকা; ওঁর কলারের নিচে ক্রসের গয়নাটা থাকা সবার কাছেই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হল। কিন্তু এই মুখটা ওদের খুব একটা পছন্দ হলো না। কর্নেল সোজাসুজি হেঁটে গেলেন কোণের দিকে। সবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সামনের ফাঁকা জায়গাটায় এসে কিছু অফিসারদের দিকে হাত নাড়লেন। ওরা বুঝতে পারলো যে উনি এখন ভাষণ দেবেন। ওদের শরীর এখন কিছু খাদ্য কিম্বা পানীয় চাইছে। কেউ স্রেফ ঘুমোতে চাইছে, আবার কেউ একটা সিগারেট। 

‘কমরেড!’ পরিষ্কার গমগমে গলাটা বলে উঠলো... ‘কমরেড, আমি তোমাদের স্বাগত জানাই। বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু একটাই কথা। ওদের খুঁজে বের করতে হবে। ওই ঝোলা কানওয়ালা জীবগুলোকে খুঁজে বের করে ওদের নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে হবে। বুঝতে পারলে তোমরা?’ 

কণ্ঠস্বরটা থেমে গেলো। এই বিরতিটা খুবই অস্বস্তিকর, এমনকি সর্বনাশা হতে পারে। ওরা সবাই দেখলো সূর্যটা লাল হয়ে উঠছে। সূর্যের মারাত্মক লাল আভা কর্নেলের কলারের লাল ক্রসের উপরে ঠিকরে পড়ে ঝকঝক করে উঠলো। দেখা গেলো যে ক্রসের মধ্যে ওকগাছের পাতার কারুকাজ। ওরা ওই কারুকাজটার নাম দিয়েছে ‘শাকসব্জি’। 

কর্নেলের গলাতে শাকসব্জি আছে। 

‘তোমরা কি বুঝতে পেরেছো?’ কণ্ঠস্বরটা এবার চিৎকার করে উঠলো। একটা বিশ্রী ধাক্কা আছে এই চিৎকারে। 

‘হ্যাঁ’—ধরা গলায় ক্লান্ত, নির্বিকার ভঙ্গিতে এক দুজন বলে উঠলো। 

‘আমি জিজ্ঞাসা করছি যে তোমরা কি বুঝতে পেরেছো-ও-ও?’ কণ্ঠটা আবার চিৎকার করে উঠলো। এবার চিৎকারের ধাক্কাটা এতটাই তীব্রভঙ্গিতে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো যে মনে হলো যেন একটা পাগল ভরতপাখি আকাশের তারার গায়ে গিয়ে খাবারের জন্য খোঁচাখুঁচি শুরু করেছে। 

‘হ্যাঁ- অ্যা- অ্যা’—আরও কয়েকটা কণ্ঠ জবাব দিলো, কিন্তু খুব বেশি আওয়াজ শোনা গেলো না। ক্লান্ত আর নির্বিকার কিছু ধরে যাওয়া ঝাপসা গলা জবাব দিলো। আসলে এই কর্নেলের কণ্ঠে এমন কিছু নেই যেটা তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিম্বা একটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে নিবারণ করতে পারে। 

কর্নেলের হাতের বেত্রদণ্ড সপাং করে ক্রুদ্ধভঙ্গিতে হাওয়া কেটে গেলো... ‘ফালতু বর্জ্যপদার্থের দল!’ এরকম কিছু বাছাই শব্দ বোধহয় বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। বোঝা গেলো না যদিও তিনি ঠিক কী বললেন, কারণ তিনি দ্রুত সরে গেলেন এবং তার পদাঙ্কানুসরণ করলো এক যুবক লেফটেন্যান্ট। এই লেফটেন্যান্ট বড্ড বেশি লম্বা এবং খুবই অল্প বয়স; এই যুবকও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবার পক্ষে বড় বেমানান। 

সূর্য তখনো আকাশে আছে। সেনাছাউনির সমতল সাদা ছাদটার ঠিক ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে যেন জ্বলজ্বলে একটা গলে যাওয়া লোহার ডিম। আকাশটা পুড়ে পুড়ে হাল্কা ছাইয়ের রং থেকে একদম সাদা হয়ে গেছে। ওরা অবশেষে পূর্বদিকে চলতে শুরু করলো। আবার কুচকাওয়াজ করতে শুরু করলো ওরা। গাছের সরু সরু পাতাগুলি ঝুলে আছে শাখাপ্রশাখা থেকে। ওরা শহরতলি পেরিয়ে, ছোট ছোট কুটির পেরিয়ে, পাথুরে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলো। কম্বল-বিক্রেতাদের পট্টি পেরিয়ে গেলো। শহরতলিতে সম্পূর্ণ বেমানান নোংরা কিছু আধুনিক ঘুপচি বসতি, জঞ্জাল ফেলবার গর্ত, বাগানে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা তরমুজ, ঝোপেঝাড়ে ঝুলে থাকা পুরুষ্টু টমেটো, বিশাল বিশাল গাছপালা একেবারে ধুলোয় ঢাকা- এসব অদ্ভুত জিনিস পেরিয়ে চলতে লাগলো ওরা। ভুট্টার ক্ষেতে ফসল তোলা হয়নি। পাখির ঝাঁক এসেছে দানা খাওয়ার জন্য। ওদের ক্লান্ত পদক্ষেপের আওয়াজে প্রথমে পাখিগুলি ডানা ঝটপট করে উড়ে গেলো। তারপরে আবার ফিরে এসে ফসল ঠুকরাতে শুরু করলো। 

এখন ওরা পঁয়ত্রিশ গুণ তিনটে মানুষের একটা দল। হা-ক্লান্ত সারিবদ্ধ ধূলিধূসরিত মানুষের দল, ফোস্কায় ক্ষতবিক্ষত পা, ঘর্মাক্ত কলেবর- ওরা চলছে একজন ক্লান্ত মুখের লেফটেন্যান্টের পিছু পিছু। এই লেফটেন্যান্ট দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ওরা বুঝে গেছে যে লোকটা কেমন। চোখের দিকে তাকিয়েই ওরা বুঝে গেছে বিশ্রীরকমের কড়া, জঘন্য। যাই হোক, যতই বিচ্ছিরি, পচা হোক লোকটা, আমাদের কিছু করার নেই!- ভেবে চলেছে ওরা। ওদের এই লোকটা কোনও নিয়মমাফিক অনুশাসনসিদ্ধ নির্দেশ দিলোনা। কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে উঠলো... ‘চল!’ 

ওরা এখন কতগুলো আধাশুকনো গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ভগ্নদশায় থাকা স্কুলের সামনে এসেছে। সামনের রাস্তায় অজস্র খানাখন্দ কালচে জলে ভর্তি, সেগুলোর উপরে মাছি ঝাঁক বেঁধে বসে আছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ, ঠিক যেমনটি প্রস্রাবখানায় হয় আর কি! মনে হচ্ছে ফুটপাথ আর রাস্তায় মাছিগুলো বেশ কয়েক মাস ধরে বসে আছে। দুর্গন্ধ আর জঞ্জাল দেখে সেরকমই মালুম হচ্ছে। 

‘থামো!’ বলে উঠলো লেফটেন্যান্ট। লোকটা বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেলো। চলনেবলনে বেশ আভিজাত্য থাকলেও এই মুহূর্তে লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। 

এখন আর ওদের বর্গক্ষেত্র তৈরি করে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। এমনকি ওদের ক্যাপ্টেন, সেও তার হাত টুপিতে রাখেনি। তার কোমরে বেল্ট নেই। দাঁতের ফাঁকে একটা স্ট্র। তার গোল মোটা মুখ, কালো ভ্রু দেখে ওদের একটু স্বস্তি হল। মাথা নাড়লো সে, ‘হুম!’ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ছেলেরা, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আমি তোমাদের ছোট ছোট কোম্পানিতে ভাগ করে দেবো।’ তার আগেই ওরা দেখে নিয়েছে মিলিটারির গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ভর্তি সবগুলো। বাড়িটার জানালার তাকে রাখা আছে সেনাদের প্যাকেজ। নোংরা ধুলোভর্তি জানালার তাকে সবজেটে প্যাকেট রাখা আছে। বেল্ট, রুটির প্যাকেট, কার্তুজের ব্যাগ, বেলচা, গ্যাসমাস্ক। 

ওরা আবার চলতে লাগলো। ভুট্টাক্ষেতের মধ্য দিয়ে ফেরত চলতে শুরু করলো। এখন ওরা আট গুণ তিন জন। ফেরত এলো নোংরা ঘুপচি আধুনিক বাড়িগুলোর কাছে। সেখান থেকে আবার চলতে শুরু করলো পূর্বদিকে। চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা বাড়ি, যেটা ‘আর্টিস্ট কলোনি’র মত দেখতে, সেখানে এসে উপস্থিত হল। একতলা, সমতল ছাদ বাড়িগুলির প্রশস্ত কাচের জানালা, বাগানে গ্রীষ্মকালীন অবসর কাটানোর জন্য চেয়ার টেবিল পাতা। ওরা দেখতে পেলো যে সূর্যটা এখন বাড়িগুলোর পেছনে। সূর্যটা আকাশের চাঁদোয়াকে মারাত্মক লালে রাঙিয়ে দিয়েছে, মনে হচ্ছে যেন রক্তের ছিটে লেগেছে। পূর্বদিকের আকাশটা একদম কালো হয়ে এসেছে। সব রঙ মুছে গেছে। বাড়িগুলোর সামনে ছাউনির মধ্যে সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে। সামনেই একটা জায়গায় পিরামিডের মত স্তুপ করে রাইফেল রাখা আছে। দেখা যাচ্ছে অনেকেই বেল্ট বেঁধে নিয়েছে। হেলমেটের সঙ্গে ঝুলে থাকা হুকগুলো থেকে লালচে আলো ঠিকরে পড়ছে। 

একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন প্রথম লেফটেন্যান্ট, পা ঠুকে কুচকাওয়াজ করে এসে টুপিতে হাত রাখার মত কিছু করলেন না। তিনি সোজা ওদের সামনে এসে সবার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ওঁর বুকের উপরে একটাই পদক আছে। সেটা আবার অর্থপূর্ণ ঠিকঠাক কোনও পদকও নয়। একটা ছাপ মারা কালচে ধাতুর টুকরো ঝুলছে। ওটা প্রমাণ যে এই লোকটা পিতৃভূমির জন্য রক্ত ঝরিয়েছে। লেফটেন্যান্টের মুখটাও ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ। তিনি প্রথমে ওদের পদকগুলির দিকে তাকালেন, তারপরে ওদের মুখের দিকে তাকালেন। ‘বেশ!’ বললেন তিনি। একটা ছোট বিরতি নিলেন তিনি, তারপরে ঘড়ির দিকে তাকালেন... ‘আমি জানি... বুঝতে পারছি যে তোমরা খুবই ক্লান্ত! কিন্তু আমার কিছুই করার নেই, কারণ পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের বেরোতে হবে।’ 

তারপরে তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন: ‘ব্যক্তিগত ঠিকুজিকুলুজি নিয়ে এখন কোনও লাভ নেই- পেবুকগুলো নিয়ে নিন তাড়াতাড়ি, ব্যাগপ্যাকেজ দিয়ে দিন। ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিন তাড়াতাড়ি- যাতে ওরা জল খেয়ে নিতে পারে আর সঙ্গের বোতলগুলোও ভরে নেওয়া দরকার।’ তিনি আট গুণ তিন জনকে ডাকলেন। 

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সার্জেন্টকে খিটখিটে, মেজাজি বলে মনে হচ্ছিল। তার বুকের পদকের সংখ্যা লেফটেন্যান্টের চারগুণ! তিনি মাথা নাড়লেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, ‘নাও, এখন পেবুকগুলো বের করো সবাই!’ 

একটা নড়বড়ে গার্ডেনটেবিলের উপরে পেবুক আর ব্যাগের প্যাকেটগুলো রেখে তিনি ভাগাভাগি শুরু করলেন। যখন নাম ডাকা হচ্ছিল এবং দলে ভাগ করা হচ্ছিল, তখন সবার একটাই কথা মনে হচ্ছিল যে ব্যাপারটা একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর হলেও খুব বেশি গুরুগম্ভীর কিছু নয়। আগের সেই জেনেরাল, বদমেজাজি কর্নেল, ক্যাপ্টেন, এমনকি প্রথম লেফটেন্যান্ট- এরা কেউই এখন ধারেকাছে নেই। ওদের সামনে যে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি টুপিতে হাত রেখে এবং গোড়ালিতে খটাস খটাস আওয়াজ তুলে ওদের পে-বুক দেখে এখন যে কাজটা করছেন, সেই কাজটা ওদের সঙ্গে চার বছর আগে একবার হয়েছিল। আরেকজন মোটা মোষের মত হেড-সার্জেন্ট, যিনি সিগারেট ফেলে দিয়ে বেল্ট সামলাতে সামলাতে পেছন দিক থেকে এলেন, এখন তার দায়িত্বে ওদের থাকতে হবে, যতক্ষণ না ওরা ধরা পড়ে কিম্বা কোথাও শুয়ে থাকে- আহত অথবা মৃত। 

হাজার জনের দলটা ভাগ হয়ে যেতে যেতে এখন একজন মাত্র অবশিষ্ট আছে। শেষ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সার্জেন্টের সামনে। লোকটার সামনে পেছনে আর কেউ নেই। সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে লোকটার খুব তেষ্টা পেলো, ভীষণ তেষ্টা। তারপরেই তার মনে পড়লো যে পনেরো মিনিটের থেকে আট মিনিট সময় খরচ হয়ে গিয়েছে। 

সার্জেন্ট টেবিল থেকে তার পেবুকটা তুলে নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো। তারপরে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো... ‘তোমার নাম ফাইনহাল্‌স্‌?’ 

-হ্যাঁ। 

- তুমি একজন আর্কিটেক্ট- আর... ছবি আঁকতে পারো? 

-হ্যাঁ। 

-কোম্পানি ট্রুপে কাজে লাগবে, লেফটেন্যান্ট! 

‘বেশ!’ বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট, তারপর শহরের দিকে চেয়ে রইলেন। ফাইনহাল্‌স্‌ও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো এবং চমৎকৃত হয়ে গেলো। সূর্যটা একদম দিগন্তরেখার কাছে নেমে এসেছে। দুটো বাড়ির ফাঁকে একটা রাস্তার উপরে অদ্ভুতভাবে মাটিতে শুয়ে পড়েছে সূর্যটা। চ্যাপ্টা, চকচকে, একটু বাসি আপেলের মত সূর্যটা দুটো নোংরা রোমানিয়ান শহরতলির বাড়ির মাঝখানে দেখা যাচ্ছে। আপেলটা ধীরে ধীরে তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলছে, হারিয়ে যাচ্ছে নিজের ছায়ার মধ্যে। 

বেশ! – আবার বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট! ফাইনহাল্‌স্‌ বুঝতে পারছিলো না তার সন্তোষের কারণ। সূর্যটা দেখে আহ্লাদিত হয়েছেন তিনি, নাকি ‘বেশ, বেশ’ বলাটা ওঁর অভ্যেস! ফাইনহাল্‌স্‌এর মনে পড়লো যে গত চার বছর ধরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চার বছর হয়ে গেছে। প্রথমে যখন ওর ডাক এসেছিল, তখন সেই পোস্টকার্ডে লেখা ছিল যে কয়েক সপ্তাহের একটা ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করতে হবে। ও বাড়ি ছেড়ে ট্রেনিংএ গিয়েছিল। কিন্তু তারপর হঠাৎ যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেলো। 

‘যাও, জল খেয়ে নাও’- সার্জেন্ট বলে উঠলো ফাইনহাল্‌স্‌কে। ফাইনহাল্‌স্‌ দৌড়ে গেলো বাকিরা যেদিকে গেছে। জলের উৎসটা দেখতে পেলো ও। দুটো পাইন গাছের কাণ্ডের ফাঁকে জং ধরা পাইপে লাগানো একটা হদ্দ পুরনো গার্ডেন ট্যাপ থেকে কড়ে আঙুলের থেকেও অর্ধেক সরু ধারায় জল পড়ছে। কিন্তু যেটা আরও খারাপ সেটা হল যে ওই কলের সামনে দশ জন মানুষ লাইন দিয়েছে, চেঁচামেচি করছে, অভিশাপ দিচ্ছে, একজন আরেকজনকে ধাক্কা মারছে, একজনের জলের পাত্র আরেকজন সরিয়ে দিচ্ছে – সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! 

জল দেখে ফাইনহাল্‌সের মনে হল যে জল না পেলে সে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। নিজের রুটির ব্যাগের প্যাকেট ছিঁড়ে সে জলের পাত্রটা বের করলো। লাইনের মধ্যে এক ধাক্কা মেরে সেঁধিয়ে গেলো এবং হঠাৎ অনুভব করলো যে তার গায়ে অসীম অমানুষিক জোর। জলের নিচে সে বাড়িয়ে দিলো নিজের পাত্র। হঠাৎ তার গুলিয়ে গেলো যে কোন পাত্রটা সে বাড়িয়েছে । নিজের হাত থেকে আবার দেখতে শুরু করলো সে। নিজের হাতে ধরা... হ্যাঁ, ওর পাত্রের এনামেলের রংটা একটু গাঢ়। ধাক্কা মেরে পাত্রটা জলের নিচে ধরলো সে। বুঝতে পারলো যে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। পাত্রটা ভারি হয়ে উঠছে। সে বুঝতে পারছিলো না যে এখন একটু জল খেয়ে নেবে, নাকি পাত্রটা আগে ভর্তি করে নেবে। হঠাৎ সে সরিয়ে নিলো পাত্রটা, কারণ তার হাত কাঁপছে, শিরাগুলো দুর্বলতায় থরথর করে কেঁপে উঠছে আর পেছন থেকে কে যেন বলছে... ‘তাড়াতাড়ি, চলে এসো!’ ও মাটিতে বসে পড়লো। দুই হাঁটুর ফাঁকে চেপে ধরলো পাত্রটা। কারণ, পাত্রটা তুলে ধরবার মত শক্তি এখন ওর হাতে নেই। ও কুকুরের মত নিচু হয়ে পাত্রের কাছে মুখটা নামিয়ে আনলো। হ্যাঁ, ভিজে উঠছে ওর ওপরের ঠোঁট। ও নানারকমের রঙ দেখতে পাচ্ছে... জল- জ- অ- অ- ল... জ... ল... ল... জ... 


(চলবে) 

১. শ্নাপ- ব্র্যান্ডি জাতীয় জার্মান মদ্য 

২. ঘেটো – ইহুদীদের যে বসতিতে ঘিরে দিয়ে থাকতে বাধ্য করা হত।   

3 comments:

  1. অত্যন্ত আনন্দ পেলাম আমার প্রিয় এই লেখকের কাহিনি বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে বলে। অনুবাদক ও ঋতবাককে ধন্যবাদ। হাইনরিশ ব্যোলের খুব বেশি বাংলায় অনুবাদ হয়নি।

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত আনন্দ পেলাম আমার প্রিয় এই লেখকের কাহিনি বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে বলে। অনুবাদক ও ঋতবাককে ধন্যবাদ। হাইনরিশ ব্যোলের খুব বেশি বাংলায় অনুবাদ হয়নি।

    ReplyDelete