1

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা - ২১ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


ঠাম্মাকে এতখানি গম্ভীর এর আগে নীরু একবারই দেখেছিল। যেদিন ঠাম্মা তাকে বলেছিল যে কলকাতার বাড়িতে তারা আর থাকবে না। নীরুর খুব কষ্ট হয়েছিল। শুধু যে বাড়িটার জন্য, তা নয়। নীল, যাকে সে নিজের ভাই বলেই ভাবত, তাকে ছেড়ে আসতে হবে, এটা ভেবে তার কষ্ট হচ্ছিল। নীলেরও খুব কষ্ট হয়েছে, এটা জানে নীরু। নীল আসবার আগের দিন অনেকক্ষণ ছাদে এসে নীরুর পাশে বসেছিল কাকিমার চোখ এড়িয়ে। অবশ্য কলকাতার বাড়িতেও বেশ কিছুদিন ধরে নীরু ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে পারছিল না। কাকিমা একদিন গম্ভীর গলায় বলেছিল তাকে যে, ‘তুমি বড় হয়ে গেছো, এখন আর ধেই ধেই করে নেচেকুঁদে খেলে বেড়াবে না আগের মতো!’ নীরু বুঝতে পারছিল না তখনও যে ‘বড় হওয়া’ মানে আসলে ঠিক কি! হ্যাঁ, পিরিয়ড একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। সে জেনেছিল নিজের শুরু হবার কিছুদিন আগেই তার বন্ধু ঈশিতার হয়েছিল বলে। নীরুকে ঠাম্মাও বুঝিয়েছিল অনেক যে এটা খুব স্বাভাবিক, সবার হয়, সব মেয়েদের হয়, এমনকি মানুষ ছাড়া সারা পৃথিবীর কোনও কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরও হয়। কিন্তু সেটার সঙ্গে খেলাধূলা বন্ধ করে দেওয়ার কি সম্পর্ক নীরু সেটা বুঝতে পারছিল না। নীরু খেলতে ভালবাসে। কলকাতার ইস্কুলে সে স্পোর্টসে অনেক প্রাইজ পেয়েছে নিচু ক্লাস থেকেই। কলকাতার ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস অনিভাদি দাদুকে ডেকে বলেছিল যে তাকে যেন কোনও খেলার বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। দাদু তাকে আলাদাভাবে ব্যাডমিন্‌টনের ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিল। তার খুব ভালো লাগতে শুরু করেছিল ক্লাবের পরিবেশ, ট্রেনিং সবকিছু। 

এমনসময় তারা কলকাতা ছেড়ে এখানে চলে এল। ব্যাডমিন্‌টনের ট্রেনিং বন্ধ হয়ে গেলো তার। এখানে সেরকম কোনও ক্লাব নেই যেখানে মেয়েরা খেলার ট্রেনিং নিতে পারে। তবে এখানে বিরাট মাঠ আছে ইস্কুলের। এখানে সবার সঙ্গে খেলতে পারে সে গঙ্গার ধারের এই বিশাল খোলা মাঠে। মেয়েরা টিম করে কখনও কবাডি আবার কখনওবা ফুটবল খেলে এই মাঠে। খেলতে খেলতে নদীর গন্ধ পায় সে। এই স্কুলেও স্পোর্টসে প্রাইজ পেয়েছে সে। তবুও কলকাতার ইস্কুল, ব্যাডমিন্‌টনের ট্রেনিং, প্রিয়বন্ধু ঈশিতার মুখ সব ভাবলেই নীরুর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কলকাতার বাড়িতে দোতলার ওই একচিলতে ছাদের কথা ভাবলেও নীরুর কষ্ট হয়। অথচ এখানে, এই হুগলীর বাড়িতে বিশাল ছাদ থাকলেও সে কালেভদ্রে ছাদে যায়। অথচ কলকাতায় সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলেই সে আর নীল মাদুর পেতে ওই ছোট ছাদে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে মেঘের মধ্যে কত হাতির শুঁড়, রবীন্দ্রনাথের মুখ এসব দেখত। আকাশ দেখতে দেখতে অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়লেই, দেয়াসি এসে মারত এক ঠ্যালা। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে আর নীলকে দুধকলা দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিত দেয়াসি। দেয়াসিকেও কতদিন দেখেনি নীরু। দেয়াসি একটু বকাবকি করত ঠিকই, কিন্তু তাকে খুব ভালবাসে এটা তো মিথ্যে নয়। এখানে চলে আসার আগের দিন সবাইকে লুকিয়ে নিজের পয়সায় ইয়াব্বড়ো এক রাজভোগ কিনে এনে খাইয়েছিল আর নীরুকে জড়িয়ে ধরে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল দেয়াসি! ভাবলেই নীরুর মন খারাপ হয়ে যায়। আর নীল? নীলের কথা ভাবলেই নীরুর কান্না পায়। ও ত আর দাদাইয়ের মত নিজে নিজে আসতে পারবেনা দিদির সাথে দেখা করতে। বড়দের কারও সঙ্গেও আসতে পারবে না। পারবে না, মানে ওকে আসতে দেবেই না কাকিমা, মানে নীলের মা। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, সেও কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিল যে দিদির সঙ্গে তার খেলাধূলা তার নিজের মা পছন্দ করেনা। কাকিমা ওকে ঘরে আটকে রাখত, যাতে ও নীরুর সাথে খেলতে বা কথা বলতে না পারে! সেজন্যই কি ঠাম্মা এখানে চলে এলো? নাকি অন্য কোনও কারণ! নীল প্রমিস করেছে একটু বড় হয়ে ও নিজেই চলে আসবে দিদির কাছে। অবশ্য নীলের এখন কতটুকুই বা বয়েস! বড় হতে এখনও অনেক দেরি! তার আগে সে নিজেই বড় হয়ে যাবে। হ্যাঁ, বড় হয়ে সে অনেক পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবে। পাহাড়, সেই মেঘে ঘেরা পাহাড় যেটা বারে বারে তার স্বপ্নে ফিরে আসে, সেটা খুঁজবে। 

কিন্তু ঠাম্মা এত গম্ভীর কেন? বিকেলের আগে একটা ফোন এসেছিল। তাদের বাড়িতে খুব বেশি ফোন আসেনা। সাধারণত দাদাই ফোন করে। নাহলে মামাদাদুরা, মানে ঠাম্মার দাদারাও ফোন করে। তবে মামাদাদুরা কেউ ফোন করলে ঠাম্মা খুব খুশি থাকে, ফোনে খুব আদুরে আদুরে গলায় কথা বলে, এটা লক্ষ্য করেছে নীরু। তারপর ফোনে কথা হয়ে যাবার পরেও অন্তত দু-তিন দিন থাকে ওই খুশির রেশ। গুণগুণ করে গান গায়, হারমনিয়াম নামিয়ে নীরুকে নতুন গান তুলিয়ে দেয়, জলখাবারে লুচি-আলুর দম বানিয়ে ফেলে। এসব দেখেশুনে নীরু ভেবেছে, মামাদাদুদের বাড়ি নিজেই একদিন ফোন করে বলবে যে ওখান থেকে যেন ঘনঘন ফোন আসে; তাহলে ঠাম্মা বেশ ভালো থাকবে, আনন্দে থাকবে। কিন্তু আজকের ফোনটা কে করেছিল? দাদাই? নাহ... দাদাই ফোন করলে নীরুর সঙ্গে কথা বলতোই একটিবার। নীরুর সঙ্গে কথা না বলে দাদাই লাইন ছেড়ে দিত না। জিজ্ঞেস করে দেখবে একবার ঠাম্মাকে? কিন্তু ঠাম্মা এত গম্ভীর হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে আজ নীলিমা মিসকেও হারিয়ে দিতে পারে। 

নীরু অনেকদিন পরে আজ ছাদে ওঠে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে জমাট মেঘ করে আছে। কিন্তু বড় গরম, গুমোট গরম। বৃষ্টি কি নামবে কিছুক্ষণের মধ্যে? অনেকদিন ভেজেনি সে বৃষ্টিতে। আজ বৃষ্টি নামলে সে একটু ভিজবে। ঠাম্মাকেও কি ডেকে নেবে একটু বৃষ্টি ভেজার জন্য? অন্যদিন হলে ডাকা যেত, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে হবেনা; ঠাম্মাকে কোনও কথা বলতেই নীরুর সাহসে কুলোচ্ছে না। ঠাম্মা হয়ত কোনও চিন্তায় আছে, বা হতেই পারে কোনও কষ্টে আছে। কে বোঝাবে ঠাম্মাকে যে বৃষ্টি ভিজলে অনেক কষ্ট ধুয়ে যায়!

1 comment:

  1. পড়তে পড়তে মায়ায় আটকে যাচ্ছি । এমন শৈশব আমিও পেরিয়ে এসেছি ।

    ReplyDelete