0

ছোটগল্প - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প


গগনচাঁদ 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



গগনচাঁদের মনে ভারি ফুর্তি লাগিয়াছিল। বাস্তবিক, ফুর্তি লাগিবার কথাই বটে! গৃহে সতীলক্ষ্মী স্ত্রী গগনচাঁদকে মাথায় করিয়া রাখিয়াছেন। তাহার উপর দোকানে খরিদ করিতে গেলে প্রাপ্যের অতিরিক্ত ‘ফাউ’ পাইয়া যেমত আনন্দ হয়, গগনচাঁদ সেইরূপ গৃহিণী ব্যতীত আরো দুইখানি রমণীর মন পাইয়াছিলেন। গগনচাঁদ খুশিতে ডগোমগো। 

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। বলিতে কি, শুধুমাত্র হাতের কড়িটি ফেলিয়া দিলেই হয় সতীলক্ষ্মীর হাতে। গৃহিনী তাহা ধুইয়া-পুঁছিয়া, ঝাড়িয়া-বাছিয়া, রাঁধিয়া-বাড়িয়া, ঘর-গৃহস্থালী ঝকঝক-চকচক করিয়া গগনচাঁদের পছন্দমাফিক খাদ্য এবং শয্যা প্রস্তুত করিয়া রাখেন। তেজারতি কারবারটিও কর্মচারীদের গুণে ভালই চলিতেছে। শুধুমাত্র গৃহে আসিয়া শয্যায় দেহ এলাইয়া দিতে পারিলেই সুখ এবং শান্তি ছাড়া আর কিছুই নাই। পতিপরায়ণা স্ত্রীটির স্বামীর সকল কিছুতেই ভক্তি, সকল কিছুতেই বিশ্বাস। এমন কি ঘরের লক্ষ্মীটিকে অবজ্ঞা করিলেও তিনি ভাবিয়া লন, স্ত্রীলোকের প্রতি বুঝি স্বামীদের ইহাই রীতি,ইহাই কর্তব্য। গগনচাঁদের এখন বৃহস্পতি তুঙ্গে, ফুর্তি রুখে কে? 

দুইখানি স্ত্রীলোকের একজন অপেক্ষাকৃত প্রবীনা, অপরজন নবীনা। গগনচাঁদ নিজেও প্রবীণ ব্যক্তি। প্রবীণার সাহচর্য তাঁহার ভাল লাগিয়াছিল। প্রবীণাটি সুরসিকা, পেটে যৎকিঞ্চিত বিদ্যাও আছে, নম্রমধুরা। রূপসী না হইলেও রূপহীনা নহে। স্ত্রীলোকের প্রেম পাইলে রূপ লইয়া ভাবে কে? গগনচাঁদ সুখে দিনপাত করিতেছিলেন।

অকস্মাৎ নবীনার আবির্ভাব। কোথা হইতে আমরা তাহা বলিতে পারি না। বোধকরি নবীনাকে গগনচাঁদ পূর্বেই দেখিয়াছিলেন, কিন্তু তখন মন ছিল অন্য তারে বাঁধা, নবীনাকে দেখিলেও তাহার পায়ে বাঁধা পড়েন নাই, এক্ষণে নবীনাকে দেখিয়া মন উদ্বেল হইয়া উঠিল। নবীনাও রসবতী, রসকে কিরূপে জ্বাল দিতে হয় তাহা জানে, উপরন্তু সে রূপবতীও বটে। সর্ব গুণে গুণবতী না হইলেও কিঞ্চিৎ গুণ তাহার আছে। প্রবীনার ন্যায় শুধু গগনচাঁদের ভালবাসাই তাহার জীবনের সর্বস্ব নহে, তাহা অবলম্বন করিয়া পড়িয়া থাকে না, নিজেকেও রসের ভিয়ানে চড়াইতে জানে। এরূপ অবস্থায় গগনচাঁদের মন ঘুরিল। পোষা পাখিটি যেমন বাহিরে যাইবার জন্য ছটপট করিতে থাকে, গগনের মনও নবীনার নিকট যাইবার জন্য ছটপট করিয়া উঠিল। দুই একবার নিজ মানসিক চাঞ্চল্যের কারণে প্রবীণার নিকটে মুখে কিছু না বলিলেও কিভাবে যেন তাহা প্রকাশিত হইয়া গেল। প্রবীনা বুঝিল সবই, কিয়ৎ তফাতে সরিয়া গেল বটে কিন্তু গগনচাঁদের মনের ভিতর কি যেন একটা ঘটিয়া গেল, প্রবীণাকে পুরাপুরি উপেক্ষা করিতে বা ভুলিতে পারিলেন না। কি এক অপরাধবোধ মনের মধ্যে রহিয়া গেল আবার নবীনাকে ছাড়াও এক্ষণে আর সম্ভবপর নহে। বোধকরি, নবীনার কথা প্রকাশ না করিয়াও প্রবীণার নিকট তাহা ধরা পড়িয়াছে, এই লজ্জ্বাও তাঁহার ছিল। প্রবীণা আড়ালেই রহিয়া গেল, দুজনের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয় নহে। ভালবাসা শুধুমাত্র ভালবাসিবার জন্যই নহে, ভালবাসার মানুষটির দোষ-গুণকে স্বীকার করিয়া লওয়াও ভালবাসা।

প্রবীণা গগনচাঁদকে যথার্থই ভালবাসিয়াছিল। 



এই পর্য্যন্ত কাহিনী ঠিক ছিল। কিন্তু কাহিনিটি শেষ হইল এইরূপে...

এক অপরাহ্নে ঘরের আঙ্গিনায় গগনচাঁদ একটি আরাম কেদারায় বসিয়া সবেমাত্র শেষ সুখটানটি দিয়া আঙ্গিনার একপার্শ্বে কিছু আগাছার ঝাড়ে হাতের শেষটুকু ফেলাইয়াছেন, অমনি পার্শ্ববর্তী আমলকি গাছের ডালে বসা কাক কা-কা করিয়া উঠিল। গগনচাঁদ শুনিলেন—খাঁ-খাঁ। চমকিয়া উঠিলেন। ব্যবসার বাজার বড় মন্দা চলিতেছে। তাহার উপর আগামীকল্য দীর্ঘদিনের পুরাতন কর্মচারী গগনচাঁদের নিকট হইতে বিদায় লইতেছে, মন ভাল নাই। দোষ বলিতে গেলে গগনচাঁদেরই। সেদিন নবীনার সহিত আপিসঘরের এক পার্শ্বে বসিয়া গালগল্প চলিতেছিল, এমত সময়ে কর্মচারীটির আবির্ভাব। আপিসঘরে নবীনাকে দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক। নবীনা চলিয়া গেলে গগনচাঁদ তাহাকে দুকথা শুনাইয়া দিলেন। কর্মচারীটিও এতদিন এই সংসারের নুন খাইয়া ভবিষ্যতে কোন বিপদের সংকেত পাইয়া গগনচাঁদের অধীনে আর কাজ করিতে চাহিল না। গগনচাঁদ অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া তাহাকে বরখাস্ত করিলেন। সন্ধ্যাবেলায় খবর আসিল অপর দুই কর্মচারীও হাজার টাকা করিয়া বৃদ্ধি না করিলে কারবার ছাড়িয়া দিবে। গগনচাঁদের আকাশে কালো মেঘ দেখা দিল।

কল্য বৈকাল হইতে গৃহবন্দী, গৃহিণীর সহিতও কথা নাই। নবীনা কয়েকবার কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু গগনচাঁদ বলেন নাই। একবার বিরক্ত হইয়া টেলিফোন রাখিয়া দিলেন। এমত অবস্থায় সবে দিবানিদ্রাটি সারিয়া বাহিরে আসিয়া বসিতেই কুডাক, কা-কা। সন্ধ্যায় নবীনার সহিত দেখাসাক্ষাৎ, খানাপিনা, গাল-গল্পের সময়, কিন্তু...চকিতে একবার গাছের ডালে বসা কাকের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে পক্ষিটি আরও একবার জোরে কা-কা করিয়া উড়িয়া গেল। গগনচাঁদ আবার শুনিলেন যা যা!

মন দুর্বল থাকিলে নানাপ্রকারের দুর্ভাবনার উদয় হয়। তাহাই হইল। গগনচাঁদ বিরক্ত হইয়া কর্কশস্বরে কাহাকেও ডাকিতে যাইতেছিলেন, অকস্মাৎ গৃহিণীর আবির্ভাব। হাতে চায়ের পেয়ালা লইয়া আসিয়াছেন, কিন্তু তাহা গগনের হস্তে না দিয়া সম্মুখের টিপাইয়ে রাখিলেন। কিয়ৎদুরে একখানি অপেক্ষাকৃত ছোট টুলের উপর বসিয়া গগনচাঁদের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। যেন তাঁহার অন্তঃস্থল দেখিতে পাইতেছেন।গগনচাঁদ ভিতরে কাঁপিয়া উঠিলেন। নবীনার কথা সেদিনের কর্মচারীটি কি কিছু বলিয়াছে? ভিতরে কাঁপিলেও গগনচাঁদ মুখে স্মিত হাসি টানিয়া কহিলেন-—কিছু বলবে?- ভুলিয়া গেলেন, কয়েকদিন তাহাদের মধ্যে বাক্যালাপ নাই।

গৃহিণী মিষ্ট কথার কোন প্রত্যুত্তর না করিয়া ঈষৎ জোর গলায় যে কর্মচারীটি চলিয়া যাইতেছে, তাহার উদ্দেশে ডাক পাড়িলেন। কর্মচারীটি বোধকরি এই ডাকেরই অপেক্ষা করিতেছিল, ত্বরিতগতিতে হাজির হইল। গৃহিণী কহিলেন— আপনি এতদিনের পুরোন কর্মচারী। বাবা, আপনি না থাকলে কি আমাদের চলে? আমি বাবুকে বলে নাহয় আরও একহাজার টাকা বৃদ্ধি করে দেব। আপনি দেশে যাবার সঙ্কল্প ত্যাগ করুন, আবার কাল থেকেই কাজে যোগ দিন। আমি বাবুকে বলে ওই আপিস ঘরেরই একপাশে আপনার জন্য আলাদা আপিস করে দিতে বলব’খন। আপনি এখন আসুন বাবা, আমাদের ছেড়ে যাবেন না, আপনি আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমলের লোক...

কর্মচারী চলিয়া গেল বটে কিন্তু গগনচাঁদ পড়িলেন আতান্তরে। কে কবে শুনিয়াছে, আপিসঘরে কর্মচারীর সম্মুখে পরস্ত্রী লইয়া প্রেমালাপ করিতে? গৃহিণী ব্যবসায় লাভ দেখিবার ব্যবস্থা করিয়া তাঁহাকে জব্দ করিলেন। গগনচাঁদ মতলব আঁটিতে লাগিলেন, ইহার পর নবীনার সহিত বাহিরে, দূরে শহরের কোন হোটেলের ঘরে দেখা করিবেন, কিছুক্ষণ সময় কাটাইবেন। তাহাতে প্রবীণার পক্ষেও উহা জানা সম্ভব হইবে না, দুই দিকই বজায় থাকিবে। নবীনার কথা জানিবার কোনরূপ সম্ভাবনার উদ্রেক হউক তিনি তাহা চাহেন না। কিন্তু গগনচাঁদ যার পর নাই বিস্মিত হইলেন গৃহিণীর ব্যবহারে। যে গৃহিণী তিনি ভিন্ন আর কিছু যে জগতে আছে তাহা জানিতেন না, তিনি কিরূপে এই ব্যবস্থা করিলেন? তাহা অপেক্ষাও বিস্ময়ের কথা, বাহিরের কর্মচারীর সহিত কথা বলিলেন কি প্রকারে এইরূপ কর্তাব্যক্তির মতো? তবে কি তিনি কিছু জানিয়াছেন? গৃহিণী যদি ডালে চড়িতে পারেন, তবে তিনিও গগনচাঁদ, পাতায় চড়িয়া ঘুরিতে জানেন। কর্মচারী দ্বারা পাহারা গগনচাঁদ সহ্য করিবেন না। গগনচাঁদ নবীনার সহিত কিরূপে বাহিরে সাক্ষাৎ করা যায়, মনে মনে সেই ফন্দি আঁটিতে লাগিলেন। গগনচাঁদ এখন নবীনা ভিন্ন আর কিছু ভাবিতে চাহেন না। নবীনা তাঁহাকে চুম্বকের মতো টানিয়া রাখিয়াছে, তিনি সব ভুলিয়াছেন।

অকস্মাৎ লটারির টিকিট পাইবার মতনই এক ঘটনা ঘটিল এবং এক সময় উপস্থিত হইল যখন সরকারি কিছু দলিল-দস্তাবেজ জমা দিবার কারণে গগনচাঁদকে শহরে যাইতে হইবে এইরূপ হইল। গৃহে গৃহিণীর নিকট মিছা কথাও কহিতে হইল না, আবার নবীনাও বজায় রহিল। গগনচাঁদের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু যত আনন্দই থাক, বাহিরে শহরে গিয়া ফুর্তি করিতে গেলে গৃহের কথা ভাবিয়া কিঞ্চিত চিন্তাণ্বিত হইতে হয়। গগনচাঁদের গৃহ ব্যতিরেকেও প্রবীণা এক সমস্যা। নবীনার সহিত সম্পর্ক গড়িয়া উঠিবার ফলে প্রবীনার সহিত একপ্রকার বাক্যালাপ তো দুরের কথা, যোগাযোগও তেমন নাই, তবু, তিনি তাহাকে উপেক্ষা করিতে পারেন না, নিজের কাছে অপরাধী হইয়া আছেন। যে সকল কথা আজ নবীনাকে বলিতেছেন, যে সকল গান আজ তাহাকে শুনাইতেছেন, কিছুদিন পূর্বে এই সকল কিছুই যে আরও একজনের নিকট বলিয়াছেন-কহিয়াছেন, তাহা তিনি ভুলিতে পারেন নাই। বোধকরি অন্তরের অন্তঃস্থলে এখনও প্রবীনার জন্য কোথাও এতটুকু করুণা কিংবা দয়া, কিংবা ভালবাসা রহিয়া গিয়াছে। তাই তাহার আড়ালেই থাকিতে চাহেন, সম্মুখে আসিতে চাহেন না, হয়ত আসিবার মতো সাহসও নাই। ভালবাসার মানুষের নিকট মুখোশ পরিলে তাহা খুলিয়া যাইবার ভয় থাকে। খুলিলে উভয় পক্ষেরই বিপদ। যাহার খুলিল, তাহার লজ্জা প্রকটিত হইল, মিথ্যা প্রকটিত হইল। যাহার সম্মুখে হইল, তাহার বেদনা প্রকাশিত হইল। সকলে সম্মুখে বেদনা প্রকাশ করিতে সম্মত হয় না, প্রবীনা তাহাদেরই একজন। কিন্তু গরজ বড় বালাই, নবীনার প্রেমে গগনচাঁদ এখন সবদিক ভুলিলেন। প্রবীনাকে উপেক্ষা করিতেও তিনি শিখিয়াছেন। এখন আর তাঁহার দ্বিধা হয় না। গগনচাঁদ চারিদিক আঁটঘাট বাঁধিয়া একদিনের ছুটি লইয়া শহরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

গগনচাঁদ শহরে আসিলে কাজকর্ম বিশেষ কিছু না থাকায় নবীনার সহিত সময় কাটিল অত্যন্ত আনন্দে, মত্ততায়। সারাদিন শহরে থাকিয়া রাত্রিতে ঘরের মানুষ ঘরে ফিরিলেন। কিন্তু যে ভাবনার দ্বারা ভাবিত হইয়া শহরে গিয়াও শান্তি পাইতে ছিলেন না, তাহাই ঘটিল।

নবীনার প্রকৃতি প্রবীণার মতো নহে। সে চঞ্চল, সাহসিনী, বেপরোয়া ধরণের। গগনচাঁদের পরস্ত্রী প্রেম দুঃশিন্তার কারণ হইলেও নবীনা তাহা পরোয়া করিত না। ফলে তাহারই কারণে প্রকাশ পাইল যে গগনচাঁদ শহরে গিয়াছিল। এতদিনে তাহাদের কথা আর কাহারও জানিতে বাকি নাই। নানা ভাবে সেকথা প্রবীনার কানে পূর্বেই আসিয়াছিল, এই ঘটনার কথাও কানে আসিল। প্রবীণা বুঝিলেন সবই, কিন্তু গগনচাঁদ ধরা দিলেন না, যেন কিছুই হয় নাই, যেন কাজকর্মে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া আছেন। পূর্বের মতো যোগাযোগ বহুদিন নাই, তবু সারাদিনে যে একবারও দেখা সাক্ষাত হইত, গগনচাঁদ তাহাও কমাইয়া দিয়াছেন। অনেক সময় গগনচাঁদের উপস্থিতি প্রবীনাকে অনুমান করিয়া লইতে হয়।

গগনচাঁদ এখন বাস্তবিকই উড়িতে লাগিলেন।

শহর হইতে ফিরিবার দিন দুয়েক পর সেই কর্মচারীটি একদিন আপিস ঘরে সকলের সম্মুখেই একখানি পত্র দিল গগনচাঁদের হস্তে। বলা বাহুল্য, পত্রটি নবীনার। গগনচাঁদ পত্রটি দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। নবীনা ভালো কাজ করে নাই, পত্র দেওয়া সমীচীন নহে। কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করিলেও কি কারণে এই পত্র তাহা জানিতে ইচ্ছা করিল। কিন্তু এক্ষণে বহু কর্মচারী সম্মুখে, কাজকর্মেরও সময় বটে, এই মুল্যবান সময়টি নষ্ট করিবার যুক্তি নাই। কিন্তু কৌতুহল বাদ সাধিল। আপিসের বাহিরে আসিয়া গগনচাঁদ নবীনাকে টেলিফোন করিলেন। নবীনা পত্রে লিখিয়াছে, সে আগামী কল্য গৃহে আসিয়া দেখা করিতে চায়। গগনচাঁদ যার পর নাই বিরক্ত হইলেন। ফোনে নবীনাকে পাওয়া গেল না। বৈকালের মধ্যে তাহাকে নিরস্ত না করিলে গৃহে অশান্তি হইবে চিন্তা করিয়া বৈকালে আপিসের কাজকর্মে আর মন দিতে পারিলেন না। বারংবার টেলিফোন করিতে লাগিলেন আপিসঘরের বাহিরে আসিয়া, কিন্তু কোন লাভ হইল না। ক্লান্ত, অশান্ত মন লইয়া গগনচাঁদ গৃহে ফিরিলেন। রাত্রে ভাল ঘুম হইল না, অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আপিসের কাজে বাহিরে যাইতেছেন বলিয়া গগনচাঁদ গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার থাকিতে সাহস হইল না। অপরাধী ব্যক্তির সাহস চিরকাল কম, মুখে প্রকাশ না করিলেও বুকে বল থাকে না। গগনচাঁদেরও তাহাই হইল। 

অনেক রাত্রে ক্লান্ত, অবসন্ন গগনচাঁদ গৃহে ফিরিয়া দেখিলেন গৃহিণী উদ্বিগ্ন মুখে পদচারণা করিতেছেন। কিশোর গৃহভৃত্যটি সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া গৃহিণীকে পাহারা দিতেছে। গগনচাঁদ কোন প্রশ্ন করিবার পূর্বেই গৃহিণী কহিলেন—কে একটি মেয়ে এসেছিল, আগামীকাল তোমার আপিসের কাজে বাইরে যাবার কথা ছিল, আর যাবার প্রয়োজন নেই। দরকার পড়লে সে খবর দেবে।

তবে কি পাখিটি উড়িল? গগনচাঁদের মনে সংশয় দেখা দিল। স্বভাবে সে বেপরোয়া, চঞ্চল...তবে কি তাহার আরও বন্ধু-বান্ধব জুটিয়াছে? প্রেম বড় বালাই, কিন্তু নবীনার কথা ঠিক এক্ষণে ভাবিতে গিয়াও ভাবিলেন না। অনেকদিন পর গৃহিণীকে আজ ভাল লাগিল। প্রত্যুষে উঠিয়াই গৃহকার্যে মন দিবেন এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া শয্যা লইলেন। রাত্রে আধোজাগরণ-আধোঘুমের ভিতর মনে পড়িল প্রবীণাও একদিন আসিয়াছিলেন তাহার গৃহে, বাটিস্থ সকলের সহিত সেই দিনটি বড় আনন্দে কাটিয়াছিল। সেইদিন ভয় হয় নাই, কি এক অনাবিল আনন্দে মন ভরিয়াছিল। অদ্য নবীনার জন্য ভয় করিতেছিল, কাহাকেও তাহার কথা বলিতে পারেন নাই। কি কারণে? কিন্তু নবীনার ক্ষুধা বড় তীব্র, তাহার আকর্ষণ এড়াইয়া যাওয়া কঠিন... নবীনার আকর্ষণ তাহাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে বুঝিতে পারিলেন কিন্তু বুঝিতে পারিলেন না ভালবাসা কোনটি, প্রবীণা... নাকি নবীনা? গগনচাঁদ আরো একবার প্রবীণার সহিত প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে করিতে চেষ্টা করিলেন, নিদ্রা আসিয়া তাহাকে গ্রাস করিল...।


পাঠক, ভালবাসা কোনটি? গগনচাঁদ এক্ষণে কি করিবে, কাহাকে ভালবাসিবে?

0 comments: