ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক১১
হেড অফিস থেকে পান্ডে মারফত খবর পেয়েছি যে আমার ট্রান্সফারের আবেদন ‘ইজ আন্ডার ভেরি ফেবারেবল অ্যান্ড অ্যাকটিভ কন্সিডারেশন’। উরিত্তারা! কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই। পান্ডে ছোট বাচ্চাদের মত বেলুন ফুলিয়ে কথা বলে। একেবারে সরলার উলটো। পান্ডে যদি বলে আজ আমাদের অফিসে সিটি সুপারিন্ডেন্ট অফ পুলিশ একটা ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছিলেন তো আমরা বুঝে যাই – হ্যাঁ, একজন হাবিলদার এসেছিল বটে!
আবার সরলা যদি বলে আজ পাড়ায় পুলিশ এসেছিল—ধরে নিই অন্ততঃ একটা ডগগা বা কালোগাড়ি এসে থাকবে। এইসব সাত পাঁচ ভাবছি এমন সময় ব্যাংকের সামনে একটি বুলেট মোটরবাইক তার ঢিক ঢিক আওয়াজে থামল। ধরাচূড়া পরে নামছেন থানেদার চৌবেজি। শয়তানের নাম নিতেই সামনে হাজির! নিজের মনে হেসে ফেলি।
--রূপেশজী! থোড়া মেরে সাথ চলনা পড়েগা।
এখন ? এই ভরা কাজের সময়ে? অন্য কেউ গেলে হবেনা? কিন্তু থানেদারের চোখ হাসছে না। ব্যাপারটা কী? আর পাঠাবোই বা কাকে? খান্ডে এক চাষীর লোন ডকুমেন্ট ফিল আপ করতে ব্যস্ত। জগন তির্কিকে নরইবোধ গাঁয়ে তিনটে ব্যাড লোনের রিকভারি আনতে এবং নতুন একটি কুয়ো ও ডিজেল পাম্প ইউনিটের ফিল্ড ইন্সপেকশন করতে পাঠিয়েছি। এসে রিপোর্ট দেবে কুয়ো কত গভীর করে খোঁড়া হয়েছে এবং জল উঠছে কিনা। তার পরে পাম্প দেয়ার প্রশ্ন। ব্যাংকের সবেধন নীলমণি রাজদুত মোটরবাইকটি ও নিয়ে গেছে। তাহলে?
চৌবেজির গলার স্বর নরম হয় । বলেন –আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি। কিন্তু ম্যাটার আর্জেন্ট, ব্যাংকের স্বার্থেই আপনার আমার সঙ্গে যাওয়া দরকার। বাকি কথা রাস্তায় শুনবেন।
বুলেটের ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিন গর্জে ওঠে। আমি ব্যালান্স সামলাতে পেছন থেকে চৌবেজির ভুঁড়ি জাপটে ধরি। রাস্তা খারাপ, আর উনি বেশ স্পীডে চালাচ্ছেন।
আমরা নরইবোধ গাঁয়ে ঢুকছি। আরে, এই গাঁয়েই তো জগনকে পাঠিয়েছি ফিল্ড ভিজিটে!
গাড়ির স্পীড কমিয়ে পঞ্চায়েত ভবনের দিকে যেতে যেতে চৌবে বলেন—আজ আমার দুজন সেপাই গাঁয়ের বাইরে পুকুরপাড়ে বটগাছের নীচে ছ’জনের একটি দলকে ধরেছে। জুয়ো খেলছিল। জব্দ হয়েছে দু’প্যাকেট তাস এবং ১৭৪ টাকা। ওদের রাখা হয়েছে পঞ্চায়েত ভবনে। সচরাচর যা হয় আপনি জানেন। এইসব ছোটখাটো জুয়োতে আমরা তাসের প্যাকেট এবং টাকাগুলো কেড়ে নিয়ে ডায়েরি লিখে একদিন থানায় আটকে বা মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দিই। কিন্তু আজ জুয়াড়িদের একজন-- ঢ্যাঙামত দাঁত বের করা—বলে কি ও নাকি গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসার! আর শ্রীমান নাকি জুয়ো খেলছিল না, রিকভারি করছিল। কিন্তু সিপাহী রামখিলাওনের স্পষ্ট বক্তব্য ওদের ধরার সময় ওই লোকটার হাতেও তাস ধরা ছিল এবং ও চাল দিচ্ছিল। তক্কে তক্কে থেকে ভাল করে আঁটঘাট বেঁধে তবে এদের ধরা হয়েছে। এবার আপনি দেখুন তো, ব্যাপারটা কী?
বুঝতে পারি, থানেদার চৌবে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি। এই শালার ব্যাংকওয়ালা নিজেদের খুব দুধ-কা- ধুলা টাইপ দেখায়, আজ এদের মুখোশ খুলে গেছে। হামাম কে অন্দর হম সব নাঙ্গে!
স্নানঘরে সবাই ন্যাংটো।
বাইক থামতেই আমি একলাফে নেমে পড়ে প্রায় দৌড়ে পঞ্চায়েত ভবনে ঢুকে পড়ি। হলের এককোণায় দেয়াল ঘেঁষে পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে ছ’জন লোক। প্রত্যেকের কোমরে দড়ি । একটা বেঞ্চিতে বসে দু’জন সেপাই চা খাচ্ছে আর মুখিয়া একটি চেয়ারে বসে বন্দীদের সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়েছেন। সবার চেহারায় অল্পবিস্তর লাথ-ঘুঁসি খাওয়ার দাগ। সেটা খেয়াল করে আমি থানেদার চৌবেজির দিকে তাকাই। উনি নির্বিকার ভাবে বলেন—শালে লোগ সিপাইয়োঁ কো গালি বকে, সরকারি কাম মেঁ বাধা ডালে, তো দো-চার লাথমুক্কা তো জমানা হী পড়েগা। তভী তো প্রশাসন চলেগা।
ব্যাটারা সিপাইদের গাল দিয়েছে , গ্রেফতার করার সময় বাধা দিয়েছে ; কাজেই দু-চারটে লাথি-ঘুষি না লাগালে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চলবে কী করে !
ওসব ছাড়ুন, দেখে নিন এর মধ্যে আপনার অফিসার কেউ আছে কিনা। এখনও কেস ডায়েরি তৈরি হয়নি, চালান কাটেনি।
আমি সবচেয়ে মারখাওয়া লোকটির কাছে গিয়ে সেপাইদের বলি –এর কোমরের দড়ি খুলে দাও, পালাবে না, আমি বলছি।
চৌবেজির চোখের ইশারায় দড়ি খুলে দেয়া হয়। আমি জগনকে বলি—জুয়ো খেলছিলে? ব্যাপারটা কী? সব খুলে বল।
--জুয়ো খেলিনি তো, রিকভারি করছিলাম।
সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে, এমনকি মাটিতে বসে থাকা বন্দীদের মুখেও মুচকি হাসির ঝিলিক।
--সেপাই বলছে যে রেইডের সময় তুমি ওদের মাঝেই বসেছিলে এবং তোমার হাতে তাস ছিল। ও স্পষ্ট দেখেছে! ও কি মিথ্যে কথা বলছে?
-- না, ও ঠিকই দেখেছে।
এবার হাসি সামলানো দায়। আমি চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছি। জগন কী হাবিজাবি বকছে?
--স্যার, উসকো সমঝনে মেঁ গলতি হুই। ডিফল্টার সতীশ বুনকর কো ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে আমি পুকুরপাড়ে পৌঁছে দেখি সতীশ জুয়ো খেলছে। ওকে বললাম তোমার ১৩৪০ টাকা বকেয়া। আজ কিছু দাও। বলল ওর ট্যাঁকে কানাকড়িও নেই, সব হেরে বসে আছে। এবার ওর হাতে ভাল তাস এসেছে, জিতলে পুরো টাকা রিকভারি দেবে।
আমি বললাম ফালতু কথা ছাড়; আমি জুয়োর পয়সা চাইছি না, চাষের লোনের পাওনা টাকা চাইছি; যাও, বাড়ি থেকে নিয়ে এস। ও বলল –তা’লে আপনি আমার তাস ধরুন, এত ভালো হাত এসেছে। আমি বাড়ি গিয়ে বৌয়ের কাছে শ’দুশ যা পাই নিয়ে আসি।আমি ওকে টাকা আনতে পাঠিয়ে ওর তাস ধরে বসেছি কি পুলিশ এসে ধরপাকড় শুরু করে দিল।
স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে ফার্স্ট এইড করিয়ে ওকে নিয়ে ফিরে এলাম। জানতে চাইলাম ওকেই কেন সবচেয়ে বেশি মেরেছে? ব্যাংকের স্টাফ বলে চিনতে পারেনি?
--না স্যার, চিনতে পেরেছে বলেই এত মেরেছে।
-মানে? খোলসা করে বল।
থেমে থেমে এক এক ঢোঁক জল খেয়ে জগন শোনায় এক অন্য কাহিনী।
মাসখানেক আগে এক শনিবারের রাতে জগন হরদীবাজার গাঁয়ের সরকারি দারুভাট্টি থেকে দু’বোতল মহুয়া আর একটা মুরগী কিনে ঘরে ফিরছিল। ফাগুন হাওয়া শুরু হলেও রাত্রে জঙ্গলের পথে শীত শীত ভাব। নিজেও দু’গেলাস মেরে নিয়েছে। মনে বেশ ফুর্তি। হরদী গাঁয়ের সীমানা ছাড়িয়ে একটা শুনশান তেমাথার মোড়। একটা ট্রাক এসে থামল, তার থেকে দুটো মেয়ে গুটিশুটি নেমে একটা বহেড়া গাছের নীচে দাঁড়াল, ট্রাক চলে গেছে। মেয়েগুলো ভিন গাঁয়ের রেজা-কামিন। আজকাল রাত্তিরে রাস্তায় খদ্দের ধরে। তারপর ফেরত ট্রাকে চলে যায়। ইদানীং এটা বেশ বেড়েছে। চারদিকে কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক, রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা ধাবা, আগের জীবন বদলে গেছে; নতুন জীবিকার চাহিদা ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জগন একটা গাছের গায়ে সাইকেল ঠেকিয়ে পাশের বেশরমের ঝোপে তলপেটের চাপ হালকা করতে থাকে।
আচমকা আরেকটি ছায়ামূর্তি অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে ওঠে। একটি মেয়ে এগিয়ে যায়। লোকটি গায়ের শাল সরিয়ে ফেলে মেয়েটির হাত ধরে ফেলে—চল, চল মোর সঙ্গ।
মেয়েটি হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। -- এ দদ্দা! মালেটরি?
শাল সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছে লোকটার পরণে খাকি পোশাক এবং নিকেলের বোতাম ও তারা।মেয়েটি কাতর অনুনয় করতে থাকে—নহী মালেটরি। তোর সঙ্গ না লাগু মালেটরি। মোলা ছোড় দে মালেটরি!
না গো মিলিটারি! তোর সঙ্গে লাগাবো না মিলিটারি। আমায় ছেড়ে দে গো!
পুলিশের লোকটি অবিচল। ও মেয়েটির ডানা মুচড়ে ধরে।
--চল শালি! জ্যাদা নখরা মত দিখা। নহী তো অন্দর কর দুঙ্গা।
বেশি ন্যাকামি করলে ভেতরে পুরে দেব।
মেয়েটি ভয়ে আকুল হয়ে পরিত্রাহি ডাক ছাড়ে।
--মোলা মলেটরি পকড় লিস। ভাগ যা রে গুড্ডি, জলদি ভাগ। আজ মোর দাঊ নহী বাঁচে।
আমায় মিলিটারি ধরেছে রে ! পালা গুড্ডি, শিগগির পালা! আজ আমার কোলের খোকাও রেহাই পাবে না ।
জগনের ভেতরে কিছু একটা ঘটে যায় । ও গিয়ে খাকি পোশাকের হাত থেকে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নেয় । মেয়েটি উর্ধশ্বাসে পালায়। অন্যটি আগেই ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে। খাকি পোশাক এই অতর্কিত হামলায় অবাক। তারপর সামলে নিয়ে তেড়ে যায় ।
--তুই কে রে? চিটি কী পংখ নিকলী হ্যায়? পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে? আমি এখানকার থানেদার। দেখ তোর কি হাল করি।
মুহুর্তের মধ্যে দুজনে গুত্থমগুত্থা। জড়াজড়ি করে রাস্তায় গড়ায়। জগন টের পায় এই লোকটি অনেক বেশি মদ খেয়েছে। সে ওর দুর্বল জায়গায় হাঁটু চালায়। লোকটি ওঁক করে উঠে গোঙাতে থাকে। জগন উঠে ওকে আঙুল উঁচিয়ে বলে—ভারি আমার থানেদার। আমিও গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসার। ঝামেলা করলে কোরবায় এসপি অফিসে নালিশ করে তোমার পোল-পট্টি খুলে দেব।
তারপর ও সাইকেলে উঠে কেটে পড়ে।
রূপেশ গুম হয়ে যায়। কোথায় একটা কাঁটা খচখচ করে। আহিরণের দুকূল ভেসে গেছে। সব কেমন পালটে যাচ্ছে। এবার ওরও পাততাড়ি গোটানো উচিত। এখানে আর নয়। আহিরণ , সেই উচ্ছল প্রাণবন্ত আহিরণ বেঁচে থাক ওর মনের মধ্যে কপালে একটা কাটা দাগ নিয়ে।
এটা কী হল? আহিরণ তো একটা নদী। সবুজ বন হল তার ঐশ্বর্য , গাছপালা পশুপাখি সব নিয়ে । আর আছে মানুষ, নদীর দু’পাড়ে। আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা। তাহলে কাটা দাগের কথা কেমন করে আমার আহিরণের কল্পনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় ? একবার ছুরি যাব নাকি? শেষ বারের মত। আসলে ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে। গতকাল সন্ধ্যেয় একটি সাদা খামে, ওপরে ইন্ডেক্স কোড—৩৩/পি/১৯৮৬। আমি তখন কারও সামনে লিফাফা খুলিনি। রাত্তিরে ঘরে গিয়ে খুলে দেখেছি। আগামীকাল সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিতে হবে। সবার আগে সরলাকে।
ট্রান্সফার হয়েছে; অডিট বিভাগে নয় , হেড অফিসের অ্যাকাউন্ট সেকশনে অফিস ম্যানেজারের আন্ডারে । হে ভগবান! ফিল্ডে যাওয়ার দিন শেষ। রোজকার রুটিন হবে টেবিলে বসে ভাউচার, স্টেটমেন্ট, ক্যাশ পজিশন, বিলস, ফান্ড ও ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট তৈরি করা। কি একঘেয়ে কাজ! নিত্যনতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ খতম। রোজ সেই একই চেহারা দেখতে হবে। তবে ভগবান নিতান্ত একচোখো নয়। লাভ হল নিজের বাড়ি থেকে ডিউটি করা। সরলা ও আমার বাচ্চা মেয়েটা! ওর মুখেভাতের দিন এগিয়ে আসছে। এবার শুরু হবে বৌ-বাচ্চাকে ঘিরে অন্য জীবন, আমি কি এতদিনে সংসারী হব?
সাতদিনের মধ্যে এসে যাবে নতুন ম্যানেজার। তাকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে আরও সাত দিন। এরপর জয়েনিং টাইম—এক সপ্তাহ। সেই ফাঁকে রায়পুর শহরে একটা দু’কামরার ভদ্রগোছের আস্তানা খুঁজতে হবে। আহিরণ রয়ে যাবে মনের অ্যালবামের এক কোণায়।
আজ শনিবার। সকাল থেকে একটা চাপা উত্তেজনা। নতুন ম্যানেজার আসতে আরও চারদিন। দাদুসাহেব জানিয়েছেন আমার ফেয়ারওয়েল উনি অন্যভাবে করতে চান।আমার অনারে আজ হবে সোনপত্তী জঙ্গলে হরিণ শিকার।
দুরপা কোলিয়ারির একাউন্টস অফিসারের হেডক্লার্ক দুষ্যন্ত সিং শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে ওঁর লতায় পাতায় আত্মীয়।ও বসের থেকে একদিনের জন্যে জীপগাড়িটা চেয়ে নিয়েছে। ড্রাইভ করবে ও নিজে আর দাদুসাহেব ও তাঁর দুই ভায়রাভাই – পোঁড়ির রাজকুমার লল্লুসাহেব, এবং চেতমার রাজকুমার লালসাহেব—নিজেদের বন্দুক ও টোটা নিয়ে জীপে বসবেন। পেছনে বসবে দাদুসাহেব ও আমি। সোনপত্তীর বিস্তৃত ঘন জঙ্গল এখান থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূর। রাত্তিরে খালি রাস্তায় মেরেকেটে দু’ঘন্টার পথ।
খেয়েদেয়ে রাত ন’টা নাগাদ দুষ্যন্ত কুমার গাড়ি নিয়ে এল। মহীন্দ্র কোম্পানির জীপ। পথে তোলা হল দুই রাজকুমারকে। দেখা গেল চারটে বন্দুক এসেছে। দুটো ১২ বোর, একটা ২২ বোর, আর একটি রাইফেল। দাদুসাহেব বললেন –রাইফেলটা আমাদের মাননীয় অতিথি -শিকারী ম্যানেজার সাহেবকে দেয়া হোক।
আমি ভয় পাই, প্রাণপণে মানা করি। আগে কখনও বন্দুক হাতে নিয়ে দেখিনি যে।
দাদুসাহেব আশ্বস্ত করেন। খামোকা ভয় পাচ্ছেন। রাইফেলটায় গুলি ভরা নেই। লল্লুসাহেব কিপটে, রাইফেলের গুলির আজকাল অনেক দাম।
জীপ চলেছে কাটঘোরা-অম্বিকাপুর রাজপথ ধরে, দেখতে দেখতে পোড়ী ছাড়িয়ে গেল। দু’ধারের জঙ্গল ক্রমশঃ ঘন হচ্ছে। এবার গাড়ি রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেল। সবাই আমাকে সতর্ক করে। গাড়ি থেকে আমরা কেউ নামব না। যদি কখনও নামতে হয় তাহলে আপনি আমাদের মাঝখানে থাকবেন। এখন মহুয়ায় ফুল এসেছে। ফল পাকছে। ভালুক আসে মহুয়া খেতে। বড় পাজি জানোয়ার। বাঘ সহজে আক্রমণ করে না। কিন্তু মহুয়া খেতে আসা হরিণের দলের পেছন আসে হিংস্র বুনো কুকুর আর লকড়বাঘঘা। কখনো সখনো চিতা বা বুন্দিয়া শের।
জীপ থামে ,এখানে নাকি হরিণ দেখা যাবে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখতে থাকি অন্ধকারের মধ্যে কেউ যেন একটা লাল লাইন টেনে গন্ডী কেটে দিয়েছে। শুকনো পাতায় আগুন লাগানো হয়েছে। মার্চ মাসে প্রতিবছর এমন হয়। শীতকাল জুড়ে শাল-পিয়াল-মহুয়ার ঝরাপাতায় এভাবেই আগুন দেয়া হয়। যদি শুকনো পাতা থেকে আগুন কচি ডালপালায় ছড়িয়ে পড়ে তখন বনরক্ষীরা স্থানীয় মানুষের সহায়তায় কায়দা করে আগুনের ছড়িয়ে পড়া আটকে দেয় , তারপর নেভায়।
আমাদের জীপ অগ্নিবলয়কে পাশ কাটিয়ে আরও গহন বনে ঢুকতে চায়, কিন্তু যেদিকেই যাই সেদিকেই আগুনের বেড়াজাল, পাতা পোড়ার গন্ধ, চড়বড় আওয়াজ আর ধোঁয়া। না, এদিকে হরিণ পাওয়া যাবে না । সব পালিয়েছে। আমাদের প্ল্যান ফেল। কী আর করা! তাহলে কি ফিরে যাব? লল্লুসাহেব ঘড়ি দেখেন—মাত্র রাত বারোটা! দূর! চল হে পাশের মোরগা হাটের জঙ্গলে।
দাদুসাহেব বলেন—তার মানে যাতায়াতে আরো ৪০ কিলোমিটার। ঠিক আছে, ফেরার সময় কাঠঘোরার পেট্রোল পাম্পে আরও দশ লিটার তেল ভরালেই হবে।
গাড়ি আবার স্টেট হাইওয়েতে। দু’পাশের জঙ্গল অন্য চেহারা নিচ্ছে। গাছগুলো বেশ উঁচু , পাকদণ্ডী পাকা রাস্তা। একটা নালার উপরে পুল পেরিয়ে মোরগাহাটের মোড়, সেখানে ঢাবায় লোকজন মন্দ নয়। হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। ঝারখন্ড থেকে যাতায়াত করা কিছু ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ডানদিকে ঘুরে আবার ঘন বনের ভেতরে ঢুকে যাই। গাড়ির আলোয় দু’একটা পাঁশুটে রঙের খরগোস পালিয়ে যায়। একবার গাছের ডালে বসে থাকা একটা বিশাল প্যাঁচা আমাদের বিজ্ঞের মত দেখে। একটা কোলিহা বা খেঁকশিয়াল অবাক হয়ে তাকায়, তারপর তিড়িং করে লুকিয়ে পড়ে। আমরা প্রায় বাঙ্গো নদীর কাছে এসে পড়েছি। আহিরণ হল এর শাখানদী। কিন্তু সামনে বাঁশঝাড়ের পাশে ওটা কী? একজোড়া লাল চোখ , যেন আগুনের গোলা? আমার ধুকধুকি বেড়ে যায় । কিন্তু গাড়ির গতি কমে না। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে দুষ্যন্ত সিং হাসে। ভয় পেলেন নাকি ম্যানেজারবাবু? ওটা গোরুর চোখ, রাত্তিরে অমন ভাঁটার মত জ্বলে।
গাড়ি পাক খেয়ে বেড়ায়। দাদুসাহেবের দল শিকারের পুরনো গল্পে মেতে ওঠেন। হাসিঠাট্টায় চিমটিকাটায় আড্ডা জমে ওঠে। আচমকা দুষ্যন্ত শ শ শ করে ওঠে। চুপ! ওই যে!
কাছেই অন্ধকারে দু’জোড়া সবুজ চোখ। একজোড়া মাটির কাছে , আর একজোড়া একটু উঁচুতে। দাদুসাহেব আমার কানে কানে বলেন—একটু চোখ সইয়ে দেখুন।
ধীরে ধীরে ওদের ছায়াশরীর আমার কাছে স্পষ্ট হয়। এক জোড়া কোটরি বা চিতল হরিণ। বড়টা গাছের থেকে মহুয়া খাচ্ছে, ছোটটা মাটিতে পড়ে থাকা ফলগুলো।
এবার চালক ইঞ্জিন বন্ধ করে জীপটা নিউট্রালে যতদূর সম্ভব কাছাকাছি নিয়ে যায়। ফিসফিস করে—গুলি করুন, দেরি করবেন না। আরে করছেন কি, চালান গুলি!
অন্ধকার ফুঁড়ে বিকট শব্দে দুটো আগুনের গোলা ছুটে যায়। হরিণগুলো প্রাণপণে দৌড়য়, কাঁটা ঝোপ লাফিয়ে পেরোয়। কিন্তু দুষ্যন্তের এই জঙ্গল হাতের তালুর মত চেনা। এসব আগে লল্লু সাহেবের জমিদারির এলাকায় পড়ত। ও ক্ষিপ্র হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বনের মধ্যে ওদের তাড়া করার চেষ্টা করে। বৃথা চেষ্টা। আমরা ফেরার কথা ভাবি। তিন ভায়রা নিজেদের মধ্যে দোষারোপ শুরু করেন নিশানা ফস্কে যাওয়ায়। লল্লু সাহেব কেন গুলি চালালেন না সে নিয়ে কটুকথা শোনা যায়। কিন্তু দুষ্যন্ত মন দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। ধূলোর মধ্যে কী যেন পড়ার চেষ্টা করছেন। এবার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ইশারায় সবাইকে ওর পেছন পেছন আসতে বলছেন। কাছে গেলে দেখান ধূলোর উপরে রক্তের ছিটে। অন্ততঃ একটা নিশানা লেগেছে। দাগ ধরে কিছু দূর গিয়ে দেখা গেল শিকারকে-- ছোট কোটরি, গায়ে সাদা সাদা ছিটে, মাটিতে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।আরে, বুকটা উঠছে পড়ছে। মহোল্লাসে চারজন মিলে হরিণটিকে তুলে পেছনে আমার আর দাদুসায়েবের লম্বালম্বি সীটের মাঝখানে খালি জায়গায় শুইয়ে দেয়। তার পেটের উপর চাপিয়ে দেয়া হল জীপের স্টেপনি চাকাটা। জীপ চলতে থাকে। সবার মনে ফুর্তি।অনেক দিন পরে শিকারে আসা, ব্যর্থ হয়নি। আবার সবার শিকারের গল্প এবং নিজেদের বড়াই শুরু হয়। আমার কিছুতে উৎসাহ নেই। হরিণটা জিভ বের করে হ্যা-হ্যা করছে। যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, বোবা দৃষ্টি। আমি মুখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্ধকার দেখি। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। মোরগার সেই ধাবার কাছে এসে গেছি। জীপ থামে। নেমে চা খাওয়া ঠিক হবে কিনা কথা হচ্ছে এমন সময় বিপর্যয়। শুয়ে থাকা হরিণটা হঠাৎ এক লাফে স্টেপনির চাপ অগ্রাহ্য করে ছিটকে পড়েছে রাস্তায় আর প্রাণপণে ছুটে পাশের জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের দল কি তা হতে দেয় কখনও? বন্দুক হাতে চারজন বিকট রণহুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে রাস্তায় এবং তাড়া করে আহত শিকারকে।
মাঝরাতে এই দৃশ্য দেখে ব্যোমকে যাওয়া ঢাবার লোকজন ডাকাত! ডাকাত! চিৎকার করে টেবিল ও খাটিয়ার তলায় ঢোকে। ঢাবার মালিক ও চাকরের দল ঝাঁপ ফেলে দেয়। আমি বুঝে যাই একা থাকলে বিপদ আছে, ডাকাত বলে ধরা পড়তে পারি। তাই শূন্যগর্ভ রাইফেল তুলে দ্রুত ওদের পেছনে যাই। একটু এগোতেই দেখতে পাই পালাতে গিয়ে হরিণটি একটা নীচু গাছের ‘ওয়াই’ এর মত জোড়া ডালের ফাঁকে মাথা গলিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একজন ওর দুটো শিঙ চেপে ধরে ওই হাড়িকাঠে ওর মাথা ঠুসে ধরে। আর একজন বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ওর চোয়ালের হাড় ভেঙে দিতে থাকে।
আমি হাতজোড় করি—দোহাই আপনাদের। এমন করবেন না । ওর মাথার পেছনে বা কপালে একটা গুলি চালিয়ে ব্যাপারটা শেষ করে দিন।
আমার কথা কেউ শোনে না। গুলির দাম আছে না? তারপর শিকারকে আদিম মানবের মত হিংস্র উল্লাসে মেরে ওর মৃতদেহ জীপে তোলা হল। জীপ চালু করে পাঁচ কিলোমিটার গেছে কিনা চালকের প্রশ্ন –জীজাজি, ও স্টেপনি ওহীঁ হ্যায় না ? সবার খেয়াল হয় স্টেপনি হয়ত হরিণের লাফের সঙ্গে ঢাবার কাছে রাস্তায় পড়ে গেছে। দুষ্যন্ত সিং গাড়ি ঘোরায়—ওই স্টেপনি এখানে ছেড়ে গেলে আমার চাকরিও যাবে।
কপাল ভাল, স্টেপনিটি গড়িয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে মাইলস্টোনের সাদা পাথরের গায়ে আটকে ছিল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু গাড়ি চলার পর লল্লুসাহেব বলেন যে বিপদ হয়েছে। এই বে-আইনি শিকারের খবর ফরেস্ট গার্ডের দল পেয়ে গেছে। ঢাবার মালিক চুপিচুপি ওনাকে জানিয়েছে। কিন্তু জীপের নম্বর ওরা জানে না। তাই বড় রাস্তায় সব গাড়ি চেক করবে। বামাল সমেত ধরলে সবার জেল নিশ্চিত। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেছে। আটচল্লিশ ঘন্টা লক আপে আটকে থাকলে সাসপেন্ড হওয়া ঠেকায় কে! কেন যে এদের কথায় নেচে ছিলাম?
উপায় আছে। জীপ হাইওয়ে ছেড়ে জঙ্গলের ঘোরা পথে আগে লল্লুসাহেবের রাজওয়াড়ায় যাবে। সেখানে ওঁর অন্দরমহলে জীপের রক্তের দাগ ধোয়া হবে এবং শিকারকে কেটেকুটে সাফ করে গুছিয়ে রাখা হবে। আমরা ফিরে যাব খালি হাতে জীপ নিয়ে। মাংসের ভাগ ওনার দেওয়ান ও কোতোয়াল মোটরবাইকে করে বিকেল বেলায় সবার ঘরে পৌঁছে দেবে।
সে না হয় হল; কিন্তু হরিণের মাংস কোনদিন আর আমার গলা দিয়ে নামবে না।
রোদ্দূর পড়ে গেলেও অন্ধকার হয় নি। সবার কাছে বিদায় নিয়ে গেওরা স্টেশনের দিকে এগোই। কাউকে সঙ্গে আসতে বারণ করেছি। আমার সামান্য মালপত্র—স্যুটকেস, হোল্ডল , কিটব্যাগ ইত্যাদি ওরা আগেই স্টেশন মাস্টারের রুমে রেখে দিয়েছে। আমার ফোল্ডিং খাট জগনকে দিয়ে এসেছি, স্টোভ ব্যাংকের টি-ক্লাবকে।
আমাকেও মোটরবাইকে করে পৌঁছে দিচ্ছিল, মানা করেছি। এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তিন কিলোমিটার পথ আমি একা পায়ে হেঁটে যেতে চাই—ঠিক যেভাবে প্রথম দিন এখানে জয়েন করতে এসেছিলাম। নদীর কাছে বিদায় নেওয়া হয়ে গেছে।
কোয়ার্টারের চাবি ফেরত দিতে গিয়ে জানলাম ওর মালিক চামারসায় সাসপেন্ড হয়ে গেছে। ও ছিল ওই রাক্ষূসে ডোজারগুলোর অপারেটর। ও নাকি হরদম নাইট শিফট করত। আসলে ইঞ্জিন চালু করে নিউট্রালে রেখে ব্যাটা ড্রাইভারের উঁচু এয়ার- কন্ডিশন্ড কেবিনটায় ঘুমোত। ইঞ্জিনের ঘরঘর শুনে কেউ সন্দেহ করত না। মাসদুয়েক দিব্যি চলছিল, তারপর ধরা পড়ে যায়। নরেশ চাবি রেখে দেয়। বলে –মনখারাপ করবেন না স্যার। ও আবার ডিউটিতে ফিরবে।
এই ক’বছরে জঙ্গল অনেক সাফ হয়ে গেছে। সেই উইয়ের ঢিবি, গোসাপের ঘর আর কেউটের গর্ত চোখে পড়ছে না, বাঁশবন প্রায় সাফ। একটা চায়ের দোকানের চালাঘর। এবার স্টেশনের কাছে এসে গেছি। একটা পিচের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। পিচ গরমের মেশিন, বালতি। কুলিকামিনের একটা ছোট দল। ওদের তদারকি করছে একজন মেট । তার পরণে নেভি ব্লু হাফহাতা জামা ও হাফ প্যান্ট, পায়ে মোজা ছাড়া ভারি বুটজুতো, মাথায় হেলমেট, চোখে রোদচশমা। লোকটি হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে স্যালুট মারে—নমস্তে সাহাব!
আমি চোখ কুঁচকে একে মনে করার চেষ্টা করি।
--চিনলেন না স্যার? আমি বিহানু। সেই বিহানু পিতা আত্মারাম বা আত্মারাম পিতা আত্মারাম? সেই যে ব্যাংকে লোন নিতে গেছলাম—আপনারা আমায় ঠগ ভেবেছিলেন, পরে পাটোয়ারি বলায় লোন দিয়েছিলেন? সেই লোনের টাকা থেকে পাঁচ হাজার পাটোয়ারিকে দিলাম। কয়লাখনিতে খালাসির চাকরি পেলাম। এখন আমি কুলিদের মেট হয়েছি।
সেই ক্যাবলাকান্ত আত্মারাম বা আজকের কুলি সর্দার বিহানু আমার হাত থেকে ব্রিফকেস প্রায় ছিনিয়ে নেয়। চলুন স্যার, আপনাকে ট্রেনে তুলে সীটে বসিয়ে দিয়ে আসি। মানা করবেন না।
ট্রেন ছাড়তে তখনও আধঘন্টা দেরি। বিহানু কাঁচের গেলাসে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে আসে, পয়সা বের করতে গেলে হাত চেপে ধরে—সওয়াল হী নহীঁ। প্রশ্নই ওঠে না।
ব্রিফকেসটি ওপরের বাংকে তুলে দিয়ে একটু হাতপা ছড়িয়ে বসি। প্রায় ফাঁকা কামরা, কোরবা স্টেশনে ভরে যাবে। একটি অল্পবয়েসি বৌ কোলে বাচ্চা, ঘোমটা সরে গেছে এবং স্বামী প্ল্যাটফর্ম থেকে জানলা দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিচ্ছে—এসব দেখতে দেখতে বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম; চটকা ভাঙলো একজন অন্ধ গায়কের গানে। স দু’আঙুলে দুটো অ্যাসবেস্টসের টুকরো বাজিয়ে তাল রাখছে এবং গ্রাম্য চড়া গলায় গাইছে একটি স্বরচিত গান।
“ অজকট লাগথে ওকর ঝিক ঝিক ম,
আরে রাতদিন মোলা রুয়াঁসি লাগে সাঁবরিয়াকে খিচ খিচ ম।
দিনভর খেলথে জুয়া ঘরকে চিন্তা নাই হাবে,
বাসি খাকে হামন জিথন নোটবর তভো গরিয়াবে,
থালি-লোটা বেচ ডারে দশো-বিশ ম।
রাতদিন মোলা—”
“দিনরাত শুনি বঁধুর খিটখিটানি,
চোখের জলে যাই সয়ে ওর দাঁতের খিচুনি।
জুয়োর নেশায় মেতে থাকে ঘরের কোন খবর নাই,
পান্তা খেয়ে পেটটি ভরাই, চাইলে টাকা ঠ্যাঙায় ভাই।
থালা-গেলাস দিচ্ছে বেচে দশটা টাকার জন্যে হায়,
দিনরাত্তির গালমন্দ, চোখের জলে বুক ভাসাই”।
গার্ডের হুইসিল বেজে ওঠে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। কয়লার ইঞ্জিন আড়মোড়া ভেঙে নড়ে ওঠে, হুশহুশ করে কালো ধোঁয়া ছাড়ে। যাক, বাঁচা গেল।
অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে—সাহেব, ম্যানেজার সাহেব গা! শুন সাহেব গা!
প্ল্যাটফর্ম হয়ে কেউ দৌড়ে আসছে আর ডাকছে—সাহেব, ম্যানেজার সাহেব গো, একটু শুনুন।
ধীরে ধীরে শামুকগতিতে চলা লোক্যাল ট্রেনকে ও ধরে ফেলে এবং আমার জানলার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। এ তো ছুরিগাঁয়ের নাচাপার্টির (যাত্রাদলের) দরশরাম ওরফে দরশু। একে যাত্রাপালার জন্যে তিনবছর আগে লোন দিয়েছিলাম। অডিট আপত্তি করেছিল।
তুই এখানে?
ও হাঁফাতে থাকে, দম নেয়। তারপর বলে –মাত্র খবর পেয়েছি। আপনি বদলি হয়ে রাজধানী রায়পুরে যাচ্ছেন। একটা প্রার্থনা। ওখানের সদরবাজারে একটা দোকানে খুব ভালো রাবণরাজার মুকুট পাওয়া যায় । আমার জন্যে গোটা দুই কিনে পাঠিয়ে দেবেন? তাহলে এ’বছর দশহরায় রাবণবধ পালা যা নামাবো না, লোকের চোখ ট্যারা হয়য়ে যাবে। মনে থাকবে তো?
আর একটা কথা এবার নতুন পালা লিখেছি, নতুন হিরোইন। আপনি চেনেন। ভালুমার দুরুপতী। ওর পেটের বাচ্চাটা গেছে, এখন ও একদম ফ্রি! পালার নাম দিয়েছি “আহিরণ নদী কো সব পতা”। সব জানে আহিরণ নদী। মুকুটের কথা ভুলবেন না যেন! ছুরি ব্যাংকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন।
ট্রেন এবার নদীর উপরের রেলপুল পার হচ্ছে।
(সমাপ্ত)
0 comments: