0

পথে প্রান্তরে - ভিরানী ব্যানার্জী

Posted in










পথে প্রান্তরে


একটি হায়দরাবাদি বিরিয়ানি এবং...
ভিরানী ব্যানার্জী





।।এক।।

হর এক জিসম ঘায়েল হর এক রুহ প্যায়াসি
নিগাহোঁ মে উলঝন দিলোঁ মে উদাসি
ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি যায়ে তো কেয়া হ্যায়!

জীবনে যতবারই চোট পৌঁছে গেছে ভেতরের শিরা অবধি, হাতে এসে পড়েছে এক এক করে রক্তাক্ত মানবদেহ কোনও, সারানোর অহঙ্কার সাজে না, শুশ্রূষারও। দু'হাতে মুখখানি ধরে ঝুঁকে দেখতে গিয়ে যেটুকু ঝামরে আসে চুলের মেঘ, তার ছায়ায় পায়রার মুখে ছায়া ফেলে জীবন কখনও হাত ভারী হয়ে এসে আশরীর নুয়ে যাই মাটিতে; টপটপ নিজের রক্ত পড়ছে বুঝলে কবুতরী বুকে নতুন সঞ্জীবনীর খোঁজতলে নামিয়ে আসি দেহ। কখনও পায়রা ডানায় বল পেয়ে উড়ে যায়। সে এক সুখের মুহূর্ত বটে... সুখ বটে। আসলে রক্তের সম্পর্ক এসবই। রক্ত কখনও বাস্তবিক ক্ষতের হোক চাই চোখে জমে থাকা ছিন্ন, সেই কবে দিল্লীর ম্যায়খানায় ম্যায়খানায় লেখা হয়ে গেছে লাইনখানি,

'যব আঁখ হি সে না টপকা তো ফির লহু কেয়া হ্যায়!'

তো নিজস্ব লাশখানি মেলবে কোথায় মানবী? তারও তো পথে চলতে মানুষ মানুষ মানুষের ঠেকা লাগে, রক্ত তারও তো শীতলশোণিত নাম নিতে ভয় পায়! তার জন্য কার্পেট মেলে রাখে একেকখান শহর, নতুন কোন মাটি, নতুন কোন চবুতরা। এবারের আশুরখানার নাম হায়দ্রাবাদ।


।।আশুরখানা।।

নিজামের নামে দৌলতের দোহাই পাড়ত দুনিয়া একসময়, সঙ্গদিল ইতিহাস কি নিজামকেও ভূলুণ্ঠিত করতে ছেড়ে দেবে? তাই হয় কখনও? সপ্তম নিজামের মা, জেহরা বেগম, ভালোবেসে 'বড়ি বেগম' বলতো সবাই তাঁকে; সময়ের ঝাপট কোপে চার হাত জমিনে নিজের গল্পগাছা গেঁথে শুয়ে পড়লেন। নিজাম পাগলের মতো হয়ে গেলেন। প্রত্যেক বিকেলে পুরানি হাভেলি গিয়ে 'মা মা' বলে কাঁদতেন। ক্ষত তো আর্তনাদে ভরে না, গভীর হয় কেবল, নতুন রক্ত ঘনিয়ে আসে তায়। তো লাখো লোকের শোক সন্তাপ একত্র করার কথা ভাবলেন নিজাম। গড়লেন মস্ত একখান আসুরখানা। শিয়াদের শোক করার সমবেতকণ্ঠ প্যালেস। দশ হাজার লোক একত্রে বসলেও চুল পরিমাণ স্থান অকুলান হয়না যেখানে। বড় রম্য মহল এই 'আজা খানা-এ- জেহরা'।


।। বিরাশি বছরের বাহুবলী।।

লাল কার্পেটটা খোলা চৌদোলের মতো ছাউনির মেঝেতে খুলতে শুরু করলেন যখন বৃদ্ধ, একটু অবাকই হলাম

- আপনি কি এখানেই শোবেন?

-  অউর কাঁহা! দুকান মে জাগাহ কম হ্যায়।

- আপনি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা এখানেই শোন? বৃষ্টি পড়লে কি করেন?

- দুকান চলা যাতা হুঁ

- আর খুব শীতে?

- সেহনা পড়তা হ্যায়, রোটি রোজি কি বাত হ্যায়, উসি কে লিয়ে না ঘর ছোড় কে ইতনে দূর আয়েঁ হ্যায়!

- বাড়ি কোথায় আপনার?

- দিল্লি

- এখানে একা থাকেন?

- হাঁ বচ্চেলোগ রেহতেঁ হ্যায়

- আপকে ঘরওয়ালী?

- ও দিল্লী মে রেহতি হ্যায়, উসকো ইঁয়াহা নহি রেহনা, বিশ সাল হো গয়ে ইঁয়াহা আয়ে হুয়ে

- উম্র কেয়া হোগি আপকি? ক্যায়সে অ্যায়সে!!

- এইট্টি টু হো গয়া। হার্ট কি ভি মরিজ হুঁ। দো বার অ্যাটাক হো চুকা।
অব উপরওয়ালা কি রহম হ্যায় কি জিন্দা হ্যাঁয়

- আপনি সরুন আমি বিছানা পেতে দিচ্ছি

- নহি বেটা, ইয়ে অপনে হাত সে করনা হোতা হ্যা, অপনা কাম হ্যায়

কিছু না বলে চাদরের উল্টোদিকে হাত লাগালাম,
- আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

- হাঁ কব কা

- কে রাঁধে?

- কে আবার, আমি!

- কিঁউ বচ্চেলোগ কিঁউ নহি বনাতে? অজীব হ্যায়

- ইতনা সা হি তো কাম হ্যায় বেটা। সুবহা খালি ভি রেহতা হুঁ। পাঁচ বজে উঠতা হুঁ, গ্যরা কো দুকান খোলনা হোতা হ্যায়। তো বাওর্চি বন যাতা হুঁ... সব আতা হ্যায় মুঝে - এগ, ফিশ, চিকেন

- আরেব্বাপরে... মস্ত মওলা হ্যায় জি আপ তো!

এবার কালো জুতোজোড়া একপাশে খুলে বৃদ্ধ পা গুটিয়ে বসলেন।

ওষুধের পুঁটুলি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। চেনা ওষুধ সব। দু'খানা ড্রপ দেখালেন

- ৯০০ কা হ্যায় জি

চোখে ড্রপ নিলেন একদম নিপুণ হাতে।

কথা শুনতে হলে চোখ বুজে কানখানি বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

- নাহ্‌ - আপনি শুয়ে পড়ুন। আসব আরেকদিন

- থ্যাঙ্ক ইউ বেটা। আনা জরুর। খুদা হাফিজ।

দৃশ্যে একখান তৃতীয় ব্যক্তি ছিল খেয়াল করিনি; ফোনখানা চার্জে দিয়ে টি স্টলের দোকানদার, অল্প বয়স। ফোনের স্ক্রিন অন করে জুলজুল গিলছে একলা বোকলাদের গপ্পো!


।।এবং শিবপার্বতীর নাটমন্দিরে।।

আমের মধ্যে ধূপ গুঁজে নিবেদন করেছিলেন এক পরিবার।

মন্দিরের দুয়ারে বসে থাকা ভিখারিণীদের একজন এসে আমটা তুলে নিয়ে গেলেন।

- আরে উসকো রেহনে দো, আম্মা

ভিখারিণী পাত্তাও দিলেন না। সঠিক জানেন কোন জিনিসটা বেশি জরুরী। ভয়ও পেলেন না অনাচারের! এতদিন প্রার্থনাস্থলে বসে থাকার লব্ধ দর্শন বোধহয়!


।।দরগার দোরগোড়ায়।।

জ্বলন্ত রোদ্দুর উপেক্ষা করে হরেক রকম মানুষ ওপরে যাচ্ছেন আসছেন... ঘাঘরা চোলি চুন্নি পরা দেহাতন, বানজারা। সারা অঙ্গে গয়না ঝমঝম করে শাশুড়ীর সাথে ভোজপুরী নববধূ। দক্ষিণী হিন্দু সধবা, এখানে বিবাহিতারা পায়ের দ্বিতীয় আঙুলে চুটকি পরেন।কারও ঊর্ধবাহু ভর্তি সাদা চুড়ি, একটু বয়স্কা। নাকে বিশাল চাকার মতো নাকছাবি। শাড়ী ধুতির মতো করে পরা, পায়ে কড়। এক সাদাচুল নারী দেখলাম টায়রার মতো কি পরেছেন চুলে, সিঁথি থেকে তিনভাগ হয়ে চুলে আটকে রয়েছে। হটপ্যাণ্টও বিরল না, গাছের ছায়ার খাটিয়ায় বসে খাওয়াদাওয়া চলছে জমিয়ে!


।। দ্বার খুলিয়া দিবেন তিনি গো।।

বরাবরই সমুদ্রের থেকে পাহাড় গহীন দেয় আমাকে। কি জানি কেন, মনে হয় পাহাড়ের জনজমজমাট থেকে পাথুরে আড়াল অনেকখানি সারল্য রেখে দেয় কোঁড়চে। উচ্চতা হৃদয়ের দরজা খুলে দেয় হাট কে হাট। পাহাড়ের স্তম্ভশিরে সাদা দোকান খুলতে পারেন যিনি, তাঁর গল্প অন্য হবে আশ্চর্য কি! দরগার শেষ তোরণে দোকান তাঁর, সেখান থেকে আরেকটু সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছাতে হয় মওলা আলির কাছে। বাপ মেয়ের সংসার, ঘরে একখান ছোট্ট টিভিতে তেলুগু সিরিয়াল চলছিল।

আমার সঙ্গের আম্মা, মন্নতের তালাচাবি কিনলেন পনেরো টাকা দিয়ে, সাথে আর পনেরো টাকার ফ্রুটজুস। ত্রিশটাকার জন্য দুহাজার টাকার খুচরো দিয়ে দিলেন এক কথায়! বললেন ঈশ্বরের জায়গা, এটুকু খুচরো দেব না!

শোভা আম্মা চাবি কিনে মন্নতের নিয়মকানুন বুঝে নিতে নিতে বললেন,

- বাবা আমার মেয়ের বিয়ে হবে তো তাড়াতাড়ি? আপনি মন থেকে একবার 'হ্যাঁ' বলে দিন

অদ্ভুত উত্তর দিলেন বাবা,

- ইয়ে সব মত বোলো আম্মা, নিয়ত ঠিক রখ কে খুদ মাঙ্গো, খুদা হ্যায়, মিলা দেগা

চুপচাপ বসে দু'জনের কথা শুনছিলাম। কথার ইন্ডাকশনে একজনের ভগবান বারবার খুদা হয়ে যাচ্ছিল, আরেকজনের খুদা ভগবান!

ধর্ম কখনও কখনও তড়িৎচুম্বক হয়; আর স্বচ্ছ দৃষ্টি মেধা সর্বদা।


।অমলু।।

অমল আলোখানি ছটফট করছিল সবুজ দেওয়ালের কোলে, মাথায় লতানোবিতানো চুল। ফুটকি আলোটার নাম জিজ্ঞেস করতেই ওর বাড়ির লোকেরও আগে বানজারনরা বলে উঠলেন সমস্বরে,
- অমলু অমলু... দরগা পে খেলনে আতি হ্যায় না

মায়ের চেয়ে বেশি বানজারনদের কোলেপিঠে ঘুরছিল অমলুরাণী; 
চৌকো কাচ টেনে কখনও ঝুমকোয় দোলা দিয়ে।


।।জ্যাকব ডায়মন্ড।।

অটোখানা ঝাড়লন্ঠনের অ্যাণ্টিক দোকানটার সামনে থামাতে থামাতে মুহম্মদভাই বললেন,
- কেবল একখানা কোহিনূরের গল্প আপনারা জানেন ম্যাডামজি, যে হাতে গেছে তার সমস্ত রোশনাই তবাহ করে দিয়েছে। সাদা হীরের গল্প জানেন কি? সব পাবেন এই মুহম্মদ আলির কাছে...

- সাদা হীরের গল্প? কিরকম?

- বহত হাসিন নিজাম থে উয়ো, মেহবুব আলি খান, শওখিন ভি থে কমাল কে। এক ড্রেস দোবারা নহি পেহনে কভি। ও লায়ে থে ইয়ে সফেদ হীরা হায়দরাবাদ মে। বহত শান্ত তমিজদার জুয়েল হ্যায় বোলে তো!

বলে চৌমহল্লা বাজারের গলিখান কাঁপিয়ে হাসির হররা তুললেন দোহারা গড়নের দরিয়াদিল মানুষটি।

এই ফাঁকে টুক করে নেটে দেখে নিলাম, জ্যাকব ডায়মন্ড। আকারে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম।


।।মক্কা মসজিদ এবং আকাশভাঙা বৃষ্টিদিন।।

আকাশ ভেঙে পড়ছে ওদিকে।

মন্দ্র স্বরে নামাজ শুরু হলো; কার্পেট পেতে সিরিয়াস মুখে জেনানারা। কেউ টাক মাথা চটজলদি আঁচড়ে নিচ্ছেন, যুবকেরা স্থাপত্যে হেলান দিয়ে এদিকওদিক মৃগয়াসন্ধানী।

একটা গুটলুস এসে পিছলে পড়ল মার্বেলের মেঝেতে। তাকে তুলে নিয়ে আরেক গোলাপি সালোয়ার পাঁচ আঙুলের কি বকুনি,
- বদমাশ বচ্চে!

বৃষ্টিতে বেদম নাচানাচি চলছে... কান ধরে টেনে আনার লোকেরা আপাতত ব্যস্ত।

দুটি গুটগুট আমার পিঠে হেলান দিয়ে নেত্য সবে শুরু করেছে।একখানি হবু সালোয়ার অবাক মুখে আমাকে টাইপ করতে দেখে গেল মুখের কাছে মুখটি এনে; মসজিদের ভারী পর্দা মুখে আছড়ে পড়ছে;

আকাশ ভেঙে পড়েছে ওদিকে। খুদে গোলাপি কুর্তা পাজামা এসে সরিয়ে নিয়ে গেল; পর্দা!


।।কবুতর খানা।।

এই শহর পায়রাদের শহর; ঝাপট ঝাপট এসে বসবে পুরানো বেলফুলের মতো যোজনগন্ধা স্থাপত্যে। কি যে অপরূপ লাগে!

নিজামের সাতমহলার সামনে ঘুঘু আর পায়রার খুনসুটি। নির্ভয় এত, আপনি পায়ে পায়ে চলে যান ওদের মধ্যে দিয়ে, গুরগুর আওয়াজ করে সরে যাবে অল্প গোল বানিয়ে; যেন স্লেট রঙের জলে ছোট্ট ঢিল পড়ল মাত্র!

হায়দ্রাবাদের কোর্ট প্যালেসটা বড় সুন্দর। তার পাশে একটা আধুনিক ফ্ল্যাট উঠেছে, বিশাল কমপ্লেক্স। তার প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্টে কার্নিশে ব্যালকনি রেলিংয়ে পায়রা ভর্তি গুটুরগু। দূর থেকে দেখলে তাক লেগে যায়!

ছোট্ট ছোট্ট চকে যেখানে সকালে পায়রাদের দানা খাওয়াতে আসেন মানুষ। দানা বিক্রেতার বস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে পায়রা। দোকানি লাঠি রাখেন হাতে হালকা হালকা খুঁচিয়ে তাড়ান, ফের চলে আসে অবাধ্য ছাত্রের মতো। হাতে নিয়ে সরিয়ে দেন, গায়ে মাথায় এসে বসে।

এ শহর পরিন্দের শহর; দেবদূতের!


।।Daruvu Pambala।।

ইয়েলাম্মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিশাল অখণ্ডজ্যোতিটি জ্বলছে পিছনে। সামনের পূজার উপচার গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গোলাপ, ফুলমালা, হলুদ চাল। মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

ইয়েলাম্মার মন্দিরে বাঁধা লালহলুদ সুতো ছুঁয়ে পদ্মাবতী অবধি বলে এসেছেন,
- আম্মা আসছি

এমন সময় ঢাকঢোল সহযোগে রবাহূত একটি দল প্রবেশ করল।গানবাজনা শুরু করতেই হাঁ হাঁ করে তেড়ে এলেন সবুজ ধুতি উত্তরীয় পরা সেবায়েতরা, 
- আম্মা ঘুমোচ্ছে! চুপ চুপ!

ওদিকে ঢোলকবাবু তখন নিজের বাজনা ছেড়ে প্রাণপণে ইউ টিউবের লিঙ্ক দিচ্ছেন 'ভারী চমকে দেব' মুখ নিয়ে!


বাসস্টপে অবশ বসেছিলাম।
এরকম অবশবিবশ, ঘেঁটে ঘ, চটকে চৌদ্দ হওয়া আমার দিনদুবেলার কেস, বক্তব্য সেটা নয়;

সমর্পণ আর বিশ্বাস মানুষের দু'খানি প্রশান্ত মহাসাগর। মানুষ শান্তির খোঁজে দু'বেলা হন্যে হয়ে ঘোরে কেন কি জানি, জ্ঞানপাপ নিয়ে আমিও তো হামেশাই তাই করি।

আসলে নিজের অংশ দিতে অনীহা; নিজেকে ছাড়তে, নিঃস্বার্থ হতে;
পাছে ঠকে যাই; 'আমার আমি'র ভাগে কম পড়ে যাবে তো; পাছে রক্তক্ষরণ হয়! 'আমার' রক্ত বলে কথা!

তাই করেছিলাম; গুটিয়ে নিয়েছিলাম সমর্পণ; বাসস্টপের সৌম্য মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করছিলাম কাছেপিঠের একখানি অদেখা মন্দিরের ঠিকানা; আমাকে যেতে হবেই বলে!

গুণগুণ করে উনি মন্দিরের সাকিনঠিকানা বলে যাচ্ছিলেন।
পকেটে দশ টাকা পড়ে। ডানদিকের আবছায়ায় তাই হাতখানি যখন নড়ে উঠল ছেঁড়া জামাকাপড়ের মধ্যে, বুকে ধড়াস উঠল!

চোখ বুজে ফেললাম; আজ চেও না, আজ কিচ্ছু নেই; ওভাবে চাইলে ফেরানো অসম্ভব হয়ে যায়, দেওয়াও অসম্ভব; ভয়ে ভয়ে চোখের দিকে চাইলাম। হলুদ; নাহ কোনও প্রত্যাশা নেই! হাতের দিকে আবার।

কনুই থেকে হাতখানা উল্টোদিকে ঘুরে গেছে; সম্ভবত কোনও অ্যাক্সিডেন্ট; একটু এপাশ ওপাশ করলেই আপনা হতে নড়ে উঠছে হাত, কনুই থেকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে উল্টোদিকে। আর দুলছে তো দুলছেই, হাতের চেটো বাড়িয়ে। যেন প্রার্থনা! নিজেকে নিমেষে এত ছোট হয়ে যেতে দেখলাম, নিজের সমস্ত সমস্যাকে।

আমি খুব সরি নওলকিশোর, আমার পার্সেন্টেজ ২০০ থেকে শুরু হয়না ঠিকই; কিন্তু ২০০ এর দিকে যেতে ভুল করেনা।

আমি খুব ভালোবাসতে শিখব, প্রমিস।।


।। বানজারা হিলস।।

একখানি রাস্তা পাহাড়ের গায়ে উঠছে হিল্লোরী; পাহাড়ের নাম কেউ বানজারা রাখে? চুয়াচন্দন সব গুল হয়ে যায় এক বদনসিব ভিড়ে শীর্ষেরা সিঁড়ি ফিরে আসে মধ্যম।


।।হালিমের হালুম।।

ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হালিমের দোকান। দোকানের নাম লেখা হালিম জামা পরে শশব্যস্ত সব কর্মচারীরা। ইরানি হালিম, শেহজাদা হালিম, সাউ ঘোষ(এরকমই উচ্চারণ, আই গেস) হালিম।

খুব খুব ব্যস্তর ভিড়ে এক একখানি জ্যামিতিক বেশ বৈঠকি। হাত ধোবার জল দিতে সময় আছে, সাকিন ঠিকানা বলে দেবার, পোজ মেরে ফোটো তোলারও।

- হালিম কে সাথ ম্যায় ভি আউঙ্গা না, ম্যাডামজি?


।।একটি হায়দরাবাদি ভ্রান্তিবিলাস।।

আমি এক অসামান্য অগা! আমাকে বিশ্বাস করবেন না প্লিজ কেউ;
ব্যাগে মাথাটা হাল্কার ওপর ডিজাইন করে ঠুকে নিলুম!

রোজ সকালে চিত্তিরমিত্তির গল্প করি যাঁর সাথে গত বারো দিন ধরে, সেই লোকটি বদলে গেলেও টের পাই না! সকালের চায়ের দোকানের কথা বলছি। যাঁর পানের ইস্তাহার ছেপেছিলাম! একদিন খালি দাড়ি উবে গিয়ে ভারী ক্লিনশেভন দেখানোয় বাহাদুরে হেঁ হেঁ করে বলেছিলাম,

- আরেহ আপনাকে তো ভারী ঝকঝকে দেখাচ্ছে! দাড়িটাড়ি নেই, মনে হচ্ছে মানুষটাই পালটে গেছে!

তিনি একটু অবাক হয়ে কেন তড়বড় করে কিছু বলতে গেছিলেন, এখন বুঝতে পারছি!

থামিয়ে দিয়ে ভীষণ কনফিডেন্ট হেসেছিলুম কিনা!

একজনের গোল মুখ, অন্যজনের চৌকো। একজনের হালকা ফ্রেঞ্চ, অন্যজনের নেই। একজন হামেশা গুনগুন করেন, অন্যজন ভারী সংযত। একজনের পেটানো চেহারা, অন্যজনের ভুঁড়ি আছে!

আজ এইমাত্র চা খেতে গিয়ে ফ্যাক্টটি আবিষ্কার করলুম। তাও সকালে আলিবেগকে ক্যামেরার চোখে দেখেছিলুম বলে একান্তই!

পুনশ্চ:দুই ভাই মিলে এই দোকানখানা চালান!


।।পটচিত্রম।।

মেঘ করে এসে অল্প হাওয়া দিলেও আশেপাশের জিয়োমেট্রি গুলিয়ে ঘরচেনা রঙ দু'তিনখানি দরোজা খুলে যায় ফটাফট; খুব সহজ হয়ে ওঠে চলাফেরা উচ্ছ্বাস। বেশ লঘুপায়ে ইচ্ছেমতো চোখে তাকানো যায় যে কারও দিকে; দম ধরে বেভুল দৌড় দেওয়া যায়।

দিনের বেলা ক্যামেরা অন করলেই তেড়ে আসা চিত্রকরের পাশে থেবড়ে বসে বলে ফেলা যায়, 
- দেখব। ছবিও তুলব!

ভারী তো আর্টিসান! ভারী তো ঐতিহ্য! বড় বড় টার্মিনোলজি; আসলে 'নিয়া মে আয়ে হো তো লাভ কর লো' চালিয়ে বিশ্বসেরা কিছু বিনির্মাণ নামিয়ে ফেলা যায় অবহেলে!

আসলেই মধ্যম গুনে গেঁথে কড়ি টিপে চলেন বেসাতির বাজারে।

পার্সখানা ভুলে এসেছিলাম ওখানেই। ততক্ষণে শান্তি এসে লেগেছে বুকের ঠাণ্ডায়! ততক্ষণে এক দৌড়ে সেখানে, যেখানে লাল আলোয় লম্বা লতানিয়া কাগজফুল দৃশ্যতই গোলাপের চেয়ে বেশি রম্য হয়ে আছে।

দৌড়ে এসে মধুবনী শিল্পী হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন পার্সখানা। ফের এক ছুট লাগিয়েই পিছনে হাঁক শোনা গেল;
হাঁফাতে হাঁফাতে;
- ম্যাডামজি, একবার গিণ লো, প্যায়সা সব সহি হ্যায় না?


।।তারামতীর বারোমাস্যারা।।

আটপৌরে দিব্যকুঁচি গুণে রোজ ত্রস্তদানিতে তিনখানি ধূপ দেখায় শ্রুতনারী; একখানি বুক, জানু আর অভ্যাসে ত্রাসজঙঘা ছুঁয়ে কিঞ্চিৎ।

ওইটুকুই আতর তার, জেনে আঁটোসাটো পরনে দেহ কিছু এদিক কিছু সেদিক করা; মাঝে মোহিনী আট্যম, শাঁখ বাজার আগেই শাঁখ লাগার যা কিছু বিদ্যা অধীত রঙ্গজ, জের বুঝে আঁটোসাঁটো থেকে সমস্ত আটপৌরে ঝেড়ে ফেলে কামিনীকৌশল, পেরেক ঠুকে গাঁথা।

বর্ণবিহ্বল ডাকে কিছু আবছা, সবুজ জলের ওপার সেঁচে; রোজউডের বর্ণসংকট ছিল না কোথাও, ফড়ফড় পাতা উলটে যায় শব্দ করে, নতুন কেনা ব্লাউজের গজকাগজ ফাটার মতো।

আসলে বাদলা করে এলে খড়ের চোঙা বেয়ে যে জল রঙে আসে, ছোট্টবেলায় পেঁপেপাতা ভিজিয়ে রাখা অবাকজাজিম জল।

আসলে বাতাসে পাতারা উলটে গেলে পালটে মাথায় বেবাক হলে; মনে পড়ে পুষ্পবৃষ্টি বাকি অনেক, অনেক ছাদের পরে!

আসলে রাস্তায় না দাঁড়ালে,জ্বলন্ত ...বোঝাই যায় না; এ অঙ্গভরা দৃশ্যদ্রাঘিমা, আসলে নিজস্ব বিষুবই এক; নক্ষত্রকুচি, মালগুড়ি ধাবার পাশে।

এই সমস্ত যে বৈপরীত্য; এই রেবেকা, বিদরি, পটচিত্রম; এই তারামতীর রঙ্গখানা; এই পানের গুমটি, পায়ে কড় আম্মা; কপালে কলাপ হয়ে চতুষ্কোণ সাধু; এসবের মাঝেও অন্য কোনও কল্প আসেনা, অন্য কোনও চ্ছটা।

সব নক্ষত্রঘোরে স্বর্গ বছর বাদে নরক মাস; আদ্যন্ত আভূমি আনভ এক জ্যোতিষ্কের মুখোমুখি নক্ষত্রবাসী হয়ে আছে। যার আশেপাশে পথেরা ঝুঁকে কুঞ্জ হয়ে আছে; নখে মাটি টানলে আকাশ নড়েচড়ে ওঠে।


।।বিদরিশিল্প।।

বিদরের মাটি গিলে কুসুমসম্ভব
দেখো জঙ্গ লেগে যাবে গলায়
জারণ কি সোজা বড়ো?
যা রণ, রণের যা
রেইন(rain)গলগল হারিয়ে যুগবর্ষঅযুত 
মেপেছিলে অনন্ত কালো;
হা আলো হা আলো;

এরে বলে জুড়ে থাকা মাটিসনে।
যাবি কোথায় যা
তোর ব্রহ্মরন্ধ্রে পা!

ইহাই হইল সংক্ষেপে Bidriware।


।।মুসি নদীর দেবী।।

মাথার ভেতরে উপনিবেশ বসে যখন বহিরাগত, রাস্তায় রাস্তায় অসংখ্য প্রার্থনাঘর পেয়ে যাই আমি ঠিক; প্রার্থনাঘরই কেন পাই বলতে পারব না, নতজানু হবার ধর্ম আদৌ তো নিইনি জীবনে!

এ রাস্তায় অসংখ্য মসজিদ, অসংখ্য দরগা, অসংখ্য ইসলামি সবুজ কিছু বাড়ি। এ খানা জলার ধারে অবহেলিতপ্রায়; ঠিক বুঝতে পারিনি কি এটা, তাই পাশেই সংসার সাজিয়ে বসা এক আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম।

আম্মার সংসারের পাশে একখানা লম্বাটে লন, রেলিং দিয়ে ঘেরা; ভেতরে কাগজফুল পর্দা পর্দা নেমে এসেছে। দুখানা ক্রাচ নামানো পাশে, অত্যন্ত হাসিমুখ এক স্নিগ্ধা বসে আছেন ঘাসের কার্পেটে, এদিকেই মিটিমিটি চোখে চেয়ে;

- সিস্টার, জিস নে ভগবান কে ঘর কা পতা বতায়া তুমহে, উস কি ফোটো নহি লোগি?

- হাঁ দিদি, কিঁউ নহি লেঙ্গে? অউর আপ কা ভি।

- তো আ যাও অন্দর

ঢালু উঁচু একখানি মাটির জমিন, ঘাসের গালচে, কাগজফুলের জাফরি, আর দিব্যভাষিণী।

- আয়্যাম হ্যাণ্ডিক্যাপড; খাড়ে হো কে পোজ!

- আপ ছোড়িয়ে না জিজি, অ্যায়সে হি মস্ত আয়েগা! অউর হাম ক্রাচ কো ফ্রেম মে রখেঙ্গে হি নহি। আপ ফুল কে সাথ জাদা আচ্ছি দিখোগি

আঙুলে ফুলের লতা জড়িয়ে পোজ দিতে উদ্যত হলেন সুহাসিনী, এক হাত ওরকম দেখে অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই;

- তোমাকে আশীর্বাদ দিচ্ছি সিস্টার। খুব ভালো হোক তোমার, খুব ভালো থাকো তুমি

ছবি তুলতে তুলতে দেখি ঠোঁট বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেই চলেছেন কিসব।


।।রামোজী ফিল্মসিটি এবং কুলফিম্যান।।

- ১৮ ফিল্ম মে এক্টিং কিরেলি ম্যাম, বলিউড ভি হায়দরাবাদি ভি।আমদানি আট্টানি খরচা রুপাইয়া, ও গোভিন্দাওয়ালা ফিল্ম ম্যাম; অউর রবি তেজা কে সাথ; এক ফোন আত্তা হ্যায়, অউর ইয়ে দু'কান বন্ধ! ৫০০০ মিলতা হ্যায় পার ডে কা, রামোজি ফিল্ম সিটি মে। আপ পুছ লো কিসিসে ভি, সব কো মালুম হ্যায়! ইয়ে আম্মা সে পুছো

- নহি ভাইসাব ঠিক হ্যায়

- নহি আম্মাজি বাতা না, ইধার আও

- নহি ভাইসাব ও টায়ার্ড হ্যায়,ছোড়ো উনকো!

- ইয়ে বাবা কো ভি পতা হ্যায়, হ্যায় কি নহি বাবা

ফেজ টুপিতে সাদা দাড়ি বৃদ্ধ বেশ বিপন্ন!

- অউর হম দোস্ত বন গয়ে না জি, ইয়ে কুলফি কা প্যায়সা মত দো আপ

- নহি ভাইসাব ইয়ে কেয়া

- হম নহি লেঙ্গে

- নহি আপ পকড়িয়ে

- বোলা না দোস্তি! আচ্ছা স্রেফ ১০ রুপেয়া দো।

- ন্নন

- হো গয়া অব আপ পার্স ব্যাগ মে ডাল লো; ফোন নম্বর লে সকতে হো জি।

- ন্ন ন নহি জি সুক্রিয়া


।।রুপোলী তবক।।

খুব মনখারাপি পায়ে ছিটকে বেড়াচ্ছিলাম কাল সন্ধ্যেবেলা।

দৃশ্য ঘটনা সজীব জটিল বেলফুল বেলুন চোখে লেগেও লাগছিল না।
সাঁ করে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গাড়িই ধাক্কা দিতে পারছিল না মাথার ধূসরপ্যাঁচে তো বিস্ময়ের স্পর্ধা কিবা!

বুঝতেই পারিনি পা স্লো হয়ে গেছে নিজে থেকে হঠাৎ একটি গুড়গুড়ি আড়াই ইঞ্চি গোলফ্রক মানুষ পা উঁচু করে মুখ ভয়ানক গোল উদগ্রীব বানিয়ে কি একটা দেখার চেষ্টা করছে! আশেপাশে ভিড় যাচ্ছে যেন স্ট্রিমলাইন কারেন্ট!

তার মাঝে উনি এমন নিমগ্ন; উঁকি থেকে আরো উঁকি হচ্ছে গোড়ালি; আমারই চক্ষু গোল্লা ইন্ডাকশন এফেক্টে!

এবার কানে এল খট খট খট খট। সমান ছেদে পুরানো সিনেমার ঘৌড়দৌড়ের শব্দ।

উনি গাল ফুচকা করে এবার কৌতূহলে ফেটে পড়বেন প্রায়; বাবা মা এসে ড্যানা ধরে তুলে নিয়ে গেল!

এবার আমারই কৌতূহল হলো ব্যাপারখানা কি! দোকানের মালিক দরাজ ডাকলেন,
- আইয়ে জি দেখ কে যাইয়ে। সিলভার পেপার বন রহা হ্যায় ইঁয়াহা।

কারিগর মহা সমাদরে বসালেন। মালিক এসে খুঁটিনাটি এক্সপ্লেন করলেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে;

- এই দেখুন, এটা হচ্ছে আসল রুপো

তাক থেকে পুরানো স্টোরেজ পেড়ে এনে দেখালেন;

- এটাকে আড়াই ঘন্টা লাগাতার পিটিয়ে তবক তৈরি হয়

- দোকানের বরফিতে দেওয়া হয় দেখেছেন, ম্যাডামজি?
কারিগর কাজ সরিয়ে মেঝেতে বসার জায়গা ঝেড়ে দিতে দিতে শুরু করলেন,

- মিষ্টিতে চিনি বেশি হয়ে গেলে ব্যালান্স রাখে এই তবক; হনুমান মন্দিরে দেয় দেখেছেন?

- অউর দেখিয়েগা তাম্বাকুমে ইউজ করতে হ্যাঁয় লোগ; উসসে উসকা স্মেল অউর কড়ওয়াহট কম হো যাতা হ্যায়

দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় একরাশ বেলিফুল দেখে ভেতরের পাম্পমেশিন চলকে উঠেছে উত্তেজনায়! খেয়াল হলো, আরেহ আমি আমার চোখ ফেরত পেয়ে গেছি আজকের মতো।


।।দোস্ত মুহম্মদ।।

- নিজামকো মক্কা মসজিদ মে সমাধি নহি মিলি, ম্যাডামজি।

- অ্যায়সা কিঁউ মুহম্মদ জি?

-আইয়াশ আদমি থে, ম্যাডাম। আইয়াশ সমঝতে হো না আপ?

বলে অটো থামিয়ে উত্তেজনায় পিছন ফিরলেন মুহম্মদ,

- খুল কে এক বাত বোলেঁ, ম্যাডাম জি? আপ কো দোস্ত সার্কল মে মান লিয়া হ্যায় না? খুল কে বোল সকতেঁ হ্যায়?

- জি আপকে দিল মে যো জ্যায়সে আ রহা হ্যায় আপ ওয়সে বোলো। কিসি ভি বাত কা বুরা নহি মানেঙ্গে, প্রমিস!

- ও যো বেগম বাজার সে হো কে আয়ে না হম? ওঁয়াহা নিজাম কে বেগম লোগো কা পট্টি হুয়া করতা থা; ৭২ বেগম থিঁ খাস; এক এক রাত এক এক বেগম। আইয়াশ থা, ইসলাম কে দায়রা হোতা হ্যায় না, ম্যাডামজি, জ্যায়সে আপলোগো মে হোতা হ্যায়, শিখ লোগো মে হোতা হ্যায়; ওয়সে হামারে দায়রেঁ কো কভি মানা হি নহি উসনে! ও যো মেহন্দি গলি দিখায়া আপকো, ও কেয়া হ্যায় পতা হ্যায়? নিজামকে জমানে মে বাহার কে দেশোঁ সে যো লোগ আতেঁ থে, মেহমান, উনকো অগর লড়কি চাহিয়ে হোতা থা তো ইয়ে মেহেন্দি গলি সে লাতে থে। বাহারওয়ালিয়োঁ কি গলি

- মুহম্মদ জি, নিজাম কো কাঁহা সমাধি মিলা ফির?

- হ্যায় ইক জগাহ, চলো দিখাতেঁ হ্যায় আপকো। পাশ হি মে, তিনকোঠি পর্দাঘেরা

জায়গাটা গুগলে 'কিংকোঠি প্যালেস' দেখায় যদিও।




।।দুই।।

-  এক ম্যাজিক দিখায়ুঁ আপকো, ম্যাডামজি?

- কেয়া ম্যাজিক, মুহম্মদজি?

- ইস তিনকোঠি কা দরওয়াজা বাহারবালোঁ কে লিয়ে বন্ধ রেহতা হ্যায়। আপ দেখো, আপন এক টোক মারেগা অউর ইয়ে খুল জায়েগা!

-  না না থাক, বাপরে!

-  না, ম্যাডামজি, এত কথা বললাম আপনাকে, আপনি ভাববেন টুপি পরায়! ইয়ে দেখিয়েগা, তো শক নহি রহেগা।

যত বলি সন্দেহ নেই, কে শোনে কার কথা! অগত্যা মাথা হেলালাম।

-  কিন্তু আপনি ভেতরে আসবেন না কোনওমতে; পাক্কা না? ছেলে হলে ম্যাডামজি কাঁধে চাপড় মেরে ভেতরে নিয়ে যেতাম!

মুহম্মদ জি দৃশ্যতই ক্ষুণ্ণ;

-  না না ঠিক আছে, আপনি যান ম্যাজিক দেখান

অতঃপর মুহম্মদ জি টোকা মারলেন! 

প্রথমে একটি কিশোরমুণ্ড বেরিয়ে এল, পরে একখানি প্রাপ্তবয়স্ক;
হাসিঠাট্টাও হলো। গর্বিত চোরা চোখে এদিকে তাকালেন মুহম্মদ সাহেব। ইশারা করলাম, আমি ম্যাজিকে আপ্লুত, চলে আসুন!

অটোখানি বাঁইবাঁই ঘুরিয়ে দিলখুশ মন্তব্য,

- আমার বন্ধু থাকে ভেতরে, ইনচার্জ। মহিনে কে দো তারিখ মে স্যালারি মিল জায়ে তো হম চিকেন খানে যাতে হ্যায় আপকে উধার।
জমিন কে অন্দর এক প্যালেস হ্যায়, ম্যাডামজি। নিজাম লোগ যব শিকার পে যাতে থেঁ তব ওঁয়াহা রুকতে থে। জানেন ওখানে বসলে অটোর মধ্যে ময়ূর চলে আসে! তোফা জায়গা! দেখাব আপনাকে, খুব কম লোক জানে ওই প্যালেস। হায়দরাবাদ কা অভি আপনে দেখা হি ক্যায়া হ্যায়, ম্যাডামজি!




।।তিন।।

- ম্যাডামজি, আপ অগর অগলে মাহিনে তক রহো না, আপকো প্রিন্সেস সে মিলওয়ায়েঙ্গে! নিজাম ফ্যামিলি কি ওয়ারিশ।

- আচ্ছা, মুহম্মদ জি।

- আপনি বিশ্বাস করলেন না তো? প্রিন্স এসেছিলেন রমজানের মাসে, চৌমহল্লা প্যালেসের সমস্ত নৌকর চাকরদের গিফট দিলেন।রোলস রয়েস গাড়ির জন্য তেল আমার এই অটোতে করেই আনা হয়েছিল, ম্যাডামজি। তবে বখশিশ সব বিছওয়ালারাই খেয়ে যায় বুঝলেন! আপনার বিশ্বাস না হলে ফোনে দেখুন আমার, সাজিদ ভাই ফলকনামা প্যালেস, ফোন লাগান এক্ষুনি! প্রিন্সেসের দেবর হন উনি।

- আরেহ না না, মুহম্মদ জি, আমি অবিশ্বাস করব কেন? একি!

- প্রিন্সেসের সাথে মুলাকাত করিয়ে দেব, ম্যাডামজি, আপনার।
আর রোলস রয়েজের গল্পটা জানেন তো? এই যে এবিডস দেখছেন;
হ্যাঁ,  এবিডস এর গল্পটা শুনুন। তখন অ্যালবার্ট অ্যাবিড এর দোকান ছিল এখানে, খুব বিখ্যাত দোকান, ম্যাডামজি। ওদিকে রোলস রয়েজের মাত্র তিনখানি মডেল তৈরি হয়েছে সদ্য। তো নিজাম বসে চৌমহল্লা প্যালেসে, আর কর্মচারীকে টাকা দিয়ে পাঠালেন রোলস রয়েজ কিনতে এখানে। সে তো খুব অপমানিত হয়ে ফিরে এল! 'তোমার কেনার অউকাদ কি' - এসব শুনে টুনে।

নিজাম পুরো ঘটনাটা শুনে কি করলেন জানেন, রোলস রয়েজ কিনলেন তো বটেই; তবে তাতে করে কেবলমাত্র আবর্জনা ফেলা হতো নিজাম প্যালেসের! বোলে তো 'কচড়া গাড়ি', ম্যাডামজি।

এসব শুনেটুনে গাড়ি মেকাররা এসে করজোড়ে ক্ষমা চাইল নিজামের কাছে। আর একখানা সোনা রূপোর কাজ করা রোলস রয়েজ উপহার দিল! পার্সোনাল গিফট, ম্যাডামজি। ওই গাড়িরই তো তেল আমার এই অটোতে করে;

মনে পড়ল, মিউজিয়ামে গাইডও এরকম কিছু বলছিলেন বটে।মেহবুব আলি খান, বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ওয়র্ড্রোবের মালিকানা যাঁর, সেই প্রিয়দর্শন নাকি রোলস রয়েজে করে আবর্জনা টাবর্জনা ফেলাফেলি করতেন!


।।জ্যান্ত মাছ থেরাপি।।

মুহম্মদজির সাথে দেখা করার কথা ছিল গত হপ্তায়। কাজ না বাগাতে পারার অসামান্য ট্র‍্যাক রেকর্ড আমার, স্রেফ ডিসট্র‍্যাক্ট হয়ে যাওয়ার দৌলতে! সাথে সাথে শরীরখানাও খুব সহবত দেখাল, যা হোক!

ফোনে না পেয়ে তাই মুহম্মদজির সম্ভাব্য ডেরায় গিয়ে হানা দিলুম।ফোন করতেই দশ মিনিটের মধ্যে এসে হাজির! 

- ম্যাডামজি, আপনে বতায়া নহি আজ আনেওয়ালি হো! পর জবান দিয়া হ্যায় না, দশ মিনিট মে ছোড় কে আগয়া দেখো! পতা হ্যায় ৪০০০০ লোগোঁ কে ভিড় বনা হুয়া থা জাঁহা থা ম্যায়। কিন্তু এই অড টাইমে কি দেখাব আপনাকে, ম্যাডামজি?

- এক কাজ করুন মুহম্মদজি, আপনি যেখানে ছিলেন সেখানেই নিয়ে চলুন; আপনার ভাড়া খাটাও হবে আমার দেখাও।

- সেই ভালো ম্যাডামজি, চলুন যেতে যেতে গল্প শোনাই আপনাকে।
এখানে অ্যাজমা, বাতের ব্যথা এসবের অদ্ভুত ওষুধ দেওয়া হয়! বর্ষার শুরুতে মিরিক লাগে, ম্যাডামজি। তো ছোট ছোট মাছের মুখে ওষুধ দিয়ে সেই মাছ জ্যান্ত গিলে ফেলতে হয়। কাতারে কাতারে লোক আসে সেই জ্যান্ত মাছ খেতে!


।।নিজাম ভার্সাস কুতুবশাহী।।

হায়দরাবাদ আদৌ নিজামের শহর না। জায়গীর হতে পারে, হৃদয় বা স্বপ্ন বা নির্মাণ না! 

হায়দরাবাদ কুতুব শাহীর খাসগোলাপ! নিজামরা নিতান্তই নাগরার ডগায় দখল নেওয়া বহিরাগত মাত্র!

তারপরে ভালোবাসা কিভাবে আকার নিয়েছে, কিভাবে এ শহরের জমিনে মিনারে রাস্তায় ফলকে গেঁথে গেছে নিজামদের নাম, সে একমাত্র জানে অধিকৃত আর মধ্যবর্তী অধিকার।

দুই প্রেমিকের মধ্যের গল্প অন্তর্বাহী বাতাসও টের পায় না বলে প্রবাদ। প্রেম আর দখলদারের অত্যাচার।।

তাই সেসব অনুমান শিকেয় তুলে আপাতত নেমে পড়া যাক হায়দরাবাদি রাস্তায় চকে;

'বারাদরি' মানে সেই মহল, যার বারোখানা দুয়ার থাকে।

কুতুবশাহী শাসনের বোধহয় একমাত্র টিকে থাকা নিশানা এ শহরের বুকে, এই 'গোঁসামহল বারাদরি'। মহিলাদের গোঁসাঘর ছিল এককথায়। শেষ কুতুব শাহী শাসক সুলতান আবুল হাসান তানা শাহ ১৬৮৪ সালে এই মহল বানান।

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য জয় কুতুবশাহীদের আর সমস্ত স্থাপত্য সৃষ্টি গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে, কেবল এই মহলটি বাদে। দক্ষিণে মুঘল হেডকোয়ার্টার ছিল এই প্যালেসটি।

প্রবাদ, এই মহল থেকে গুপ্ত সুড়ঙ্গ চলে গিয়েছে চারমিনার গোলকুণ্ডা এবং শহরের অনেক অন্যত্রে।


।।মেহবুব কি মেহেন্দি।।

সেকালের বেশ্যা আর একালের বেশ্যার মধ্যে প্রভেদ অনেকখানিই।

সম্মান তো ছুতোরের বিদ্যুৎ, চোখ ঝলসে যাবার আগে অবধি টের পাওয়া যায় না, কার ছিল, কে পেল আর কে দিল! আর চোখ ঝলসে যাবার পর বালতিউপুড় কাল্পনিক রঙীন, তার মান আর হুঁশ দুইই নিক্তি হারিয়ে ফেলেছে!

মুহম্মদজির 'মেহেন্দি গলি' সেকালে 'মেহবুব কি মেহেন্দি' ছিল।গলিটার নামই ছিল এতখানি রম্য!

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের আগে অবধি খুব সমাদরের জায়গাই ছিল এই মুজরা জয়েন্টটি। এবং একটু কম অসম্মানের। 'মেহবুব শুভানির চিল্লা' থেকে এই গলির নাম 'মেহবুব কি মেহেন্দি'।

এক অসামান্যা নারী থাকতেন এই গলিতে, সেই মরচেগন্ধী আতর জমজম হায়দরাবাদি সময়ে। নাম ছিল মাহ লাকা বাঈ বা চন্দা বিবি।
ইনি সেসময়ের নামকরা উর্দু কবি এবং ফিলানথ্রপিস্টও ছিলেন, বেশ্যার পাশাপাশি। ১৮২৪ সালে তিনিই প্রথম মহিলা কবি (কথাখানাকে যেভাবে পারেন চিবিয়ে খান বা মাথায় দিন) হিসেবে 'দিওয়ান' লাভ করেন তাঁর লেখার জন্য। তাঁর গজলসমগ্র ছাপা হয় 'গুলজার-এ-মাহ লাকা' নামে। হায়দরাবাদের নিজাম তাঁকে 'ওমরাহ' উপাধি দেন।

১৯৮০ সালের পর থেকে জায়গাটা একালের বেশ্যাভূমে পরিণত হয়, অর্থাৎ লালবাতি এলাকা। ১৯৯৬ সালে পুরো এলাকা খালি করে দেওয়া হয়। তার পরের কিছু খবরাখবর আপাতত জানা নেই। 'Prajwala' নামের এনজিও এই সব সেক্স ট্র‍্যাফিকিং এবং ছোট বাচ্চাগুলোর পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে আপাতত।


।।কবি মাহ লাকা এবং দক্ষিণী।।

কবি এবং বেশ্যা মাহ লাকা চন্দা উর্দু ভাষার এক সন্ধিক্ষণে জন্মেছিলেন। 'দক্ষিণী' হলো দাক্ষিণাত্য মালভূমির নিজস্ব উর্দু।সেসময় হায়দ্রাবাদের স্ট্রিট ল্যাঙ্গোয়েজ ছিল দক্ষিণী। দক্ষিণীর মধ্যে অন্যান্য ভারতীয় স্টেটের ভাষাগত ছোঁয়াচ লক্ষ্য করা যায়। বহুল পরিমাণে মারাঠি, কোঙ্কণী, কন্নড়, তেলুগু প্রভাব রয়েছে এই উর্দুতে। দাক্ষিণাত্যে উর্দুকে বয়ে নিয়ে আসেন আলাউদ্দিন খলজি।পরে পরে অত্যন্তড়বড় প্যাশনে যখন মুহম্মদ বিন তুঘলক দৌলতাবাদে শিফট করেন রাজধানী, উর্দু আরও গাঢ় হয়ে বসে দক্ষিণে। অত:পর বাহমনি সাম্রাজ্যের উল্কাউত্থান। এবং তাঁরা দৌলতাবাদকে রাজধানী বানিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেন। সেখান থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় বিদরে এবং সো অন। শো অন।

উর্দু দাক্ষিণাত্যের রুহ রুহ গেঁথে যেতে থাকল। এই ভাষাকে 'জবান হিন্দুস্থানী', 'দেহলভি' ইত্যাদি নামেও ডাকা হতো। প্রচলিত উর্দু বা 'রেখতা' ভাষার গঠনেও দক্ষিণী বলার মতো ছাপ রেখে গেছে। সূফীরাই প্রথম লিখিতভাবে দক্ষিণীর ব্যবহার চালু করেন। কবি মাহ লাকা যে সময়ে জন্মান, সে সময় এই ভারতীয় দক্ষিণী উর্দু ক্রমশ ভারী পার্সিয়ান শব্দে ভরে যাচ্ছিল। ওঁর লেখা কবিতাগুলি তাই ভারতীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের অদ্ভুত টলটলের স্বাক্ষর বহন করছে সর্বাঙ্গে।


।।হায়দ্রাবাদ।।

মুসি নদীর বুক এতখানি মজে গেছে জায়গায় জায়গায় যে সেখানে ছাঁচবেড়া লাগিয়ে বসতি উঠে গেছে অস্থায়ী। হায়দরাবাদ নতুন কাঁসার পিরিচদানিতে এক কণা ধুলো জমতে দেয় না কিম্বা দশক কিছু পুরানো। নদী নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই! ও আছেই, থাকবেই। বুক ও পেতে দেবে ঠিক চাইলে সময়াসময়।

হায়দরাবাদ নতুন কনস্ট্রাকশনের ভিত বাঁধে কোন নয়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে। হায়দরাবাদ গোলকুণ্ডার গ্রানাইটকে বৃষ্টির জলে ক্ষয়ে যাবার অগাধ পরোয়ানা দিয়ে দেয়।ঘাঘরা চোলির শিশু হাঁফায় রোদ্দুরে; আঁচল মায়ের স্তনবিভাজিকা সামলাতে ব্যস্ত। বোরখার শিশু অবিন্যস্ত ঘুমিয়ে পড়ে কাঁধে। বৃষ্টি এসে নিটোল ভাঁজের পা জুড়ে রিনিঝিনি নকশা কাটে। শিশুরোম জাড় পেয়ে শিউরে শিউরে ওঠে। বোরখার আঁচল নেই! 

হায়দ্রাবাদ!


।।পরিশেষে বলিউড।।

রোজ সন্ধ্যায় কথক হয়ে যান অমিতাভ। আজ্ঞে, অমিতাভ বচ্চন।গোলকুণ্ডার পরিত্যক্ত গ্রানাইট থেকে তার গর্ব অহঙ্কার ঐশ্বর্য খোদ ঔরঙ্গজেবের জিঘাংসাও মেটাতে পারেনি, বলিউডের শাহেনশাহকে রোজ টেনে নিয়ে আসে অসামান্য ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রিয়দর্শন ভগ্নস্তূপে।

সময়ের চোখে চোখ রেখে তারামতীর প্রেমকাহিনী শোনায় হলুদ স্তম্ভেরা, কুচিপুড়ীর উত্থান, সন্ত রামদাসের বিশ্বাসের গাথা। ভাঙা খণ্ডহর আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। ভগ্ন ফোয়ারার পাশে ফুলকি মেরে ওঠে আলোর কোহিনূর হীরে। দর্শকের রোম রোম শিহর হয়ে যায়।

ছবি তোলা বারণ গল্প চলাকালীন। দু একটি বাচ্চা ইতিহাসের গুরুত্বকে চঞ্চল পায়ে লাথিয়ে ঘোড়ার খুরের উৎস জানতে চায়, রীতিমতো গলার শির ফাটিয়ে। আশেপাশের বড়োরা বিরক্ত হন। কখনও ফোনের লাইট জ্বালিয়ে মুখে মারে পাশের চেয়ারাসীনের। বড়ো খানখান কান্নায় একটি ছোট বাচ্চা জ্বালিয়ে চলেছিল দর্শক শ্রোতাদের। মা বিরক্ত হয়ে তাকে কোলে নিয়ে উঠে চলে যেতে গেলেন শশব্যস্তে। কাঠের পোডিয়ামে হোঁচট খেয়ে হঠাৎ বাচ্চা ছিটকে পড়ল মাটিতে। আর খণ্ডহর ফাটিয়ে কান্না!

সমস্ত দর্শক হাঁহাঁ উঠে দাঁড়ালেন। বাচ্চা সহ মা কে তুলে ধরলেন।

অমিতাভ একা প্রলাপ হয়ে গেলেন পরের পাঁচ মিনিট। নাহ, ইতিহাস সংস্কৃতি বৈভব বর্তমানের প্রতিস্থাপক হয় না আর যাই হোক।

মানুষের প্রতিস্থাপক হয়না। যদ্দিন নতুন মানুষ বইবে এই শহরের বুকে, হায়দ্রাবাদের জার্নাল শেষ হবে, সাধ্য কি!


0 comments: