প্রবন্ধ - শবনম দত্ত
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
অ্যান ওড টু ওয়াটার অব লাইফ
শবনম দত্ত
আমার সাথে অ্যালকোহলের চেনাচিনি সেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর আমলে। কিছুদিন টুকটাক হুইস্কি, ভদকা, জিন, রাম, টম কলিন্স, স্ক্রু ড্রাইভার, ব্লাডি মেরির সাথে ঝাড়ি টাড়ি মেরে, ফাইনালি ভদকার সাথেই পার্টনারশিপ করলাম। ককটেল ব্যাপারটা খুবই ভাল কিন্তু সমস্যা একটাই। জিভ বলত, "এসো এসো এসো প্রিয়" আর পকেট বলত, "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"। তা তখন পকেটের যা হাল থাকত তাতে করে স্টেপল দারু ছিল হোয়াইট মিসচিফ। স্মারনফ আলে কালে। বাড়িতে বাবাদের আসরে আর সি, আর এসের পেসাদ মিলতো বটে, কিন্তু সে আমার জমত না। আর সাথে ভাজাভাজি, চানাচুর, কাজু এগুলো জাস্ট পোষাতো না। আমি শুধু একটু শশা খেতাম দারুর সাথে। শুরু থেকেই সাত্ত্বিক টাইপস আরকি।
চাকরি বাকরি পেয়েও আমার ভদকার প্রতি লয়ালটি একটুও কমেনি বুঝলেন? আফটার অল সীতাসাবিত্রীর দেশের মেয়ে আমি। আনশেকেবল লয়ালটি। খালি তখন হোয়াইট মিসচিফ থেকে স্মারনফে শিফ্ট করলাম পার্মানেন্টলি। তারপরে এলাম ইউ কে। এক সিনিয়র জে ডি উইথ কোক খাওয়ালো। খেয়ে দেখলাম জম্পেশ কেস। বিটকেল গন্ধ নেই, গলা জ্বলে না। বুঝলাম হুইস্কির ডেফিনিশন আপডেট করতে হবে। বেশ ক'মাস কাটল জ্যাকদার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে। তারপরে লোকজন বলল এবার তো লেভেলে ওঠ! নিষ্পাপ মনে জিগালাম, "মানে?" দাদারা বলল জ্যাককে ছেড়ে জনিকে ধর। তা ধরলাম। ব্ল্যাক লেবেল খেলাম কোক সহযোগে। দেখি সেও ব্যাপক! প্রায় ধর্মসংকটে পড়া গেল। জ্যাক, না কি জনি? শ্যাম রাখিনা কুল? কিন্তু বুঝলেন কিনা, দিন তো কারোর সমান যায় না। মাসের শেষ বলে একটা কথা থেকেই যায়। সুতরাং মার্কেটে এলেন ফেমাস গ্রাউজ। সে একটি ব্লেনডেড হুইস্কি যেনাকে কোক ছাড়া খেতে গেলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলা, চুল্লু এসব গেলার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমার সে বালাই ছিল না। সুতরাং আমি তেনার সঙ্গে বেঁধেছি আমারো পান/কোকেরো বাঁধনে।
ঠিক এমনই সময়ে, আবির্ভাব হলো তাঁর। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। আগমন নয়, আবির্ভাব। আপনার শিলংপাহাড়ের অসম্মান বলে মনে হলে, আমি নাচার। তাঁর নাম গ্লেনফিডিথ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বিক্রি হওয়া সিঙ্গল মল্ট। না না সে যুগে আমি এসবের কিস্সু জানতাম না। কোন এক পূণ্য শুক্রবারে আমার পতিদেবতাটি প্রথমবার গ্লেনফিডিথ আমদানি করেছিলেন এবং সেই রাতটা আমি তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদন করেছিলাম। এইখানে বলে রাখা ভাল যে কিছু কিছু লোক জন্মায়ই ন্যাচারাল গ্রেস, ন্যাচারাল ক্লাস নিয়ে।আমি ঠিক তেমনটা নয়। মানে আদতে পেঁচো মাতাল আর কি। সুতরাং গ্লেনফিডিথও প্রথমে কোক দিয়েই খেতাম। তবু বড় স্মুথ লাগতো। হাল্কা হাল্কা সুগন্ধ। একটু একটু আমেজ।
এই সময়ই প্রথম ডিস্টিলারি ট্যুর নেবার সৌভাগ্য হলো এডিনবরাতে। শেষ ডিসেম্বরের হু হু করা ঠাণ্ডাতে আটশ বছরের পুরোনো এডিনবরা ক্যাসলের আনাচ কানাচ ঘুরে হাতের আঙুল, নাকের ডগা যখন প্রায় ফসিল হয়ে গেছে, তখন ক্যাসল চুড়ো থেকে গড়াতে গড়াতে নেমে (তিনপ্রস্থ সোয়েটার জ্যাকেট পরারপর আমার নিজেরই নিজেকে বোল্ডার বলে ভুল হয়, আর বোল্ডাররা গড়ায়। হাঁটে না মোটেই) ডান দিকে একটি ডিস্টিলারি ট্যুরের সাইন দেখতে পেলাম। টিকেট দেখলাম বেশ পকেট ফ্রেন্ডলি। সুতরাং ঢুকে পড়লাম।
এ্যাদ্দিনে প্রায় সব্বাই জেনে গেছেন হুইস্কি কি করে তৈরী হয়। তবু একটু সুখস্মৃতি রোমন্থন করেই ফেলি? খুব শর্টে বলতে গেলে বার্লিকে অঙ্কুরিত করে, সেটাকে শুকিয়ে, ম্যাশ করে, তার উপরে জল ঢেলে সুগারবার করে নেওয়া হয়। এই সুগার লিকুইডটাকে বলে ওয়র্ট (wort)। এর সাথে ইস্ট মিশিয়ে ফারমেন্ট করা হয়। ফারমেন্টেশনের পরে যে অ্যালকোহলিক লিকুইডটা তৈরী হয় তাকে ওয়াশ (wash) বলে। এবার বারকয়েক ডিস্টিলেশন। ফাইনালি যে জিনিষটা বেরোয় সেটাকে কাস্ক মানে কাঠের ব্যারেলে রেখে ম্যাচিয়োর করানো হয়। বার্লির জাত থেকে শুরু করে কাস্কের কাঠের জাত সব কিছুরই ওপরে ডিপেন্ড করে হুইস্কির স্বাদ, রং, গন্ধ। এক কথায় সামারি এই যে, যে বস্তুটা খেয়ে আমরা একটু সময় হিসাবের দুনিয়া থেকে ছুটি চাই সে বস্তুটা কিন্তু প্রচুর হিসাব করে বানানো হয়।
ডিসটিলারি ভিজিটে কাজের জ্ঞান যেগুলো লাভ হয়েছিল তার মধ্যে প্রধানতম হলো স্কটল্যান্ডে তৈরী হুইস্কিকে বলে স্কচ। হাসবেন না, মোটে হাসবেন না! আমি কত্ত ইনোসেন্ট ছিলাম সেটা ভেবে একটু উদাস হোন বরং! অ্যামেরিকায়ও নানা রকমের হুইস্কি হয়। সেগুলোর মধ্যে মোস্ট পপুলার হল বার্বন (Bourbon)। এটাতে 51% ভুট্টা ব্যবহার করা হয় আর 49% অন্য কোন গ্রেন। আমার আগে খাওয়া জ্যাক ড্যানিয়েলস হলো গিয়ে বার্বন হুইস্কি। টেনিসি স্টেটে তৈরী। আরও জানলাম সিঙ্গল মল্ট স্কচ হুইস্কি আর ব্লেন্ডেড স্কচ হুইস্কির মধ্যে তফাত মল্টের সংখ্যায় নয়। ডিস্টিলারির সংখ্যায়। যে স্কচের মধ্যে দুই বা তার বেশী ডিস্টিলারি থেকে তৈরী স্কচ মেশানো হয় তাকেই বলে ব্লেন্ডেড স্কচ। জনিদার সব লেবেল এবং দুনিয়া কাঁপানো শিভাস ব্লেন্ডেড স্কচ। সিঙ্গল গ্রেন স্কচ বলেও একটা বস্তু হয়। সেটা সিঙ্গল ডিস্টিলারি থেকে হয় বটে কিন্তু বার্লি ছাড়া অন্য গ্রেনও ব্যবহার হয়। এত সব জেনে টেনে স্কচের প্রতি যাকে বলে বেশ একটা ইনফ্যাচুয়েশন হলো।
ইউ কে থেকে ফিরে ব্যাঙ্গালুরু। বছর দেড়েক যাবত আমার এবং দারুর মাঝে চাইনিজ ওয়াল হয়ে খাড়া রইলেন (ঠিক খাড়া বলা যায় না, শুয়ে রইলেন বলা ঠিক) একটি ই টি টাইপ দেখতে মানবশিশু। যেদিন ছাড়া পেলাম..! পুরো মনে হলো বঙ্গলক্ষ্মী বাম্পার লটারি জিতেছি। বর একটা ডিস্টিলারি এডিশন গ্লেনফিডিথ এনে রেখেছিল ডিউটি ফ্রী থেকে। 51%। সেটি নিউ ইয়ার ইভে খোলা হলো। তারপরে কি হলো, সে প্রশ্ন আউট অব সিলেবাস।
এরপরে চেঞ্জ অব সিনারি। ইউ এস গমন। সেখানে গিয়ে চোখে পুরো ধাঁধাঁ লেগে গেল। কত শত রকমের নতুন দারু রে ভাই। টেকিলা, কাছাখা, কাহলুয়া আর কত বলব। আর আজব সব নামের বীয়ার; ডগ ফিশহেড, স্টিল রিজার্ভ। তবু মাঝে মাঝেই তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসি। তাঁর এক কাজিনের সাথেও পরিচয় হলো, গ্লেনলিভেট। ততদিনে গ্লেন মানে যে শীর্ণ উপত্যকা তা জানা হয়ে গেছে। জনিদার উপরের লেভেলগুলোর দাম আড়চোখে দেখতে শুরু করেছি। দেখলাম ব্লুটা একদমই নাগালের বাইরে। কিন্তু গ্রীন আর গোল্ডটার জন্য একজন উদারমনস্ক মানুষকে মোটিভেট করা দরকার। সেটা কে, সে কথা গেস করার জন্য কোন প্রাইজ নেই! তা একদিন গোল্ড লেবেল এলেন আমাদের বাড়ি। আমি গাড়িতে পেছনের সীটে তাকে তিনমাসের ছেলে ভেবে আঁকড়ে ধরে বসেছিলাম প্রায়। তা সে যাত্রা কি মনে হলো কোকটা মেশালাম না।বরফ দিয়ে খেলাম। জীবনে প্রথমবার ঢোক গিলেও দেখলাম একটা টফি টফি ভাব রয়ে যাচ্ছে জিভে। ইউএসে-তে বছর চারেক স্কচ বলতে ওই গ্লেনের দিকেই খেলাধুলো হলো আর জনিদা। তবে হ্যাঁ, সিঙ্গল মল্টের প্রতি একটু পক্ষপাত দেখা দিল।
এরপরে আবার কন্টিনেন্ট শিফট এবং খুকুমণির প্রত্যাবর্তন টু ইউ কে। এ পাড়ায় স্কচের দাম কম হওয়াটা এই ডিসিশনের পেছনে কতটা রোল প্লে করেছিল, এসব কূট প্রশ্ন ইললিগাল। ইউ কে আসার পর পরই জীবনে প্রথম নন স্পেসাইড (speyside) স্কচ খেলাম। খাইয়েছিল এক বন্ধু। স্কচটার নাম জুরা (Jura) (অরিজিন)। জুরার লেবেল পড়ে জানলাম এটা অ্যাকচুয়ালি জুরা নামের দ্বীপে বানানো হয়েছে। গুগুল করে দেখলাম যে জুরা হলো স্কটল্যান্ডের পশ্চিমে একটা ছোট্ট দ্বীপ যেখানে কেবল একটাই ডিস্টিলারি আছে আর পুরো কম্যুনিটি বেঁচে আছে এই হুইস্কির ওপরে বেস করে। বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে দূরদ্বীপবাসিনী গাইবার পরিকল্পনা করছি সবে, বন্ধুবর জুরা, জলে জ্বারিত করে এনে দিল। আমার অশিক্ষিত জিভেও প্রথম দুটো সিপের পরে বুঝলাম, এ অন্য জাতের জিনিষ। গ্লেন যদি উচ্ছল পাহাড়ী ঝরনা হয় তো জুরা কাকচক্ষু জলাশয়। গ্লেন বড্ড চঞ্চল, খেয়াল না করলে স্বাদ ভাল করে বোঝার আগেই খাওয়া হয়ে যায়। জুরা জিভের কোষগুলোকে ডেকে বলে, "ওঠো, আমি এসেছি তো।"
এ অভিজ্ঞতার পরে বাধ্য হয়ে হুইস্কি নিয়ে আরও একটু পড়তে হলো। দেখলাম স্কটল্যান্ডে চারটে মেন হুইস্কি প্রোডিউসিং রিজিয়ন আছে। মাঝ মধ্যিখানে পাহাড়ি হাইল্যান্ড হলো একটা রিজিয়ন। হাইল্যান্ডের ডানদিকে, উত্তর পূর্বদিকে, একটা ছোট্ট রিজিয়ন হলো স্পেসাইড। হাইল্যান্ডের বাঁ দিকে, আটলান্টিকের দ্বীপগুলো হলো আইল্যান্ড রিজিয়ন। আইলে একটা আইল্যান্ড কিন্তু আইলেকে একটা আলাদা রিজিয়ন বলে ধরা হয়। প্রতিটা রিজিয়নের হুইস্কির নিজস্ব চরিত্র আছে (গ্লেনফিডিথ আর গ্লেনলিভেট দুটোই স্পেসাইডের প্রোডাক্ট)। এত পড়াশোনা করার পরে ভেবে দেখলাম আমি অ্যাজ ইউজুয়াল নিষ্পাপ। এমন চরিত্রবান পুরুষদের প্রেমে না পড়ে কি আদৌ উপায় আছে? হ্যাঁ, ততদিনে পক্ষপাত প্রেমে পরিণত হয়েছে।
যাই হোক, স্কুলে ক্লাস শুরু হলো। স্টুডেন্টদশা, এক পয়সা ঘরে আনি না উল্টে খরচ করাই। সাথে গোদের উপরে বিষফোঁড়াসম পড়ার চাপ। দিনরাত নিজের মনে গাই, "হরি ক্লাস তো হলো, এক্সাম এলো, পার করো আমারে"। সব কাল রাতেরই শেষ থাকে। আমারও পড়া শেষ হলো। চাকরী হলো। জারা সা ঝুম লু ম্যায় মোডে তল্পিতল্পা নিয়ে লন্ডনে থাবা গাড়লাম।
সামার আসতে না আসতেই স্কটল্যান্ডে উদয় হলাম লং উইকেন্ডের সাথে দু'দিন ছুটি জুটিয়ে নিয়ে। স্কটল্যান্ডের ট্র্যাভেলগ সিরিজ আলাদা লিখছি, তাই সে দিকে আর গেলাম না (সংযমটা, স্কচের প্রতি ডেডিকেশনটা, লক্ষ্য করবেন। স্কটল্যান্ডের কথাও তাকে তুলে রাখলাম)। সে যাত্রা গেলাম আরেকটা ডিস্টিলারি ট্যুরে। সিঙ্গলটন। এদের দুইখান ডিস্টিলারি আছে। একটা গ্লেন অর্ড, হাইল্যান্ডের মাথায়, ইনভারনেসের গায়ে। অন্যটা ডাফটাউন, স্পেসাইডে। সিঙ্গলটন আগে খেয়েছিলাম, স্পেসাইডওলাটা। কিন্তু খুব যে আউউটস্ট্যান্ডিং লেগেছিল এমনটা নয়। তবু হিরের আংটি থুড়ি স্কচ হুইস্কির আবার ট্যারা আর বাঁকা!
এই ডিস্টিলারি ট্যুরে পুরোনো কিছু জ্ঞান আবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল আর নতুন কিছু জ্ঞানও হলো। তারমধ্যে একটা হলো পরীরাও দারু খায়। সত্যি বলছি। ওই যে কাস্কের মধ্যে হুইস্কি ম্যাচিওর করানো হয়? তখনই কাঠের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রতি বছর ২% বা তার বেশী পালায়। সেটা হলো অ্যাঞ্জেলস্ শেয়ার। ভাবছেন তো ফাঁকফোকর রাখার দরকার কি ছাই? দারু নষ্ট করা কি কোনও বুদ্ধিমানের কাজ? আমিও ঠিক ওই কথাটাই ভেবেছিলাম, বুঝলেন! তারপরে বুঝলাম যে কেস অত্যন্ত জটিল। হুইস্কির মধ্যে ডিস্টিলেশনের সময় মেটাল স্টিল (পাত্র) থেকে যে মেটালিক ভাবটা আসে, কাস্কের কাঠ সেটা নিয়ে নেয় আর কাঠ থেকে হুইস্কি পায় ভ্যানিলা, টফি, আরও সব রকমারি গন্ধ, কাঁচা সোনা বা তামার মতন রং। তাই এটুকু স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। তা ২% দিলেও হাতে অনেকটাই থাকে বলুন? এরপরে আমার ঘোর বিশ্বাস জন্মেছে যে, দাদু আসলে লিখতে চেয়েছিলেন, "দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, যাবে না উড়ে, স্কটল্যান্ডের ডিস্টিলারির কিনারে কিনারে।" ভুললে হবে না যে ভদ্রলোক এদিকে এসেছিলেন।
কাঠ আবার দু'রকম হয়। অ্যামেরিকান আর ইয়োরোপিয়ান ওক। অ্যামেরিকান ওক হলে গাছের বয়েসসত্তর পেরোলে তবেই তার কাঠ নেওয়া যায় আর ইয়োরোপিয়ান ওক হলে গাছের বয়েস অন্তত এক'শ পেরোতে হবে। এর থেকে অ্যামেরিকানরা অকালপক্ক এমন সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছলে আমি কিচ্ছু দোষ দেব না। এরপর আছে কাঠের তক্তা, যেগুলো দিয়ে কাস্ক বানায়, সেগুলো কাটবার আর্ট। গাছের গুঁড়িতে যে অ্যানুয়াল রিং থাকে, সেগুলো কাস্ক বানানোর পরে যেন ভার্টিকাল থাকে। আরও অনেক জটিল হিসাব আছে। নাহলে পরীরা আরও বেশী বেশী দারু খেয়ে নেবে এই আর কি। কাস্ক বানিয়েই সাথে সাথে ব্যবহারকরা যায় না কিন্তু। পোড়াতে হয়। সেই পোড়া কাস্কে স্কচ ম্যাচিয়োর করা হয়। স্কচের ক্ষেত্রে নতুন কাস্ক ব্যবহার হয় না। বার্বন বা শেরি বানানো হয়েছিল যে কাস্কে সেই কাস্ক রিইউজ করা হয়। হ্যাঁ, এই ইউজঅ্যান্ড থ্রো-র যুগেও রিইউজ। কাস্কে কতদিন রইল তার ওপরে নির্ভর করে কাঠ থেকে কি কি ফ্লেভার পেল বা কাঠকে কতটা কি দিল। একই হুইস্কি, একই কাস্ক, আট বছরে এক রকম আবার বারো বছরে একরকম।
ডিস্টিলারি ট্যুরের শেষে এখানে তিন রকম দারু টেস্ট করাবে জানতাম। আমার তো প্রাণে পুরো রোদ উঠেছে ফুল ফুটেছে অবস্থা (বিশ্বাস করুন, লন্ডনে সারা বছর বৃষ্টি ঝেলবার পর চাঁদের থেকে রোদ অনেক দামী হয়ে ওঠে)। তিন রকম দারু, তাও আবার ডাবল ডোস পাব আমি। আসলে ট্যুরে গেছিলাম আমি, বর, ছানা, বাবা আর মা। মা তো আর দারু খায় না! সুতরাং উত্তরাধিকার সুত্রে সে দারু আমারই পাওনা হয়। তা ডিস্টিলারির লোকজনেরা বললেন প্রথমে সবচেয়ে কম স্মোকি তারপরে মাঝারি স্মোকি আর শেষে খুব স্মোকি দারু খাওয়াবেন। প্রথমে সিঙ্গলটন খেলাম গ্লেন অর্ড ডিস্টিলারির। আমি তো ধোঁয়ার ধোঁও পেলাম না। তারপরেরটা কি ছিল সে ভুলে গেছি। লাস্ট এল লাগাভুলিন (lagavulin) নামের একটা স্কচ। যে মাত্র সে বস্তুটি গ্লাসে ঢালা হলো নাকটা আরামে পাশ ফিরে শুলো। ঠিক যেন দামী সিগারেট বাসিগারের গন্ধ আর তার সাথে একটু বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধের ছোঁয়া। পপাত চ, মমার চ। এই একই যাত্রায় আইল অব মলের একমাত্র ডিস্টিলারি, লেজিগও ( Ledaig) গিয়েছিলাম। সেখান থেকে টোবারমোরি ১০বছর বলে একটা সিঙ্গল মল্ট বাণিজ্য করা গেছিল। লন্ডন দূরস্থান, কোনদিন গ্লাসগোতেও এনাকে দেখিনি আগে।
সে যাত্রা বাড়ি এসে, কোনও রকমে সপ্তাহটা পার করে, শুক্রবারের সন্ধ্যায় টোবারমোরির আরাধনায় বসা গেল। গ্লাসে ঢেলে প্রথমেই মনে হলো মুরগী হয়েছি। এ কি স্কচের রং? এ তো জল, জাস্ট জল। বুকটায় হু হু করে লু বইতে শুরু করেছে এমন সময় পতিদেবতা অল্প ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে গ্লাসটা হাতে দিলেন। প্রথম সিপটা নেবার পরেই মুণ্ডুটা ব্যোমকে গেল। বলি কোনওদিন শুনেছেন ঝাল দারু? আমি তো শুনিনি। ভাবলাম ঠকে যাবার শোকে কি টেস্টবাডগুলো ঘেঁটে গেল? বরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও চোখ গোলগোল করে হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতিউতি তাকিয়ে আবার একটা সিপ নিলাম। এবারে সতর্ক ছিলাম। কই? নাকে কেমন জানি হাল্কা সমুদ্দুর, সমুদ্দুর গন্ধ, জিভে হাল্কা মিষ্টি স্বাদ। কিন্তু ঝাল তো নেই! ঢোক গিললাম। গিলেই বুঝলাম আলজিভের কাছটায় আবার ঝাল। ঢোক গেলার ৩ সেকেন্ড পরেও মুখে ঝাল ঝাল ব্যাপারটা রয়েই গেল। অগত্যা গুগুল দেবতাকে স্মরণ করা গেল। তিনি জানালেন টোবারমোরির ফিনিশে আসলেই পেপার ব্লাস্ট রয়েছে আর ফিনিশটা লম্বাও। ফিনিশ মানে হলো ঢোক গেলার পরে যতক্ষণ ধরে স্বাদটা জিভে থেকে যায়। আইল্যান্ড স্কচের সাথে প্রথম আলাপটা ছিল এমনই তীক্ষ্ণ মধুর।
সেই উইকেন্ডেই মনে পড়ে গেল লাগাভুলিনের কথা। লোকাল গ্রসারি স্টোরে তাঁর দেখা পাওয়া গেল না। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু হদিশ হলো না। মনের দুঃখে বাড়ি এসে খুঁজতে বসলাম যদি অনলাইন অর্ডার করা যায় কোথাও। করতে গিয়ে দেখি ইনি হলেন আইলে মল্ট। আইলে মল্ট কোনওদিন খাইনি। সুতরাং পুরো বাঁধ ভেঙে দাও টাইপ উৎসাহ এল প্রাণে। লাগাভুলিন ছাড়া আর কি কি আইলে মল্ট হয় তার খোঁজে লেগে পড়লাম। খোঁজ শেষে লিস্ট মিলিয়ে বোমোর (Bowmore) কিনে আনা গেল। সন্ধ্যেরাত করে হাতে গ্লাস নিয়ে সোফায় বসলাম। তখন আমরা থেমসের একদম পাশে একটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। নদীর ওপারে আমাদের মুখোমুখি ক্যানারি হোয়ার্ফের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো। বোমোর গ্লাসে ঢালার পরপর ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম বটে, কিন্তু লাগাভুলিনের গন্ধের থেকে অনেক কম তীব্র সে গন্ধ। নাকের কাছে এনে দেখি ধোঁয়ার ওদিকে আরও কিছু যেন আছে। একটু ডিটেকটিভগিরি করতেই তিনি ধরা দিলেন। এ তো লেবু লেবু গন্ধ! স্বাদ? একটু মিষ্টি, একটু ফল, একটু ধোঁয়া। সন্ধ্যারতি হয়ে যাবার ঠিক পরে প্রসাদের থালা থেকে কমলালেবু আর আপেলের সাথে লেপটে থাকা সন্দেশটা খাবার কথা মনে পড়ে গেল (কারোর ভাবাবেগে আঘাত লাগলে লেখক ক্ষমাপ্রার্থী)। শেষটুকু? লঅঅং ফিনিশ। বোমোরের হাত ধরে সে রাতে ক্যানারি হোয়ার্ফের সাদা বাড়িগুলোকে লাল কমলা রং ছেড়ে হাজার তারার নকশীকাঁথা হয়ে উঠতে দেখেছিলাম।
এরপর ঘাড়মোড় ভেঙে পারিবারিকভাবে আইলে মল্টের প্রেমে পড়া গেল। ল্যাফ্রয়েগ (Laphroaig), কুল্যাইলা (Caol ila), লাগাভুলিন। এইখানে একটু পিট নিয়ে পিটপিট করতেই হবে। মস জাতীয় উদ্ভিদ ঠাণ্ডা, সামুদ্রিক আবহাওয়ায় ডিকমপোজ করে হয়ে ওঠে পিট। স্কটল্যান্ডের ২০% জায়গাই পিটে ঢাকা। পিটকে জ্বালানি হিসেবে মানুষ ব্যবহার করছে খুব সম্ভবত ব্রোঞ্জ যুগ থেকে। আইলে মল্টের ক্ষেত্রে অঙ্কুরিত বার্লি শুকানো হয় পিটের আগুনে আর তার থেকেই আসে ধোঁয়াটে ভাবটা। যত বেশীক্ষণ পিটের আগুন খাবে তত বেশী ধোঁয়াটে ভাব। কি ভাবছেন? সহজ ব্যাপার? ধীরে বন্ধু ধীরে! ধোঁয়ার ব্যাপার খুবই ধোঁয়াটে। ভুললে হবে না অঙ্কুরিত বার্লি শুকানো হুইস্কি তৈরীর একদম শুরুর দিকের স্টেপ। এরপরের স্টেপগুলোতে ধোঁয়াটে ভাব কমে যাবার হাই চান্স থাকে। কতক্ষণ ফারমেন্টেশন হচ্ছে, ডিস্টিলকরার স্টিলের মাপ কত, ডিস্টিলেশনের পরে অ্যালকোহল স্ট্রিমের কোন পার্টটা ডাইরেক্টলি নেওয়া হচ্ছে, কোন কাস্কে কত বছর ম্যাচিয়োর করছে সবকিছুরই উপর ডিপেন্ড করে ফাইনাল প্রোডাক্ট কতটা স্মোকি। তাই ফারমেন্টেশনের আগে ল্যাফ্রয়েগ আর লাগাভুলিনের মল্ট সমান স্মোকি হলেও শেষে গিয়ে লাগাভুলিন অনেক বেশী স্মোকি।
এই অবধি এসে নিশ্চয়ই মাথা তাজ্ঝিম তাজ্ঝিম করছে? বলি কি, আজ তবে এইটুকু থাক। বিভিন্ন স্টিলেডিস্টিলেশনের গল্প, আলাদা আলাদা কাস্কের গল্প, হাইল্যান্ড স্কচের গল্প, এসব অন্য একদিন হবে। আমি এখন যাই বুঝলেন? হাল্কা হাল্কা বরফ পড়ছে সেই সন্ধ্যে থেকেই। চারদিকটা প্রায় সাদা হয়ে এসেছে। এক পেগ ল্যাফ্রয়েগে একটুখানি ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে নিয়ে, সোফায় বসে পায়ে থ্রো চাপা দিয়ে, রবার্ট গর্ডনের দারাইজ অ্যান্ড ফল অব অ্যামেরিকান গ্রোথ টা পড়া শুরু করি। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে...
0 comments: