0

গল্প - সুদীপ ঘোষাল

Posted in


প্রীতিলতার দাদুর মৃত্যুর পর তাঁর পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন। তিনি পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। এই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়। আদর করে মা প্রতিভাদেবী তাঁকে “রাণী” ডাকতেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতেন ওয়াদ্দেদার পরিবার। 

প্রীতিলতার দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিলো তাঁর অসীম মনবলের জন্য। পাড়ার দাদু প্রীতিলতাকে খুব স্নেহ করতেন। কাছে বসিয়ে তিনি নানারকম গল্প বলতেন তার সাধের নাতনিকে। 

প্রীতিলতা গ্রামের বুড়ো দাদুর বয়স একশ দুই বছর। দাদু এখনও বাড়ির সামনে খোলা বারান্দায় লাঠি হাতে বসেন বিকেলবেলা। সকলে নিজের নিজের কাজ করে। আজকালকার ছেলেরা দাদুর বীরত্ব সম্বন্ধে বা দাদুর প্রচুর অভিজ্ঞতার ঝুলি কত তা জানতে চায় না। এখনকার ছেলেরা অনেকে চেনেই না দাদুকে দাদুর খুব দুঃখ হয়। তবে দাদুর থেকে ছোট কিন্তু পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরের প্রৌঢ় যারা তারা মাঝে মাঝে দাদুর কাছে বসে গল্প করে। 

প্রীতি বলেন, দাদু তোমার কাছে বসলে অনেককিছু জানতে পারি। 

আজ শরতের সুন্দর বিকেলে দাদু দু তিনজনের সঙ্গে গল্প করছে। দাদু বলছে, জানিস যদু, তখন আমি পোরো বোলানের লাঠিয়াল দলের একজন। গাজনে গান গেয়ে বেড়াতাম পাড়ায় পাড়ায়। আগেকার জমিদার বাড়িতে একদিন ডাকাত এসেছিল রাতে। আমি রিহার্সাল সেরে বাড়ির পাশ দিয়ে আসছিলাম গান গাইতে গাইতে। ডাকাতের একজন বাইরে পাহারায় ছিল। ভেতরে চলছে ডাকাতের অত্যাচার। পাহারাদার ডাকাতটি বলল,কে যাস ওদিকে। ফিরে আয়, তোকে বাঁধি। 

আমি বললাম, আমি ওপাড়ায় ছিলাম। রাত হয়ে গেছে। বাড়ি চললাম। 

ডাকাত বলল,সাবধান এখন দেওয়াল বাগু মুখ করে দাঁড়া। নড়লেই মাথা ফাটিয়ে দোব। 

আমি ডাকাতের লাঠিটা কেড়ে তাকে বেঁধে ঘরের ভেতরে এলাম। বন বন করে লাঠি ঘোরাতে থাকলাম। ডাকাতরা একে একে সরে পড়ল অন্ধকারের আড়ালে। প্রাক্তন জমিদার বলল,তুমি আজ বাঁচালে আমাদের। 

গল্প শুনে অনেকে বিশ্বাস করে আবার অনেকে হাসে। বলে, বুড়ো দাদুর বাতেলা কে শুনবে বল? চল পালাই। 

দাদু ভাবে,মানুষ বুড়ো হয়ে গেলেও তার অভিজ্ঞতার দাম আছে। তার কাছে শুনতে হয় জীবনের কাহিনী। তাতে শিক্ষা পাওয়া যায় অনেক। 

দাদু চুপ করে থাকে। কোনদিন পাশে কেউ বসলে গল্প বলে। তবু দাদু দেখে পৃথিবী রঙীন ফিতে জড়িয়ে নাচে বিভিন্ন ঋতুজুড়ে। বাড়িতেও বুড়োদাদুর সম্মান নেই। মাঝে মাঝে বিছানায় পায়খানা হয়ে যায়। দাদুর টাকা নেই।কোনো পেনশনও পায় না। তাহলে দাদুর আছে কি? তার আছে জ্ঞানের ঝুলি, ওস্তাদের কায়দা তার জানা। কেউ নেই যে এই অমূল্য সম্পদ নেবে। 

দাদু কয়েকদিন হল একটা পঁচিশ বছরের ছেলেকে সঙ্গি হিসেবে পেয়েছে। তার নাম বীরবাহাদুর। সে কার কাছে শুনেছে দাদু নাকি তন্ত্র মন্ত্রও অনেক জানে। বীরবাহাদুর লাঠি খেলা শিখতে চায়। দাদু বলে দেয় প্যাঁচ পয়জার। বীরবাহাদুর দেখে দাদুর কথায় যাদু আছে। কত কঠিন কাজ সহজেই হয়ে যায়। দাদু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও জানেন। বীরবাহাদুর বলে,দাদু হোমিও মেডিসিনে ক্যান্সার রোগ কি গাল হয়? দাদু বলে, শুধু ক্যান্সার নয় এর চেয়ে মত মরন রোগের চিকিৎসক হচ্ছে হোমিওপ্যাথিতে এখন অন্নপ্রাশনের ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন রকমের ওষুধের গবেষণা হয় এ রোগের চিকিৎসায় তারা দেখতে পেয়েছেন হয়তো অনেক রোগী সুস্থ আছেন ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা কাজ করবেন। 

বীরবাহাদুর জানে, এছাড়া অন্যান্য রোগ নিয়ে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত বর্তমানে তাদের ওয়েবসাইটে চিকিৎসা সম্পর্কে তথ্য সাহায্য চেয়ে আবেদন আসে। ভারত সরকার এক্সপার্ট কমিটি গঠন করেছে। সেই এক্সপার্ট কমিটি সুপারিশ করবে আমাদের চিকিৎসা প্রথাগত উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হবে এবং এবং বিশেষ করে ওষুধ প্রয়োগ করা হবে। আজকে তরুণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের চিকিৎসা উদ্বুদ্ধ এবং উন্নতি করেছে। 

দাদু আবার তার জীবনের গল্প শোনায় নাতি বীরবাহাদুর ও আরও ছেলেমেয়েকে ।প্রীতিলতা রূপকথার মত গল্প শুনতে ভালোবাসে। সে দাদুর নাতির বয়সি। তাই দাদু তাকে নাতনি বলেই ডাকেন। দাদু বলে, ছোট থেকেই নারাণ সাহার মুদির দোকানে মুদিখানা বাজার করতাম। বাসুদার রেশন দোকানে রেশনের বাজার করতাম। মা আমাকে ছোট থেকেই দোকানে পাঠাতেন, যাতে অভ্যস্ত হতে পারি জীবনের সঙ্গে। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম কাজকর্ম করতাম। কল থেকে জল নিয়ে চলে আসতাম। আর আটা মাখতাম মায়ের সাহায্য করার জন্য।জীবনটা কিভাবে ছোট থেকে আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যায় তা আমার জীবনে দেখা হলো। কি ভাবে ছোটবেলায় যে পরিবার ছিল সেই পরিবেশ পাল্টে গেল। হঠাৎ গিয়ে দেখি সেই পরিবার নেই। তখন মন খারাপ হয়ে যেত। আর ফিরে আসতেই মনে পড়ে গেলো সেই পুরোনো স্মৃতি। পুরোনো স্মৃতি ধরে পথ চলা ছোটবেলার সেই শিশু আজও হেঁটে চলে সহজ জীবনের গতিপথ ধরে। 

বীরবাহাদুর কয়েকদিন ধরেই সকালবেলা উঠেই লক্ষ্য করছে তার গামছা ভিজে থাকে। কে যেন তার আগে চান করে চলে গেছে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। বাড়ির লোকদের জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারে না, কে যে তার গামছা নিয়ে ব্যবহার করে, সে আজ পর্যন্ত ধরতে পারেনি।। কিন্তু তার মনে মনে একটা জেদ জন্মায় কে এই গামছা ব্যবহার করে তাকে ধরতেই হবে। তাইতো সে তালে তালে থাকে বিকেল, সন্ধ্যা এবং সকালে এসে যখন দাঁত মাজে তখন তার আগে তার লক্ষ্য স্থির রাখে । 

পাড়ায় মোড়ের মাথায় যখন বেড়াতে বেরিয়ে ছিল বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে ছিল এই ব্যাপার নিয়ে।। বন্ধুরা ওকে বলেছে, রাক্ষস বলে সত্যিই আমাদের হিন্দুদের শাস্ত্রে পাওয়া যায় এবং তাদের আমরা অসুরও বলে থাকি। অনিকেতের বন্ধু স্বদেশ বলে, রাক্ষস হল হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী একপ্রকার দানবীয় প্রাণী। রাক্ষসরা পরবর্তীকালে স্থান লাভ করে। রাক্ষসদের মানুষ ভক্ষণ করার কথাও বর্ণিত আছে। স্ত্রী রাক্ষসকে রাক্ষসী বলা হয় এবং মানুষের রূপ ধরা রাক্ষসীকে বলা হয় মনুষ্য-রাক্ষসী। কখনো কখনো অসুর এবং রাক্ষসবৃন্দ একই রূপে আখ্যায়িত হয়।এখন কথা হল রাক্ষস বলে যদি কোন প্রাণী থাকে তারা যেমন সবসময় খেয়ে যায়, দিনের বেলা দুপুর বেলা, সন্ধ্যা বেলা মানে না, তেমনি তাদের নিশ্চয়ই কোনদিন নিজেদের গা পরিস্কার করা বা দাঁত পরিষ্কার করার প্রয়োজন অনুভব করে। 

স্বদেশবলেহিন্দুধর্মে বর্ণিত ছিলেন একজন রাক্ষসী৷ তিনি মা ছিলেন৷ গাত্রবর্ণ কষ্টিপাথরের মত হওয়ায় তিনি নিকষা নামে অধিক পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিলো কৈকসি। তাহলে বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়। 

দাদুকে বীরবাহাদুর জিজ্ঞেস করে রাক্ষসের আর ভূতের প্রসঙ্গে অনেক কথটা। দাদু বলে, এই মন্ত্রটা বলবি সব অপ আত্মা ভ্যানিস হয়ে যাবে। বীরবাহাদুর বলে মন্ত্রটা কি বলো দাদু। দাদু বলে,খটাং খটাং খটাং দশ দিকের বাতাস সটাং। আসতে কাটুক যেতে কাটুক, আমার দেহে যে করে আঘাত তার বুকে মারি বাবা মহাদেবের লাথ। 

বীরবাহাদুর একদিন দাদুকে পঁচিশে বৈশাখে মঞ্চে তুলে দিলো। দাদু সভাপতি। শেষে সভাপতির ভাষণ।দাদু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, বিজ্ঞানের গবেষণার চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলার সুন্দর একটি উদ্যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চা হচ্ছে। আমেরিকা রাশিয়া চীন লন্ডনে উঠে পড়ে লেগেছে কবি বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে গবেষণা করার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডনের কিংস কলেজের কাজ করছে।কবি এক জায়গায় লিখেছেন বিজ্ঞানচেতনা না থাকলে এরকম লেখা কি করে সম্ভব তিনি বলেছেন যে কোনো সভ্য মানুষের সভ্যতার আঙিনায় বিজ্ঞানের আনাগোনা থাকা উচিত মানুষকে সাবধান করে বলেছিলেন প্রকৃতিকে অধিক্রমণ কিছু দূর পর্যন্ত তারপরে আসে বিনাশের পালা আমরা প্রকৃতির কথা চিন্তা করিনা প্রকৃতিকে নিত্য নিয়মিত আমরা ধ্বংস করে চলেছি কিন্তু এর বিরুদ্ধে অনেক আগেই কথা বলে গেছেন কিন্তু সেসব কিছুই খবর আমরা রাখি না আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এটা জানানোর খুব দরকার সেই উদ্দেশ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে টেগর সেন্টার অব সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিলোজফি বিষয়টা অনেক দিন ধরেই অনেকের মাথায় মাথায় ঘুরছিল কবি-সাহিত্যিক সবাই একসাথে বিজ্ঞান চেতনার কথা বলেছেন । 

দাদুর বক্তব্য শেষ হলে বীরবাহাদুরের সঙ্গে সকলে হাততালি দিল। সকলে বলাবলি করল, দাদুর কত জ্ঞান আর আমরা দাদুকে অবহেলা করি। 

দাদু চুপচাপ বীরবাহাদুরকে ধরে বাড়ি এলেন। তখন বেলা এগারোটা বেজে গেছে 

দাদু প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। 

স্কুলে প্রীতিলতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত। এক ক্লাসের বড় প্রীতিলতা কল্পনার সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। তাঁদের স্বপ্নের কথা লিখেছেন কল্পনা দত্ত, “কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।” 

দাদু জানেন, অবশ্য পৃথিবীর সর্বত্রই পুরনো দের প্রতি বয়স্কদের একটা নস্টালজিয়া থাকে এতে দোষের কিছু নেই কিন্তু দেখা যায় পুজোর সাজানো দেখান নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে পুজো প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে দেখা যে মজা সেই মজার এখন যুবককে কিশোররা অনুভব করতে পারে না তারা শুধু মোবাইল নিয়ে নিজের সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত আগে পুজো বড় একটা টাকা খরচে রাস্তা হয়ে উঠেছে বছর 10 বছর আগেও পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে বসে চা খেয়ে আড্ডা মারা যেত আর ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে ও রাস্তা থেকে মাত্রিষদন করা যেত সে গুড়ে বালি কারণ ছাড়া পাড়ায় পাড়ায় পুজো বিভিন্ন বিষয়ের উপরে পুরস্কার এই ধারা শুরু হয়েছিল একটা রংয়ের কোম্পানির জন্য তারা কিছু লেখকের ছবি আঁকিয়ে ডাক্তার উকিল দের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঠাকুরের গুনাগুন বিচার করে পুরস্কার ঘোষণা করতেন 

দাদুর কাছে এখন বিকেলে অনেক ছেলেমেয়ে ভিড় জমায়, গল্প শোনে বুড়ো দাদুর কাছে।শিখতেও পারে অনেককিছু। একটা গাছের মধ্যে যখন অনেক ফুল ধরে থাকে, তখন দেখতে সুন্দর লাগে। তখন বোঝা যায় না কে কখন ঝরে পড়ে। তার চিন্তা কেউ করে না। কিন্তু দেখতে সুন্দর লাগে। এমনই এক সংসারে মানুষ হয়েছিল রমেন। সে তার দাদার ছেলেদের পড়াশোনা শিখিয়ে নিজে চাকরি করে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে তাদের সংসার চালানোর ব্যবস্থা করেছিল। ধীরে ধীরে তার বয়স বাড়লো। এদিকে দাদা তার ছেলে মেয়েদের মানুষ করে চাকরির ব্যবস্থা করল অথচ সে যখন বড় হল তখন তার বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। 

কলকাতার একটা মেসের বাড়িতে বারান্দা ঝুলে যাওয়া, বারান্দা ভেঙে পড়া বাড়িতে থেকে এমএসসি পড়ছিল যে ছেলেটা সে আজ চাকরি পেয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এক একটা সফল জীবন কিভাবে ছোট থেকে বড় হয় তার ঘটনা আমরা সকলেই দেখি কিন্তু মনে রাখতে পারিনা। 

তার সফলতা টাই দেখা যায় কিন্তু তার দুঃখগুলো কষ্টগুলো আড়ালে থাকে। সেগুলো আমরা পর্যালোচনা করতে গেলে দেখতে পাই প্রত্যেক জীবনে কিছু না কিছু কষ্ট আছে দুঃখ আছে সেগুলো অতিক্রম করে তারপর সফল হওয়া যায়। 

এমনই এক জীবন রমেনের। সে চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে বা পড়াশোনা করত। তার বাবা বাইরে স্টিল কোম্পানিতে চাকরি করতো। কোনদিন ভাবেনি বাবা আর সে একসাথে থাকতে পারবে। তার বাবা রিটায়ার্ড হওয়ার পর কলকাতার মেসবাড়িতে ওই ভাঙ্গা বারান্দায় এক চিলতে ছোট্ট একটা ঘরে, কোন রকমের মাথা গুঁজে পড়াশোনা চালিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে দিনের পর দিন চেষ্টা করে গেছে। কিভাবে একটা চাকরি পাওয়া যায়, তবে 

শেষে সফল হয়েছিল সে। শেষ হাসিটা হেসে ছিল সে। চাকরিতে জয়েন করে অনেক দূরে চলে গেছিল। এখন সে সুখেই আছে তার সংসার সাজানো-গোছানো একটা গাছের ফুল গাছের মতো। অনেক ফুল ধরে আছে সেখানে তার সৌরভ পায় পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন। 

স্কুল জীবনের বন্ধুগুলো কেমন করে একটা একটা করে সঙ্গছাড়া হয়ে যায় চলে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তার কাহিনী আমরা জীবন থেকে পাই। তারপরে রমেনের বন্ধু সিরাজ, সেও প্রথম জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। অনেক দূরের ইস্কুলে হেঁটে গেছে। জল কাদা তখন পাড় হয়ে সাঁতার কেটে স্কুলে যেতে হতো। তখন রাস্তা ছিল না। সেই কষ্ট করে তা তারপরে একদিন সে বিদেশে গেল। বিদেশে গিয়ে সে এখন সুখেই আছে। তার সঙ্গে সম্পর্ক সুন্দর সকলের এবং সে প্রায় পাঁচ বছর পর পর একবার করে বাড়ি আসে। দীনেশ ফুটবল খেলাও খেলতো ভালো সে খেলতে খেলতে হঠাৎ আর একদিন অনুভূতি হল তার বয়স তো পেরিয়ে গেছে। এবার একটা চাকরি বাকরি দরকার। কিন্তু শেষে কোন চাকরি পায়নি। সে এলআইসি এজেন্ট হয়েছিল এলআইসি এজেন্ট হয়ে বেশ ভালোরকম স্থান দখল করে এখন ডেভলভমেন্ট অফিসার হয়ে আছে এবং তার বাড়িতে কম্পিউটার রেখে সে এখন সমস্ত কিছু পরিচালনা করে তার মাসিক ইনকাম এখন প্রায় 30 হাজার। 

যেকোনো খাবার শেখায় কিভাবে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয় কিভাবে এডজাস্টমেন্ট তৈরি করতে হয় তাই খেলার এত গুরুত্ব তাই খেলার পরে সে জানতে পেরেছিল যে আমার চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও আমাকে যে করে হোক আর সেল্ফ কনফিডেন্স হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। 

যতীন একটা পাড়ায় খালি জায়গা কিনে ছিল তার বাড়ি থেকে সবাই বলত বেড়ার বাড়ি এতটাই খালে যে তোর তোর বাড়ি দেখা যায় না দূর থেকে যতীন বলতো এই খালি দেখবি একদিন কত সুন্দর পাড়া হয়ে যাবে তার অপেক্ষায় আমি দিন গুনবো আর তার সঙ্গে চালাদো টিউশনি টিউশনি করে সংসার চালাতে দেখা গেল সেই শহরে সেই জায়গায় তার পাশ দিয়ে রাস্তা হয়ে গেছে তারা এখন শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা। 

যতীনের ছোটবেলায় জন্মাবার আগে ছিল কিন্তু তার বাবার সেবা করে সে ধীরে ধীরে বাবাকে সুস্থ করে তুলেছিল বাবার শেষ জীবন অব্দি এসে সঙ্গে ছিল তখন সে শহরে যায়নি গ্রামে ছিল তার বাবার আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়লো তার মাথায় ও তার বাড়ি হল তার নিজস্ব দোতলা বাড়ি হল টেলিফোন হল তার পরে তার চাকরি হলো এবং সে এখন একটা শহরের বিশিষ্ট লোক। 

প্রত্যেক জীবনী দেখা যায় প্রথম জীবনে যদি সুখে থাকে তো শেষ জীবনটা কষ্টের হয় আর প্রথম জীবনটা কষ্টের হলেও শেষ জীবনটা সুখের হয় কিন্তু সব ক্ষেত্রে হয়তো হয় না ব্যতিক্রম থাকতেই পারে কিন্তু একটা সফল জীবন এই ভাবেই তৈরি হয় তৈরি হয় তার জীবন যৌবন ধনবান। 

ছুটন্ত পাথরে যেমন শ্যাওলা জমে না তেমনি ছটফট করে জীবনে উন্নতি করার চেষ্টা করলে সে কোনদিনই উন্নতি করতে পারে না ফিরে এক জায়গায় আছেন যে পাথর থাকে সেই পাথরের হিসাব জমে তাই জীবনকে অস্থির করতে হয় তার জন্য মেডিটেশন প্রয়োজন প্রয়োজন হয় তবেই হবে তার জীবনের লক্ষ্য পূরণ। 

আমরা সাধারণ মানুষ সাধারণ মানুষ চেষ্টা করে একইভাবে একটু সুখে থাকবে কিভাবে তার ওজন বাড়বে অর্থ উপার্জন করবে এবং সাফিসিয়েন্ট সংসারের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করতে পারবে কিন্তু যারা মহাপুরুষ তারা তো সে আশা করে না তারা পরের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় কিন্তু সেই মহাপুরুষ হতে পারে কয়জন। 

এমনই এক জীবন আমার জীবনে দেখা আছে সে পরের জন্য যাবতীয় তার তার শিক্ষাদিক্ষা এবং রোজগার ব্যয় করেছিল নিজের ফকির হয়ে আসে না পরের সাহায্য প্রার্থনা প্রার্থনা করে তার নিজস্ব কিছু বলতে এখন আর নেই পরের উপরে সে বেঁচে আছে। 

প্রত্যেকে প্রত্যেকের জীবনে সফলতার পিছনে তার কোন অর্থ হয় না জীবন্ত বিভিন্ন রকম কোনো জীবনের সঙ্গে কোন জীবনের মিল নেই তাই জীবনকে উপভোগ করতে হয় দুঃখ-কষ্ট বাদ দিয়ে হাসি হাসতে জানতে হয় হাসতে জানলে তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট গুলো ঝরে ঝরে পড়ে ঝরা পাতার মত গল্পের মত হলুদ পাতার মর্মরে মিশে যায় তার দুঃখের কাহিনী সুখগুলো ও প্রস্ফুটিত হয় গাছের সবুজ পাতায়। 

যৌথ সংসারে দেখা যায় একজন তার জীবন পাঠ করে তার জীবন দিয়ে সমস্ত অর্থ দিয়ে তার সংসারকে খাড়া করে কিন্তু সেই সংসারে কাছে পর হয়ে যায় এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায় সে সে সে নিজের পরিবার চালাতে হিমশিম খায় তাকে আরো দেখার কেউ থাকে না ভাইরা বোনরা তাকে ভুল বোঝে কিন্তু সে না থাকলে হয়তো সংসারটাই ভেসে যেত। 

শুভেন্দুর তিন ভাই দুই বোন সে তার বাবার চাকরি বাবা মরার সূত্রে চাকরি পেয়েছে তার ভাই বোনদের মানুষ করেছে আমি কি তার স্ত্রী তার সোনা গয়না দিয়ে দিয়েছে কিন্তু সে কথাটা মনে রাখে নি একদিন তারা সম্পত্তির লোভে তাদের প্রিয় দাদা কে ধরে এবং যাবতীয় অপমান করে তাকে উত্ত্যক্ত করে তোলে এবং সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয় ধীরে ধীরে। 

এই স্বার্থপর সমাজে কোন কিছুই বেশি গুরুত্ব দিতে নেই কোনো কিছুরই মন থেকে একদম হৃদয় গ্রহণ করতে নেই তাহলে দুঃখ পেতে হয় যে সহজভাবে সবকিছুতে মানিয়ে নিতে পারে সেই জীবনে জয় লাভ করে তা না হলে দুঃখ-কষ্ট ব্যথা বুকে করে চিরদিন বয়ে বেড়াতে হয় জীবন যন্ত্রণা। 

সিরাজের মা ছোলা শাক তুলে আনতে প্রতিদিন খালি পেটে দুই চামচ অর্ধেক পাতি লেবুর রস মিশিয়ে এক গ্লাস সরবত করে খেয়ে তো খুদা দুর্বলতা দূর হতো ছোলার ছাতু প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ উপকারী তাই সে খেত মা বলতেন যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা সকালে উঠতে দুর্বল বোধ করে তারা সকালে ছোলা ভিজিয়ে খেলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায় পড়াশোনায় মন বসে ছাড়াও ছোলার ডালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছোলার ডাল দিয়ে কত রকমের রান্না তৈরি হতো তাই ছোলার ডাল আমাদের বাঙালি যে কোন ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত প্রিয়। 

শুভেন্দু বাবা বেঁচে থাকতে বলতেন যে তোমরা প্রার্থনা করবে ভগবানের কাছে আমি এই মহান সে জন্ম পেলাম দুর্ভাগ্যবশত আমি শুধু এর অপচয় করলাম কেন মনুষ্য জনম আমি ঠাকুরের স্মরণ করলাম না এজন্য ঠিক জেনে শুনে বিষ পান পান করার মত কখনো গর্ব আমরা না জেনে বিষাক্ত হয়ে পড়ি কখনো খাবারের সঙ্গে বা অন্য কোনোভাবে আমরা 20 গ্রহণ করি কিন্তু কেউ যদি জেনে শুনে বিষ পান করে তার মানে সে নিজেকে হত্যা করছে সেটা জানে না তার বাবা আরো বলতো এই মর্মে আমরা যদি এই সহসা বিপরীত উপলব্ধি স্তরে উন্নতি না হয় অর্থাৎ আমাদের ভগবত চেতনা না হয় তাহলে জীবন নষ্ট হয়ে গেল গত স্মৃতির বিচিত্রতা পান তাকে শুধু দুঃখময় পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হবে। 

শরীর হলো স্মৃতির এক স্তূপ। মানুষ তার চোদ্দপুরুষ আগের বংশধরকে দেখে নি কোনোদিন কিন্তু তার চোখ, নাক হয়ত বংশের কোন একজনের প্রতিরূপ। নাকুদাদু বলতেন শ্যামকে, তোর মুকটা ঠিক তোর ঠাকুরদার মত দেখতে।কিন্তু শ্যাম কোনদিন তার ঠাকুরদাকে দেখে নি। 

শ্যাম তার ঠাকুরদার মতই পরিশ্রমী ছেলে। নিজের চাষের জমিতে সে চাষ করে শস্য ফলায় এবং সেই ফসল বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। 

শ্যামের সংসারে মা ছাড়া আর কেউ নেই। মা তার বন্ধু, মা তার নিত্যসঙ্গী। তার মায়ের যখন মাত্র উনিশ বছর বয়স তখও বিবাহ হয়। শ্যামের বয়স এখন একুশ বছর।তাহলে তার মায়ের বয়স চল্লিশ বছর। শ্যামের মায়ের একজন পুরুষবন্ধু ছিলো। সে শ্যামের মা রমাকে থ্রিসাম সেক্সও করাতে পেরেছে। রমা বলে, প্রথম যুগের মানুষের যৌনতা ছিল কেবল মাত্র ক্ষণিক আনন্দের একটি উত্‍স। পরবর্তী সময়ে যৌনতার ব্যবহারিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এক সময়ে এক নারী একই সাথে একই পরিবারের সবার সাথে যৌনমিলনে রত হতে পারতো। এটি ছিল যৌনতার সংস্কৃতি। তখন কার সমসাময়িক যৌন সংস্কৃতি ছিল এই রকম। যুগে যুগে যৌন সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। আবার যৌতার ব্যাপারে ধর্মীয় নানা মতবাদের প্রভাবে যৌনতার বিষয়টি একেক সমাজে একেকভাবে অনুশীলন করা হয়ে থাকে। রমার বন্ধু জনু বলে, যৌনমিলনের ব্যাপারে বা যৌনতার ব্যাপারে সব নারীর ইচ্ছা একই রকম হয় না। কোনো কোনো নারী অত্যাধিক যৌনকাতর । আবার কোনো কোনো পুরুষের যৌন ইচ্ছা থাকে বেশি অর্থাত্‍ যৌনতার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ এবং যৌন মিলনের ইচ্ছা থাকে ব্যাপক। আবার কোনো কোনো নারী-পুরুষ সুস্থ যৌনতার প্রতিক এবং তারা প্রয়োজন মাফিক যৌনমিলন পছন্দ করে। আবার কিছু কিছু নারী-পুরুষ যৌনতাকে খুবই কম মাত্রায় পছন্দ করে। অনেকের এ ব্যাপারে ভীতিও থাকে। যৌনতার ব্যাপার বিশেষ করে নারী, পুরুষের যৌনতার ব্যাপারে উত্‍সাহ এবং আগ্রহ যদি না থাকে তবে চরম পুলক আসতে পারে না। 

যৌনমিলনই শুধুমাত্র জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। 

দাদু বলতেন,সত্য হল একমাত্র কর্তৃত্ব।সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনকে চলমান করে সব কিছু নতুন করে দেখতে হবে।পৃথিবীর সবকিছু সম্ভাবনাময় । বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে শুধু স্পষ্টভাবে দেখে যাওয়া হল কঠিন এক সাধনা। আত্মা এটাই চায়।কোনো কিছুর উপসংহার টানলে তা মৃত্যুর সমতুল্য। স্মৃতি আর বুদ্ধিমত্তা গুলিয়ে ফেলবে না। স্মৃতি বাদ দিয়ে যদি আপনার বুদ্ধিমত্তার উন্মেষ ঘটে তাহলে আপনি আত্মজ্ঞানী। 

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লেখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক তক্তা দিয়ে তৈরী মঞ্চে পরিবেশন করেন। পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তাঁর বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারনে বিয়ের ব্যবস্থা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়। 

আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ়ের ছাত্রী নিবাসের মাসিক থাকা খাওয়ার খরচ ছিল ১০ টাকা এবং এর মধ্যে কলেজের বেতন ও হয়ে যেত। এ কারনেই অল্প বেতনের চাকুরে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে আই.এ. পড়তে ঢাকায় পাঠান। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি এ পড়তে যান। 

বেথুন কলেজে মেয়েদের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। বানারসী ঘোষ স্ট্রীটের হোস্টেলের ছাদে বসে প্রীতিলতার বাঁশীঁ বাজানো উপভোগ করত কলেজের মেয়েরা। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভাল ফলাফল লাভ করতেন। এই বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্পবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারনে অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেওয়া হয়নি। ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাঁদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়। 

বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে বলেন। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বি এস সি ক্লাসে ভর্তি হন। সেজন্য প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদার দেখা হয়। 

প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারনেই কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট কুটিরে তাঁর সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে ঐ সাক্ষাতে নির্মল সেন প্রীতিলতাকে পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারব”। 

যুব বিদ্রোহের পর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মাষ্টারদা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কারনে প্রীতিলতার সাথে সে রাতে তাঁর দেখা হয়নি। প্রীতিলতার সাথে এই সাক্ষাতের কথা বলেতে গিয়ে মাষ্টারদা লিখেছেন “অল্প কয়েকদিন পরেই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হতেই নির্মলবাবু আমায় বললঃ আমি রাণীকে (প্রীতিলতার ডাক নাম) কথা দিয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করাব, সে এক সপ্তাহের জন্য যে কোন জায়গায় আসতে রাজ়ী আছে। রামকৃষ্ণের সঙ্গে সে ফাঁসীর আগে দেখা করেছে শুনেই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিল। তার দেখা করার ব্যাকুলতা শুনে রাজী হলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে (মে মাসের শেষের দিকে) তাকে আনার ব্যবস্থা করলাম”। 

মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম…”। 

রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তার দেখা হও্য়ার ইতিবৃত্ত, রামকৃষ্ণের প্রতি তার শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় দুই ঘন্টার মতো মাষ্টারদার সাথে কথা বলেন। মাষ্টারদা আরো লিখেছেন “তার action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে”। তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। 

১৯৩২ সাল–চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা নুতন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী বিপ্লবী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 

এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটা। পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামটা ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার চেষ্টা করত। 

সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিল ঐ ক্যাম্প থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। বিপ্লবীদের কাছে ঐ বাড়ির গোপন নাম ছিল “আশ্রম”। বিধবা সাবিত্রী দেবী এক ছেলে এবং বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে ঐ বাড়িতে থাকতেন। বিপ্লবীদের কাছে তিনি ছিলেন “সাবিত্রী মাসিমা”। এই আশ্রমে বসে সূর্য সেন এবং নির্মল সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সাক্ষাত করতেন এবং আলোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। অনেক সময় এই বাড়িতেই তাঁরা দেশ বিদেশের বিপ্লবীদের লেখা বই পড়ে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে সময় কাটাতেন। 

১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড় বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তাঁর মাকে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলেন। মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে তখন ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামী তরুন বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা) অবস্থান করছিলেন। 

ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন খবরটা জানার পর ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুরস্কার এবং পদোন্নতির আশা নিয়ে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাতজন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনষ্টেবল নিয়ে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। 

এর একটু আগেই মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়িটার নীচতলার রান্নাঘরে ভাত খেতে বসেছিলেন। জ্বরের কারনে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে উপরের তলায় শুয়ে ছিলেন। মাষ্টারদার সাথে খেতে বসে অস্বস্তি বোধ করায় প্রীতিলতা দৌড়ে উপরে চলে যান। প্রীতিলতার লজ্জা দেখে নির্মল সেন খুব হেসেছিলেন। এমন সময় মাষ্টারদা ঘরের ভিতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে বলেন “নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে”। 

মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে নিচে নেমে এসে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন। ততক্ষনে সিপাহী এবং কনষ্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান। “ঘরে আর কে আছে?” এ প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পাওয়া অভিযান পরিচালনাকারীরা এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ শুনতে পান। 

ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলবার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা দুইটা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরন করেন। গুলির শব্দ পাওয়ার পরেই ঘরের চারিদিকে থাকা সৈন্যরা চারিদিক থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়। টাকা পয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন। এই সময়ে আমের শুকনো পাতায় পা পড়ার শব্দ পেয়ে আশেপাশে থাকা সিপাহীদের চালানো গুলিতে সবার আগে থাকা অপুর্ব সেন মারা যান। 

মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল ঐ বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন। মাষ্টারদার জন্য রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরন লিখে ধলঘাটে এনেছিলেন প্রীতিলতা। সে পান্ডুলিপি পুকুরের মধ্যে হারিয়ে গেলো। তাঁদেরকে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বলেন মাষ্টারদা 

মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর। 

২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন এর। 

বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তাঁর গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন। 

প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। তবুও তিনি ভয় পান নি। 

ইংরেজদের হাতে প্রীতিলতা মরতে চাননি। গুলি লাগার পরে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড জিভে ঠেকিয়ে নেন আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর মুখে দেশের প্রথম শহীদ। 

0 comments: