2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বিপুল দাস

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


কবিতার জন্ম 
বিপুল দাস 



(ব্যবহৃত পংক্তিগুলো কবি তপন রায়, সমর চক্তবর্তী, তুষার চৌধুরী, রাহুল পুরকায়স্থ ও জীবনানন্দের।) 

মানুষ কি তার নিজের রহস্যময়তা টের পায়? মানুষ কত সহজে ভুলে যায় তার এই শরীর, বড় আদরের এই শরীর আসলে আকাশবাতাস, তেজোময় শক্তিকণা, জলমাটি দিয়ে তৈরি। মৃত্যুতে তো উপাদানের পরিবর্তনমাত্র। জড় ও জীবের ক্রমাগত রূপান্তর এই জীবনপ্রবাহ। প্রকৃতিকে মানুষ কেমন করে ভুলে থাকবে। যদি এই পৃথিবীতে শুধুই জীবন থাকত, কণামাত্র জড় নেই কোথাও, তবে চেতন ও অচেতনের দ্বন্দ্বে জীবনের যে লীলাময়তা ফুটে ওঠে, যথার্থ অর্থে জীবন বিকশিত হয় – কেমন করে সেই সুর বেজে উঠত। 

প্রকৃতির ভেতরে সেই রহস্যময় সঙ্গীত, সেই প্রচলিত সমস্ত সংজ্ঞা মিথ্যে করে দেওয়া সঙ্গীত খুব গোপনে বাজে। মানুষ বড় বেশি সাংসারিক শব্দে সেই ধ্বনি, বিপুল তরঙ্গময় সেই গভীর বীণা শোনে না। আর যে শোনে, তার বড় তকলিফ হয়। এই গান কুয়াশার মত মগ্নচৈতন্যে ছড়ায়। এই সঙ্গীত দিব্য, অথচ এক বিষাদময় রাগরূপ সৃষ্টি করে। সে আর এই পৃথিবীর থাকে না, সে একা হয়ে যায়। অনন্ত দুঃখের পাষাণ-ভার বুকের ওপর চেপে বসে। 

একটা হাত এগিয়ে আসে। কখনও মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরার পথে, কখনও অলিম্পিয়ায় বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করার সময়। দু’একবার রমণকালেও। সে হয় পার্ক স্ট্রিটের ফুলওয়ালি, সে হয় শুঁড়িখানার মদ্য-পরিবেশক, সে হয় আমার অকালে মৃত গোপন প্রেমিকা। কিন্তু সব হাত এক রকম মনে হয়। নোটিস থাকে সেই হাতে। নিলামের ঢোল বাজে। এই নাও, তোমাকে দুঃখ দিলাম। যদি সেই প্রমা চাও, তবে তুমি একা। যদি স্বাধীনতা চাও, তবে তুমি একা। যদি রমণে দৈব-সম্ভোগের পুলক চাও, তবে তুমি একা। তোমাকে দিলাম বিষাদসিন্ধুর অতলান্ত গভীরতা। তোমার বুকের বাতাস আমার কাছে গচ্ছিত রেখে নেমে যাও। 

চূড়ান্ত প্রশ্নের জন্য কবির ক্রমাগত অন্বেষণ। এই চূড়ান্ত প্রশ্ন কবির গোপন ত্রাস। এই প্রশ্ন সংসারের মলিনতা থেকে দূরে, অনেক গভীরে বিষাদময় কুয়াশায় লুকিয়ে-রাখা প্রত্নসম্পদ। পাবলিক আবিল হাতে ছুঁতে চায় ওই স্বর্ণময় নিস্তব্ধ যন্ত্রণা। স্বর্ণময় যন্ত্রণা ছুঁয়ে দিলে মোহাবরণ খসে যায়। কনক-বিভা নিতান্ত সাংসারিক পাউডার হয়ে যায়। যা ছিল তেজস্ক্রিয় অস্পৃশ্য উজ্জ্বল ধাতু, ক্রমাগত disintegration-এর ফলে শেষ পর্যন্ত নিতান্ত সিসায় পরিণত হয়। জগত দ্যাখে জীবনের সেষ, আসলে শক্তির রূপান্তর। 

কবি শুধু খুঁড়ে যায়। হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভাবে মনে পড়ে অনন্ত টানেলের শেষ বলে কিছু নেই। আছে শুধু নাস্তির গা-ছমছম করা ধারণামাত্র। তাতেই অন্তরাত্মা শিউরে ওঠে। আসলে তাহলে কিছু নয়, কিছু নেই। তবে কেন রাত জেগে একটি প্রার্থিত শব্দের জন্য প্রাণপণে পরিত্রাণ প্রার্থনা। কী আসে যায়, যদি ওই শব্দ আর না-ই খুঁজে পাওয়া যায়। একক মানুষের এই নতজানু পরাজয়ে কী আসে যায় অসীম ভরসম্পন্ন মৃত নক্ষত্রদের, ছায়াপথের অর্বুদ আলোকবিন্দুর, জড়পৃথিবী ও পৃথিবীর প্রাণপ্রবাহের। ত্রাসে কেঁপে ওঠে এই অস্তিত্ব, যখন ‘কারণবিহীনতাই কারণ’ –এই বাক্য ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত হয়। কোথাও মহাপরিণাম অপেক্ষা করে আছে। কারণবিহীনতাই কারণ – এই সত্য উদ্‌ঘাটিত হলে সহসা এক সফল মানুষ গৃহকোণ ও গ্রামাফোনের মায়া তুচ্ছ করে কোথাও চলে যায়। আমরা বলি ‘বিপন্ন বিস্ময়’’। 

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলছে নিয়মের ছন্দে। কোথাও এতটুকু ব্যত্যয় হওয়ার উপায় নেই। কবি শুধু খুঁড়ে যায়। একটি শব্দের জন্য মাথা কুটে মরে। যেন ওই শব্দ পালটে দেবে নিয়মের ভুবন। সুশৃঙ্খলের বিন্যাসের অবয়ব থেকে একটি কুসুম ছিঁড়ে ফেলে একমাত্র কবিই পারে ওই ফোটোগ্রাফিক বিন্যাসকে রহস্যময় করে তুলতে। কবিই শুধু শিকল ভাঙার সাহস দেখায়। কবিই আর্কিমিডিস, যিনি বলেছিলেন – পৃথিবীর বাইরে দাঁড়ানোর মতো একটু জায়গা পেলে আর যথেষ্ট লম্বা একটা দণ্ড পেলে আমি পৃথিবীকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি। 

আসলে একটা গোলমাল পাকাতে হয়। এ গোলমাল অন্য জিনিস। মালটা ঠিক গোল নয়, কিন্তু বড় গোল বাধায়। গেল-গেল রব ওঠে সমস্ত সংসার জুড়ে। শিমুলতুলোর নরম বালিশ এবং বিশ্বাসী পাপোষও আর নিরাপদ মনে হয় না। দেশি নিরোধে ভরসা পাওয়া যায় না। 

আসলে ত্রাস, আসলে সংকট। ঘর্ষণহীন মসৃণ জীবনযাপনে কোনও সংশয় নেই, দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ববিহীন মসৃণ জীবনযাপনে কোনও ফুল ফোটে না। সংশয় থেকেই শিল্পের জন্ম। 

তবে কি করিন্থের রাজা সিসিফাসের মতই কবির নিয়তি। এক অন্ধশক্তি কি তাহলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের চালিত করে। এই শক্তিও বিশ্বব্রহ্মান্ডের সনাতন নিয়মের মতো অমোঘ ও স্থবির। তবে আর কেন বেঁচে থাকা। ত্রস্ত জীবনযাপনের সড়কি এবং বল্লম, সংকটের কুঠার ও থানইটের আঘাতে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত হতে হতে একজন দুখি মানুষ যখন বেঁচে থাকার পথ খোঁজে, তখন ভেতরে একটা লড়াই শুরু হয়। মুক্তিবেগের তীব্র কামনায় থরথর কেঁপে ওঠে সমগ্র অস্তিত্ব। তারপর মহানিষ্ক্রমণ। ভুবন ভরে ওঠে ক্ষারগন্ধে। তখন শিল্পের জন্ম। 

কবিতা লিখতে তার ভয় করে। ব্রহ্মস্বাদ কাকে বলে ধারণাতেই আসে না। উপনিষদ-টিষদ পড়েছে, এমন এক বন্ধুর কাছে একদিন সে একান্তে ব্যাপারটা বুঝতে চেয়েছিল। বন্ধু হেসে বলেছিল – তোর সঙ্গে একদিন বসতে হবে। অলিপাবে চলে আয়। বসা হয়নি। কাব্যকে কেন বলা হবে ব্রহ্মস্বাদ-সহোদরা? যতদূর জানা যায় 

ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছন্তি ন বাগ্‌গচ্ছন্তি নো মনঃ। 
ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষাৎ।। 

আমাদের দৃষ্টির বাইরে, আমাদের বাক্যের বাইরে, আমাদের মনেরও বাইরে – তা হলে আচার্যদেব কী ভাবে শিষ্যদের কাছে ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করবেন ? 

সমস্ত পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ব্রহ্মা স্বতন্ত্র। কবি কী ভাবে ব্রহ্মস্বাদ-সহোদরার কাছে যাবে। এই জড়জগতের সঙ্গে কবি তার অস্তিত্ব আপেক্ষিকতার হাজারও বাঁধনে বেঁধেছে। এই দৃশ্যমান জগতের সঙ্গেই তার অবিরত সংঘর্ষ। এই কামনাবাসনাময় শরীর, ইন্দ্রিয়মগ্ন হতে হতে ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে দূরে কোথাও ফুটেওঠা চাঁপাফুলের গন্ধ কবি পায়। তখন সে বুঝতে পারে – এই তো সত্যি। একটু বেলা হলে মনে পড়ে আজ রবিবার। তাড়াতাড়ি গিয়ে কবি মাংসের দোকানে দাঁড়ায়। এসব নিয়েই তো তার বেঁচে থাকা। বড় জান্তব বেঁচে থাকা। 

অথচ কবিতা লিখতে গেলেই সেই ভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গের দিকে কেউ ডাক দেয়। কী ভীষণ মায়াবী, অথচ অমোঘ সর্বনাশের মত ডাক দেয়। ওই কি কল্পনার দেবী? তারই ইচ্ছেপূরণের বাসনায় যার জন্ম। অথচ সে কি জানে অপেক্ষার শেষে অপেক্ষা করে আছে ত্রিভুবনজোড়া ‘না’-এর অন্ধকার। ও-ই বাঘিনী। খায় লোহা, বোতাম, প্লাস্টিক, দমকলের গাড়ি। জাহাজ অদৃশ্য করে। খায় তার হাড়মাংস। রক্ত চাটে। আর সংসার পায় রন্ধনকালীন সুগন্ধ। শেষে পরিতৃপ্তির উদ্‌গার তুললে সেই শব্দ শোনার জন্য কেউ থাকে না। প্রকৃতপক্ষে শব্দ শোনাই যায় না। আমাদের চেনা বাতাসের বাইরে অন্য বাতাস বয়। আমাদের সাংসারিক সময় সেখানে দালির ঘড়ির মত গলে গলে মিশে গেছে থকথকে অন্ধকারে। সুতরাং, নাস্তি, চির অন্ধকার অথবা বাঘিনীবিষয়ক এই গল্প সংসারে অশ্রুত থেকে 

তখন বড় কষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসে। ব্রহ্মস্বাদ কাকে বলে , সে জানে না। কবিতা লিখতে তার ভয় করে। রাস্তার চাপাকলে বস্তির সুন্দরীকে স্নান করতে দেখলে তার মনে পড়ে প্রাচীন গ্রিসের কথা। গভীর রাতে ভিক্টোরিয়ার সামনে একটা টাঙা উলটে পড়ে আছে। তার মনে হয় শেষ যুদ্ধ সাঙ্গ হওয়ার পর থেকে নিঃশব্দে পড়ে আছে ওই গাড়ি। শতাব্দীর ধুলোর ঝড়, সহস্র উল্কাপাত এবং বিদেশি মাল্লার কৌতূহলী দৃকপাতেও স্থবির। কোনও এক মায়াবী বিকেলে খিদিরপুরের দিকে ট্রাম চলে গেলে সভয়ে দেখি ময়দানের নবদুর্বাদল মখমল গালিচার নীচে একজোড়া চকচকে ধাতব ট্রামলাইন। আড়ালে আড়ালে থাকে। সবুজের মোহিনী মায়ার নীচে ওৎ পেতে থাকে একজোড়া ধাতব হুংকার। মাথার ভেতরে অস্পষ্ট ছবি নাচে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা ট্রেন গেল। মালগাড়ি, না প্যাসেঞ্জার, মেটেলাল, না নীলসাদা – কবি বুঝতেই পারল না। শুধু একটা ‘কু’ ডাক শুনতে পেল সে। 

এসব নিয়ে তার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। খাতাকলম নিয়ে দস্তুরমত প্রস্তুতও হয় সে। ভাবতে থাকে। আসলে কী বলতে চায় সে, তা-ই ভাবে। নরম শব্দ, গরম শব্দ, হালকা এবং ভারি শব্দ। ছন্দের প্যাঁচপয়জার, মাত্রা-গণ-মেল। এসব নিয়ে খুব ঝামেলা শুরু হয়। য-ফলা এবং বিসর্গের ওজন নিয়ে খুব আতান্তরে পড়ে যায় সে। আর ক্রমাগত ভাবতে থাকে পথের ধারে চাপাকলে স্নান করা বস্তির সুন্দরী দেখে কেন তার মনে পড়ে প্রাচীন গ্রিসের কথা। তার মুগ্ধ চোখ সেই ভেজা শরীর ছুঁয়ে ছিল সেকেন্ডের ভগ্নাংশ। কই, কোনও অপরাধ বোধ তো জাগেনি। শুধু দেখতে পায় নীল সমুদ্র। বন্দরে সারি সারি জাহাজ, দশ বছরের জন্য ট্রয় অবরোধ হবে, লাসিডিমনের রাজা মেনেলাউসের বউ হেলেনকে চুরি করে নিয়ে গেছে ট্রয় রাজপুত্র প্যারিস। সে লেখে – প্রতিটি প্রণয়-হত্যা বারবার লিখে যেতে চাই। অ্যালকেমির খেলা শুরু হয়। সে খুঁড়তে শুরু করে। 

তখন প্রথমে একটা মৃদু কিনকিন শব্দ শোনা যায়।একটু পরে সেটা হয়ে যায় কুট্টুস কুট্টুস। এটা হ’ল ঘুণ পোকার কাঠ কুরে খাওয়ার শব্দ। ঘুণের ঘন্টা। তার শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে। সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে এখন খুনির দুপুর। কতগুলো রক্তচাটা হিংস্র কালো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তখন একটা লড়াই শুরু হয়। তার মাথার ভেতরে সূক্ষ্ম একটা ইশারা পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্যার মত চোখ মারে। সে লেখে – প্রলয়ে আনন্দ জাগে, আনন্দে প্রলয়/ এ পৃথিবী সুরা আর জীবশস্যময়। 

সুরায় কারণবারির কথা মনে পড়ে। যে জল থেকে জন্ম প্রাণের। পৃথিবী জীবশস্যময়ে হয়ে ওঠে। তবু কেন শেষ পর্যন্ত বিষাদ আসে। রোমান্টিকতার সমস্ত পথের শেষে তা হলে যে অপেক্ষা করে আছে, সে আসলে এক বিষাদময়ী। মানুষ কি তা হলে কোনও ভাবে অবচেতনের প্রছন্ন সংকেতে বা আর কোনও রহস্যময় নিগূঢ় ইশারায় টের পায় অবিমিশ্র সুন্দর পূর্ণতা পায় না। বোদলেয়ার-বিষয়ক বুদ্ধদেব বসুর আলোচনায় দেখি এক জায়গায় তিনি(বোদলেয়র) বলছেন – “ আনন্দ তার এক ইতরোচিত ভূষণ, কিন্তু বিষণ্নতা তার মহিয়সী পত্নী। যার সঙ্গে দুঃখের কোনও সম্পর্ক নেই, এমন কোনও সৌন্দর্য আমার ধারণাতীত”। পরে আমরা দেখতে পাই – তার বিষাদ পরিণত হয়েছে বিতৃষ্ণায় – শুধু জগতের প্রতি নয়, তার নিজেরও প্রতি; এবং বিতৃষ্ণা থেকে সঞ্জাত হয়েছে নির্বেদ। সেই বিরাট, বহুকথিত বোদলেরীয় নির্বেদ – যা ‘ব্যাপ্ত হয় অমরত্বে, অন্তহীন যার পরিমাণ’। নির্বেদকে তিনি বলেছেন ‘জড়ের সন্তান’, যার প্রভাবে সময়ের মন্থরতা অসহ্য হয়ে ওঠে, নিজেকে মনে হয় ‘নামহীন ত্রাসে পরিবৃত এক শিলাখন্ডমাত্র’। 

এই ত্রাসের কথা বলছিলাম। বিষাদ থেকে যে বাষ্প উঠে আসে, ঘনীভূত হতে হতে একখণ্ড কালো মেঘ হয়ে যায়, সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে মেঘ ঘনায়। সংশয়ের মেঘ, সংকটের মেঘ। অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতার মসৃণ ম্যাজিকমলম মাখানো অবস্থান থেকে উঠে এসে -- “চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে/একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা ...। আর সে লেখে – “ যে রাত দংশনে জাগে/ আমি তার অন্ধ ক্রীতদাস ... যে রাত দংশনে জাগে/ আমি তার বিদেহসঙ্গম। 

কায়াহীন এই সঙ্গম ছাড়া মুক্তি নেই কবির। দংশনে উচ্ছ্রিত হয় বাসনার তপ্তশ্বাস, চোখ আর সনাতনকে দেখতে পায় না। নিবেদনের মন্ত্রপাঠ সারা হলে তার পিঠের ওপর প্রভু উঠে বসেন। সে তার অন্ধ ক্রীতদাস। এই নাও ক্ষত, এই নাও অনন্তযোনি 

আমি এক বিষাদময়ীর কথা বলতে চেয়েছিলাম। প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় যে নান্দনিক অনুসন্ধিৎসা খুঁজে মরে এক কঙ্কাবতীকে, যে নারীর চোখের তারায় কবি আলো খুঁজে পায়, ভাবে – এই তো আমার পরম পাওয়া, প্রকৃত এবং পূর্ণ সৌন্দর্য সে কোনও দিন খুঁজে পায় না। কারণ – “চোখের তারার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির –পৃথিবীর কঙ্কাবতী সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর। শরীরী সৌন্দর্য পার হয়ে গেছে পৃথিবীর কঙ্কাবতী। ‘ম্লান’ শব্দে বিষাদ ব্যাপ্ত হয়। ‘ধূপের শরীর’ – এই শব্দে অলৌকিক, রহস্যময়, বিমূর্ত সৌন্দর্য ফোটে। তবে হোক বিদেহসঙ্গম। 

কবি তো আসলে দ্রষ্টা। জাগতিক, মহাজাগতিক কিছু খণ্ডমুহূর্তের ব্যতিক্রমী ঘটনায় সাময়িক ভাবে সংসারে আলোড়ন ওঠে। কিন্তু এসব ব্যতিক্রমী ও অনুক্রমী ঘটনার অনুপুঙ্খতা কবির মগ্নচেতনায় যদি সমগ্র জীবনপ্রবাহ, জড় ও প্রাণের রহস্যময়তা এবং শেষ সত্য কী – এসব প্রশ্ন না তোলে, যদি ভূমাদর্শনের আকাঙ্ক্ষা না-ই জাগে, তবে কেন কবিতার জন্য অমরত্বের বাসনা তুচ্ছ মনে হবে। তবে কেন প্রাণপাত, প্রণিপাত। কবির থাকে ইতিহাস চেতনা। সাংসারিক মানুষের আড়ালে অন্য মানুষ খোঁজার সাধনা, মৃত্যু ও যৌনতাবিষয়ক চূড়ান্ত জিজ্ঞাসার তাড়না। সামগ্রিকভাবে মানবাত্মার লাঞ্ছনার জন্য বিষাদ। একই সঙ্গে সে ত্রস্ত হয়, গ্রস্ত হয়। যতই ত্রস্ত হয়, ততই গ্রস্ত হতে থাকে। চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে ধাবিত হয় সমস্ত মেধা ও মনন। শেষতক দ্রষ্টা যখন স্রষ্টা হয়ে ওঠে, তখন বমি পায়। হাতে উঠে আসে ছেনি, তুলি, কলম। কবি তখন লেখেন -- 
দেশকাল অন্ধকার, দেশকাল অঙ্গের বিকার 

বিকৃতি হে, ভালোবাসি তোমার রন্ধনশালা 
তোমার প্রতিভা। 

এই বিকৃতি (Distortion) শিল্পের জন্মগাথায় নান্দীপাঠ। এই বিকৃতি এক আরশি। এই আরশি থাকে রানী ভানুমতীর তাপ্পিমারা ঝোলায়। এই বিকৃতি মানুষকে পাগল করে, প্ররোচিত করে, সন্ন্যাসী ও প্রেমিক করে। কবি সেই আরশির ভেতরে অরূপদৃশ্য, অলীকসুন্দর খুঁজে পায়। দেশ (space), কাল (Time) মিথ্যে হয়ে যায়। এই বিকৃতি আলতামিরার গুহায় ছবি আঁকে, স্পেনীয়-আলজিরিয়ার রৌদ্রস্নাত প্রান্তরে সূর্যমুখী ফুল ফোটায়, টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে জীবনে অন্তত একবার সূর্যাস্ত দেখার সাধকে প্রকাশ করে। 

কাকে বলে কবিতা? কোন রসায়নে কয়েকটি শব্দের বিশেষ বিন্যাস ও বিশেশ সমন্বয়ে একটিমাত্র বাক্যও কবিতা হয়ে ওঠে ? সম্প্রতি বন্ধুকবি সমর চক্রবর্তীর কবিতার বই-এ একটি পৃষ্ঠা জুড়ে একটিমাত্র লাইন পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন – এখনও যা অলিখিত/তার সাদা তোমাকেই পড়ে নিতে হবে। 

বুঝতে পারি, লাইনটি লিখেই কবি লুকিয়ে পড়েছেন। ন’টি শব্দের গোলোকধাঁধার রহস্য ভেদ করে তাকে চিনে নাও। তার সঙ্গে যোজনদূরত্বের কুয়াশা সরিয়ে তার ইশারাটুকু বুঝে নেবার দায় কবি যেন পাঠকের দিকেই ছুঁড়ে দিলেন। আবার – “হে প্রাণ ভোরের রথ/ তোমার ভ্রুকুটি আমি ফুল ভেবে তুলি প্রতিদিন” ( রজকিনীর হাঁস, তপন রায়)। এ যেন সেই সিসিফাসের গল্পই দু’লাইনে বলা হ’ল। মানুষের যা কিছু অর্জন, যা কিছু মনে হয় পরমধন – আসলে সে প্রাণের ভ্রূকুটি। অনন্ত জীবনপ্রবাহের কৌতুকজড়ানো নিষেধের তর্জনী থাকে ওই ভ্রূকুটির আড়ালে। মানুষ বোঝে না। ছোট্ট একটা তরঙ্গকে মনে করে সিন্ধুকল্লোল। কায়া মনে করে যাকে তীব্র আবেগে আলিঙ্গন করেছে, আসলে সে মায়া। চিরবহমান প্রাণের রথ ভ্রূকুটি তোলেন শুধু। মানুষ বোঝে না। কবি টের পায়। সূক্ষ্ম ইশারাটুকু কবি বুঝতে পারে। তারপর শব্দ দিয়ে তার আরতি শুরু হয়। 

তুমিও কল্পনা, তুমি রতিমরীচিকা 
যতিভ্রমে গতি আনো প্রাণ 
সন্তরণপটু পক্ষী 
বাতাসে আজান। 

আজান তো মুক্তির আহ্বান। হায়্যা আলাল-ফালাহ্‌। মুক্তির দিকে এসো। 

কালের স্রোতে রামায়ণ, মহাভারত, হোমারের কাব্যকৃতি, মৃচ্ছকটিক, রঘুবংশ, এমন কী মেঘনাদবধ কাব্যও যে দার্ঢ্য নিয়ে আজও অম্লানজ্যোতি, তার মূলে চিরকালের সত্যকে অনুসন্ধানের ইতিহাস রচনা। ব্যক্তিমানুষের কামক্রোধলোভমোহমদমাৎসর্যকে নিংড়ে, তার ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে দেশ ও সমাজের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কখনও বা বাস্তবকে অতিক্রম করে পরা-বাস্তবের কুহকি মায়ার আভাস – এভাবেই সে সব লেখা বিশেষ সময়, বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও দেশকালপাত্র নিরপেক্ষ এক চিরকালের গাথা হয়ে যায়। আলোছায়ার ব্যবহার যেমন ছবির ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বিষয়বস্তুকে ত্রিমাত্রিক ধারণাযুক্ত করে, কবিতার ক্ষেত্রেও আলোছায়া যদি না থাকে, তবে কখনওই সেটি সার্থক কবিতা হয়ে ওঠে না। কবির কাজ নিজের চৈতন্যে নিহিত রূপকে আশ্রয় করে অরূপের সন্ধান। রূপের এই ধারণা সে অর্জন করেছে হাজার বছর ধরে লালিত সৌন্দর্য-বিষয়ক সংস্কার থেকে। জীবনযাপনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, যত বই সে পড়েছে – তার সারাৎসার, সিনেমা, নাটক, গান, চিত্রকলা – এসব তার অন্তর্লোকে সুন্দরের ধারণা তৈরি করে দেয়। অবশ্য এই সংজ্ঞা নিতান্তই অ্যাকাডেমিক। তাড়িত কবি এই সংজ্ঞা তার নিজের মত করে পালটে দিতে চায়। প্রচলিত অবয়ব ভাঙতে ভাঙতে তার যাত্রা শুরু হয়। শেষে সেও একদিন লোরকার মত বুঝতে পারে মরণ আর ভালোবাসার কেমন নিত্য সহবাস। 

আসলে এক নির্দেশতন্ত্রের ভেতরে আমাদের বেঁচে থাকা। পারিবারিক, সামাজিক, শারীরবৃত্তীয়ভাবে, এই নির্দেশতন্ত্র সমাজে সব সময় সক্রিয়। লক্ষ বছর পেরিয়ে গেলেও মূলগতভাবে এই তন্ত্র অপরিবর্তিত। সেই ঘৃণা, যৌনতাড়না, খিদে, লোভ, আরও শস্যশ্যামল উর্বর জমির লোভে এক্সোডাস, প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন কৌওল আবিষ্কার। হেমলক থেকে ফলিডল হয়ে মেট্রোর থার্ড লাইনের দিকে বিপন্ন ও বিস্মিত মানুষের চলে যাওয়া। এই তন্ত্রের কাছে শরীর অসহায়। 

আমাদের বেঁচে থাকার অনেক সেট আছে। কখনও তাদের ভেতরে ইন্টারসেকশন হয়, কখনও ইউনিয়ন হয়। সব মিলে মনে হয় – আঃ, এই তো কী সুন্দর বেঁচে আছি। কবির থাকে সেই নির্দেশতন্ত্র অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস। ভেতরে ভেতরে একটা এক্‌সেন্ট্রিসিটি (উন্মার্গগামীতা?) তাকে প্ররোচিত করে। কারও কারও ক্ষেত্রে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ জীবনযাপনের সেটে ভরকেন্দ্র টালমাটাল করে। আবার বহিরঙ্গে অত্যন্ত ভারসাম্যযুক্ত কবিকে দেখেও আমার বিস্ময় জাগে তার অন্তর্লোকে উচ্চারিত নিভৃত-সংলাপ কী তীব্র উচ্চারণে ছিন্নভিন্ন করে আমাদের স্ট্যাটাস-কো-এর এই বেঁচে থাকার, আপাতত শান্তিকল্যাণের এই সময়কে। তার অবচেতনেও সেই সংকট কাজ করে। বলা বাহুল্য এই সংকট ব্যক্তিমানুষ ও সমগ্র মানব অস্তিত্বের সংকট। সমকালের কথাকেই তিনি নিয়ে যান চিরকালের চিরন্তন এক কথায়। সুনামিতে মৃত মানুষ ও বস্তি থেকে উৎসন্ন মানুষের দুঃখগুলো জুড়ে জুড়ে আরও বড় সন্ত্রাস, মহাজগত ও মহাজীবনের চিরকালীন রহস্যময়তার দিকে কবির যাত্রা। 

কী খোঁজেন কবি ?কখন জীবন আর মরণের সীমারেখা ঘুঁচে যায়। পরম সত্য কী -- খায়, না মাথায় দেয় ? সত্যকে খুঁজতে গিয়ে যদি দেখা যায় স্বর্গীয় নরক ? এই স্বর্গ আর নরকের ধারণা তো মানুষেরই তৈরি। তা হলে প্রকৃত স্বর্গ বা প্রকৃত নরক বলে কিছু নেই ? তা হলে আমদের কল্পনার যাবতীয় অবস্থার বাইরে কী আছে ? কিচ্ছু নেই। আবার সেই পরম নাস্তির কথা এসে গেল। চরম অন্ধকারের কথাই ফিরে এল। 

আমাদের সংসারের সুন্দর তাহলে ফিরে যাক। বিকৃত হোক বৈয়াকরণের বেঁধে দেওয়া সুন্দরের সংজ্ঞা। শব্দের আন্তর-আণবিক শক্তিকে জাগাবে বলে সুন্দরীর শবের ওপর সাধনায় বসুক কবি। সোজাসাপটা নিয়মে-বাঁধা যে ভয়ঙ্কর পাথর থমকে আছে খাদের কিনারায়, তাকে গড়িয়ে যেতে দাও। হুড়মুড় করে জাপানি তেল ছাড়াই প্রকৃত লিঙ্গোত্থান হয়। উপত্যকা ভেঙে যায়। চা-বাগানে ধ্বস নামে। লতাগুল্ম ছিঁড়ে যায়। একক মানুষের বাবা, মা, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, পিসেমশাই, বন্ধু, প্রেমিক, একজন চাকুরিজীবী ইত্যাদির পরিচয়ে জনকে বেঁধে রেখেছিল ওই লতাগুল্ম। আর ওই লিঙ্গোত্থান আসলে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কবির শস্ত্র। জন্মবীজের নান্দীপাঠে দৃঢ় কথকতা। তবে জন্মবীজের ওদিকে শরীর যায় যাক। রক্তমাংসমেদমজ্জা চোলাই করা একবিন্দু অনিবার্য সংকেতে থেকে যায়। 



... প্রতি ভোরে 
যমের দখিনদ্বার, গুহামুখে উড়ছে পতাকা 
আমাকে ও-ধ্বজা দাও 
ধ্বজার শোণিতে মেলি ডানা 
মৃতের সঙ্গম থেকে 
জন্ম নিক সুরের বেদনা। 

দীর্ঘ কবিতার/ কত কাছে যেতে পারে একাকী মানুষ/ নির্জনতা, আজও হায় ইশারামর্মর। 

এই নির্জনতা ধূসর উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। মৃত্যুগন্ধবাহী এই নির্জনতা শেষ পর্যন্ত কবির গম্য। নিয়তির মত বাতাস আসে। জাগতিক সম্পর্কের উষ্ণতা দিয়ে আমাদের সুস্থিত বেঁচে থাকার জন্য হিম-নৈঃশব্দকে ভাঙার আয়োজন শুরু হয়। কিন্তু উড়ে যায় সেই আয়োজন। কোথা থেকে বাচাল হাওয়া আসে। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কবি দেখতে পায় – শিরা উপশিরা দিয়ে কামসূত্র দিয়ে / যেই সব মায়াতাঁবু একদা খাটানো হয়েছিল/ হিম মালভূমি থেকে হাওয়া এসে সে সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে; (তুষার চৌধুরী)। এই হাওয়া ইশারামর্মর। এই হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়েও এক ফোঁটা বাতাসের জন্য দমবন্ধ হয়ে আসে। তখন কেউ কানে কানে বলে – সুন্দরের সঙ্গ যদি চাও, জীবনেমরণে তুমি একা (হিমেনেথ, অনুবাদঃ শঙ্খ ঘোষ)। 

ত্রিগুণের আধার আমাদের এই প্রকৃতি। প্রাণের নিজস্ব প্রবৃত্তি তমোগুণের গড়ানো ঢালের দিকে। আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্বে অন্ধকারই যেন আলোর অধিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শিল্পের জয়জয়ন্তীর আসরে তামস-উৎসব। প্রাণের নিজস্ব নিয়মে সে কি বোঝে আসলে শূন্য সব। তার আগে কবি দেখে নিতে চায় ধ্বংস। এই কি চূড়ান্ত রতিসুখসার। নাকি চূড়ান্ত প্রহার। সময় স্থির হয়ে আসে। সুন্দর ভেঙেচূরে যাচ্ছে। প্রাণ আসলে মুখোমুখি হতে চেয়েছিল মৃত্যু। কেমন সে সুন্দর। “ মৃত্যুর প্রতীকে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ / মৃত্যু এক যৌন প্রতিচ্ছবি/ কিছুই পাওয়ার নেই চিতার ভস্মের মত মসৃণতা ছাড়া”(তুষার চৌধুরী)। 

আততায়ী ত্রাস অপেক্ষা করে থাকে প্রত্যেকটা বাঁকে। “ কবিতা কল্পনালতা / সেও মৃত্যু লেখে বাঁকে বাঁকে”। কোথাও মাথায় ঝালর-দেওয়া রঙিন কাগজের টুপি মাথায়, অন্য পৃথিবীর পোশাক-পরা গাধার পিঠে – সে কবি। আবহমানের ভাঁড়। অন্যজন্ম থেকে উঠে এসে আত্মরতিপর ‘তোমার’ সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে বলে অপেক্ষা করে আছে। 

প্রাণের এই তামসযাত্রার শেষে সব স্থির হয়ে আসে। কবি দেখতে পায় – “ ... সংকেতচমক তুমি চমকসংকেত/ যতিচিহ্নে অগ্নিগ্রন্থি, ক্ষত গুঞ্জরণ/ নিয়তিতাড়িত শিখা, অস্থিচর্মসার/ আবার ডুবছি দেখি বিষাদতামসে/ তামসজর্জর আত্মা, আবেগমন্থন/ করে তোলো বিষ আর গরলপিপাসা/ জলরেখা ভাঙে দ্রুত, দিগন্ত চৌকির/ আলো ক্রমে স্তব্ধ হয়, স্থির হয়ে আসে/ স্থির রক্ত, স্থির মজ্জা, স্থির যৌনতায়/ আনন্দ বিলাও তুমি, অস্থির বিলাও 

এই আনন্দ সেই বিখ্যাত absurd, এই ‘অস্থির’ সেই ইশারামর্মর ভেঙে ডিকোড করতে করতে না পারার নির্যাতন। এই আনন্দ আর অস্থির আসলে মহাজাগতিক অসীম শূন্যতা, ব্রহ্মান্ডের জড়বস্তুসমূহে ব্যাপ্ত সীমাবদ্ধতা ও অসীমের কারণ-নির্নায়ক রহস্যময়তা। কবি তাই দার্শনিক। এই পৃথিবীকে, এই সৃষ্টিকে কবিই একমাত্র ডি-সেকশন করার সাহস দেখাতে পারে। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে শেষ পর্যন্ত প্রত্ন-কঙ্কাল, তবু তার মাঝে সূক্ষ্ম কারুকাজ। 

কে ছড়ায় আনন্দ ? অস্থির ? নরক, করোটি, নীলবিষ, কঙ্কাল – এসব শব্দের অনুষঙ্গে মৃত্যুর হিম ছুঁয়ে দেয় আমাদের বেঁচে থাকার উষ্ণতাকে। সর্বব্যাপী অনির্ণেয় পরমা বলে কিছু আছে নাকি ? “ দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা / যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে ... প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের”। নিরাপদ, সাংসারিক, প্রচলিত, সামাজিক “তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে / স্বাদ নেই ...”। দেখবি আয় – বলে ঈশ্বরীর মত কয়েকটি নারী চিরকালের কাঙাল পুরুষকে ডাক দেয়, “ ক্রূর পথে নিয়ে যায় হরিতকি বনে – জ্যোৎস্নায়”। এখানে প্পথের বিশেষণ ‘ক্রূর’। তাই তো হবে। এই শব্দের নির্দয় অনুরণনে চকিত আভাস স্ফূরিত হয় পথের শেষে চরম সর্বনাশের। এই দ্যাখ তবে – “ বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,/ পায়ের ভঙ্গির নীচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন”। 

এখানে চারটি মাত্র রাশির উল্লেখ করা হলেও সমস্ত নক্ষত্রমন্ডলকে পদতলে রেখে চরাচর-ব্যাপ্ত এক চিরন্তনীর আভাসটুকু দেখতে পাই। কয়েকটি নারী মিলে যে নাচ দেখায়, সেই নাচের অঙ্গন সীমাহীন, কাল নিরবধি। ও-ই মহাপরিণাম। তার ‘ বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ’। নারীর কেশপাশের এমন বিশেষণ আমাদের অশ্রুত ছিল। 

অনন্তকালের শাশ্বতীর মুখে জানি ‘মৃত্যুর সূক্ষ্ম কারুকাজ’। হিমযুগ আসে, হিমযুগ পার হয়ে যায়। মাঝে কিছু ‘দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা’ যুদ্ধ ভুলে যায়, বাণিজ্য ভুলে যায়। জটিল গোলকধাঁধার মত অবিশ্বাসী পথ পার হয়ে কোনও এক জ্যোৎস্না রাতে হরিতকি বনে গিয়ে গোধূলি সন্ধির ওই নাচ দ্যাখে। তারপর অন্ধ হয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। 

শুনেছি জীবনানন্দের এই কবিতাকে অনেক কবি অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা সবাই বড়মাপের কবি। আমার শ্রদ্ধেয়। আমি যতটুকু বুঝি, ততটুকুই জানালাম। 

কবি, তুমি চাঁপাফুলের গন্ধ পাও ? দোলনচাঁপার ? ওই গন্ধ বিষবাষ্প হয়ে তোমার চৈতন্যকে সম্পৃক্ত করে। যে সৌন্দর্যে তীব্র বিষ, যার মুখ ঘুরিয়ে দিলে ভয়ঙ্কর নাস্তির হাহাকার মরণসঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে, সেই বিষ যখন অস্তিত্বে একটু একটু করে মিশে যেতে থাকে, তখন সেই ঘুণের ঘন্টা, খুনির দুপুর, রক্তচাটা কুকুর আড়মোড়া ভাঙে। 

মনে রেখো তোমার জন্মের কোনও শেষ নেই। আলতামিরার গুহায় তুমিই ছবি এঁকেছিলে, আবার ওই ছবিতে বল্লম হাতে – সে তো তুমি। ‘শেষ ভোজ’-এর টেবিলেও তুমি ছিলে। তোমারই অনুশাসন লেখা ছিল স্বর্ণমুদ্রায়। আর একবার রাজরোষে আগ্রীবাপ্রোথিত হয়েছিলে। কবি, তোমাকে শিয়ালে খাইয়াছে। পেনিসিলিনের অভাবে কতবার তুমি সিফিলিসে মরে গেছ। 

পরের জন্মের জন্য আড়াল নাও। বলো -- মা আমার, আমিই থিব্‌সের রাজা, লেয়াসের পুত্র। এই যে খেজুরকাঁটা, কলোনসের পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছি। এই যে আমার দু’টো চোখ। তার আগে আর একবার আমার আড়াল চাই। তোমার ঘনজলে কুঁকড়ে থাকব। দ্বার খোলো। অন্ধকার দাও। 

“মূর্ছা যাই, মূর্ছা যাও, শরীরে শরীরে ঢালি প্রাণ 
কামনার প্রতি বাঁকে আমি আজও তোমারই সন্তান”।

2 comments:

  1. সৌভাগ্য, এমন একটি বিশ্লেষণ ঋতবাকের সৌজন্য পাঠকের কাছে সহজলভ্য হ'ল। যারা আধুনিক কবিতা নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের অবশ্যপাঠ্য এই প্রবন্ধটি। আমরা, যারা সাধারণ পাঠক, চিরকাল ঋণী থেকে গেলাম মাননীয় শ্রী বিপুল দাসের কাছে।

    ReplyDelete
  2. সৌভাগ্য, এমন একটি বিশ্লেষণ ঋতবাকের সৌজন্য পাঠকের কাছে সহজলভ্য হ'ল। যারা আধুনিক কবিতা নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের অবশ্যপাঠ্য এই প্রবন্ধটি। আমরা, যারা সাধারণ পাঠক, চিরকাল ঋণী থেকে গেলাম মাননীয় শ্রী বিপুল দাসের কাছে।

    ReplyDelete