0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















 (২)

ভূমিকা

সরকার ও কিসানঃ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে

ভারত সরকারের তিনটে কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন প্রায় ৬০ দিন ছুঁতে চলেছে । ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনরত বিভিন্ন কিসান ইউনিয়নের চল্লিশ প্রতিনিধির আলোচনা নয়বার বৈঠকের পরও ব্যর্থ। কোন সমাধান-সূত্র বেরোল না। কিসানদের দাবি তাড়াহুড়ো করে পাশ করানো তিনটে কৃষি সংস্কার আইন বাতিল করতে হবে, কারণ ওগুলো কৃষকের স্বার্থবিরোধী এবং বিগ কর্পোরেটের স্বার্থে তৈরি। সরকার বলছেন, আইন বাতিল করা যাবেনা। কিছু কিছু ধারা বদলানো যেতে পারে।

কিন্তু কৃষকদের এক কথা। ওই তিনটে খামতিভরা গন্ডগোলের আইনে কোন আধাখ্যাঁচড়া পুলটিস লাগানো চলবে না। আগে তিনট্রে আইন বাতিল করতে হবে। তারপর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে নতুন ত্রুটিহীন আইন পাশ করতে হবে। ইতিমধ্যে কৃষকদের ইউনিয়নের সংযুক্ত কমিটি লিখিতভাবে সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবে অসহমতি জানিয়ে দিয়েছে। এবার কী হবে?

কৃষকেরা বলছেন করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! ফতে না করে ফিরব না। আরও ছ’মাস ধর্নায় বসতে তৈরি হয়ে এসেছি। আরও বলছেন-আন্দোলনের এলাকা বৃদ্ধি হবে, গতি তীব্র হবে। প্রথম চরণে ১২ ডিসেম্বর দিল্লি-জয়পুর ন্যাশনাল হাইওয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। ওইদিন কোন টোল ট্যাক্স আদায় হয়নি। এরপর আছে জেলায় জেলায় শাসক দল বিজেপির অফিস ঘেরাও করা, ঘেরাও করা হবে ওই দলের সাসংদ ও বিধায়কদের, বাদ যাবেন না মন্ত্রীরাও। তারপর ১৪ই ডিসেম্বর ভুখ হরতাল হয়ে গেছে। দু’সপ্তাহ আগে জনতার রোষে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার নির্ধারিত সভাস্থলে নামতে পারেনি।ভবিষ্যতে হয়ত আরও একবার ভারত বন্ধ হবে।

এতদিন আন্দোলন শান্তিপূর্ণ পথে চলেছে। যদিও সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা এবং কিছু মিডিয়ার লোকজন ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের পেছনে খালিস্তানি ও মাওবাদীদের উস্কানি ও মদতের কথা বলেছেন কিন্তু কোন প্রমাণ বা ঘটনা দেখানো যায়নি। দিল্লি-গুরগাঁও-নয়ডার রাজপথে লাখো কৃষক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচন্ড শীতেও রাস্তা অবরোধ করে শিবির লাগিয়ে বসে আছেন। আন্দোলনচলাকালীন শীতলহর, বার্ধক্য ও আত্মহত্যা মিলিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ জন মারা গেছেন।

কিন্তু এরপর? এভাবে অনন্তকাল তো চলতে পারেনা। আমরা যারা শহরে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে এই আন্দোলন দেখছি তাদের মনে হচ্ছে “ সির্ফ হঙ্গামা খড়া করনা মেরা মকসদ নহীঁ, মেরী কোশিশ হ্যায় কি ইয়ে সুরত বদলনী চাহিয়ে”।

‘শুধুমুদু ঝামেলা বাড়াতে কেন চাইব, চেষ্টা করি যাতে এই অবস্থাটা বদলে যায়’।

বিচারপতিদের বিশেষ অবস্থান ও কিছু উদ্বেগজনক ঘটনা

ইতিমধ্যে ঘটে গেছে কিছু ঘটনা।

কৃষকেরা ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২৬ জানুয়ারি তারিখে সাধারণতন্ত্র দিবসে তাঁরা রাজধানী দিল্লিতে সরকারের সৈন্যবাহিনীর শৌর্য প্রদর্শনের সমান্তরাল এক ট্র্যাক্টর র‍্যালি করবেন। তাতে দিল্লি পুলিশ শান্তিশৃংখলা বিঘ্নের আশংকায় সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে পিটিশন দাখিল করে। অবশ্য সেদিন 4thpillars.com পোর্টালের একটি ভিডিও আলোচনায় কোলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বললেন—পুলিশ হল হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন বিভাগ। ওদের কাজ হল আদেশ পালন করা । নীতিগত প্রশ্নে সুপ্রীম কোর্টে যাওয়া ওদের কাজ নয় , সেটা হোম ডিপার্টমেন্ট করবে।

আবার সংবিধান অনুযায়ী কৃষি রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে। তাতে আইন তৈরি করার কাজ রাজ্যের, কেন্দ্র শুধু নীতিগত পরামর্শ দিতে পারে।কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে ‘সংযুক্ত সূচীতে খাদ্যের পরিবহন ও যোগান’ রয়েছে এই যুক্তিতে কৃষি ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের আইন প্রণয়ন করেছেন তা ‘অসাংবিধানিক’ বলে বাতিলের দাবিতে সুপ্রীম কোর্টে কিছু পিটিশন আগেই জমা পড়েছে।

সুপ্রীম কোর্ট সাংবিধানিকতার প্রশ্নটি আপাততঃ মূলতবি রেখে আগামী আদেশ পর্য্যন্ত ওই তিনটি আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।এটি একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। কারণ, সংসদে পাশ হওয়া কোন আইনকে পরীক্ষা করে সর্বোচ্চ আদালত তাকে বাতিল করতে পারে কিন্তু মাঝপথে স্থগিতাদেশ দিতে পারেনা। এই যুক্তিতেই সুপ্রীম কোর্ট ধারা ৩৭০ বাতিল বা সি এ এ বা ‘লাভ জিহাদ’ আইন স্থগিত করেনি। বলেছে সবার যুক্তি-তক্কো শুনে হয় সঠিক নয় বেঠিক (অতঃ বাতিল)নির্ণয় দেবে।এটাকে কৃষকেরা তাঁদের নৈতিক জয় হিসেবে দেখছেন। কারণ, তাহলে এই আন্দোলনকে জনমানসে খালিস্তানি, পাকিস্তানি বা মাওবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ে বৈকি!

কিন্তু এখানে সরকার স্থগিতাদেশ দিয়ে চারজনের এক কমিটি বানিয়ে নির্দেশ দিয়েছে কমিটি যেন দু’মাসের মধ্যে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে তার রেকমেন্ডেশন কোর্টে পেশ করে।এছাড়া সুপ্রীম কোর্ট কৃষকদের আন্দোলনের অধিকার মেনে নিয়েছে , কিন্তু বলেছে ১) অন্যের অধিকার খর্ব করাও ঠিক নয়, ২) রিপাবলিক ডে’র অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি ঠিক নয়।

কিসানদের সংযুক্ত মোর্চার ঘোষণা – ওরা সরকারের সঙ্গে আরও আলোচনায় বসতে রাজি আছে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের তৈরি ওই কমিটির কাছে যাবেনা।

কারণঃ,

১ কৃষকরা তো সুপ্রীম কোর্টে কোন পিটিশন দেয়নি, কোন কেস বা প্রকরণে পার্টিও নয়। ওরা তো সরকারের কাছে আবেদন দিয়েছে ওদের মত না নিয়ে ওদেরই স্বার্থের পরিপন্থী আইন বাতিল করে দিতে।

২ এই একতরফা চারজনের কমিটি নিরপেক্ষ নয়। চারজনই ইতিমধ্যে সরকারের আইনের পক্ষে এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে বা ইন্টারভিউ দিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। যেমন, অর্থনীতিবিদ সুরজিত ভাল্লা, যিনি নীতি আয়োগ এবং সরকারের কৃষি মূল্য নির্ধারণ কমিশনে যুক্ত। অথবা মহারাষট্রের বড় বড় গন্না-কৃষকদের স্বার্থে খোলাবাজার এবং রপ্তানির দাবিতে বহুবছর ধরে মুখর “শ্বেতকারী সংঘটণা”র প্রতিনিধি। আজ ১৯ তারিখ কমিটির প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা । তার আগেই গ্রহণ লেগে গেল। ১৫ তারিখে একজন সদস্য, যিনি সরকারপক্ষীয় একটি কৃষক ইউনিয়নের নেতা, বর্তমান আন্দোলন এবং পাঞ্জাবের কৃষকদের সমর্থনে পদত্যাগ করলেন।

কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে এবং সর্বত্র বলছেন- এটা মিথ্যে কথা যে রাজ্য সরকারদের সঙ্গে আলোচনা না করে সহমতি না নিয়ে এই তিনটি বিল তৈরি করা ও পাশ করানো হয়েছে। নীতি আয়োগের তত্ত্ববধানে কাউন্সিল অফ চিফ মিনিস্টারদের বৈঠকে এর খসরা অনুমোদিত হয়েছিল। অথচ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং, যিনি ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন, জোর দিয়ে বলছেন- এসব কিছুই এজেন্ডাতে ছিল না, আলোচনাও হয় নি। তাহলে কে সত্যিকথা বলছেন?

এই বৈঠক হয়েছিল জুন ২০১৯শে। বর্তমানে ‘সূচনার অধিকার’ আইনের সক্রিয় কার্যকর্তা অঞ্জলি ভার্গবের পিটিশনের উত্তরে নীতি আয়োগ জানিয়েছে যে এখনও(১৬ মাস পরেও) ওই বৈঠকের রিপোর্ট ও রেকমেন্ডেশন নীতি আয়োগের কাছে পেশ হয়নি।কাজেই ওরা উত্তর দেবে না। এই পারদর্শিতার অভাবই কৃষকদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ফলে ওরা সরকারের আশ্বাসন—মৌখিক বা লিখিত- কোনটাতেই ভরসা করতে পারছে না। তাই ওদের দাবি পার্লামেন্টের শীতকালীন সেশনে ওই তিনটে আইন বাতিল করে নতুন আইন পাশ করানো। কিন্তু সরকার করোনার অজুহাতে শীতকালীন সত্র পিছিয়ে সোজা বাজেট সেশনে মিলিয়ে দিচ্ছে।

গত সপ্তাহে সুপ্রীম কোর্টে ভারত সরকারের এটর্নী জেনারেল বলেন যে এই আন্দোলনের মধ্যে খালিস্তানি আতংকবাদীরা ঢুকে পড়েছে।আদালত বলে এমনি নয়, এফিডেফিট করে কে বা কাহারা ওই আতংকবাদী সেটা বলতে হবে।

তাই গত সপ্তাহের মাঝামাঝি এন আই এ(ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) গন্ডাখানেক আন্দোলনের সক্রিয় কার্যকর্তাকে – যারা খাবারের স্টল, তাঁবু ইত্যাদির বন্দোবস্ত করেছে এমন- বৃটেনের একটি খালিস্তানি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত বলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নোটিস দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে।

আন্দোলনকারী চাষিরা এটাকে আন্দোলনকে বদনাম করে ল’ এন্ড অর্ডার ক্যাটিগরিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখে ঘোষণা করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আগামী ১০ম বৈঠকে তারা এন আই এ’র নোটিস ইস্যু গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবে।

সব মিলে কেস গুবলেট। ব্যাপারটা আদৌ সমাধানের দিকে এগোচ্ছে না। আমরা যারা শহুরে মধ্যবিত্ত তাদেরও এসব ক্রমাগতঃ শুনতে শুনতে ‘ঘিলু যায় ভসকিয়ে’ অবস্থা।

আপাততঃ আমরা দু’পক্ষের উক্তি-প্রত্যুক্তির জট ছাড়িয়ে ব্যাপারটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

উক্তি-প্রত্যুক্তির জট

মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে কৃষকদের সমস্ত আপত্তি মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবিত সংশোধনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা কেন অবুঝ? কারা ওদের মাথা খাচ্ছে? যারাই করুক, তারা সত্যিকারের কৃষকহিতৈষী নয়। বরং চাইছি, কৃষকেরা আন্দোলনের রাস্তা ছেড়ে আবার আলোচনায় বসুক।

আন্দোলনকারীরা বলছেন—বাজে কথা। আমরা কোন দলের কথায় নাচি না।সরকার আমাদের মূল দাবিকে এড়িয়ে গোল গোল কথা বলছে। আমরা চাইছি কিছু, সরকার বলছে অন্যকিছু, অর্ধসত্য। সবটা মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় সরকার নিজের এজেন্ডায় কোন পরিবর্তন করতে রাজি নয়।কাজেই আন্দোলন চলবে।

দু’পক্ষ নিজের নিজের অবস্থানে অনড়। ধনুকের ছিলা টানটান।

এখন ‘আল্লা জানে ক্যা হোগা আগে’।

সরকার বলছে গোটা দেশে ব্লক স্তরে বৈঠক এবং প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের কৃষক এবং আমজনতাকে বোঝানো হবে ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন কৃষকদের ভালোর জন্যে আনা হয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের আশংকাগুলো কেন ভিত্তিহীন।

আসুন, আমরা বোঝার চেষ্টা করি দু’পক্ষের বক্তব্য, দু’পক্ষের যুক্তির ভালোমন্দ, দুভাগে। আমরা দেখব আন্দোলনের গোড়ার দিকে কিসানদের আইনগুলো নিয়ে কী সমস্যা ছিল , ওদের যুক্তির পক্ষে কী বলা হত। পরের পর্বে সমঝোতা প্রস্তাব ও আন্দোলনকারীদের আপত্তি।

সরকারের সংশোধনী প্রস্তাবগুলোঃ

সরকারের কৃষকদের কাছে পাঠানো সংশোধনী প্রস্তাবে আইন তিনটের মধ্যে এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট বা খাস্যশস্য মজুত করার অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে কোন কথা নেই। কিন্তু বাকি দুটো নিয়ে আছে।

এপিএমসি অ্যাক্ট বা মন্ডী তুলে দেওয়া এবং এমএসপি বাতিল করা নিয়ে সংশোধনী প্রস্তাবঃ

আইনে কোথাও মন্ডী বা এপিএমসি তুলে দেওয়ার কথা তো বলা হয়নি। তবু আমরা লিখে দিচ্ছি দুটোই থাকবে। মন্ডীর ভেতরে ন্যুনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) থাকবে, বাইরে থাকবে খোলা বাজার।

কৃষকেরা বলছেন--ধেত্তেরি। বাইরে ট্যাক্স ও কমিশন নেই, ভেতরে আছে। তাহলে বাইরের ক্রেতা সহজেই মন্ডীর চেয়ে বেশি দামে কিনবে। এভাবে দ্রুত মন্ডী এবং এমএসপি উঠে যাবে। আইনে লেখা নেই তো কি হয়েছে? তাইতো বলছি আইন করে দাও যে এমএসপির চেয়ে কম দামে কেউ কিনলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।ওই তো আমাদের রক্ষাকবচ, ওটা কেন কেড়ে নিচ্ছ?

ওটা সম্ভব নয়।

কারণ ক) এমএসপি কোনদিন আইন ছিল না, সরকারী আদেশে ১৯৬৬ সালে শুরু হয়েছিল, সরকারের আদেশে এখনও বলবৎ থাকবে।

খ) ন্যুনতম দাম বেঁধে দিলে আর ‘খোলা বাজার’ কথাটার কী মানে? মার্কেট প্রাইস ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরির মাধ্যমে ঠিক হবে। সরকার নাক গলাবে না।

কিন্তু লেভেল প্লেইং ফিল্ডের যুক্তি মানছি। রাজ্য সরকার চাইলে বাইরের ক্রেতার জন্যেও মন্ডীর সমান ট্যাক্স লাগাতে পারে। এবার হল তো?

কৃষকদের আপত্তি ছিল যে নতুন আইন মোতাবেক মন্ডীর বাইরে যে কেউ এসে প্যান কার্ড দেখিয়ে ফসল কিনতে পারে। এতে কৃষকদের ঠগের হাতে পরার সম্ভাবনা। নকল প্যানকার্ড তৈরি আকছার হচ্ছে।তাই সরকারের সংশোধনী হল বাইরেও ক্রেতাকে নামধাম রেজিস্টার করতে হবে যাতে কোন অজ্ঞাতকুলশীল এসে মাল নিয়ে পেমেন্ট না করে কেটে পড়তে না পারে।

এর পরে আর কী চাই?

বিচার ব্যবস্থার মধ্যস্থতা চাই। চাষীর কোর্টে যাবার অধিকার চাই। সরকার বলছেন তোমাদের ভালোর জন্যে বললাম যে ক্রেতা-বিক্রেতা মতভেদ হলে সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা কালেক্টরের তৈরি সমিতির মধ্যস্থতায় সমঝোতা করে ঝামেলা মিটিয়ে নাও। কেন খামোকা উকিলের পয়সা খরচ করে ‘তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ’ নেবে?

কৃষকদের বক্তব্যঃ ওসব বুঝেছি। খামোকা কেউ আদালতের দরজায় কড়া নাড়ে না। কিন্তু যদি কালেকক্টরের ফয়সালা আমার না পোষায় তাহলে কোর্টে যাব। সেই অধিকার কেন কেড়ে নিলে?

--বেশ, কৃষি বিবাদ সমাধানের জন্যে আলাদা একটা কোর্ট গোছের ব্যবস্থা করছি। আর কিছু?

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষ নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই আইনে ক্রেতার বা অগ্রিম দাদন দিয়ে নির্দিষ্ট দামে নির্ধারিত কোয়ালিটির ফসল কেনার কন্ট্রাক্টের পরও বাজারে দাম চড়লে ক্রেতা (যাকে আইনে ‘স্পন্সর’ বলা হচ্ছে) কোয়ালিটি বা পেস্টিসাইড বেশি এইসব অজুহাতে ফসল কিনতে অস্বীকার করতে পারে।মানে বিয়ের মন্ডপে বসে পাত্র ‘আমাকে অন্য মেয়ের ফটো দেখানো হয়েছিল’ বলে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে যেতে পারে। এবং উলটে চাষীদের থেকে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। পাঞ্জাবে পোট্যাটো চিপ্স বানানোর জন্যে আলু কেনার কন্ট্র্যাক্টে আলুচাষীদের থেকে এক কোটি ক্ষতিপূরণ চেয়ে পেপসি কোম্পানির মামলার ঘা’ এখনো শুকোয়নি।

সরকার বলছে-আরে একটু মন দিয়ে দেখ।কৃষকের স্বার্থে এতে ভারতীয় কন্ট্র্যাক্ট অ্যাক্টের ‘ফোর্স মেজর’ (Force Majeure) শর্ত ঢোকান হয়েছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা আকস্মিক মৃত্যু ইত্যাদির জন্যে যদি কৃষক চুক্তির শর্ত পূর্ণ করতে না পারে ,তাহলে তাকে কোন পেনাল্টি দিতে হবে না। বা কোন কারণে কালেক্টরের বা কোন কোর্টের বিচারে যদি কৃষক কোন লোকসানের দোষী হয় তাহলে তাকে শুধু বিবাদের টাকার মূল ফেরৎ দিতে হবে।যদি অন্য পক্ষ বা ক্রেতা শর্ত পূরণ না করে তাহলে তাকে শর্তের চেয়ে ৫০% বেশি পেনাল্টি দিতে হবে।

আন্দোলনকারীদের ভয় বড় কোম্পানি কোন না কোন অজুহাতে কৃষকের জমি নিয়ে নেবে বা বেচতে বাধ্য করবে। সরকার বলছে, এর ধারা ১৫ দেখ। স্পন্সর বা দাদনদেনেওলা পার্টি চাষির জমি বন্ধক রাখতে পারবে না বা জমিতে কোন স্থায়ী ধাঁচা দাঁড় করাতে পারবে না।যদি কোন অস্থায়ী কিছু বানায় সেটা চুক্তি শেষ হতেই স্পন্সরের নিজের খরচায় ভেঙে দিতে হবে, নইলে চাষি এর মালিক হয়ে যাবে।

কৃষক সন্তুষ্ট নয়। ভারত কিসান ইউনিয়নের নেতা বলছেন এই আইনের ধারা ১৬ তো বলছে- যদি রায় চাষির বিরুদ্ধে যায় তাহলে সরকার ল্যান্ড রেভেনিউ অ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তার মানে তো, সেই দাঁড়াল যে ওর জমি নিলাম করে বকায়া টাকা আদায় হবে।

কট্র্যাক্ট অ্যাক্টে দরাদরি করে দাম নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে? যদি খোলা বাজারে দাম বেড়ে যায়? তবে তো চাষির লোকসান!

সরকার বলছেন—দু’রকম দামের ব্যবস্থা রয়েছে। একটা হল আগে থেকে ফিক্সড প্রাইস। তাতে বাজারে দাম পড়ে গেলেও কৃষকের ক্ষতি নেই, বেড়ে গেলে লোকসান।

অন্যটি হল, একটা অংশ ফিক্সড বা পূর্ব নির্ধারিত , অন্য অংশটি ভ্যারিয়েবল বা বাজার দামের ওঠাপড়া (ধরুন এমএসপির চেয়ে খানিকটা বেশি বা কম) হিসেবে দু’পক্ষ মিলেমিশে বা দরাদরি করে জুড়ে নেবে। এতেও আন্দোলনকারী কৃষক সন্তুষ্ট নয়?

কৃষকেরা বলছেন ওসব হল শুদ্ধ আইনের কথা। গরীব বা সাধারণ কৃষক কবে আম্বানী আদানীদের সঙ্গে মামলা লড়ে পেরে উঠবে? সরকার কেন নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সরে যাচ্ছে? ছোট ও ক্ষূদ্র শিল্পের জন্যে ব্যাংক লোনের ব্যাপারে যেমন ১০০% গ্যারান্টি নিয়েছে তেমনই চাষিদের জন্যে এগিয়ে আসতে কেন অনীহা?

তাই চাষিদের দাবিঃ ১) ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের জন্যে আইন হোক। এর নীচে কেনা বেচা – মন্ডীর ভেতরে বা বাইরে, পাঞ্জাবে বা বাংলায়—আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষিত হোক। ওটাই হবে বেঞ্চমার্ক, ওটাই সরকারের পক্ষ থেকে চাষির জন্যে গ্যারান্টি।

২) ওই এমএসপি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে C2 উৎপাদন মূল্যের দেড়গুণা বা ১৫০% হোক।

সরকার এটা মানতে রাজি নয়।

কিন্তু যদি মিয়া-বিবি রাজি না হয় তাহলে সুপ্রীম কোর্টের কাজি কী করতে পারে!

কেন এই অচলাবস্থা? বর্তমান প্রতিবেদকের মতে এ হল পারস্পরিক

অবিশ্বাস ও দুটো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই।

আগামী কিস্তিতে আমরা আলোচনা করব ওই দুটো পয়েন্ট, এমএসপির কেন এল, খাদ্য সুরক্ষা আইন, রেশন ব্যবস্থা এবং উন্নত দেশের কৃষি ও খোলা বাজার নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসবে এই আন্দোলন শুধু দুটি রাজ্যের কৃষকের সমস্যা কিনা? এমএসপি কি শুধু কৃষকের স্বার্থে নাকি দেশের স্বার্থেও? সবশেষে আমাদের দেশে কৃষির সংস্কার চাই কিনা ও চাইলে কেমন সংস্কার চাই। (ক্রমশঃ)

0 comments: