গল্প - রাণুশীল ও বাঙ্ময়ী
Posted in গল্প
ষোড়শ জনপদের অন্যতম মগধ। ইতিহাস তাহার অনেক কথাই বলিয়াছে। কিন্তু ইতিহাসের আঁকে-বাঁকে কিঞ্চিৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণ হইতে উদ্গত কয়েকটি ঘটনা, মানসপটে কী এক চিত্র রচনা করিয়া যায়, তাহার সামান্য অংশ আজ প্রিয় পাঠকের সহিত ভাগ করিয়া লইব…
*********** ইন্দ্রপতন***********
নভমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণ বজ্রগর্ভ বারিদকুলে সম্পূর্ণরূপে আবৃত। মধ্যে মধ্যে অশনির নীলাভ বিচ্ছুরণ পরিবেশকে ভয়ঙ্কর করিয়া তুলিয়াছে।
পথেঘাট প্রায় জনশূন্য। শুধু অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দুইটি হস্তিনীর পৃষ্ঠে দুই সৈনিক রাজপুরীর সিংহদ্বার রক্ষা করিতেছে।
মৌর্য রাজবংশের ইহাই রীতি। সিংহদ্বারের শীর্ষে বিশাল একটি কেতন, তাহাতে ছয়টি ময়ূরের চিত্র রহিয়াছে। রাজপুরীর দ্বারের নিকট উন্মুক্ত তরবারি হস্তে প্রহরীরাও সতর্ক। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর, কিন্তু পুরীতে কেহ নিদ্রা যায় নাই। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্দ্রপতন ঘটিবে। এমত অবস্থায় দেবকুলও যেন আসন্ন দুর্ঘটনা অবশ্যাম্ভাবী জানিয়া অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামাইলেন।
রাজপুরীর অন্দর মহলের পূর্বে যে মহলটিতে রাজার শয়ন-মন্দির ! এই দূর্যোগের রাত্রিতে সেইখানেই সবাই উপস্থিত। রাজার ষোড়শ রাণীদের মধ্যে চারুমিত্রা ও সুভদ্রাঙ্গী রাজার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছেন। অন্যেরা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করিয়াই বোধহয় বেশ উচ্চগ্রামে রোদন করিতেছিলেন। শতপুত্র যেন পরস্পরের অচেনা।
চারুমিত্রার চক্ষু নিষ্পলকে রাজা বিন্দুসারের পান্ডুর বর্ণ মুখাবয়বের পানে চাহিয়া রহিয়াছেন।
সুভদ্রাঙ্গী ফোঁপাইতেছেন। বৈদ্যরাজ এবার একটু কঠোর কণ্ঠে বলিলেন, ----
---রাজমহিষীগণ, মহারাজের অন্তিম সময় আসন্ন। আপনারা শোক সংবরণ করুন, ও এই স্থান পরিত্যাগ করুন।
রাজপুরোহিতের দিকে চাহিয়া বলিলেন,
--- রাজ পুরোহিত ! আপনি ঈশ্বরের নাম করুন।
অমাত্য সুবন্ধু হস্ত তুলিয়া থামিতে বলিলেন, রাজার দিকে ইঙ্গিত করিলেন, রাজা বিন্দুসার অস্ফুটে উচ্চারণ করিতেছেন,
---হে মহাবীর তীর্থঙ্কর !
কক্ষমধ্যে স্তব্ধতা নামিয়া আসিল। প্রদীপগুলি দুর্যোগের দমকা বাতাসে নির্বাপিত-প্রায় হইয়া আসিল।
সুভদ্রাঙ্গী কান্না চাপিয়া প্রস্থান করিলেন। চারুমিত্রা ভাবিলেন,
---সুসীম এখনও আসিল না। সে এতোটা উশৃঙ্খলতা কোথা হইতে পাইল ? পিতার মৃত্যুশয্যার পার্শ্বে থাকিবার সৌজন্যটুকু যে দেখাইল না , সে রাজা হইবে কি করিয়া ? পিতা বলিলেই বা রাজ্যের প্রজারা, অমাত্যরা মানিবে কেন ? বিশেষত সুভদ্রাঙ্গীর যখন দুই
পুত্র রহিয়াছে ।
সুভদ্রঙ্গীর পুত্রদ্বয় অনতিদূরে দন্ডায়মান রহিয়াছে। তাহারা অশোক ও বীতশোক। শোক করা তাহাদের পক্ষে শোভন নয়। অশোকের হনুদ্বয় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিয়াছে পিতা তাহাকে রাজা বলিয়া মনোনীত করেন নাই। তাঁহার মাতা রাজপুত্রী নন। সুসীম রাজা হইবে। ঐ লম্পট, বিলাসী, কোপন-স্বভাব, নিষ্ঠুর সুসীম।
বাল্য কালে অশোক শান্ত,ভীরু ও ক্ষীণতনু ছিলেন বলিয়া কম নিগ্রহ করে নাই সে। একবার তাহাকে পোশাক ধরিয়া বৃক্ষের সুউচ্চ শাখায় ঝুলাইয়া রাখিয়া রাজপুরীতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। নৈশাহারের সময় ডাক পড়িলে তাহার অন্বেষণ শুরু হইল। ততক্ষণে ষষ্ঠ বর্ষীয় বালকটি রোদন করিতে করিতে জ্ঞান হারাইয়াছে, সুসীমের ত্রাসের কারণে অন্য ভ্রাতাগন শঙ্কিত ছিল, কেহ কিছু কহে নাই।
রাত্রিকালে প্রহরীবৃন্দ তাহাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া আসে। মাতা সুভদ্রাঙ্গী অতীব রোদন করিয়াছিলেন, কিন্তু প্রতিবাদ করিতে পারেন নাই, তিনি অজীবিক গোষ্ঠীর কন্যা,তাহার উপর নম্র স্বভাবা। ফলে তাঁহার উপস্থিতি ছিল অনেকটা অমাবস্যার চন্দ্রের ন্যায়। আছেন, কিন্তু কেহ দেখিতে পাইতেছেনা। এবংবিধ অত্যাচার অশোক ও বীতশোককে শৈশবে অহরহ ভোগ করিতে হইয়াছে।
এক্ষণে সুসীম মগধের রাজা হইলে, তাহাদের কি হইতে পারে, ভাবিয়া অশোক সক্রোধে স্থান ত্যাগ করিয়া নিজ কক্ষে আসিলেন। পিতার জীবদ্দশাতেই উজ্জয়িনীর শাসনভার পাইয়াছেন ।কিন্তু অশোক মগধের সিংহাসন চান। বীতশোক তাহার অনুগত। কিন্তু অন্যেরা.... অশোকের মস্তিষ্ক নিজ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্যস্ত হইয়া পড়িল। সুসীমের রাজ্যলাভ কোনক্রমেই সহ্য করা যাইবে না। সত্বর রাধাগুপ্তর সহিত বাক্যালাপ প্রয়োজন।
অশোকের চিন্তাধারা সবেগে বহিতেছিল, ইতিমধ্যে বাতাস মৃদু ক্রন্দন ধ্বনি বহিয়া আনিয়া বুঝাইয়া দিল, অশোকের কর্মকাণ্ড আরব্ধ হইবার সময় আসিয়াছে। অশোক পিতার জন্য শোক অনুভব করিলেন , উঠিয়া পিতৃ মন্দির অভিমুখে গমন করিলেন।
সিংহদ্বারে পতাকা অবনমিত হইল, হস্তীযুগল বৃংহন করিয়া রাজার অন্তিমযাত্রাকে সম্মান জানাইল।এইবার সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করিতে হইবে।
অশোক কক্ষমধ্যে ঢুকিয়া দেখিল মাতা সুভদ্রাঙ্গী ও বিমাতা চারুমিত্রা চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। রাজা বিন্দুসারের সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হইয়াছে , এক্ষণে তিনি শান্ত--সমাহিত ---হইয়া নক্ষত্রালোকিত পথে যাত্রা করিয়াছেন। সে পথে শত্রুতা নাই , অস্ত্র নাই , সে পথে রক্ত নাই, প্রতিযোগিতা নাই। প্রয়োজন নাই কোন বাহনেরও।
অশোক পিতার চরণপ্রান্তে দীনহীনের মতো বসিয়া পড়িলেন। এদৃশ্য রাজপুরীর সকলেই দেখিল। বীতশোকও আসিয়াছে, সুসীম এখনও আসে নাই। বর্ষণ ক্ষান্ত হইয়াছে। ঊষাকাল সমুপস্থিত.........
পরদিন প্রাতে ঘোষক, রাজা বিন্দুসারের জীবনাবসান ঘোষণা করিল , মগধবাসী রাজপুরীর বাহিরে ভিড় জমাইল। তাহারা রাজকীয় শোকযাত্রা দেখিবে।
************ভ্রাতৃনিধন**************
অশোক তাঁহার কক্ষে রাধাগুপ্তের সহিত একান্তে আলাপ করিতেছিলেন। রাধাগুপ্ত বলিতেছিলেন,
---কুমার, তিন বৎসর অতিক্রান্ত । যা করার করতে হবে, এই উপযুক্ত সময়। রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে চলেছে, প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কা। কেউ ঐ দুরাচারীকে রাজা হিসেবে চায় না। এই সুযোগ হারানো চলবে না। গুপ্তহত্যা ব্যতীত পথ নাই।
---ঠিক বলেছেন রাধাগুপ্ত , সুবিশাল এই মগধ রাজ্য, একে সুসীমের মতো অনুপযুক্তের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
---সুসীম সর্ব বিষয়ে অসংযত। বিদ্রোহ দমনেও ব্যর্থ। কুমার আপনি শুধু ছলেবলে তাকে পরিত্যক্ত পাকশালার পশ্চাতে নিয়ে
আসুন। আমার লোক থাকবে, দেহ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
---সাবধান রাধাগুপ্ত ! আমার রাজ্যাভিষেকের আগে যেন জনগন হত্যার সংবাদ জানতে না পারে !
---পারবে না কুমার ---সবাই জানবে তিনি নিরুদ্দেশ।
*****************
অশোক সেদিন দ্বিপ্রহরে ভ্রাতা সুসীমের কক্ষে গিয়া দাঁড়াইলেন। সুসীম মাদকাসক্ত ছিলেন, তিনি অর্ধচেতন অবস্থায় দেখিলেন, কেহ যেন আসিয়াছে, বলিলেন,
---কে এসেছো? এই সুসীম এখন রাজা। জানো না, মগধ মাহারাজকে সসম্মানে সম্বোধন করতে হয়? কার এতো বড়ো দুঃসাহস?
কণ্ঠস্বর উচ্চে তুলিয়া ডাকিলেন,
---প্রহরী, প্রহরী ---
প্রহরী ছুটিয়া আসিল। সে অশোককে আসিতে দেখিয়াছিল, তাই কিছু বলে নাই। এক্ষণে প্রমাদ গনিল,
সুসীম বজ্রপাতের মতো কঠিন শব্দে বলিলেন,
---তোমাকে পদচ্যুত করব। জানোনা ! আমার এখন বিশ্রামের সময় ? কেন এ সময় কক্ষে আসতে দিয়েছো?
প্রহরী নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিল, কাহাকে কি বলিবে বুঝিতে পারিল না। সুসীম অশোকের দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করিয়া আবার বলিলেন,
---বহিষ্কার করো, এক্ষুনি ---
বলিয়া টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, হস্তে খোলা তরবারি ঝলসিয়া উঠিল। পদস্খলন হইতেছিল, প্রহরী অগ্রসর হইয়া সুসীমের বাহু চাপিয়া ধরিল। সে বোধকরি নবীন প্রহরী ছিল। জানিতনা রাজার বাহুতে স্পর্শ করিবার মতো ধৃষ্টতার কি শাস্তি হইতে পারে।
সুসীম তৎক্ষণাৎ তীব্রস্বরে,
---পাপিষ্ঠ ! তোর এত দুঃসাহস---
বলিয়া তরবারির এক কোপ বসাইয়া দিলেন, তাহার দক্ষিন স্কন্ধে, প্রহরীর দক্ষিন হস্তটি দেহচ্যূত হইয়া ভূপাতিত হইল, প্রহরী চিৎকার করিয়া ছটফট করিতে লাগিল যন্ত্রণায় । সুসীম রক্তাক্ত প্রহরীকে দেখিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন।
অশোক ঐ ঘটনার পর আর থাকিতে পারেন নাই। চলিয়া আসিলেন, এবং সায়ংকালের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। তাঁহার বাল্যকাল হইতে দেখা এই নিষ্ঠুরতা তাহার অন্তরের কোমল অনুভূতি গুলিকে মারিয়া ফেলিয়াছিল। তিনি বুঝিয়াছিলেন, অস্তিত্ব রক্ষা করিতে হইলে নিষ্ঠুরতাই একমাত্র পথ।
সায়ংকালে সুসীম একা কিছুক্ষণ উদ্যানে সময় অতিবাহিত করেন। এক্ষনে তিনি দ্বিপ্ররের কথাই ভাবিতেছিলেন, কে আসিয়াছিল ? কোনো ষড়যন্ত্র হইতেছে কি?
অশোক হাসিমুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, এক্ষণে সুসীম তাহাকে চিনিতে পারিলেন। বলিলেন,
-
---অহো ভ্রাতা অশোক, বলো, উজ্জয়িনীর বার্তা কি ?
দুই হস্ত ছড়াইয়া ব্যঙ্গ মিশানো কণ্ঠে বলিলেন,
---মগধরাজের নিকট কিছু প্রার্থনা থাকলে বলতে পারো ! নিরাশ হবে না ! হাঃ হাঃ হাঃ---
অশোক অত্যন্ত বিনীত স্বরে বলিলেন,
---ভ্রাতা, কালই আমি এ প্রাসাদ ত্যাগ করব,
আজ ঐ স্থানে চলুন, ক্ষণিক উপবেশন করি, আপনার অভিষেক অনুষ্ঠানের কিছু আয়োজন করবেন আশা করি!
রাধাগুপ্ত তাঁহার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছেন। অশোক সুসীমকে পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে লইয়া আসিলেন। আলো কমিয়া আসিয়াছে। উদ্যানের এই প্রান্ত অবহেলিত পড়িয়া আছে। পূর্বে একটি পাকশালা ছিল। তাহার বিশাল একটি কুন্ড এখনও রহিয়া গিয়াছে।
অশোক ও সুসীম বাক্যালাপ করিতে করিতে কুন্ডের নিকট আসিয়াছিলেন। সুসীমের হস্তের সুরাভান্ড হইতে তিনি সুরাপান করিতে ছিলেন, এক্ষণে তাহার অন্তর কিঞ্চিৎ উৎফুল্ল, বলিতেছিলেন অনেক কথা। অশোক দেখিয়া আসিলেন কুন্ডটিতে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি রহিয়াছে, তাঁহার চক্ষুদুটিও জ্বলিয়া উঠিল। উদ্যান হইতে একটি শুষ্ক বৃক্ষশাখা তুলিয়া লইলেন। সুসীম এখন ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর। অশোক দেখিতে পাইলেন, একজন বৃক্ষের আড়ালে দন্ডায়মান, অপর পার্শ্বে রাধাগুপ্তও রহিয়াছেন।
এই সুযোগ। সুসীমের শির লক্ষ্য করিয়া সজোরে বৃক্ষশাখাটি নিক্ষেপ করিলেন অশোক। তরবারি কোষমুক্ত করিবার সুযোগ পাইলেন না সুসীম। পড়িয়া গেলেন, অশোক তরবারি কোষমুক্ত করিয়া তাহার পঞ্জর ভেদ করিয়া দিলেন। রাধাগুপ্ত আসিয়া বৃক্ষশাখাটি তুলিয়া সুসীমের মস্তকে আঘাত করিতে থাকিলেন। সুসীম জ্ঞান হারাইলেন। সকলে মিলিয়া সুসীমের অচৈতন্যদেহ অগ্নিকুন্ডের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। বৃক্ষশাখাটিও তাহার মধ্যে বিসর্জিত হইল। সুসীমের দেহ ধীরে ধীরে অগ্নি গ্রাস করিয়া লইল।
কেহ জানিল না, একটি অধ্যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে ভষ্মীভূত হইয়া গেল। অশোকের চক্ষু এখন আবার স্বাভাবিক হইয়াছে। আর তাঁহার রাজা হইবার পথে কোনো কন্টক রহিল না। অন্য ভ্রাতাদের মারিতে বেগ পাইতে হইবেনা। বিস্বস্ত সৈন্যগনই তাহা করিতে পারিবে। শুধু বীতশোক রহিল। সে বড়ই অনুগত। অশোক ও রাধাগুপ্ত নিশ্চিন্ত মনে প্রাসাদে চলিলেন।
নিষ্ঠুর একটা হাসি তাঁহার মুখে লাগিয়া রহিল। অশোক--- রাজা ---অশোক হইবেন পৃথিবী শ্রেষ্ঠ রাজা। বীর দর্পে মেদিনী কম্পিত করিয়া চলিলেন---ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট--- অশোক মৌর্য।
*************রাজ্যগ্রহণ***********
প্রত্যুষের অরুণাভা মগধের রাজপুরীর শীর্ষ স্পর্শ করিল। প্রাকার চূড়ায় তূর্য ধব্বনি হইল। আজ যুবরাজের অভিষেক । গতরাত্রি হইতে সমস্ত রাজপুরী ও যুবরাজের মহল নিশ্ছিদ্র প্রহরায় মুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। রাধাগুপ্তের বিশ্বস্ত ও সশস্ত্র প্রহরীগণ অতন্দ্র প্রহরারত । একটি মূষিক প্রবেশেরও পথ নাই।
সূর্যোদয়ের দুই দন্ডের মধ্যেই রাজপুরীর প্রশস্ত অঙ্গন জনসমাগমে পূর্ণ হইয়া উঠিল। মগধের শিশু হইতে বৃদ্ধ, ধনী হইতে দরিদ্র, উচ্চ শ্রেণী হইতে নিম্ন শ্রেণী কেহই বাদ রহিল না।
একটি উচ্চ শিলাপট্টের উপর চতুষ্কোন যজ্ঞকুন্ড রচিত হইয়াছে। যুবরাজ ও রাজ পুরোহিতের জন্য সুদৃশ্য চন্দ্রাতপের নিম্নে বিশেষ আসন। সমস্ত স্থানটি মাল্য ও পুষ্প দ্বারা শোভিত। রাজমাতা ও অন্যান্য অন্তপুরিকাদের জন্য সামান্য দূরে দ্বিতল একটি মঞ্চ নির্মিত হইয়াছে। তাঁহারা দূর হইতে রাজ্যাভিষেক দেখিবেন।
শঙ্খধ্বনিতে আকাশ প্রকম্পিত করিয়া অশোক আসিতেছেন। যুবরাজের পরনে কাঞ্চন বর্ণ কৌশিক বস্ত্র। ঘন নীল উত্তরীয় স্কন্ধ হইতে নামিয়া বাম বাহুকে আলিঙ্গন করিয়া রহিয়াছে। বক্ষ স্বর্ণ জালিকায় আবৃত। তাহার উপর স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত মুক্তার সাত লহরী হার, তাহারই পার্শ্বে শ্বেত ও লোহিত পদ্মের সুবিশাল মাল্য গ্রীবা হইতে জানু পর্যন্ত লম্বিত। মস্তক অনাবৃত, অনতিবিলম্বেই তাহা রাজ মুকুটে শোভিত হইবে।
ঘোষকের আহ্বানে গুঞ্জন স্তব্ধ হইল। সকলেই আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
হস্তীবৃন্দ বৃংহন করিল, নর্তকীগন পুষ্পবর্ষণ করিল, পুরবধূরা শঙ্খধ্বনি করিলেন, লাজাঞ্জলি বর্ষিত হইল যুবরাজ আসিলেন।একটি স্বর্ণ সিংহাসন পুষ্পমাল্য শোভিত।
জানুর উপর কোষবদ্ধ তরবারি রাখিয়া দৃপ্ত ও তৃপ্ত ভঙ্গিতে মস্তক উন্নত করিয়া তিনি উপবেশন করিলেন। যজ্ঞ আরম্ভ হইল। যজ্ঞাগ্নি তিন হস্ত ঊর্ধ্বে উঠিল, উপনিষদের মন্ত্রে বাতাস আন্দলিত হইল, পুরোহিত রাজটীকা পরাইয়া দিলেন।
ললাটে রক্ত বর্ণ রাজটীকা পরিয়া উন্মুক্ত তরবারি হস্তে মগধরাজ অশোক উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রাধাগুপ্ত ও সুবন্ধু জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন---
---জয় মগধেশ্বর অশোকের জয়।
প্রজাগণ এতক্ষণ চিত্রার্পিতের ন্যায় মূক হইয়াছিল, তাহারা সহর্ষে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। আকাশ -বাতাস মথিত করিয়া সেই ধ্বনি দিকে-বিদিকে পরিব্যপ্ত হইল। দেবী সুভদ্রাঙ্গী করজোড়ে চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। দেবী চারুমিত্রা ধীরে ধীরে সংজ্ঞা হারাইয়া লুটাইয়া পড়িলেন। কেহ বুঝিলনা, কেহ জানিল না, শুধু সুভদ্রাঙ্গীর অধরে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল।
************পদ্মনাভান************
কলিঙ্গ রাজপুরীর অভ্যন্তরে মন্ত্রণাকক্ষ। ইচ্ছাকৃতই কক্ষটি সামান্য ছায়ান্ধকার করিয়া রাখা হইয়াছে। অভ্যন্তরে মৃগচর্মের উপর উপাধানে দেহ রাখিয়া উপবিষ্ট আছেন কলিঙ্গরাজ আনন্দ পদ্মনাভান। সুকঠিন পেশী তরঙ্গের সহিত মুখমন্ডলের রাজকীয় আভিজাত্য ও অভিজ্ঞতায় এক অভূতপূর্ব ব্যাক্তিত্বের প্রকাশ । তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রগলভতা করিবার দুঃসাহস কাহারও হয় না।
নিকটে অপর দুইটি আসনে মহামন্ত্রী বসুমিত্র ও সেনাপতি ভীমদেব বসিয়া আছেন । সম্মুখে গুপ্তচর কঙ্ক। সে মগধের খবর আনিয়াছে।
সে বলিতেছিল,
---রাজা অশোক সৈন্যসমাবেশে অপূর্ব নৈপুন্য রেখেছেন। মগধ সেনাপতি অভয়ঙ্কর, ভদ্রক, দেবক --- কলিঙ্গকে অবরোধ করার পরিকল্পনা করেছে মহারাজ। ওরা পুন্ড্রবর্ধন, উজ্জয়িনী, পাটলীপুত্র, তিন দিক থেকে আক্রমন করবে। তবে কে কোথা থেকে আক্রমন করবে, শত চেষ্টাতেও জানতে পারিনি মহারাজ। তাদের সাথে জয়লাভ করতে হলে...
রাজা স্বর্ণমুদ্রা দান করিয়া গুপ্তচরকে বিদায় দিলেন,
সেনাপতির দিকে চাহিলেন,
---সেনাপতি, কলিঙ্গ-সৈন্যদের যথেষ্ট শিক্ষিত করো, আর পুরাতন পন্থার ওপর নির্ভর করা যাবেনা।
সেনাপতি সম্মতি জানাইল, চিন্তিত আননে রাজাকে অভিবাদন করিয়া বিদায় চাহিল। সভা ভঙ্গ হইল।
******************
ভাস্কর অস্তমিত হইতে এখনও কিছু বিলম্ব রহিয়াছে। আনন্দ পদ্মনাভান তাঁহার প্রাসাদের শীর্ষে উঠিলন। যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় রাজ্যের সমৃদ্ধি চোখে পড়ে।
মগধের পূর্ব দিকে তাঁহার এই রাজ্যের সমৃদ্ধি মগধরাজ চন্দ্রগুপ্তও সহ্য করিতে পারেন নাই। তিনি যুদ্ধ যাত্রা করিয়াছিলেন, কিন্তু কলিঙ্গ নিজ সম্মান অক্ষুন্ন রাখিতে পারিয়াছিল। বিন্দুসারও কলিঙ্গের কেশাগ্র স্পর্শ করিতে পারেন নাই।
কিন্তু পদ্মনাভান ভাবিতেছিলন, রাজা অশোক উগ্রতায় পূর্বপুরুষকে ছাড়াইয়া বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছেন। অতএব এইবার বোধকরি রাজ্য রক্ষা করা অতোটা সহজ হইবে না। কিন্ত জনগন সমর্থন করিতেছে, ইহাই তাঁহার ভরসা। আবার কিছু সৈন্যক্ষয়, অযথা অর্থব্যয়---একটি দীর্ঘশ্বাস রাজার বুক কাঁপাইয়া বাহির হইয়া বাতাসে মিশিয়া গেল। রাত্রি পোহাইলেই যুদ্ধ।
মহামন্ত্রী আসিয়া দেখিলেন, রাজা চিন্তাকুল আননে দন্ডায়মান। তিনি মৃদু কণ্ঠে বলিলেন,
---মহারাজ ! এসময় কি বহির্বাণিজ্য স্থগিত রাখব ? বিদেশীদের কিছু বাণিজ্য তরী এসেছে। তারা রাজ্যের বর্তমান অবস্থা অবগত নয়। কি কর্তব্য মহারাজ ?
---স্থগিত রাখো। কোনো বিদেশী বণিক যেন এসময় এ রাজ্যে না থাকেন। কলিঙ্গের নাম বৈদেশিক বাণিজ্যে সবার উপরে। তার যেন নিন্দা না হয়। এই যুদ্ধে একজন বিদেশীর মৃত্যুও কাম্য নয়।
----যথার্থ মহারাজ -----
---হ্যাঁ, রাজ্যে যুদ্ধের বার্তা ঘোষিত হয়েছে?
---বিলক্ষণ মহারাজ---
---প্রজাদের কি প্রতিক্রিয়া?
---তাহারা জন্মভূমি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। প্রয়োজনে প্রতিটি মানুষ যুদ্ধে যোগ দেবে মহারাজ। তাদের যুদ্ধকালীন শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়েছে।
---কলিঙ্গ তবে প্রস্তুত?
---সম্পূর্ণরূপে মহারাজ !
কলিঙ্গরাজ আনন্দ পদ্মনাভান জানিলেন না, তাঁহার রাজ্য ছারখার হইয়া যাইবে, আজ যে রাজ্যে ঊষাকাল ঘোষিত হয় পক্ষিকুলের কাকলিতে , অচিরেই তা শিশুর আর্তচিৎকারে আকুল হইয়া উঠিবে , হস্তীকুলের বৃংহতি যে রাজ্যের সমৃদ্ধি ঘোষণা করে , সেই রাজ্যের সমাপ্তিও ঘোষিত হইবে তাহাদেরই আর্তনাদে।
ধৌলিপর্বতের ময়দান হবে রক্তাক্ত, যে দয়া নদীর স্বচ্ছ বারি জীব কুলের তৃষ্ণা নিবারণ করে , সেই নদী রুধিরধারা বহন করিবে। চন্ডাশোক আসিতেছেন, তিনি মৌর্য কেতন নহে, ধ্বংসের উন্মত্ততা বহিয়া আনিতেছেন--- কালান্তক অশোক---নিষ্ঠুরতম অশোক---
---পৃথিবীর বিভৎসতম যুদ্ধের নায়ক
---সম্রাট অশোক মৌর্য---
রচিত হইবে এক অভিনব ইতিহাস। কলিঙ্গের আত্মদানে, মানুষ সন্ধান পাইবে শান্তির। দিকে দিকে ধ্বনিত হইবে শিক্ষার জয়ধ্বনি।
*************ষড়যন্ত্র গঠন*************
১৮৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। কালচক্র ঘুরিয়াছে। মৌর্য বংশের সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত প্রায়। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আবার মাথা তুলিতেছে, মগধের সীমানাও খর্ব হইয়া আসিয়াছে। দিকে দিকে ষড়যন্ত্র হইতেছে।
দ্বিজশ্রেষ্ঠ বক্রতুন্ড দুই হস্ত বন্ধন করিয়া প্রবল বেগে পিঞ্জরাবদ্ধ শার্দূলের ন্যায় পদচারণা করিতেছিলেন। তাঁহার নধর শিখাটিও তাহার সহিত দোদুল্যমান
---তিনি ভাবিতেছিলেন,
---এতকাল ঐ বৌদ্ধগুলার খুব বাড় বাড়িয়াছিল , তাহারা ভাবিয়াছিল কী ! রাজার ধন- সম্পদ সমস্ত ! স---ম---স্তই কী তাহাদের ঐ সঙ্ঘারামের মৃত্তিকা তলে সন্তান প্রসব করিবে ? বেদ উপনিষদ মানিবেনা ? এইবার কী হইল ! অ্যাঁ? কী হইল?---কিন্তু না না, এখনই এত উল্লাসের কিছু হয় নাই।
তিনি বেদিকায় উপবেশন করিলেন,
----চাণক্য দেবের শিষ্যপরম্পরা আমি, এত অধৈর্য হওয়া শোভা পায়না আমার। শেষ অবধি ঐ পুষ্যমিত্রকে দিয়া কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নাই। বলাও যায়না, যা উগ্রচন্ড ঐ শুঙ্গটা...অকস্মাৎ আমাকেই না মারিয়া ফেলে! ফেলিলেও আশ্চর্য হইব না ।
তবে বৌদ্ধগুলাকে নির্মূল করিতে হইলে অবশ্য সুস্থির মস্তিষ্ক হইলেও চলিবেনা। গোঁড়া ব্রাহ্মণ ভক্ত হইতে হইবে,তাহার সহিত ক্ষাত্রতেজের সংমিশ্রনও আবশ্যক।
এমত সময়ে বিষ্ণুশর্মা আসিলেন, দেখিলেন, বক্রতুন্ড অতিশয় উত্তেজিত,
---কি হে ! "বঙ্কিম শুন্ড" কী এতো নিজের মনে বকছো?
---না আচার্য বিষ্ণুশর্মা ! পরিহাসের সময় এ নয়। আমাদের ষড়যন্ত্র যদি প্রকাশ হয়ে যায় ? তবে শিরশ্ছেদ অনিবার্য।
---চতুর্থ পুরুষ রাজা দশরথ মৌর্য থেকে নবম পুরুষ বৃহদ্রথ মৌর্য ! ছয় পুরুষ ধরে যে ক্ষোভ ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়েছে, এই ষড়যন্ত্র তার ফসল। অতো সহজে প্রকাশ হবার নয়। শুধু বৌদ্ধগুলাকে মেরে সঙ্ঘারাম থেকে সোনাদানা উদ্ধার করার সময় একটু সাবধানে থাকতে হবে। শুঙ্গটা যেন আবার লোভে পড়ে আমাদের ফাঁকি না দেয়...
---হুঁ-উঁ-উঁ-উঁ-ম্ ---বলিয়া বক্রতুন্ড ও বিষ্ণুশর্মা দুই চক্ষে কুটিলতা মাখাইয়া ভ্রু বাঁকাইয়া, নাসিকা স্ফীত করিয়া মুন্ডিত মস্তকের শোভা-বর্ধনকারী সুপুষ্ট শিখাটি অঙ্গুলিতে জড়াইতে লাগিলেন।
**************
মগধের প্রধান রাজপথ দিয়া একটি কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব অতি দ্রুতবেগে ছুটিয়া যাইল। অশ্বারোহীর দৃঢ় বলিষ্ঠ অবয়ব, তাহার ধাতব বর্ম ও শিরস্ত্রাণ রৌদ্রকিরণে জ্যোতি বিচ্ছুরিত করিয়া মুহূর্তে অন্তর্হিত হইল। পথচারীরা বেগবান অশ্বকে সভয়ে পথ ছাড়িয়া দিয়াছিল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় আসিলে একজন পথচারী তাহার সঙ্গী কে বলিল ---
---কে হে বাপু ? ওঃ তাড়া দেখ না, যেন যুদ্ধে চলেছেন!
---আহা! ওঁকে চেন না ? উনি যে মগধের নূতন সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ!
---নূতন কেন? পুরানো সেনাপতির কি হল?
--- আরে তুমি দেখছি কোনো সংবাদই রাখ
না? পুষ্যমিত্র ছিলেন একজন সেনানায়ক । সীমান্ত প্রদেশে বীরত্বের সঙ্গে শত্রু দমন করে এসেছেন তাই মহারাজ বৃহদ্রথ পুষ্যমিত্রকে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেছেন ।
--- সীমান্ত প্রদেশে প্রতিদিনই যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পশ্চিম সর্ব দিকেই সীমান্ত আক্রান্ত । মগধের উপর এত লোভ কেন রাজাদের কে জানে?
---আদিগন্ত বিস্তৃত ছিল এই মগধ। এই বৃহদ্রথ ! দুর্বল তার প্রশাসন। অন্য রাজারা রাজ্যবিস্তারের সুযোগ ছাড়বে কেন? যে যেদিকে পারছে মগধের অংশ অধিকার করে নিচ্ছে।
---মহারাজ ধর্মে বৌদ্ধ হলে আর হবে কী ? স্বভাবত অলস ও বিলাসপ্রিয়। নিজে যুদ্ধ করতে চান না।কিন্তু যুদ্ধবিদ্যার প্রদর্শন, মল্লযুদ্ধ ইত্যাদি উপভোগ করেন। এই পুষ্যমিত্র কিন্তু খুব বীর ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। মহারাজ সম্ভবতঃ যুদ্ধক্রীড়া প্রদর্শনের জন্য পুষ্যমিত্রকে সেনাপতি পদ দিয়েছেন।
--- রাজা-রাজড়ার ব্যাপার বোঝা কঠিন।
--- তা ঠিক । নাও চলো চলো! বেলা যে গড়িয়ে এল! আর অধিক বিলম্ব করলে গৃহে গৃহিণী যুদ্ধঘোষণা করবেন।
দুইজনে হাসিতে হাসিতে গন্তব্যস্থলের অভিমুখে অগ্রসর হইল।
***************
সেনাপতি পুষ্যমিত্র আসিয়া পৌঁছিলেন আচার্য বিষ্ণুশর্মার গৃহে। অশ্ব হইতে অবতরণ করিতেই একজন দাস আসিয়া অশ্বটিকে মন্দুরায় লইয়া গেল। অন্যজন পথপ্রদর্শন করিয়া নির্দিষ্ট কক্ষে লইয়া চলিল---
চতুষ্কোণ কক্ষটির সমস্ত গবাক্ষ ও দ্বার রুদ্ধ। ভূমিতে আসন পাতিয়া কতিপয় ব্রাহ্মণ বসিয়া আছেন। পুষ্যমিত্র করজোড়ে প্রণাম করিয়া শূন্য আসনটিতে উপবেশন করিলেন। আচার্য বিষ্ণুশর্মা কহিলেন---
---যুদ্ধবিদ্যা প্রদর্শনের আয়োজন সম্পূর্ণ?
---হ্যাঁ, আচার্যদেব।
পুষ্যমিত্র বলিলেন।
আচার্য পঞ্চক বলিলেন ---
---উত্তম। কোন কোন বিদ্যার প্রদর্শন হবে?
---প্রথমে মল্লযুদ্ধ। তারপর ধনুর্বিদ্যা ও রথযুদ্ধ। সর্বশেষে হস্তী ও অশ্বারোহীর ক্রীড়া, যা অভিনব।
---উত্তম! অতি উত্তম! তুমি কোন ক্রীড়াতে অংশগ্রহণ করবে।
---আমি হস্তীপৃষ্ঠে থাকব। আমার অধস্তন সেনানায়ক ধরণীধর অশ্বপৃষ্ঠে আরোও অষ্ট অশ্বারোহীর সঙ্গে থাকবে।
---হস্তীপৃষ্ঠ থেকে নিশানা অব্যর্থ হবে?
---অবশ্যই ! লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না । পরন্তু ধরণীধর অত্যন্ত চতুর ও প্রত্যুৎপন্নমতি সেনা। অন্য কোনোদিক থেকে প্রতি আক্রমণ হলে সে প্রতিহত করতে পারবে।
---সাধু ! সাধু ! অস্ত্র অভ্যাস নিয়মিত হচ্ছে তো ? প্রহরীদের কিরূপ ব্যবস্থা ?
---নিশ্চিন্ত থাকুন আচার্য। এরূপ যুদ্ধক্রীড়া পূর্বে কেউ দেখেনি, না মহারাজ, না তাঁর প্রজাগণ। সমস্ত নবীন প্রহরী নিযুক্ত করেছি। ব্যবস্থাপক আমারই অধীনস্থ। এবারে জনসমাগম বিপুল হবে। আপনাদের জন্য নির্দিষ্ট সময় নিমন্ত্রণ লিপি পাঠানো হবে। আসনও স্বতন্ত্র থাকবে সকলেই উত্তমরূপে ক্রীড়া উপভোগ করতে পারবেন।
বলিয়া পুষ্যমিত্র গূঢ় হাস্য করিল। ক্রমশঃ সেই হাস্য ব্রাহ্মণদের আননেও সংক্রামিত হইল। পুষ্যমিত্র পুনরায় কহিলেন---
--- আশীর্বাদ করবেন দ্বিজগন ! যেন প্রচেষ্টা সার্থক হয়।
---কৃতকার্যম্ ভবতু ! শুভমস্ত।
সকলে একযোগে বলিয়া উঠিলেন।
প্রণাম করিয়া সেনাপতি পুষ্যমিত্র দ্বিজভবন হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
**********মৌর্যপতন***********
মহারাজা বৃহদ্রথ।
এক্ষণে তিনি কিঞ্চিৎ বিপাকে পড়িয়াছেন। ধর্মাশোকের উত্তর পুরুষ হইয়া এবং বৌদ্ধ উপাসক হইয়া যুদ্ধ মৃগয়া ইত্যাদি করিবার উপায় নাই । অথচ শরীরচর্চা, যুদ্ধবিদ্যা, মৃগয়া ইত্যাদি তাহার অতি প্রিয় ব্যসন। সমগ্র জীবৎকাল বসিয়া বসিয়া মোক্ষলাভের চেষ্টায় শরীরের যন্ত্রাংশগুলি বিকল হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে মধ্যে ক্ষাত্রতেজ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলে তিনি নিজে সেনাগণ কে যুদ্ধবিদ্যায় শক্তি প্রদর্শনের জন্য আহ্বান করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি এক সুবৃহৎ মল্লভূমি নির্মাণ করাইয়াছেন। দুগ্ধের পরিবর্তে তক্র পান করিবার ন্যায় , যুদ্ধ বিদ্যাকে ক্রীড়ায় রূপান্তরিত করিয়া বিনা রক্তপাতে আমোদ লাভ করিতেছেন।
বৃহদাকার এক প্রকান্ড ভূমিকে সু-উচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টন করিয়া এই মল্লভূমি নির্মিত হইয়াছে। কেন্দ্রীয় ভূমিটি বালুকা মিশ্রিত । চারিটি তোরণ দ্বার, সেইগুলি দিয়া অনায়াসে হস্তী প্রবেশ করিতে পারিবে। প্রাচীরের অভ্যন্তরে ভূমি স্পর্শ করিয়া বৃত্তাকারে সারিবদ্ধ ত্রিতল কাষ্ঠ-নির্মিত মঞ্চ। সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সুদৃশ মঞ্চটি মহারাজা বৃহদ্রথ বয়স্যদের লইয়া বসিবেন। তাহার দক্ষিণ পার্শ্বে মন্ত্রী ও অমাত্যদের ও বাম পার্শ্বে রাজ মহিষী ও অন্তঃপুরিকাদের বসিবার প্রকোষ্ঠও তাহাতে রহিয়াছে । ব্রাহ্মণ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের আসন পৃথক। ইহা ব্যতীত সুবৃহৎ ভূমিটি ঘিরিয়া সাধারণ নগরবাসীদের জন্য সহস্রাধিক আসন। ক্রীড়াবিদ সৈনিকদের জন্য সারিবদ্ধ শুভ্র শিবির --- বিশাল যুদ্ধ ভূমিকে চাপিয়া ঠেসিয়া ক্ষুদ্রকায় করিবার এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ।
প্রভাত হইতেই মল্লভূমিতে জনসমাগম আরম্ভ হইয়াছে। সুবেশ পুরুষরা দলবদ্ধ হইয়া আসন গ্রহণ করিয়াছেন। ধীরে ধীরে মন্ত্রী ও অমাত্যগণ আসিলেন। সর্বশেষে মহারাজা বৃহদ্রথ অশ্বপৃষ্ঠে অনুচর ও দেহরক্ষীসহ আসিলেন।
অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া সানুচর মহারাজ সোপান বাহিয়া নিজ প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন। কয়েকজন দাস খাদ্য পানীয় লইয়া তাহার পশ্চাতে দাঁড়াইল। দুইজন ব্যজনকারিণী দুই পাশ হইতে ব্যজন করিতে লাগিল। দেহরক্ষীগণ নিম্নের সোপানে ও অলিন্দে প্রহরায় রহিল।
দুন্দুভি ও রণতূর্যের শব্দে পশুগুলি চঞ্চল হইয়া উঠিল। ঘোষক আসিয়া মহারাজকে প্রণাম জানাইয়া অনুমতি চাহিল মহারাজ বৃহদ্রথ একখানি ত্রিকোণ শ্বেত পতাকা আন্দোলিত করিতেই ক্রীড়া আরম্ভ হইয়া গেল।
প্রথমে দুইজন মল্লবীর আসিয়া মল্লযুদ্ধ আরম্ভ করিল। যে জয়ী হইল তাহার সহিত নূতন আর এক মল্লবীর আসিয়া যুদ্ধ করিল। এইভাবে পঞ্চমবারে যিনি জিতিলেন তাহাকেই শ্রেষ্ঠ মল্লবীর সম্মান দেওয়া হইল।
ইহার পর পদাতিক সৈন্যরা ধনুর্বাণ হস্তে ও অশ্বচালিত রথী যোদ্ধারা তরবারি লইয়া প্রবেশ করিল । ভূমির মধ্যস্থলে পদাতিক সৈন্যরা বৃত্তাকারে ধনুর্বাণ লইয়া দাঁড়াইল তাহাদের কেন্দ্র করিয়া ছয়টি রথ চক্রাকারে সবেগে পরিক্রমা করিতে লাগিল। প্রতি রথে একজন করিয়া সারথি ও দুইজন করিয়া সেনানী। পদাতিকরা রথীদের উদ্দ্যেশ্যে তির ছুঁড়িতে লাগিল । রথের উপর হইতে একজন সেনানী তিরগুলি তরবারি দ্বারা প্রতিহত করিতে লাগিল অন্যজন উন্মুক্ত তরবারি দ্বারা পদাতিকদের আঘাত করিতে লাগিল। জনগণ হর্ষোল্লাসিত হইয়া দুই পক্ষের যোদ্ধাদের প্রভূত উৎসাহিত করিতে লাগিল।
ক্রিড়াটিতে প্রচুর উন্মাদনা থাকিলেও হতাহতের সংখ্যা হইল প্রচুর। বেশ কিছু যোদ্ধা ও অশ্ব গুরুতর আহত হইল। কিছু তির দিকভ্রষ্ট হইয়া প্রাচীর গাত্রে বিঁধিল। কিন্তু রাজা ও রাজ্যবাসী উভয়েও রোমাঞ্চিত ও হর্ষোৎফুল্ল হইলেন।
সর্বশেষে আরম্ভ হইল হস্তী ও অশ্বের যুগল ক্রিড়া। একটি সুবৃহৎ হস্তীপৃষ্ঠে আসিলেন সেনাপতি পুষ্যমিত্র। দ্রুতগামী অষ্ট অশ্বারোহী হস্তীটিকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। সেনানায়ক ধরণীধর তাহাদের নায়ক। পুষ্যমিত্র হস্তীপৃষ্ঠ হইতে অশ্বারোহীদের প্রতি ভল্ল নিক্ষেপ করিতেছেন। অশ্বারোহীরা দ্রুতবেগে সরিয়া গিয়া আত্মরক্ষা করিতেছে। উত্তেজিত দর্শকদের কলোরোল উত্তোরোত্তর গগনভেদী হইয়া উঠিল।
প্রবল শব্দ ও কলরোলে হস্তীটি কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া পড়িল। পুষ্যমিত্রর নিক্ষিপ্ত ভল্লে একটি অশ্ব আহত হইয়া পড়িয়া গেল এবং অশ্বারোহীর হস্তচ্যুত ভল্ল লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া পুষ্যমিত্রর হস্তীকে আঘাত করিল। হস্তীটি বিকট বৃংহণ করিয়া ধাবিত হইল, অকস্মাৎ পুষ্যমিত্র ভরচ্যুত হইয়া হস্তীপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল।
মত্ত হস্তী সবেগে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া আসিতেছে।
ক্ষিপ্রগতিতে পুষ্যমিত্র নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরাইয়া লইল। ইতিমধ্যে হস্তীচালক হস্তীটি কে কিঞ্চিৎ আয়ত্বে আনিয়াছে। সে তাহার বেগ সম্বরণ করিয়া একস্থানে দাঁড়াইয়া শুন্ড আন্দোলিত করিতে লাগিল। চালকের আশ্বাসে সে সম্ভবত তাহার ক্রোধ সম্বরণ করিয়া রহিল। এই অবসরে অশ্বারোহীরাও তাহাদের গতি স্তব্ধ করিয়া স্থির হইয়া রহিল।
কেহই লক্ষ্য করে নাই হস্তীটি মহারাজের অতি নিকটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সহসা পুষ্যমিত্র এক প্রকান্ড উল্লম্ফনে হস্তীর শুন্ডের উপর পদ রাখিয়া তাহার পৃষ্ঠে উঠিয়া পড়িল।
সহস্রাধিক দর্শক এক যোগে উঠিয়া দাঁড়াইল। মহারাজা উত্তেজিত হইয়া প্রকোষ্ঠের কিনারায় আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িলেন। পুষ্যমিত্র চকিতে একটি নূতন ভল্ল তুলিয়া সজোরে মহারাজা বৃহদ্রথের প্রতি নিক্ষেপ করিল। পলক মধ্যে ভল্ল আসিয়া বৃহদ্রথের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া দিল।
সমস্ত দর্শক রুদ্ধশ্বাসে সত্রাসে তাকাইয়া রহিল। শ্বাস ফেলিতে যেইটুকু সময় তাহার মধ্যে পুষ্যমিত্র হস্তীপৃষ্ঠ হইতে রাজ প্রকোষ্ঠে এক লম্ফে উঠিয়া গেল। একবার নিম্নে তাকাইয়া "ধরণীধর" বলিয়া হস্ত বাড়াইয়া দিল। মুহূর্ত মধ্যে ধরণীধর নিজ তরবারিটি কোষমুক্ত করিয়া ঊর্ধ্বে ছুঁড়িয়া দিল। বাম হস্তে মহারাজা বৃহদ্রথের কেশাকর্ষণ করিয়া দক্ষিণ হস্তের তরবারি দ্বারা তাহার শিরশ্ছেদ করিলেন পুষ্যমিত্র।
আচার্য বিষ্ণুশর্মা, বক্রতুন্ড, পঞ্চক ও মল্লভূমি হইতে ধরণীধর সোল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিলেন -----
---" জয় মহারাজ পুষ্যমিত্র শুঙ্গের জয়। "
মন্ত্রী, অমাত্য ও নাগরিকগণ এতক্ষণ চিত্রার্পিতের ন্যায় নির্বাক হইয়াছিলেন। তাহারা সত্রাসে সেই জয়ধ্বনিতে যোগদান করিল।
শুরু হইল ইতিহাসের এক নূতন অধ্যায় ।
মৌর্যের শৌর্য-বীর্য মুখ ঢাকিল ইতিহাসের
পাতায়।
********************
হে পাঠক , কালের গতি রুদ্ধ হয় নাই । শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হইয়া গিয়াছে রাজবংশগুলি কালের বহনান ধারায় ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া গিয়াছে। বৃহদ্রথের বংশধরগন অথবা লতায় পাতায় তাহার সম্পর্কের মানুষেরা কোথায় যাইলেন তাহা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় নাই। কিন্তু তাহারা ইতিহাসে কিছুই যোগ করিতে পারেন নাই বলিয়া কি তাহাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়া থাকা রাজরক্তবীজ মিথ্যা ?
যে মানুষটি জনাকীর্ণ রাজপথে আপনার বহুমূল্য পাদুকা সম্বলিত পদ মাড়াইয়া চলিয়া যাইলেন অথবা যাহার বিপনি সম্ভার হইতে আপনি দন্তমার্জনীটি ক্রয় করিলেন তাহাদের শোনিতবিন্দুর সুক্ষ্ণতম অংশে যদি রাজরক্তের কোনো চিহ্ন রহিয়া থাকে, কোনো উজ্জ্বল প্রভাতে যদি তাহা স্ফুলিঙ্গের ন্যায় প্রকাশমান হয় ! পাঠক, আপনি বিস্মিত হইবেন না। এই বিশাল পৃথ্বীতল অতিশয় বৈচিত্র্যময়।
0 comments: