0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






প্রাচীন কথা


ভাবসিদ্ধ
অনিন্দিতা মণ্ডল


খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক। উত্তর ও মধ্যভারতে নতুন যুগের আরম্ভ। সবে ঐশ্বর্যের পুঞ্জায়ন শুরু হয়েছে। কতগুলি জনপদের নৃপতি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করছেন। উত্তরপশ্চিম ভারতের এই জনপদগুলিকে মহাজনপদ বলে উল্লেখ করা শুরু হয়েছে। এগুলিতে রাজতন্ত্র থাকলেও এদের ঘিরে আরও যে কয়েকটি জনপদ আছে উত্তরপূর্বে, হিমালয়ের কোল ঘেঁষে, সেগুলি গণতান্ত্রিক। এই গন্তান্ত্রিক জনপদগুলির সঙ্গে রাজতন্ত্রের বড়ই অমিল। কিন্তু অর্থনীতির নির্ভরশীলতার কারণে সাধারণ মানুষ জন ও শ্রেষ্ঠী বনিকদের নির্বিঘ্ন যাতায়াত অব্যাহত। মাঝে মধ্যে পথেঘাটে শ্রমণদের চলাফেরা। সাধারণ মানুষ এঁদের শ্রদ্ধা করে। পথ ছেড়ে দেয়। ভিক্ষা দেয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে অসংখ্য ধর্মমতের জন্ম হয়েছে। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী শ্রমণরা একে অন্যের সঙ্গে নিজ নিজ ধর্মমত ও দর্শন আলোচনা করেন। অবিরত ভ্রমণ করে চলেন বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড। ফলে, বৈদিক হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি নয়, জাতিভেদ নয়, পরস্পরের প্রতি অসূয়া নয়, বরং একে অন্যের ধর্মের গ্রহনীয় আচরণগুলিকে নিজধর্মের সামিল করেন। মাত্র কিছুকাল আগে পরম ‘জিন’ বর্ধমান মহাবীরের সঙ্গে পরম কারুণিক তথাগতর সাক্ষাৎ হয়েছে। দুজনেই পরিব্রাজন করছেন। শেষ সাক্ষাতে দেখা গেল বিস্তর পার্থক্য জন্মেছে। তথাগতর চিন্তাধারা ততদিনে নির্দিষ্ট আকার নিয়েছে। এরকম সময়ে, যখন বৌদ্ধধর্ম তখনও সেভাবে রাজানুকুল্য পায়নি, ভারতবর্ষে কোনও একচ্ছত্র রাজচক্রবর্তী নেই যে সমগ্র ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পরবে, তখন কোশলরাজ প্রসেনজিত অনুসরণ করছেন এক শ্রামনিক ধর্মকে। এ ধর্ম সম্পূর্ণ বেদবিদ্রোহী। ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। কিন্তু প্রবর্তক শ্রমণ মক্ষলি গোশালা নিজেই কি এক ঐশ্বরিক ভাবাবেশে মত্ত থাকেন। তিনি বলেন, কর্ম করে জীবনের গতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রতিটি জীব ও অজীব নিয়তি দ্বারা পরিচালিত। একটি সুতোর গোল্লা যেমন ফেলে দিলে তা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের জীবনও তাই। যা হবার তা হবেই। কোনও এক অদৃশ্য মহাজাগতিক নিয়মে বাঁধা আছে বিশ্বচরাচর। তিনি হাতের পাতায় খাদ্য গ্রহণ করেন। মদ মাংস গ্রহন করেন না। নারীসংগ বিবর্জিত। নগ্ন, বহুদক সাধু। তাঁর চরিত্রের নির্মল শুচিতা এবং ধর্মের আচার সহজ সরল ও উচ্চভাবাপন্ন হওয়াতে বহু মানুষ তাঁর শরণ নিয়েছেন। বিশেষ করে কারুশিল্পী, গায়ক বাদক, ও চিত্রকরদের মধ্যে তাঁর মহিমা বহুল সমাদৃত।

রাজা প্রসেনজিত যখন গোশালা সন্দর্শনে প্রথম আসেন তখন মোহিত হয়ে লক্ষ করেছিলেন, কী এক অদ্ভুত আনন্দের উৎস যেন তাঁর মধ্যে সতত স্ফুরিত হচ্ছে। এমন সদানন্দ পুরুষ তিনি আগে দেখেননি। গোশালা বৃদ্ধ হয়েছেন। শ্রমণের ধর্ম যে পরিব্রাজন, তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। শ্রাবস্তী নগরীর প্রান্তে তাঁর ভাবানুসারী এক পটুয়া রমণীর কুটীরে আশ্রয় নিয়েছেন। গৈরিক রঙের একটি মাটির কুটীরগৃহ। সামনে প্রাঙ্গণে একটি খোলা চারচালায় রমণীর মাটির পাত্রগুলি রাখা। পাশে ধাতুপাত্রে নানা রঙ ও তুলি। রমণীর কর্মশালা। অদুরে আর একটি চারচালায় কুমোরের চাক। সেখানে কিছু কাঁচা মাটির কলসী হাঁড়ি শুকাতে দেওয়া আছে। প্রাঙ্গনের দুটি দিকে দুটি মাটির কুটীর। একটি রমণীর নিজব্যবহারের। অপরটি তাঁর আরাধ্য পুরুষ মক্ষলি গোশালার। রমণীর কর্মশালা থেকে গোশালার কুটীরের অভ্যন্তর পর্যন্ত স্পষ্ট দৃশ্যমান। গোশালা দিবারাত্র কি এক আবেশে মগ্ন থাকেন। কখনও স্থির ধ্যানমগ্ন চিত্রবৎ। কখনও দুটি হাত তুলে ধীর লয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকেন। যেন সুরলোকে নৃত্য পরিবেশন করছেন। রমণী সেই সব মূর্তির চিত্র আঁকে তার পাত্রগুলির গায়ে। সে অনেক রকম চিত্র তৈরি করতে জানে। কিন্তু আপাতত এই সব চিত্রই আক্তে ভালো লাগে তার। গোশালা যে তার মত দীনের কুটীরে আশ্রয় নিয়েছেন তাই ভেবেই সে আপ্লুত। 

কিন্তু নগরীর পথে পথে আলোচনা চলছে। তথাগতর মহিমা প্রখর দিবাকরের ন্যায় ধীরে ধীরে দীপ্যমান হচ্ছে। গোশালার মত সন্ন্যাসী সিদ্ধপুরুষদের আর তেমন মনে রাখছেনা মানুষ। শুধু দিবাকরের পাশে চন্দ্রের ন্যায় আছেন বর্ধমান মহাবীর। পথে পথে কি আলোচনা চলছে, কান পাতা যাক। সকলে কানাকানি করছে, নগ্ন ধর্মগুরু, শ্রমণ গোশালাকে একাকী রমণী আশ্রয় দিয়েছে। তিনি যে ব্রহ্মচারী! কোনও সাধারণ পুরুষ নন! যতই রমণী স্বাধীনা হোক, সে যে তাঁর ধর্মনাশ করবেনা তার কি বিশ্বাস আছে? এর মধ্যে কতিপয় দুরাত্মা ব্রাহ্মণ রটিয়েছে, ব্যাভিচার চলছে। অবশেষে এই রটনা পৌঁছল রাজার কাছে। রাজাদেশে এক সন্ধ্যায় রমণীর কুটীরে পৌঁছলেন কয়েকজন রাজ পারিষদ। অবশ্যই ছদ্মবেশে। যেন গোশালাকে দর্শন করতে ও তাঁর উপদেশ নিতে গিয়েছেন। কিন্তু এ কি! একটি কুটীরে একাকী গোশালা কী এক দৈবভাবে মগ্ন হয়ে নৃত্য করে চলেছেন। ছদ্মবেশী অভিজাতদের তখন বিহ্বল অবস্থা। গোশালাকে দেখতে গিয়ে তাঁরা ক্রমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন সেই দৈবভাবে। ভিতরে ভিতরে এক আনন্দময় স্রোত অনুভব করতে করতে বাহ্যিক বোধ লোপ পেল তাঁদের। ভাবমোহিত হয়ে শরণ নিলেন গোশালার। গোশালা টেরও পেলেন না। অদূরে তখন দীপালোকে সেই রমণী এঁকে চলেছে ভাবমত্ত গোশালাকে। অপরিচিত মানুষের পদধ্বনিতে মুখ তুলে চাইল সে। মুখে প্রশ্নচিহ্ন তার। একজন জানতে চাইলেন, গোশালা তো নাস্তিক। তবে কার আরাধনায় এমন মগ্ন? নারী ধীর স্বরে উত্তর দিলো, গোশালা বিশ্বাস করেননা জগতের বাইরে কোনও ঈশ্বর আছেন। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিটি জীবের মধ্যেই ‘হাল্লা’ আছেন। তাঁর রূপ বাঁশের মুলের মত, শুভ্র শুক্ল। নৃত্য দিয়ে তাঁকে বীণার মত বাজাতে হয়। তবেই আনন্দে তাঁর দর্শন মেলে। 

নতমস্তকে ফিরে গেলেন পারিষদবর্গ। দেখা করলেন রাজার সঙ্গে। শয়নকক্ষে রাজা প্রসেনজিত তখন স্মিত হাসছেন। গোশালা সিদ্ধপুরুষ। ভাবসিদ্ধ। সে সিদ্ধি এমন অনায়াস, এমন বাধ্যবাধকতাহীন ধর্মাচরণ, যে মানুষ ভুল বোঝে আবার আকৃষ্ট না হয়েও পারেনা। 

ভক্তিবাদের মান্যপুরুষ গোশালা অজীবিক ধর্মের প্রবর্তক। প্রসেনজিত জানেন ধর্ম নাম পরিবর্তন করবে হয়ত, দিক পরিবর্তনও অসম্ভব নয়, কিন্তু এই ভূখণ্ডের আকাশে গোশালা বহু শতাব্দী ধ্রুবতারার ন্যায় সমুজ্জ্বল থাকবেন।

0 comments: