ছোটগল্প - সুরজিৎ মণ্ডল
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
ইরাকি বাতাস যেমন
সুরজিৎ মণ্ডল
|| পরশখানি তব ||
বুটের ময়লাগুলো একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে সাফ করছিল বারেস। ট্রেভিস বারেস, রুস্তমিয়া ক্যাম্পের নওজোয়ান স্নাইপার। দক্ষিণ ইরাকের সুন্নী ত্রিভুজে কর্মরত ১-৬৪ ব্যাটালিয়ন এ অনেক দক্ষ স্পটার ও শুটার থাকলেও বারেস স্বতন্ত্র। তার কনফার্ম কিল অনেক বেশীও বটে অন্যদের তুলনায়। বারেস জানে সে সক্ষম, এক অদৃশ্য যোদ্ধা; ইরাকি প্রতিরোধের বিপক্ষে নিয়োজিত এক মূর্তিমান মৃত্যুদূত।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমেরিকান বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি ইরাকের সামরিক বাহিনীর লড়াই ছিল অবশ্যই অসম। বাগদাদ দখল ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। বাগদাদের সরকারি হাসপাতাল গুলিতে ঘন্টায় ঘন্টায় লোক আমদানির মাধ্যমে সে কাজ সহজেই সম্পন্ন করেছে দেশোয়ালি ভাইয়েরা। আমেরিকার কর্তৃত্বে ইরাকে সামরিক অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইতিহাস প্রসিদ্ধ হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কোনওদেশে, কোনওসময়েই ক্ষমতাসীনকে উৎখাত প্রক্রিয়া নিষ্কন্টক হয়নি। বাগদাদের সাদ্দাম অনুগামীদের ইনসার্জেন্সি ও তাই ইতিহাস পরম্পরাই ধরা যায়। বাগদাদে বারেস জেনেশুনেই এসেছে যে আড়াল থেকে বিদ্রোহী খতম করাই তার কাজ; ঝুঁকিপূর্ণ বটে। কিন্ত তারা পেশাদার স্নাইপার। তার মতো আরও অনেকেই আছে এ কাজে নিয়োজিত।
ক্যাম্পের সামনে ফাঁকা জায়গাটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় বারেস। বুটটা পরিষ্কার করা থামিয়ে কিছু একটা ভাবে সে... অজান্তেই তার হাত চলে যায় শিরদাঁড়ায়, হাত ঘুরে বেড়ায়... সে অনুভব করে তার বুকের অস্তিত্ব, কপালের উন্মুক্ত অঞ্চলটিকে। নাহ্, সব ঠিকঠাকই তো আছে।
"ডু নট স্টে ইন ওপেন"- আপ্তবাক্য মনে পড়ে যেতেই বারেস উঠে দাঁড়ায়; রুফটপ পজিশন এ যেতে হবে। দক্ষিণ বাগদাদের না মানুষি, তীব্র ঠাণ্ডা, ভগবানের চেয়েও নির্ভুল নিশানার কথাটা বেমালুম ব্যাটালিয়ন সৃষ্ট একটি উৎকৃষ্ট রিউমার বলেই প্রথমে মনে হয়েছিল তার, কিন্তু এখানে থাকা তার আট মাসে সে দেখেছে তিনশ মিটার দূরত্ব থেকে তিন ইঞ্চি অরক্ষিত অঞ্চলে বার বার এসেছে ঠিকানা লেখা এস ভি ডি ড্রাগুনভ এর বুলেট... ইনহিউম্যান পেশেন্স, আনক্যানি অ্যাকুরেসি... ডেডলি কাউন্টার স্নাইপিং বাই আ নেটিভ বাগদাদ স্নাইপার।
|| এক ||
প্রেম নিবেদন (৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
খাঁ খাঁ করা ইরাকি দুপুর। যৌথ বাহিনীর কনভয়টা বাগদাদ এয়ারপোর্ট রোড ধরে পূর্বে সাত-আট কিলোমিটার এসে একজায়গায় দাড়ালো। রাস্তার দুপাশে নিঝুম বাড়িগুলো চোখে রোদ আড়াল করে ভবিষ্যৎ ধ্বংসকে যাচাই করছে যেন। নিরীহ ইরাকি জনগন ভবিতব্য জানে; অনুপ্রবেশকারী ও প্রতিরোধ বাহিনী- উভয়েরই আয়রন সাইটের নিশানায় পড়েছে তারা। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় চোরাগোপ্তা আক্রমণে যখন লড়াই করছিল, ঠিক একই সময়ে সাধারণ ইরাকবাসীকেও শিকার হতে হয়েছে হিংসার। বুলেট শুধু কর্তব্যপরায়ণ, মানুষ চেনার দায় তার কোনওকালেই ছিলনা।
জেকব রাস্তার ডানদিকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। হাতের এম ফোর কারবাইনটা বুকের কাছে আড়াআড়ি ধরা। কিছুই না, একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া... এ রাস্তার ইতিহাস বিশেষ সুবিধের নয়। বেস থেকে ইন্সট্রাকশন আছে, অ্যালার্ট থাকতে হবে রোডসাইড বোম্বিং নিয়েও। মিলিটারী অপারেশনের মূল যোগসূত্র হওয়ায় রাস্তার হালও তথৈবচ, পরে হয়ত কোন সময়ে মেরামত হবে। আপাতত কোনও বিশৃঙ্খলা নজরে আসছেনা কোত্থাও।
যে জায়গায় কনভয়টা দাঁড়িয়ে ছিল, তার পেছনে প্রায় দু-আড়াইশ মিটার দূরে একটা ঝুল বারান্দাওয়ালা হলুদ রঙের বাড়ি আছে। বাইরে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, দ্বিতল না ত্রিতল। কয়েকটা টেলিস্কোপিক সাইট সেদিকে তাগ করা আছে। এ জায়গা গুলোতে সন্দেহজনক নড়াচড়া দেখলে দ্বিতীয়বার ভাবনার জায়গা নেই অন্তত।
কিছুক্ষণের স্নায়বিক উত্তেজনা, বিকারহীন এয়ারপোর্ট রোড...
এগোতে হবে আবার। রামাদি আরও পঞ্চান্ন-ষাট মাইল দূর; যেতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা লাগবে। গুরু গম্ভীর আওয়াজ তুলে কনভয় এগোতে শুরু করে, পিষে দেয় নীচের ধূসর বাগদাদি রাস্তা।
অপেক্ষাকৃত লম্বা জেকব সামনের গাড়িটায় হাঁটু গেড়ে বসেছিল, কারবাইনটা আকাশমুখো। আওয়াজটা এল এবার। এল সামনের দিক থেকেই। জেকবের মাথার মিলিটারী হেলমেট এবং গাড়ির লোহার আচ্ছাদনীর মধ্যে যে চার-পাঁচ ইঞ্চির শূন্যতা, রাস্তার ডানদিক থেকে ঐদিক দিয়েই এসেছে অমোঘ মৃত্যু। গাড়ির ভেতরেই লুটিয়ে পড়েছিল জেকব।
সামনে প্রায় ফাঁকা জায়গা, রাস্তার ধারে বড় দুটো বাড়ি, একটু পুরানো; আন্দাজ তিনশ মিটার দূর। ওখান থেকে কোনও বন্দুকবাজের কম্মো না মিলিটারী পোশাকের অরক্ষিত অঞ্চল নিশানা করা। ভীত, উত্তেজিত, সুসজ্জিত যৌথবাহিনীর পরপর কয়েকটা স্ট্যানাগ ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেল ঐ বাড়ি দুটির আনাচে কানাচে। সব্বাই ইন পজিশন বিদ্যুৎগতিতে।
জেকবের পোষাক রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, ফার্স্ট এইডের সুযোগটুকুও পাওয়া যায়নি। জেকব নিখুঁত শিকার তার।
অবস্থান সনাক্ত করা কঠিন কাজ... এসব ক্ষেত্রে সাধারণত পরবর্তী গুলি না চললে বোঝা কার্যত অসম্ভব যে কোথায় ওঁৎ পেতে আছে ঘাতক। আর যেটা এখন হচ্ছে, সিঙ্গল শটের পর সম্পূর্ণ নীরবতা। কেউ কোত্থাও নেই যৌথবাহিনীর প্রবল পরাক্রমের মোকাবিলার অপেক্ষায়। কমান্ডার ম্যাথু একবার সেনাদের দেখে নেন আড়চোখে। নাহ্, দেখে বোঝার উপায় নেই ভয়টা চারিয়ে গেছে কিনা।
কেটে গেছে অনেকক্ষণ। থমথমে নীরবতায় শিকারীর ন্যায় সাবধানতা। গুপ্তঘাতক নিপুণ ও ধৈর্যশীল; ক্যাট এন মাউসের আদর্শ... বাস্তবে যা চূড়ান্ত ভীতিকর। সন্ধ্যা হয়, হয়... রামাদি, রামাদি।
ম্যাথু শুনেছেন গল্পটা, কম্পানিতেই শুনেছেন। জুবা নামে আদর করে ডাকে বিদ্রোহীরা। জুবা এক না একাধিক, এ দ্বন্দ্ব কাটেনি তার। যদি এক হয়, তবে সন্ধ্যা বেলায় রামাদি বেস এ যাওয়ার পথে কাঁটা কম, আর তা যদি না হয়...
বিদ্রোহীদের বিশৃঙ্খলা, বোমাবাজি, আত্মঘাতী স্কোয়াড- প্রেসিডেন্ট পতনে সব দেখা গেছে, কিন্তু এত দক্ষতার সঙ্গে স্নাইপিং? নাহ্। একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি...
সারিবদ্ধ, জেকবের মৃতদেহ বহনকারী চলমান কনভয়কে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নেন ম্যাথু। রামাদি যাওয়ার পথে রাস্তায় ফাঁকা ফাঁকা জায়গাগুলো অন্ধকারে আরও বেশী অনিশ্চিত দেখাচ্ছে। বেস এ গিয়েই চীফ এর সঙ্গে আলোচনাটা করে নিতেই হবে... স্নাইপার টীম এখানে আনা যায় কিনা, বিশেষত বাগদাদে। তার একার সুপারিশে কিছু যাবে আসবে না হয়ত, তবু।
লস অব জেকব ইজ টু মাচ ডিমরালাইজিং।
|| দুই ||
প্রেম প্রস্তাব স্বীকার (১৭ই এপ্রিল, ২০০৫)
রুস্তমিয়া ক্যাম্পে যখন বারেসসহ স্নাইপার টীম পৌঁছেছিল, তারা জানত যে দক্ষিণ বাগদাদে ডিউটি অবধারিত। সাধারণ ইরাকি বেশে হাওয়ার মত মিলিয়ে যাওয়া জুবা দের মোকাবিলা বাগদাদ থেকে ক্রমে পশ্চিমে চলে আসতে হতে পারে। ইউফ্রেটিস সংলগ্ন ফালুজা বেস থেকেও সেই ইঙ্গিতই ছিল। কিন্তু দেখা গেছিল সম্পূর্ণ বিপরীতটাই; ধীরে বাগদাদের পূর্বে চলে যেতে হয়েছিল, জুবা বা জুবাদের দৌরাত্ম্যে। অতন্দ্র প্রহরা, গলা শুকিয়ে কাঠ, সারাদিন শুধু ফাস্টফুড খেয়ে বাগদাদে কোনও বাড়ির ছাদে কাটিয়ে দিয়েছে তারা। ইসলামিক স্টেটের গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে সাফল্যও এসেছে। কিন্তু হাওয়া শুধু হাওয়াই থেকে গিয়েছে। মৃত্যুগণনা ধীরে ধীরে বেড়ে হয়েছে চব্বিশ... গর্বভরে ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে তা বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করাও হয়েছে। ক্রমশ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়েছিল একথা যে জুবা একজনই... অস্বাভাবিক দক্ষ, ভৌতিক ক্ষমতাসম্পন্ন; চূড়ান্ত ধৈর্যশীল। মার্কিন মিডিয়ায় বলে দেওয়া হয়- "ইয়েস। হি ডু এক্সিস্টস।"
তারপর? তারপরই পাতলা কোনও গাছের ছায়ার মতো নজর এড়ানো জায়গা থেকে শ্রবণ ও দর্শণাতীত লঘু পদসঞ্চার... নিশ্চিত ও নিখুঁত, .৭৬২X৫৫ এম এম আর কার্তুজ এর আঘাত... আর একটি গণনা।
যৌথবাহিনীর স্নাইপার বাহিনী বাগদাদে পোস্টিং হয়ে অবধি সাফল্য মোটে কম নয়। বিদ্রোহী ইসলামিক স্টেটের স্নাইপারদের স্পট অ্যান্ড কিল পদ্ধতিতে তারা সাবাড় করেছে অনেক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও তার প্রয়োগ ক্ষমতা নিয়ে বিশ্বের কোনও প্রান্তেই সন্দেহর অবকাশ নেই। তামাম দুনিয়া অবাক হয়ে দেখছিল কি ভাবে বিশৃঙ্খলাকে ধীরে ধীরে দমিয়ে আনছিল মার্কিন সমরব্যাবস্থা। বাগদাদের বাড়ির ছাদগুলো থেকে নিশানা করা আছে রেমিংটন ৭০০, রাতের অন্ধকারে নাইট ভিশন। রাস্তায় সামান্য নড়া চড়াও ডেকে নিয়ে আসবে নিশ্চিত মৃত্যু।
জুবা বলে যার মৃতদেহকে দাবী করা হলো, সে ইরাকি ছেলেটি ইসলামিক স্টেটের বিদ্রোহী, তরুণ, মাঝারি উচ্চতা। জুবা প্রকাশিত ভিডিওয় দেখা আবছা চেহারার সঙ্গে হুবহু মিল। মায় মাথায় বাঁধা সাদা ফেট্টি পর্যন্ত। যেহেতু জাত-কুল-গোত্র সম্পূর্ণ অজানা, "আভাসে মিলায় বস্তু" থিয়োরীই তখন একমাত্র সহায়সম্বল। তার ছোঁড়া স্নাইপার বূলেটে জখম এক স্নাইপারকে চিকিৎসাধীন রাখতে হয়েছে। শেষরক্ষা করতে পারেনি সে। ফারেল অভিজ্ঞ আমেরিকান স্নাইপার শুটার, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলিয়ে তার কনফার্ম কিল একুশ। ফারেল বিবৃতি দিয়েছিলেন, - "দেয়া ইজ আ হিউজ ডিফারেন্স বিটুইন আ প্রফেশনাল স্নাইপার অ্যান্ড আ ম্যানিয়াক উইথ গান।"
হ্যাঁ, চূড়ান্ত পেশাদার ফারেল। অভিজ্ঞতা তাকে আরও নিপুণ করেছে। হাড়হিম করা সে বিবৃতি। মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যায় জুবা, ইরাকি হিরো, মৃত। বাগদাদের রাস্তায় মিশে থাকা আতঙ্কের পরিসমাপ্তি। এতবড় যৌথবাহিনীর প্রত্যেকের মনের অলিগলিতে অতিরিক্ত সাবধানতার অবচেতনে যে অনায়াস ছমছমানি ধরিয়ে দেয়, সে সাধারণ ইরাকি বিদ্রোহী বা সংগঠিত ইসলামিক স্টেট অব ইরাকের কেউ নয়।
শোনা যায়, তাকে নাকি আল-কায়েদার মতো সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সংস্থা থেকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, সে যোগ দেয়নি।
যৌথবাহিনীর স্নাইপার টীমগুলিকে ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ করা থাকত। দুজন করে; একজন স্পটার, আরেকজন শুটার। ইরাকি বিশৃঙ্খলা চলাকালীন বিপরীত পক্ষের কোনও স্পটারের অস্তিত্ব কোনওদিন পাওয়া যায়নি। কিন্তু মেনে নিতে হয়েছে, "দে আর ওয়েল ট্রেইনড"। কানাঘুষো চাউর হয়েছিল যে "জয়েশ আল ইসলামি ফিল-ইরাক" সংগঠনের একজন সে। আর সকল স্নাইপারের মতোই জন প্লাস্টারের লেখা স্নাইপার ম্যানুয়াল "দ্যা আল্টিমেট স্নাইপার" দীক্ষায় দীক্ষিত সে।
"জয়েশ আল ইসলামি ফিল-ইরাক" কিন্তু বেমালুম অস্বীকার করে গেল পুরো ব্যাপারটাই। এটা একটা চাল ছিল বলেই মনে হয়েছিল সমগ্র মার্কিন প্রশাসনের; চাপে রাখার কুশলী নীতি। কত ভুল ভাঙে; যা কিছু প্রকৃত বিদ্যমান, তাকে লুকিয়ে, দাবিয়ে রাখা যায়না। সেই নির্মম সত্যিটা মূর্তিমান শয়তান রূপে হঠাৎ হঠাৎ দেখা দিয়ে সব তছনছ করে যায় হয়তো।
||তিন||
কালোত্তীর্ণ প্রেমে মজি (৪ঠা জুন, ২০০৫)
জুবার যে ভিডিওটি প্রকাশ্য মার্কিন প্রশাসনকে চূড়ান্ত অবমাননাকর হুমকি বলে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিতে তাকে বলতে দেখা গেছিল, - "আই হ্যাভ ওনলি নাইন বুলেটস নাউ ইন মাই গান...অ্যান্ড আই হ্যাভ আ গিফট্ ফর বুশ"। খুব সম্ভবত এক-দেড় দশকের মধ্যে এর চেয়ে শীতল, রক্ত জমিয়ে দেওয়া বিবৃতি কারও কাছ থেকেই পাওয়া যায়নি।
আমেরিকান মেরিন স্কাউট স্নাইপার টীম গুলো সাধারণত বড় হয়; আটজন, দশজন অবধি। চারজনের একটা মেরিন স্কাউট স্নাইপার টীমকে আনা হয়েছিল রামাদির "ডেথ ট্র্যাঙ্গল" এ কেবলমাত্র নৈশকালীন অভিযানে ইনফ্রারেড লেসার বা নাইট ভিশন দ্বারা সজ্জিত করে বিদ্রোহী স্নাইপার নির্মূল করার উদ্দেশ্যে যারা রামাদির সর্বত্র মিশে ছিল। বাগদাদ থেকে রামাদি প্রায় পঞ্চান্ন-ষাট মাইল; রামাদি বাগদাদের পশ্চিম দিকটায় অবস্থিত।
একটা বিস্ফোরণের পর সেদিন রাতে থমথমে পরিবেশে চারজনের টীমটা পৌঁছে গেছিল রামাদি। চূড়ান্ত পেশাদার মেরিন স্কাউট টীমটা রামাদির যে জায়গায় বিস্ফোরণটা ঘটেছিল, তার ঠিক দু'শ মিটার দূরে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে পজিশন নিয়েছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মাফিক। এনিথিং আনন্যাচারাল উইল বি ব্রুটালি পানিশড্।
ছাদটা অনেক বড়, দুটো আলাদা প্রান্তে দুজন দুজন করে বিভক্ত হয়ে চলছিল প্রতীক্ষা। রামাদি বাগদাদের পরেই বিপজ্জনকতম ক্ষেত্রবিশেষে পরিণত হয়ে গেছে।
সেকেন্ড ইউনিট যে পরদিন দুপুরের আগে বাগদাদ থেকে রামাদি পৌঁছচ্ছে না, সেটা দলের চারজনই জেনে বুঝে গেছিল; তাই অতিরিক্ত সতর্কতা। রাত বাড়ছিল, সঙ্গে এক নিশ্চুপ, অন্ধকারে অপেক্ষমান হিংস্র বন্যজন্তুর ন্যায় চোরা স্নায়ুশীতলতাও।
রাতে আইসাইট ঠিক করা অনেক কঠিনতম কাজের মধ্যে একটি। বড় বাড়িটার ছাদের ডানদিকে যে ছেলেটি ছিল, বয়সে তরুণ... ওয়াল্টার। রেমিংটন ৭০০ প্রস্তুত ছিল, চোখ নিবদ্ধ সাইটে। দূরে যে প্রাচীর ঘেরা মাঠটা, অন্ধকারে বিভাজন রেখা বোঝা যাচ্ছিল না।
আর মৃত্যদূত? সে মেপে নিচ্ছিল অন্ধকারের পরিধি...
বেড়াল ইঁদুরকে ধরবার আগে ঠিক কতক্ষণ নিশ্চুপ থাকে? ওয়াল্টারের নাইট ভিশনে ধরা পড়েনি প্রাচীরের সংলগ্ন সূক্ষ্ম নড়াচড়া। শয়তান স্বয়ং নিজেই এস ভি ডি ড্রাগুনভ এর ঠাণ্ডা নলটা ধীরে সুস্থে তুলেছিলেন দূরে চোখে আটকে থাকা বড় বাড়িটার ছাদে অপেক্ষমাণ কোয়ালিশন আর্মির মেরিন স্কাউট টীমের তরুণ তুর্কি স্নাইপার ওয়াল্টারের দিকে।
ক্ষণিকের তীব্র মনোসংযোগ...আছড়ে পড়েছিল বুলেট ওয়াল্টারের ডানচোখের পাশে। থেঁতলে গেছিল পুরো মুখের ডানদিকটাই। প্রত্যুত্তরে প্রাচীরের কংক্রিটের বুকে ধাক্কা খেয়েছিল পরপর তিনটি রেমিংটন ৭০০ র বুলেট।
ওয়াল্টারের তদ্বির করার সময়টুকুও ছিলনা বাকি তিনজনের; তারা দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষায় ছিল সামান্যতম আভাসের।
তুলনামূলক সুবিধাজনক জায়গায় ইন পজিশন ছিল মাঝের জন। ছাদের জলনিষ্কাশন পাইপের সামনের উঁচু অংশটা বুলেটপ্রুফ বলেই ধরা যায়। ব্যাবধান পাঁচ থেকে সাত মিনিটের; ছেলেটি মাথা ঘুরিয়ে বাম দিকে সঙ্গীদের দিকে একবার চোখ বুলিয়েছিল.. এটুকুই। সম্পূর্ণ অদৃশ্য কোনও জায়গা থেকে আবার এসেছিল অব্যর্থ মারণাস্ত্র...
চারপাশের মৃত্যুশীতল অন্ধকার ভয়াবহতা আরও বাড়িয়েছিল; বাকি দুজনের মানসিক অবস্হা সহজেই অনুমেয় ছিল। তারা রীতিমত প্রশিক্ষিত স্নাইপার, পেশাদার.. কিন্তু রাতের অন্ধকারে আপাদমস্তক অচেনা রামাদির উপদ্রুত অঞ্চলের এক কুখ্যাত, মেনাসিং শয়তানের পাল্লায় পড়ে যাওয়া দুর্ভাগ্য বই কিছুই নয়। বাকি দুজনের সময়কাল ছিল সাকুল্যে দশমিনিট। এরি মধ্যে উপুর্যপরি দুটি গুলি... রাতের রামা।।তে নিঃশেষ হয়ে গেছিল একটা সম্পূর্ণ ওয়েল ট্রেইনড অ্যান্ড এক্সট্রিমলি স্কিলফুল স্নাইপার ইউনিট; উইদিন থার্টি মিনিটস -
ইয়েস, থার্টি মিনিটস। মাত্র আধঘন্টা সময় রাশিয়া-ফিনল্যান্ডের যুদ্ধের কিংবদন্তী সিমো ইয়োহাকে লজ্জা পাইয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
|| ৪ ||
মিলন যদি তব সনে এমন মধুর (২৪শে মার্চ)
গত কয়েকদিনের পরপর বিষ্ফোরণে জমাট বেঁধে থাকা থমথমে ভাবটা বাগদাদ থেকে কাটতে শুরু করেছে কাল থেকে। সাধারণ ইরাকিরা ঘরের বাইরে আসছেন... ঘুরছেন। এই সাময়িক আতঙ্ক বিরতি তাদের পরম পাওয়া; নিত্যদিনের দুঃসহ চাপে থাকা ইরাকবাসী।
ট্রেভিস বারেসসহ চারজন দক্ষিণ বাগদাদের যে জায়গায় কর্তব্যরত ছিল, তা মূল বিষ্ফোরণের কেন্দ্র থেকে কমবেশী দুই-তিন মাইল দূরে। অলস দুপুরের কর্মহীনতাকে ধূর্ত চার জোড়া চোখ জরিপ করে চলছিল। যে বাড়িটার ছাদে বারেসসহ পুরো ইউনিটটা তৈরী ছিল, তা এয়ারপোর্ট রোড থেকে কয়েকশো মিটার ভিতরে। গলি রাস্তাটা দিয়ে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত লোকজনের আনাগোনা... এরা বিদ্রোহী সংগঠনের কেউ নয়। আর্মড তো নয়ই। বারেস ভাবছিল, ইরাকি বিদ্রোহী সংগঠনগুলো যে ধাক্কা দিতে শুরু করেছিল, তাতে ঝক্কি পোহাবার সমস্ত উপকরণ বর্তমান ছিল। প্রশাসন গণতান্ত্রিক ইরাকি সরকার স্থাপনে পিছনে সরে আসেনি একচুলও। কোয়ালিশন আর্মি ইজ ওয়েল ইকুইপড...
সামনের গলি দিয়ে এগিয়ে আসা হুড খোলা জীপটার আওয়াজে চিন্তায় ছেদ পড়ে বারেসের। শক্ত হয়ে যায় প্রতিটি স্নায়ু, তর্জনী রেমিংটনের ট্রিগার ছোঁয়... ইফ সিচুয়েশন ডিমান্ডস, উইল নট স্পেয়ার এনি অফ দেম, মে ইট বি সুইসাইড স্কোয়াড অর এনিথিং এলস্ ...ওয়েট।
কতগুলো মাথায় ফেট্টি বাধা ইরাকি যুবক গান করছে তারস্বরে, আর দু'হাত উপরে তুলে বিসদৃশ নাচ। অজানা আনন্দ... ড্রাইভারটিও সরেস। মাথা দোলাচ্ছে সেও। শিথিল হয় বারেসের আঙ্গুল। যন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয় চোখ; তাকিয়ে দেখে সে ইরাকি আনন্দ। অপসৃয়মান গাড়িটি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই সমসাময়িক কি চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা গেছে জায়গাটা দিয়ে, শান্তির বাতাবরণেই এ জিনিস সবচেয়ে বেশী মানানসই বোধ হয়।
পেশাদারিত্বে আবেগের কোন জায়গা নেই..বারেসের চোখের চাউনি তে বাঁদিকে কিছু দূরে ১-৬৪ ব্যাটালিয়নের কলিন্স আবার মনোনিবেশ করে তার পরম আপন রেমিংটনে। কিন্তু পরপর যা চলে আসছে সামনে, তা যথেষ্টই কৌতুকোদ্দীপক। আবার একটি হুড খোলা জীপ, আবার তিন-চারজন ইরাকি, হাসাহাসি তে মত্ত। বারেস তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আজ পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা, আনন্দ ঝরে পড়ছে বাগদাদে হঠাৎ করেই। সেনাবাহিনী র গাড়ি লক্ষ্য করে মাত্র পাঁচ দিন আগে বোমাবাজির রেশ কেটে গেছে অনেকটাই মনে হচ্ছে। গাড়িটা বারেসদের চোখের সামনে দিয়ে বাঁদিকে এগিয়ে যায়... একজনের হাতে আবার ভিডিও রেকর্ডার; উফ্, হাসি পেয়ে যায় বারেসের।
নলটা ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে কলিন্স বুঝতেই পারতনা... হঠাৎ ধীরে ধীরে গাড়িটার ড্রাইভারের পাশের জানালা দিয়ে দরূহ কোণে বারেসের দিকে উঠে এসেছিল। পাশে চালু থাকা ভিডিও রেকর্ডার সাফল্যের সংবাদ সারা বিশ্বে পরিবেশনের জন্য তৈরী... সম্পূর্ণ অরক্ষিত বারেসের বাম চোয়াল।
পেশাদারী বিদ্যুৎগতি, ক্ষণিকের জন্য সারা শরীরের সমস্ত পেশী চুক্তিবদ্ধ কলিন্সের; বন্দুকধারীর বুকের বাঁদিকে টার্গেট করা অপেক্ষাকৃত সহজ তার কাছে, রেমিংটনের বুলেট পরপর ছুটে যায়... তারপর আরও কয়েকটি।
|| হেন বিরহে তার ||
লম্বা, ফর্সা মৃতদেহের মুখটি দেখে বারেসের পক্ষে কঠিন হয়েছিল বিশ্বাস করা যে এই লোকটিই জুবা, কতগুলো স্পেশাল ফোর্সের দফায় দফায় ইরাকে নিয়োজিত হওয়ার কারণ। ছিপছপে, লম্বা ও গালে চাপ দাঁড়ি... কলিন্সের বুলেট হৃৎপিণ্ড পরপর ছ্যাঁদা করে দিয়েছিল। শয়তান নিজে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন... বারেস ভাবে; মুহূর্তের অসতর্কতার মাশুল চড়া দামে মেটাতে হতো। ধাঁধা লাগানোর পরিকল্পনা জুবার মস্তিষ্কপ্রসূত কিনা আর বোঝার উপায় নেই; কিন্তু বাজি প্রায় জিতে নিয়েছিল সে। খাতায় কলমে সে যৌথবাহিনীর একচল্লিশ জনকে গ্রেভ ইয়ার্ড দেখিয়েছিল... ইরাকি মিথ অনুযায়ী সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশী।
বাগদাদি ঘাতক সম্পর্কে মেজর জন প্লাস্টার এ বি সি নিউজকে বলেছিলেন, "অ্যান্ড হি হ্যাজ দ্যা জাজমেন্ট অ্যান্ড ডিসিপ্লিন টু টেক আ শট, ওয়াইজলি চুজ অ্যান এস্কেপ রূট অ্যান্ড ইমিডিয়েটলি ডিপার্টস টু অ্যাভয়েড ক্যাপ্চার। দিস ইজ নট আ জিলট; দিস ইজ আ ক্যালকুলেটেড শুটার।"
নিখুঁত হিসেবী, শীতের সন্ধ্যার হঠাৎ আসা হাওয়ার মতো শিরশিরে চোরা আতঙ্ক ইরাকি জুবা বাগদাদের হাওয়াতেই হয়তো মিশে গেছিল আবার।
0 comments: