0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥১৩॥



তখন ভিতরে ভিতরে অতীত দ্রোহের স্মৃতিকণাগুলি ঘাই মেরে বেঁচে উঠতে বলছিল

জেরকা 

ক্যাথিটারের লাল তরল কবে যে সাদা হলো বুঝতে পারেনি জেরেকা। সারা অঙ্গে ক্ষতের বেদনা আর নেই। শরীর যে আরাম চায় বহু বছর পর এটা বুঝতে পেরেছে। এখানের মতো শান্তি আরাম আর সেবাযত্ন জীবনে কখনও পায়নি। শরীরের কাটা ছেঁড়া তো আজ চল্লিশ বছর ধরে লেগেই রয়েছে। জীবনের প্রথমে যেদিন থেকে আদি প্রজাতি অরণ্যবাসীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ও নির্যাতিত হওয়ার বিরুদ্ধে দ্রোহের জ্ঞান হয়েছে তখন থেকেই এই দেহকে বিপ্লবের হাতে সঁপেই দিয়েছে সে। আর বাকি থাকে মন। মন তো এতদিন প্রতিকারের আগুন হয়েই জ্বলতো। এখন এই জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুধু একটিই ছবি বারবার তার চোখের সামনে সমানে ভেসে উঠছে। আর মন থেকে অভিমান উথলে উঠছে আর অসহায়তা ঘিরে আসছে। দ্রোহের আগুন নিভে যেতে চাইছে। এমনটা কেন করল ও? ও এমন কিকরে করতে পারলো? জীবন ফিরে পাওয়ার পর নতুন ভাবে আন্দোলনের আগুন জ্বালাবে কি, ঘুরে ফিরে একটা মুখ ছ্যাঁচড়ের মতো তার মাথায় অভিমান হয়ে ঘুরছে। জন্মের পর থেকে তার পেটের সন্তান পেরো কোল পায়নি। পেরোর জন্ম হয়েছে জঙ্গলের এক গোপন নির্জন জায়গায়। জন্ম হওয়ার পরদিনই পুলিশ ও মাইন্স মালিকদের বিশেষ সুরক্ষা বাহিনীর এনকাউন্টারে পেরোর বাবা নিহত হয়। ওরা জেরেকাকে তুলে নিয়ে গেছিল হাজতে। পেরোকে দীর্ঘদিন লালনপালন করেছেন গোরাচাঁদ। পেরো যখন তিনবছরের তখন এই হাজত সেই হাজত ঘুরে যেদিন শিমুলিয়াতে ফিরেছিল জেরেকা। তার দিনদুই পরেই গোরাচাঁদের স্ত্রী সমুকে জন্ম দিয়েই মারা যায়। পেরো তার মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে কিন্তু সমুকে সে তার বুকের দুধ খাইয়ে বড়ো করেছে। আজ সমুর বয়েস আঠাশ। সেই সমু কী না?

তাঁবুর ভিতরে নিঃশব্দে নীল চোখের সাদা মানুষদের সাদা পোশাকে চলাফেরা। তাঁবুর ভিতরে সবকিছুই ফিট সাদা। প্রথমদিকে আধোজ্ঞান স্থিতিতে সবকিছু সাদা কেবল ক্যাথিটার টিউবের রঙ লাল দেখে জেরেকা ভেবেছিল বুঝিবা এটাই মরণোত্তর বোধ। নিশ্চয় সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু এখন ভারি আরাম। একটু পাশ ফিরতেও পারে। শুধু গলায় একটা মোটা ব্যাণ্ডেজ। তাই ঘাড় ঘোরাতে পারেনা। পাশে একটা সাদা টুলের ওপর ওষুধপত্র রাখা আছে। একটা প্যাকেট তুলে দেখেছে ওষুধের নাম রাশিয়ান ভাষায় লেখা। তবে ওষুধ ইনজেকশন রোগীর শুশ্রষা সে ভালই জানে। বছর দশেক আগে দু'হাজার সাত সালে আদিবাসী নারীমুক্তিযুদ্ধে যোগদান দিতে আসামের প্রত্যন্ত এলাকাতে গেছিল সে। দীর্ঘ দু'বছর জেরেকা সেখানের অত্যন্ত শক্তিশালী আদিবাসী মহিলা সংগ্রামী কাঁকন বিবির সাথে কাজ করেছে। সেখানে এক ডাক্তারের সাথে নার্স হয়ে পীড়িতা লাঞ্ছিতা মহিলা লেবারদের সেবা করে নার্সিংটা ভাল করেই রপ্ত করে নিয়েছে। 

এখানে তার বিছানার পাশে তিন চারবার গোরাচাঁদকেই দেখেছে। পেরোকে একবারও দেখতে পায়নি। পেরো এখন কোথায়? আজ চল্লিশ বছর ধরে গোরাচাঁদের সাথে আছে জেরেকা। এটা সবাই জানে। আর এও বিশ্বাস করে ওদের মধ্যে প্রাণ ও কর্তব্যের নিবিড় সম্পর্ক। শরীরের নয়। জেরেকাও ভাবতেই পারেনা ওঁর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হতে পারতো। জেরেকা মনে প্রাণে গোরাচাঁদকে গুরু রূপে বরণ করে নিয়েছে। জেরেকা জানে ও দেখতে আকর্ষণহীন। কিন্তু উনি তাকে রীতিমতো শিক্ষিত করে তুলেছেন। শুধু ও কেন? পেরো ও আরও কয়েকজন তাঁর শিক্ষিত সহযোগী। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে একজন উচ্চপদস্থ রাশিয়ান অফিসার ঢুকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। জেরেকা দেখল ওনার সাথে একজন বয়স্ক টাঁক মাথাওলা ভারতীয় আছেন। আর দুজন রাইফেলধারী গার্ড। বয়স্ক লোকটিকে দেখে জেরেকা বুঝল ইনি নিশ্চয়ই বাঙালি। ওনাকে সঙ্গে করে কেন নিয়ে এসেছেন ওরা? নিশ্চয়ই উনি দোভাষী। অফিসারটি কাছে এসে দু'হাত জুড়ে নমস্কার করে নিজের নাম ও পরিচয় দিল। ওর নাম সারগেই ইভানোভিচ। বিছানার কাছে এসে একটু নুয়ে পরিষ্কার গলায় ওরাওঁদের কুরুখ ভাষায় বলল। 

- নিন একা সে রাদাই? (কেমন আছেন)

-দাও রা দান (ভালো আছি) 

জেরেকা বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে গেল। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে থেমে থেমে বাংলাতে বলল, কষ্ট করে আর আদিবাসী ভাষায় কথা বলার দরকার নেই। আপনি আপনার ভাষায় কথা বলুন। এই কথা বলে জেরেকা দোভাষী লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসল। সারগেই একটু হেসে বলতে শুরু করল। দোভাষী বাংলায় তর্জমা করতে লাগল। 

সারগেই: আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী। আমরা আপনার বিষয়ে যত বেশি জেনেছি তত বেশি অভিভূত। আপনার মতো একজন সংগ্রামী মানুষের যারা এই অবস্থা করেছে তাদের আমরা অন্তর থেকে কনডেম করছি। অবশ্য যাদের বিরুদ্ধে আপনার এই লড়াই তারা তো সুযোগ পেলে এ কাজ করতেই পারে। কিন্তু তাদের এই এক্টিভিটিকে আপনাদের সরকার প্রশ্রয় কেন দেয়? এটাই আমরা বুঝে উঠতে পারিনা। শুনেছি লেবার ওয়েজ ঠিকমত দেয়না। কতটা খনিজধাতুর, বিশেষ করে কপারের নিষ্কাশন হলো সেটারও নাকি ঠিকমতো রিপোর্ট হয় না। এদিকে এখানে আমরা সার্ভে করে দেখেছি মাইনসের কাছে বিশাল বিশাল গর্ত। কপার মাইনসে এইরকম গর্ত কিন্তু পরিবেশের পক্ষে খুব ক্ষতিকর ও মানুষের প্রাণঘাতক। গর্তের ভিতরে থাকা তামার আকরের সাথে জল ও বাতাসের বিষক্রিয়া পরিবেশ দূষিত করে। সেই পরিবেশে আপনাদের অনেক আদিবাসী লেবার মারা যায় এই খবর আমার কাছে আছে।

জেরেকা: (ক্লান্ত ও শুকনো হাসি হেসে) এটা আমাকে কেন বলছেন? এই সার্ভে করা আর একশন নেওয়া কি আপনাদের কাজ?

সারগেই: না। একেবারেই নয়। আপনাদের জাতীয় সম্পত্তি কে কিভাবে শোষণ করছে আমাদের তাতে কি? দেখুন, আমাদের এই মিলিটারি যৌথ মহড়ার আর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাদের ও আমাদের সরকার একটা চুক্তিতে সাইন করেছে। সেটা হলো এখানের যারা মিলিটেণ্ট, তাদের চিরুনি তল্লাশি করে হত্যা করা। (খুব কাছে এসে ফিসফিস করে স্পষ্ট ইংরেজিতে) এখন বলুন ম্যাডাম, আমরা আপনাকে কেন বাঁচিয়ে তুললাম?

জেরেকা: কেন তাই তো আমার কাছে একটা ধাঁধা। কিন্তু এটা মনে হয় আপনি মানুষ হিসেবে মানব দরদী খাঁটি সাম্যবাদী। এটা আমার নিজস্ব ধারণা। হতে পারে এটা ওই খনি মালিকদের একটা চাল। যদি কিছু কথা থেকে থাকে তা জানতে। এ ছাড়া আমি কিছুই জানিনা।

সারগেই: (একটু থেমে বেশ কিছুক্ষণ জেরেকার দিকে চেয়ে থেকে) ম্যাডাম আমাদের আর্মি সমাজে হিপনোটাইজার হিসেবে আমার খ্যাতি আছে। আমি মানুষের কাছে গিয়েই তার চরিত্র ও তার মানসিক স্থিতি বুঝে যাই। কিন্তু আপনি দেখছি এমন জিনিয়াস যার এক্সপোজার নেই। একটু যদি আপনার স্কিল পালিশ করা যেত তবে এখানের মানুষের আর দুর্দশা থাকতো না। আপনি আমাকে ঠিকই স্টাডি করেছেন। আমি এই সিডিউলড আর্মি প্রাকটিস ছাড়া এই সবে কেন মাথা গলাচ্ছি জানেন? আমি জানতে পেরেছি এখানে একটা মানববিরোধী লোভী মানুষের একটা চক্র চলছে। আমি যখন জানতেই পেরেছি তখন আমার হাত দিয়ে নির্দোষদের হত্যা করার বা হত্যা করতে সাহায্য করার মতো পাপ কেন করব?

জেরেকা: আমি তো একা আহত রুগ্ন, আপনাদের আশ্রিত। আমার গুরুজিও জানিনা কি করতে পারেন। আমি জানিনা আপনি আসলে কি চান।

সারগেই: আমি জানি ম্যাডাম আপনার সাথে কোথায় কখন আর কিভাবে এই জঘন্য অমানুষিক কাণ্ডটা হয়েছে। আমাদের স্নাইপার গ্রুপ সব তথ্যই এনে দিয়েছে। ওরা এও বলেছে ঘটনাস্থলে আপনাদের মিলিটারী কনভয় সেখান দিয়ে পার হচ্ছিল। খোদ মেজর জেনারেল মিঃ দাস সেখানে ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিনা তিনি কোনও স্টেপ নিলেন না কেন। যারা এই কাজটা করেছে তারা মিলিটারির সামনে এত ডেয়ার করল কি করে?

জেরেকা: ছাড়ুন ওইসব কথা। আসল কথা বলুন। আবার আমি জানতে চাই আপনি এখন কি চান?

সারগেই: আপনাদের এই অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার হতে হেল্প করতে চাই। তবে এটা মনে করবেন না এই ডীলে আমার কোনও স্বার্থ নেই। আপনি আপনার গুরুজি গোরাচাঁদের কাছ থেকে সেটা জেনে নিবেন। এখন এটা জানুন আজই আপনাদের আর্মিদের চিহ্নিত করা কম সে কম সাত আটটা গ্রামকে মর্টার ও শর্ট রেঞ্জড কামান দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। ওই সব গ্রামগুলির ব্যাপারে জিওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট যে ওই গ্রামগুলির ত্রিসীমানায় বিষাক্ত বননীল ঝাড়ি নেই। ওই গ্রামগুলি দিয়ে ঘেরা বিস্তীর্ণ জায়গাটি প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক দিক দিয়ে স্বাস্থকর। ওখানে একটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সিটির পত্তন হতে পারে যেখানে কারখানাও বসবে আর ওই গ্রামগুলোর মাইল দুই দূরে বিশাল প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লাল সবুজ নুড়ি পাথর আর ওই বিষাক্ত বননীলের ঝোপ। তার মানেই সেখানে কপার মানে তামা ধাতুর অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে। সেখানটা হবে কপার মাইন্স। বুঝেছেন?

খনিজ সমৃদ্ধ এই এলাকায় কম সে কম তিরিশটি বড় ছোটো মাইন্স আছে। তার মধ্যে একটা ছোটো অথচ বহুমুল্য তামার খনিজে সমৃদ্ধ এরিয়া সৌমজিত মাইন্স ওনারদের কাছ থেকে উপহার স্বরূপ পেতে পারে। যদি তাদের জন্যে এলাকাটি আদিবাসী উপজাতি মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই লোভে মেজর জেনারেল সৌমজিত দাসের সাথে খুব নামী একটি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের গোপনে ডীল হয়েছে। আমি চাইনা আপনাদের সরকার বঞ্চিত হোক আর এইভাবে কুরুখ উপজাতি নিপাত যাক।

এত কথা বলে সারগেই ও দোভাষী দুজনেই থামলেন। কিছুক্ষণ পর জেরেকা পরিষ্কার গলায় বলল।

জেরেকা: কিন্তু আপনি যদি আমাদের হেল্প করবেন আপনার কি স্বার্থ? আমি আবার আপনাকে বলছি।

সারগেই: ওই গ্রামগুলো ঘিরে যে বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে ওই জায়গাতে উপজ মেডিসিন্যাল হার্বাল প্লাণ্টএর পেটেন্ট নিতে চাই। সে জায়গাটি যেকোনও ভাবে অক্ষত রাখতে হবে। তার জন্যে আপনাদের সেই আদিম জঙ্গলী এয়ারলেস টেলি সিস্টেমে গ্রামগুলিতে ম্যাসেজ পাঠাতে হবে। মানে বড় ধামসা বা ঢাক বাজিয়ে সংকেত পাঠাতে হবে। যাতে আজই দুপুরে এখানের মাঠে সবাই ঘর ছেড়ে জমায়েত হয়। প্রতিবাদ করতে হবে। তারপর আমরা বুঝে নেব। শুধু ওই ম্যাসেজ পাঠানোর কাজটা ম্যাডাম আপনাকেই করাতে হবে। আজই এক্ষুনি। 

0 comments: