2

ছোটগল্প - অনিমেষ ভট্টাচার্য্য

Posted in


ছোটগল্প


কদম ফুল
অনিমেষ ভট্টাচার্য্য



রাজুদা ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজাতেই সব্বাই হই হই করে বেরিয়ে পড়ল ইস্কুল থেকে। হলুদ রঙের একতলা বাড়িতে সাকুল্যে ছ’টা ঘর। চারটে ক্লাসরুম আর বাকি দু'টো অফিসকাছারি আর শিক্ষকদের জন্যে। গেল বার পঞ্চায়েত থেকে একটা টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছে। ইস্কুলের সামনের মাঠের একধারে। আশেপাশে দু'তিনটে সোনাঝুরি গাছও লাগানো হয়েছিল তখনই। সেগুলোও এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। হালকা ছায়া ছায়া ভাব। আর তাছাড়া, উল্টো দিকের দিঘি থেকে সবসময় একটা শীতল ঢেউ আসে। সেইখানে এখন ছেলেমেয়েদের ভিড়। সব্বার একসঙ্গে জল তেষ্টা পেয়েছে। কেউ কেউ আবার কল টিপতে খুব উৎসাহী। হাতলের উপর শরীরের পুরো ভর দিয়ে জোরসে শূন্য থেকে লাফিয়ে কল টিপেই যাচ্ছে বুবুন। সবার জল খাওয়া হয়ে গেলে ব্যাগ থেকে একটা স্টিলের গেলাস বের করে তাতে জল ভরবে, তারপর সেটা খেতে খেতে, গলায় মুখে মাখতে মাখতে বাড়ি ফিরবে।

ভাদ্র মাসের বেলা। মোরাম বিছানো রাস্তা এগারোটা বাজতে না বাজতেই তেতে ফাল। অভিভাবকদের পরামর্শেই সকালে ইস্কুল হচ্ছে মাসখানেক ধরে। মাস্টারদেরও সুবিধে। ছুটি দিয়ে দুটো জলমুড়ি খেয়ে মাঠে যেতে পারে। বর্ষার ধান এবারে বেশ ভালোই হবে মনে হয়।

রাজু চুল-টুল আঁচড়ে সাইকেল নিয়ে বেরোল। বারোটার বাসের কন্ডাক্টর সে। ভাত খেয়েই রওনা দেবে। রাস্তায় বুবুনকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে বুবুন, শুনলাম তুই অঙ্কতে রসগোল্লা পেয়েছিস!”

বুবুন ঢোক গিলে ঘুরে তাকাল। পাশের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে হালকা বাতাস দিচ্ছে। বুবুনের ফিনফিনে চুল উড়ছে তাতে। পরণের জামাটা পুরোটাই বেরিয়ে এসে হাঁটু অব্দি ঝুলছে। নাক ঘষে বুবুন বলল, “কি! কে বলল তোকে? ওই ব্যাটা বিশু নিশ্চয়ই!”

“যা তুই আজ বাড়ি। তোর হবে! এতক্ষণে বিশু হয়তো রানু কাকিমাকে বলে-ফলে দিয়েছে!”, বলে একগাল হেসে রাজু সাইকেল নিয়ে ধাঁ করে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল।

“আমি তো দুই পেয়েছি! গোল্লা পাইনি। ...বিশু গুল দিয়েছে!”, বুবুন মরিয়া হয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির দিকে দৌড় দিল।






সন্তর্পণে বাড়ির দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল বুবুন। ও জানে আজ বাবা-ঠাম্মা কেউ বাড়িতে নেই। ঠাম্মাকে নিয়ে বাবা চৌহাট্টা গেছে চোখ দেখাতে। কাল রামায়ণ পাঠ করবে বলে মহাভারত নামিয়ে বসেছিল। চোখটা পুরো গেছে। মা বোধহয় এখন দুধ দোয়াতে গিয়েছে। এই সুযোগ চুপি চুপি পরীক্ষার খাতাটা লুকিয়ে রাখার। 

হলে কি হবে, বড় ঘরের দরজা ঠেলে যেই ঢুকতে যাবে অমনি দেখে সাক্ষাৎ মা জননী, বড় ঘরে বসেই চাল মাপছে।

“বুবুন এলি?”, পাই-এ করে বাটিতে চাল তুলতে তুলতে রানু বলল।

“এগুলো কী চাল,মা? রত্না না মিলের চাল?”, বুবুন ভাব জমানোর অদ্ভুত চেষ্টা করল।

“ভাতের চাল। শুনলাম তোদের কাল ধানা মাস্টার নাকি অঙ্ক পরীক্ষা নিয়েছিল?”

বুবুন এই অব্দি শুনেই ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে সোজা বাইরে উঠোনে। সেখান থেকে বলল, “দেখো দিকি আক্কেল। এভাবে দুমদাম কেউ পরীক্ষা নেয়? পরীক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।”, বড়ো শব্দটা কালকেই কোথায় একটা পড়েছে।

“কিন্তু তুই ছাড়া আর কি কেউ শূন্য পেয়েছে?!”, ঘর থেকে বেরিয়ে রানু নিজমূর্তি ধারণ করেছে। ডান হাতে চালের বাটি। বাঁ হাতে চাবির গোছা। চোখ রাগে ঠিকরে বেরোচ্ছে। কপাল বেয়ে শালিমার তেলের সঙ্গে ঘাম মিশে গড়াচ্ছে।

“আ ...আমি শূন্য পাইনি। ...দুই পেয়েছি! বিশুটা গুল দিয়েছে তোমায়। আমি ওর পেনের কালি শেষ করে দিয়েছি বলে বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলেছে, মা!”, শিউলি গাছের নীচে ভয়ে এইটুকু হয়ে গেছে বছর সাতেকের বুবুন।

“দুই পেয়েছিস! লোকের পেন নিয়ে ফুটানি হচ্ছে! কেন রে তোকে তোর বাবা পেন কিনে দেয় না?”, রাগে কটমট করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল রানু। ভাত বসাতে দেরি হলে আবার শাশুড়ি ফিরে এসে প্রলয় বাঁধাবে। বিধবা মানুষ, একবেলা সময়ে ভাত না পেলে হলো-

“আমি তো আমার পেনটা মৌ'কে দিয়েছিলাম। এখনও ফেরত দেয়নি!”, বুবুন হঠাৎ দেখল উঠোনে মা আচার রোদে দিয়েছে। পা টিপে টিপে শিশিটার দিকে গেল।

আন্দাজ করতে পারেনি শিশিটা রোদে অতটা গরম হয়ে গিয়ে থাকবে। কাজেই, হাতে নেওয়ার পরমুহূর্তেই ছ্যাঁকা লেগে সেটা অসাবধানতায় হাত থেকে পড়ে গেল। ঢাকনা খুলে আচার গোটা উঠোনময় হয়ে গেল! বুবুন ঠকঠক করে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে “শিশিটা ভাঙলি তো!!” বলে রণচণ্ডী রানুকে বেরিয়ে আসতে দেখে পাঁই পাঁই করে দৌড় লাগাল বুবুন। গোয়াল ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে দে ছুট!






বেশ কিছুক্ষণ ছুটে বেচারা ক্লান্ত হয়ে গেল। সকাল থেকে কি ধকলটাই না যাচ্ছে তার। কিছু খেতেও পায়নি। আচারটাও হাতছাড়া হয়ে গেল।

“কাঁদরের দিকে কোথা চললি রে বুবুন? পেয়ারা খেতে?”, ষষ্ঠীতলার টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে ফিরছিল বাসন্তি কাকি।

“পেয়ারা! কোথায় আছে গো, কাকি?”, জিজ্ঞাসু নয়নে বাসন্তির দিকে তাকাল বুবুন।

“ওই তো, সুবলদের আলুর ভুঁইের পাশেই তো। কত্ত পেয়ারা। কাল আমার রাহুলের বাবা দশটা নিয়ে এসেছিল-”, বলে সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ষষ্ঠীতলার গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সূর্য তখন প্রায় মাঝগগনে।

বুবুন মনে মনে হিসেব করল, সুবলদের ভুঁই মানে নদীর ওদিকে। বেশ খানিকটা বটে। এখন বাড়ি গেলে কপালে খুন্তি নাচছে। তার চেয়ে যাওয়াই যাক।

বুবুন আবার দৌড় লাগাল।

পালেদের বড় ছেলে মোষ নিয়ে ফিরছে ক্ষেত থেকে। নামোপাড়ার পুকুরে চান করার ভিড়। কাঠের মিস্ত্রি সনৎ, কাজ থামিয়ে তেঁতুল তলায় বসে বিড়ি টানছে। সমীরদের কলা গাছে মনে হয় হনু এসেছিল। সব কেমন ভেঙে চুরে গেছে। বুবুন কখনও জোরে কখনও আস্তে দৌড়চ্ছে।

বেশ অন্যরকম একটা ভালোলাগা মনে ধরেছে তার। কানের পাশ দিয়ে গাছ গাছালির সবুজ, পাখিদের ডাক সব বুঝতে পারছে। একটা করে পা ফেলছে আর প্রকৃতি যেন নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরছে তার সামনে। গোপালদের পুকুর পাড়ে হাঁস চরছিল। বুবুনকে আসতে দেখে সদলবলে জলে নেমে গেল। তাই দেখে বুবুনের কি হাসি! যাক, কেউ অন্তত বুবুনকে ভয় পায়।

কাঁদরে জল কম। হেঁটেই পেরিয়ে গেল। বিনোদদা সাইকেল বগলে সাঁইথিয়া থেকে ফিরছে। ব্যাগে একটা বড় কাতলা মাছ চোখে পড়ল।






সবই তো হলো। কিন্তু, গাছটা যে বড্ড উঁচু। পেয়ারার ডাল দূরে থাক, একটা পাতাও নাগাল পাচ্ছে না সে। আর এই অবেলায় জমিতেও কেউ নেই, যে তাকে বলবে পেড়ে দিতে। থাকার মধ্যে এক বুবুন আর ওই পাশের জমিতে একটা কাগতাড়ুয়া। দু'জনেই সমান বেকুব।

খান কতক ঢিল ছুঁড়ল। তাতে প্রথম প্রথম কিছু পাখি উড়লেও এখন আর কিছুই ঘটছে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগল বুবুনের। পেয়ারা গাছের ছালগুলো টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বাড়ির কথা মনে পড়ল।

“এই কে রে ওখানে!”, হঠাৎ দেখে একটা লম্বা মতন লোক গাছটার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা পাতলা জামা। পায়জামাটা ছোট। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপার লোকটার ছায়া পড়ছে। তার মানে ব্রহ্মদত্যি নয়। বুবুন জানে এই সমস্ত গাছে অনেক সময় ব্রহ্মদত্যি থাকে। বুবুনরা ব্রাহ্মণ হলে ও'ও বড় হয়ে ব্রহ্মদত্যি হতো।

“তুমি কে?”, সাহস ভরে প্রশ্ন করল বুবুন।

“আমার নাম শঙ্কর। তুই কে?”, ছেলেটা বুবুনের দিকে দু'পা এগিয়ে এল।

“আমি বুবুন। থাকো কোথায়?”, একটুও ভয় না পেয়ে বুবুন বলল।

“ শিবগ্রাম। এখান থেকে ক্রোশ খানেক। তোকে তো এদিককার মনে হছে না। কী চাই?”

“পেয়ারা। খুব খিদে পেয়েছে-”

ছেলেটা আর বাক্যব্যয় না করে তরতর করে গাছে উঠে একসঙ্গে পাঁচটা পেয়ারা পেড়ে নেমে এল। বুবুন তো অবাক। এভাবে গাছে চড়তে পারলে এতদিনে বিশুদের বাগানবাড়ি ফাঁকা করে দিত সে।

তারপর দু'জন মিলে গাছতলায় বসে পেয়ারা খেতে লাগল। গল্প করতে করতে বুবুন জানতে পারল, ছেলেটা বাঁশি বাজায়। ওদের যাত্রার দল আছে। নদীর ধার দিয়ে বেশ খানিকটা গেলে একটা গাঁ আসে। গুপিনপুর। ওখানে ভালো বাঁশি পাওয়া যায়। শঙ্কর ওদিকেই চলল। ঢিবি থেকে একটা বাচ্চাকে ঢিল ছুঁড়তে দেখে নেমে এসেছে।

ভালোই হল। বুবুনের এদিকটা মোটামুটি জানা। দুজনে মিলে আরও গোটা দশেক পেয়ারা নিয়ে হাঁটতে লাগল। নদীর ধারে ওই উঁচু রাস্তাটাই দক্ষিণ দিক বরাবর গুপিনপুর গেছে আর উত্তর দিকে সাঁইথিয়া। ঢিবি থেকে নামলে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে শুধুই ময়ূরাক্ষী।

হাঁটতে হাঁটতে জল তেষ্টা পেল দুজনেরই। সাবধানে পা টিপে ঢিবি থেকে নীচে নদীর দিকে নামল। এখানে আবার একটা ছোট্ট পুকুর আছে। বুবুনও জানতো না। আর সেখানে অনেক শালুক ফুটে আছে। নদীর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে নদীতে গেল ওরা।

“ওই যে মন্দিরের চুড়ো দেখতে পাচ্ছিস, ওইটে শিবগ্রাম। আমি তো নদী পেরিয়েই এলাম।”

“ওটাই শিবমন্দির। যেখানে মেলা বসে বললে?”

“হ্যাঁ। চড়কের মেলা। খুব ধুম হয়। কেত্তন হয়, যাত্রা হয়, অর্কেস্ট্রা ... সব বসে।”

দুজনে খুব খানিকটা জল খেল, বালি সরিয়ে। আশ্চর্য বেশ – বালিটা কি ভীষণ গরম। অথচ, জল দ্যাখো... কি মিহি ঠাণ্ডা। এবারে তাও বর্ষা ভালোই হয়েছে, তাই নদীতে জল আছে। আরবারে তো পুরো বালি আর বালিতে ঢাকা ছিল।

বাঁ দিকে, দূরে একটা ঘাটে দুটো নৌকা বাঁধা চোখে পড়ল। কিন্তু মানুষজন নেই কোথাও। ক'টা বাজছে কে জানে!

চোখে মুখে জল দিয়ে ওরা উঠে দাঁড়াল। আর আর্ধেক মাইল মতো। ওই রাস্তা ধরিয়ে বুবুন বাড়ি ফিরে যাবে। গুপিনপুর ঢোকার আগেই ডানদিকে একটা বলখেলার মাঠ পড়ে। ঢিবির উল্টোদিকে। ওইটে দিয়ে গেলে সোজা হবে বুবুনের।

ফেরার সময়, শঙ্কর হঠাৎ পুকুরে নেমে পটাপট তিনটে শালুক তুলে বুবুনকে দিল। সত্যি, শঙ্করের মতো মানুষ হয় না। কি ভালো ছেলে! অঙ্ক করে না, পেয়ারা খায়, বাঁশি বাজায়। সব থেকে বড়ো কথা, ভালো ভালো গল্প বলে। এখনও অব্দি জিলিপির গল্প বলেছে, কচ্ছপ মাছরাঙার গল্প, তারপর ওই ভাদুগানের গল্পটা যেখানে মেয়েটা ভাদুমায়ের দেখা পাবে এরকমই মাঠে ঘাটে। ওটাই ওর সব থেকে ভালো লেগেছে।

বুবুন কোনওদিন ওর দাদুকে দেখেনি। জন্মের আগেই কোথায় একটা পালিয়ে গেছিল। ঠাম্মার ঘরে ছবি দেখেছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে কেউ জানে না। ঠাম্মা তো দিব্যি পুঁটি মাছ খায়, চুনো মাছের টক ...সব খায়। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। ভাদু মায়ের মতো যদি হঠাৎ করে দাদুর দেখা পেয়ে যেত বুবুন, কি ভালোই না হতো। কিন্তু, একটা সমস্যা আছে। কী করে চিনবে বুবুন!?

দাদুর ছবিটাও ছোটবেলার। এখন দাদু নিশ্চয়ই সন্নিসি কাকার মতো হবে। সব দাড়ি সাদা। শোনপাপড়ির মতো।

“কী রে, বুবুন, কী ভাবছিস?”, শঙ্কর ওকে আরেকটা পেয়ারা ভেঙে দিল।

“হুঁ? না, কিছু না।”, বুবুন হাত বাড়িয়ে পেয়ারা নিতে গিয়ে অবাক হয়ে শঙ্করের দিকে তাকাল। এতক্ষণ ওর মুখটা ভালো করে দেখেইনি। দাদুর যে ছবিটা ঠাম্মার কাছে আছে, তার সঙ্গে খুব মিল ! কপালটাও বেশ চওড়া। কিন্তু, শঙ্করের একটাও দাড়ি পাকা নয়। তাহলে ! 

“বুবুন, তোকে একটা জিনিস দেব, নিবি?”, বুবুনের চিন্তায় ছেদ পড়ল। আবার কী জিনিস দেবে ছেলেটা!






“সেই তখন থেকে বুবুন বাইরে!! কি যাতা বলছ!”, শ্যামলকে উত্তেজিত দেখাল। বেশ উত্তেজিত। চৌহাট্টা থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ হল। ডাক্তার, বৃদ্ধা জ্ঞানদাকে একটা চশমা করিয়ে দিয়েছেন। তাতেই বেশি দেরি হলো। এদিকে দিঘি পেরোতে না পেরোতেই শুনেছে বুবুনকে পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা গ্রামে বুবুন নেই।

রানু তো কেঁদে-কেটে অস্থির। রান্না ভরা আছে। কিচ্ছু খায়নি। একবার করে সুবলদের বাড়ি যায়, একবার বিশুদের বাড়ি। কিন্তু কোথাও বুবুনের কোনও পাত্তা নেই। বাসন্তির সঙ্গেই যা শেষ দেখা হয়েছে। এর বেশি কিছুই জানা যায়নি। গাঁ ঘরে সবাই ঘুমোচ্ছে। এখন কে যাবে নদীর দিকে বুবুনকে খুঁজতে।

“ভালো করেই জানো, আমাদের ঘরে পালিয়ে যাওয়াটা রক্তে আছে। আমার দশ বছর বয়েসের সময় বাবা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। যাত্রা-যাত্রা করে! আজও ফেরেনি। ...পাঠশালা থেকে আমি পালিয়েছিলাম। পুরো একদিন পর ফিরেছিলাম। বুবুন এমনিতেই বাচ্চা। এখন কোথায় খুঁজি বলো তো! ”

“তারপর যা দিনকাল পড়েছে। ছেলেধরা কম নাকি এখন!”, বৃদ্ধা আয়নার সামনে চশমা ঠিক করতে করতে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।

এহেন চরম দুশ্চিন্তায়, পিঁড়েতে পা ছড়িয়ে রানু সুর করে কাঁদতে বসে গেল। পুরোনো দম দেওয়া ঘড়িতে চারটের ঘণ্টা পড়ল। ঢং...ঢং...ঢং...ঢং...!

সঙ্গে সঙ্গে খিড়কি দরজা দিয়ে সুরুৎ করে কে একজন একছুটে জ্ঞানদার ঘরে ঢুকল। জ্ঞানদা তখনই সবে চশমাটা নিরীক্ষণ করার জন্য ভাদু গানের বইটা খুলে মাটিতে বাবু হয়ে বসেছে। 

“এবার সব পষ্ট দেখতে পাচ্ছ, বলো ?”

জ্ঞানদা চোখ তুলে তাকালেন। “কোথায় ছিলিস তুই, হতচ্ছাড়া!”

“আস্তে! আস্তে! চেঁচিও না! শোনো তোমার লেগে একটা জিনিস এনেছি।”, বুবুন ফিসফিস করে বলল।

জ্ঞানদা কেমন রহস্যের গন্ধ পেয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাল। “কী বটে?”

বুবুন ওর জামার পকেট থেকে একটা মিইয়ে যাওয়া কদম ফুল রাখল সামনে। “তুমি কদম ফুল খুব ভালোবাসো, তাই না ঠাম্মা ?”

বৃদ্ধা অবাক হয়ে ফুলটা তুলে নিতে নিতে বললে, “হ্যাঁ। তুই কী করে জানলি? আর এখন এই ফুল তুই কোথায় পেলি?”

“কেমন ? সুন্দর না? শঙ্কর দিয়েছে। বলল, ‘ঠাম্মাকে দিস। খুব খুশি হবে। কেউ তোকে বকবে না, দেখিস।’... আমিও অমনি নিয়ে নিলাম।”

“শঙ্কর? কে শঙ্কর?”, বৃদ্ধার চোখে বিস্ময় ক্রমশ জমাট বাঁধছে।

“আরে ওই শিবগেরামের শঙ্কর। যাত্রা করে। ...ওই যে, দাদুর যে ছবিটা আছে। অনেকটা ওইরকম দেখতে। লম্বা... খুব ভালো গাছে চড়তে পারে ...” , বুবুন বলে চলল –

“শঙ্কর ...যাত্রা ...সে কি বাঁশি বাজায়?”, জ্ঞানদার হাত'পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শিরার ধুকপুক কানে শুনতে পাচ্ছে।

“হ্যাঁ। তুমি কী করে জানলে? চেনো নিশ্চয়ই। শঙ্কর ঠিকই বলছিল। তুমি ওকে চিনবে- ”

“ওরে সামু, রানু ... দেখে যা। ভাদু মায়ের খেলা দেখে যা। বুবুনকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর রক্ষে করেছে। ... বলেছিলাম, ওই পোড়ারমুখো মিনসে আমাদের ছেড়ে কোথাও যায়নি ... শুনে যা রে...!!”

বুবুন এসবের কিচ্ছু বুঝতে পারল না। পেটের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। ভালোই খিদে পেয়েছে বুবুনের।

রাস্তার ধারে বিশ্রামরত গরুটা জাবর কাটা থামিয়ে হাম্বা ঘোষণা করল। আকাশে ইতস্তত সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। শরৎ নেমে আসছে গ্রামের বিকেলে...

2 comments: