ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক৩
আজ সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বেড়াতে আসলে সাগরিকার বৃষ্টি-বাদলা একেবারেই না-পসন্দ্। বৃষ্টি তো তার নিজের অলীক সঙ্গী। কলকাতার বাড়ির জানলায় এখনো সেকেলে গরাদগুলো আছে। সেগুলো ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনটা কোথায় যেন চলে যায়। নারকেল গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ে। আর শিলাবৃষ্টি হলেই...ছুট্টে বারান্দায় গিয়ে শিল কুড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভিতর...সাতাশ বছরেও ওর এই অভ্যেসগুলো একটুও বদলায়নি।
সকালে এর মধ্যেই মা উঠে বাজার থেকে এক চক্কর লাগিয়ে এসেছে। আসার সময় হাতে করে তালশাঁস আর ছেনাপোড়া বলে একরকমের মিষ্টিও এনেছে।
বাবাও ঠিক এমনি করত। বেড়াতে এলে ঠিক সকালে এক চক্কর ঘুরে এসব কিছু না কিছু নিয়ে আসত। দাদা এত নতুন জিনিসপত্র খেতে ভালোবাসত না। সাগরিকা কিন্তু ছেনাপোড়াটা একাই সাবড়ে দিত। ওই শৈশব কৈশোরের দিনগুলো আর ফিরবে না কখনো।
বাবা যেন এই অনন্ত সমুদ্রের বিছানায় আজও একইভাবে শুয়ে আছে। মনে হয় এখনি উঠে এসে পিঠে হাত রাখবে কখনো বা মা এর পাশে বসে গুনগুন করে সুর ভাঁজবে!
হাসপাতালে বাবা মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একবার একটুর জন্য জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সাগরিকার মনে আছে বাবা 'মণি'....'মণি' কথাটা দু'বার বলার পর মনিটরে জীবনের উঁচু নীচু চলমান জীবনরেখাচিত্রটা একবারে একটি সরলরেখায় এসে থেমে গেছিল। আর তারপর ডঃ সুচেতা পাণিগ্রাহী
মা 'এর হাতটা একটু আলতোভাবে ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আই টি ইউ কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন।
এর বহু পরে সাগরিকা মা'কে জিজ্ঞাসা করেছে ওই 'মণি' র ব্যাপারে। মা এর একটাই উত্তর ছিল 'বোধহয় মনের ভুল!' সাগরিকা টের পায় যে মা ঠিকই জানে আসলে ওই ' মণি'টা কে, আর সেটা ওকে জানাতে চায় না।
**********
সনৎ আর সুশান্ত কদিন খুব ব্যস্ত। কলেজ স্কোয়ারে ছাত্রদের একটা জমায়েত আছে শুক্রবার। কলেজে ভর্তির বিষয়ে রুলিং পার্টীর স্টুডেন্ট উইং পিছনের দরজা দিয়ে মোটা টাকা ঘুষ নিয়ে ভর্তি করাচ্ছে। ওরা তার প্রতিবাদ করছে। এমন সময় সমুদ্র হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরী তে এসে ঢুকল। এক ভাঁড় চা টেবিলের ওপর তখনও বেঁচে ছিল দেখে এক ঢোকে চুমুক দিয়ে সেটা শেষ করে বলল
' এ্যাই সনৎ দা! লিফলেটগুলো রেডি।
গুলু ওস্তাগর লেনের হরিশ আছে না? ওর বাবার হ্যান্ডপ্রেসে ছাপিয়ে নিয়ে এলাম। কিছু টাকা নিল বটে তবে কুড়িটাকায় কেই বা এসব আজকাল...'
তারপর বলল ' অরুণ, চন্দন ওরা কোথায়? আসেনি না কোন কাজে পাঠিয়েছ?'
সনৎ গম্ভীর মুখে বলে -
' শোন! এখন ফাঁকা আছে, তোকে এইবেলা বলে নিই। হাইকম্যান্ড তোর ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখতে বলেছে। কারণটা অবশ্য তোর বাবার কাগজ! ওরা ভাবছে তুই বোধহয় খোঁচড়গিরি করে.....। তাই বলছিলাম এই মিটিংটার পর তুই কদিন নর্থবেঙ্গল চলে যা। হাসিমারায় যে কাজগুলো হচ্ছে স্টাডিসার্কেল বা নাইট ইস্কুল- টুল গুলো না হয় কয়েকমাস সামলালি, শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ বাড়ালি....তারপর না হয় অামি আবার সময়মত ডেকে নেব তোকে এখানে। '
সমুদ্রের মুখের পেশী শক্ত হয়ে ওঠে।
' তুমিও কি আমায় তাই ভাব না কি আজকাল?'
সনৎ একটা বিড়ি ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
'ভাবিনা বলেই তো বলছি! তোকে আবার ফিরিয়ে আনব বলেই তো নর্থবেঙ্গল! নইলে ওরা তো দন্ডকারণ্যে কমরেড রামেশ্বর রাও এর কাছেই পাঠাতে বলেছিল তোকে। ধরে নে আমিই কমরেড রবীন কে বলে কয়ে....'
সমুদ্রর ভিতরটা তোলপাড় করে ওঠে। নর্থবেঙ্গল যেতে হলে বাড়িতে ও কি বলবে? বাবা বা মা দুজনেই রাজনীতিমনস্ক হলেও দুম্ করে অতদূরে ছাড়বেনা। তাছাড়া সামনে পরীক্ষাও আছে। এম এ 'র শেষবছর এটা....
"আমায় সাতদিন সময় দাও। বাড়িতে কি বলব একটু গুছিয়ে ভেবে নিই...তেমন হলে না হয় মিটিং এর দিনেও কলেজ স্কোয়ার ঢুকবনা। প্লিজ সনৎ দা! প্লিজ.."
ওদের কথার মাঝখানে হৈ হৈ করতে করতে অরুণ, চন্দন আর রাজিবুল রা সবাই এসে গেল। চন্দনের হাতের শালপাতাটা থেকে এখন গরম গরম সিঙাড়ার গন্ধ বেরোচ্ছে।
*********
কার্তিক পূর্ণিমা বলে আজ ভোর থেকেই এখানকার সহজসরল মেয়ে-মহিলারা তারা মূলতঃ ধীবর পল্লীরই ছোট ছোট থোড়ের নৌকো (বইতা)বানিয়ে তাতে রঙীন কাগজ সেঁটে তার মধ্যে পান -সুপুরি আর মাটির প্রদীপ রেখে সমুদ্রের জলে ভাসাচ্ছে আর উলু দিচ্ছে। সঙ্গে সমস্বরে একটা গানও গাইছে '
' অা ক মা বৈ, পানঅ গুয়া থৈঅ...'!
এটাকে বালিযাত্রা বলে। সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো নাবিক বা ধীবরদের বৌ বা বোনেরা এই ব্রত করে তাদের স্বামী বা ভাই এর আয়ুষ্কামনা আর সমৃদ্ধি কামনা করে। সেই আদ্যিকাল থেকেই এটা চলে আসছে।
সাগরিকার মনে হচ্ছে এই সুর কোথায় যেন আগে শুনেছে ও। এখানে প্রত্যেক বছর একবার আসলেও এই সময়টায় আগে আসেনি কখনো।
মা এর সাথে সে দিনের আলাপ হওয়া ওই ডাব বিক্রেতা মেয়েটিও এসেছে তার বইতা হাতে। ওর বর ট্রলারে চড়ে মাছ ধরতে যায় তো। সে মুচকি হেসে ওদের হাতে একটা মর্তমান কলা আর কয়েকটা বাতাসা দিয়ে চলে যায়। সাগরিকা শুনতে পাচ্ছে কোথাও কাছাকাছি একটা মন্দিরে যেন ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে। কিন্তু এদিকটায় তো তেমন কোন মন্দির তো নেই। মোটামুটি পাঁচ কিলোমিটার দূরে গোপালস্বামীর মন্দির থাকলেও তার আওয়াজ এত স্পষ্ট শুনতে পাবার কথা নয়। মনে হচ্ছে যেন এখানেই কোথাও একটা অদেখা মন্দির আছে। আর সেই মন্দিরের থেকেই ভেসে আসছে কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ। সাগরিকার মাথাটা হঠাৎ যেন টলে গেল। চোখের সামনে আস্তে আস্তে দৃশ্যপটের বদল হতে লাগল। এবারে যেন পায়ের নীচে মাটিটাও দুলছে....!
0 comments: