গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পদুম করে জবলপুরে বদলি করে দিল, ব্যাঙ্কের চাকরিতে এরকমই হয়। তবে এখানে আমাদের পুরোনো বন্ধু সাত্যকি-সংযুক্তা থাকে, শনি-রবিতে হয় ওরা আসত নয় আমরা যেতাম। সাত্যকির ছেলে চার বছরের হল, নাম অত্রি। কয়েকদিন হল ইস্কুলে দিয়েছে। সীমা, মানে আমার বউ বলল ছেলেকে নিয়ে নাকি ওরা খু্ব ভাবছে, ইস্কুলে বোধহয় কিছু হয়েছে।
শনিবার সন্ধেবেলা আমরা গেলাম। সংযুক্তাকে অন্যদিনের তুলনায় একটু গোমড়া দেখাল। অত্রিকে একইরকম দেখলাম – পুরোপুরি স্বাভাবিক হাসিখুশি একটা বাচ্ছা। বললাম –“কি রে অত্রি, ইস্কুল যেতে ভাল লাগছে?”
-“ইস্কুলে ছোটছোট চেয়ার-টেবিল আছে, আমরা বসি”
-“তা তো হলো, তোরা কি করিস ইস্কুলে?”
-“খেলি, অনেক বন্ধু আছে”
অত্রি অন্য ঘরে কী একটা করতে গেল। সংযুক্তাকে বললাম, তোমার ছেলে তো কদিনেই সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে, তুমি এত ভাবছ কেন বলতো…
-“তাহলেও ভাবনা হচ্ছে। ইস্কুলে ও সবাইকে বই, টিফিন বাক্স সব বিলি করে আসছে। আর জিগেস করলে অদ্ভুত কথা বলছে, আমার ভালো লাগছে না”
সাত্যকির দিকে তাকাতে সে ও বলল –“ হ্যাঁ রে, ব্যাপারটা একটু কীরকম যেন …”
এমন সময় অত্রি ঘরে ঢুকল। সীমা ওর হাত ধরে জিগেস করল –“কি রে তুই নাকি কাকে বই দিয়ে এসেছিস?”
-“ওই বাঘের ছবি দেওয়া বইটা দীপিকা নিয়েছে”
-“নিয়েছে না তুই দিয়েছিস?”
-“দীপিকা বলল বইটা খুব ভালো, ছবি দেখব।“
-“ওরে অত্রি তুই তো দেখালি রে, এই বয়সেই মেয়ে-বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে নিয়েছিস…”
আমরা সকলে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লাম। হাসি থামলে সংযুক্তা বলল –“যখন ওকে বললাম নিজের জিনিস ওরকম করে দিয়ে দিস না। ও দেখলাম ‘নিজের জিনিস’ ব্যাপারটাই বুঝল না!”
“মানে?”
“ ও বলতে চায় ‘বইটা আমার’ মানে কী। আমরা বললাম, এই তো তোকে দিলাম সেদিন। ও বলে – তোমরা তো দোকান থেকে কিনেছ। বই কীকরে ‘আমার’ হয় ! সত্যি রে সীমা, ওর কথাগুলো কেমন যেন ঠেকছে..”
সীমা অত্রির হাত ধরে বলল –” এই শোন, টিফিন বাক্সটা কী করেছিস, ওটা তো তোর জিনিস ..”
অত্রি বলল – “ টিফিন বাক্স আমার নয়”
-“কেনো নয়, তোর মা তো তোর সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল…”
-“না, টিফিন বাক্স আমার নয়”
সীমা এবার নতুন ভাবে চেষ্টা শুরু করল। অত্রির হাত ধরে বলল – “আচ্ছা, অত্রি, এই হাতটা কার?”
একটুও সময় না নিয়ে অত্রি বলল –“আমার হাত”
- “কেন এটা তোমার হাত? ”
অত্রি একটা অদ্ভুত কাজ করল। বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাতটা চিপে ধরল – “ ই ই … দেখ কতজোরে টানছি… খুলছে কি? খুলছেই না। দেখ এটা আমার গায়ের সঙ্গে লাগানো..”
এবার জামা খুলে হাত কী করে গায়ের সঙ্গে লাগানো সেটা দেখাতে গেল। আমরা বলে উঠলাম “থাক থাক বুঝেছি”
আবার অত্রি এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগলো। তারপর একবার বাগে পেয়ে আমি বললাম –“তাহলে বইটা কেন তোমার নয়?”
টেবিলে ওর একটা বই পড়েছিলো সেটা নিয়ে সটান খাটের ওপর উঠে পড়ল। বইটা ধপাস করে মেঝেতে ফেলে বলল –“ দেখ কত জোরে পড়ল। আমার কি লাগলো? একটুও লাগেনি”
অত্রির যুক্তি শুনে আমি তো হাঁ হয়ে গেলাম। সাত্যকিকে বললাম – “গুরু, এ ছেলে বড় হয়ে সক্রেটিস কিংবা শঙ্করাচার্য হয়ে যেতে পারে … চাইল্ড সাইকোলজিস্ট দেখা ..”
সাত্যকি বলল –“খোঁজ নিয়েছি, এখানে একজন আছেন, রবিবার রবিবার বাচ্ছাদের দেখেন। তবে বাচ্ছাদের জন্য ফী নেন না। মোটামুটি ভীড় হয় শুনেছি।”
বললাম –“না না ওসব সমাজসেবী ধরনের ডাক্তারের কাছে যাস নে .. ওসব দেখে অত্রি যদি আরও ঘুরে যায় …”
“ভোপালে নামকরা একজন আছেন, মোটা ফী। শুরুতে তিন হাজার, তারপর যতবার ততবার সাড়ে-সাতশো করে”
“পয়সার মায়া না করে তুই বরং ভোপালেই যা। দেখিয়ে আয়।”
সংযুক্তা একবার বলছিল –“ওই অত্রি নামটা আমার একদম পছন্দ ছিলো না, শাশুড়ি-মা জোরজার করে রেখে দিলেন। সে বৈদিক যুগের কোন এক ঋষি-মুনির নাম, সেখান থেকে ওর মনে কিছু ঢুকে গেল কি না কে জানে ।
খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা উঠলাম। গাড়িতে যেতে যেতে সীমা বলছিল – “ইস, অত ছোট ছেলেকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, একটু বড় হলে এসব খেয়াল এমনই চলে যেত …”
বললাম –“ আর যদি না যায়? সারা জীবন যদি এটা থেকে যায় তাহলে কী হবে বলত? ‘আমার জিনিস’, নিজের জিনিস’ এই ধারণাটাই যদি তৈরি না হয় তাহলে এ দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারবে?...”
0 comments: