0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in
প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক
মিথিল ভট্টাচার্য্য



সপ্তম পর্ব

মথুরার রাজকুমারকে নিয়ে মহাসামন্ত অক্রূরের রথ এসে পৌঁছায় রাজপ্রাসাদের সামনে।

সিংহদ্বারের সামনে তাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এগিয়ে আসেন দুই রাজমহিষী দেবী অস্তি ও প্রাপ্তি।

হাসি মুখে এগিয়ে এসে নিজের দুই মাতুলানীকে প্রণাম জানায় কৃষ্ণ ও বলরাম।

মধুর হাসি মুখে নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে ওঠে আর্যাবর্তের ভবিষ্যত ভাগ্যনায়ক, মহারাজের সাক্ষাৎ পেলামনা? মাতুল কি কাজে ব্যস্ত?

ইতস্ততের মতো পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষ অব্দি কোনওমতে বলে ওঠেন দেবী অস্তি, মহারাজ নিজের কক্ষে বিশ্রাম করছেন কুমার। তোমরা দু'জন এত পথ যাত্রা করে এসেছো, আপাতত কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নাও। উনি খুব শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। দাসী দুই কুমারকে তাদের কক্ষে নিয়ে যায়। 

হাসি মুখে সম্মতি দিয়ে নিজেদের কক্ষের দিকে এগিয়ে যান কৃষ্ণ এবং তার অগ্রজ। 



নিজের অন্ধকার কক্ষে একাকী বসে রয়েছেন মথুরাধিপতি মহারাজ কংস।

এখনও তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেননা দূতেদের কাছ থেকে পাওয়া খবরকে।

তার নিখুঁত মৃত্যু ফাঁদকে অনায়াসে অতিক্রম করে মথুরার রাজপ্রাসাদে পা রেখেছে তার জীবনের সব থেকে বড় অভিশাপ। কিভাবে সম্ভব হলো এই অসমম্ভব?

তার পরিকল্পনায় তো কোনও ত্রুটি ছিলোনা, পথের মাঝে গহ্বরের নির্মাণ করে রাখা, আর সঠিক সময়ে গজরাজের পায়ে অঙ্কুশ বিঁধিয়ে থেকে রাজপথে ছেড়ে দেওয়া সব কিছুই তো ঠিকঠাকই চলছিল। তাহলে কোন মায়াবলে এই কালরূপী মৃত্যুকে বশ করে মথুরার প্রাসাদে পদার্পন করলো তার সব থেকে বড় শত্রু ?

- প্রণাম মহারাজ 

অকস্মাৎ এই ধ্বনিতে নিজের কল্পনার জাল ছিঁড়ে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসেন মথুরাধিপতি কংস।

এক গভীর উদ্বিগ্ন মুখে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার প্রধান অমাত্য চন্দ্রক।

ক্লান্ত ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন কংস, এসো চন্দ্রক, পরিকল্পনার ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছো? আমি নিজেও স্তব্ধ, কিন্তু এখনও আমরা সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি অমাত্য। শত্রু এখন মথুরার প্রাসাদে বন্দী। আমরা তাকে ধ্বংস করার আরোও অনেক সুযোগ পাবো। তৈরি থেকো। 

উদ্বিগ্ন মুখে বলে উঠলেন প্রধান অমাত্য, মহারাজ আমি এখানে শুধু পরিকল্পনার ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করতে আসেনি। এই ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য চিন্তার। কিন্তু তার থেকেও বড় দুশ্চিন্তা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মহারাজ। 

কংস হতবাক হয়ে বলে ওঠেন,  আর কি সমস্যা, চন্দ্রক?

চন্দ্রক চিন্তিত স্বরে বলে ওঠেন,  মহারাজ জানিনা কিভাবে মহারাজ শিনি রাজকুমার কৃষ্ণ ও বলরামের মথুরার আগমনের বিষয়ে অবহিত হয়ে গেছেন। আর এই ধূর্ত বৃদ্ধ সিংহ এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ব্যবস্থা নিয়েছেন। 

আতংকিত স্বরে বলে উঠলেন কংস, কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? মহারাজ শিনি এই সংবাদ পেলেন কিভাবে? আর পেলেও তিনি কিভাবে আগে থেকে আমাকে না জানিয়ে পদার্পণ করতে পারেন মথুরায়? তিনি কি ভুলে গেছেন যাদব গোষ্ঠীর চুক্তি অনুসারে, এই ভাবে কোনও একজন যাদব নৃপতি অন্যের রাজ্যে আগমন করতে পারেননা ?

চন্দ্রক ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠেন,  মহারাজ, বৃদ্ধ সিংহ এত বড় ভুল কোনওমতেই করবেননা। তিনি খুব ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিয়েছেন মহারাজ। তিনি নিজের বদলে তার কিশোর পৌত্র যুযুধানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মথুরা নগরীতে। 

প্রায় আঁতকে উঠে চীৎকার করে উঠলেন কংস, না কোনওমতেই নয় চন্দ্রক, কিছুতেই রাজকুমারকে প্রবেশের অনুমতি দেবেনা। তাকে প্রবেশ করতে দিলে নিজের পৌত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অজুহাতে সসৈন্যে মহারাজ শিনি প্রবেশ করবেন মথুরায়। এই চক্রান্তকে কিছুতেই সফল করতে দেওয়া যাবেনা চন্দ্রক, কিছুতেই না। 

বিষণ্ণ সুরে বলে উঠলেন কংসের মহা অমাত্য, আমি ক্ষমাপ্রার্থী মহারাজ, কিন্তু চাইলেও আমরা তাকে আটকাতে পারিনা। এক যাদব রাজকুমারকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া থেকে বিরত করার ক্ষমতা আমাদের কারওর নেই। আর শুধু তাই নয়, তাকে অনুমতি না দিলে যাদব সংঘের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো আপনাকে। বিশেষ করে পরে যা ঘটতে চলেছে তা মাথায় রাখলে কোনওভাবেই রাজকুমার যুযুধানকে আটকানো সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। 

একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন কংস, এখন কোথায় রাজকুমার যুযুধান অমাত্য?

অমাত্য চন্দ্রক মৃদু স্বরে বলে ওঠেন, তিনি মথুরার রাজকীয় অতিথিভবনে বিরাজ করছেন মহারাজ। আর তিনি ইতিমধ্যে দূত মারফত তাঁর পিতামহকে তাঁর আগমনের সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। 

কিছু সময়ের জন্য মাথা নিচু করে নীরব হয়ে রইলেন প্রবল পরাক্রান্ত মথুরাধিপতি।

তারপর অবশেষে নিজের বিশ্বস্ত অমাত্যের দিকে চোখ তুলে বলে উঠলেন তিনি, মহারাজ শিনির এখানে প্রবেশ করতে কম করে দু'দিন সময় লাগবে চন্দ্রক। তার অর্থ আমাদের কাছে সময় পরে রয়েছে মাত্র দু'দিন, যেভাবেই হোক কৃষ্ণ এবং তার অগ্রজকে এই দুদিনের মধ্যেই আমাদের মৃত্যু প্রদানের ব্যবস্থা করতেই হবে অমাত্য। 

নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করলেন অমাত্য চন্দ্রক।

কিছু সময়ের বিরতি নিয়ে চন্দ্রকের দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠলেন মথুরাধিপতি, চন্দ্রক যত দ্রুত সম্ভব চানুক ও মুষ্টিকের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দাও যে আমি তাদের সঙ্গে বিশেষ কারণে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক। 

একটা হালকা হাসির রেখা মুহূর্তের মধ্যে খেলে গেলো অমাত্য চন্দ্রকের মুখে। কিন্তু একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে নীরবে তিনি বেরিয়ে এলেন মহারাজ কংসের শয়ন কক্ষ থেকে।



ভোরের আলোর নরম ছোঁয়া এসে লাগে কৃষ্ণের কৌতূহলী মুখে, ভোর হবার অনেক আগেই শয্যা পরিত্যাগ করে মথুরা নগরীকে দু'চোখ ভোরে দেখার জন্য অলিন্দে এসে দাঁড়িয়েছে সে।

একটু একটু করে নবীন ভোরের আলোয় মথুরার শুভ্র নগরী উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তার দুই চোখের সামনে।

একটা অল্প হাসির রেখা মুখে নিয়ে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে সে।

কক্ষের বাইরেই অপেক্ষারত প্রহরী সন্ত্রস্ত স্বরে বলে ওঠে, আপনার কোনওকিছুর প্রয়োজন আছে, কুমার?

প্রহরীর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে ওঠে কৃষ্ণ, মথুরা নগরীকে নিজের পায়ের হেঁটে দেখার অভিলাষ নিয়ে বেড়িয়েছি, কোনও আপত্তি?

প্রহরী ইতস্তত স্বরে বলে ওঠে, কিন্তু কুমার আপনি মথুরায় প্রথম পা রেখেছেন, এইভাবে একা বেরোলে আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। আমরা আপনার প্রহরীরা আপনার সঙ্গেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। 

প্রহরীর দুই চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর স্বরে বলে উঠলেন কৃষ্ণ, মাতুলের প্রতিশ্রুতি অনুসারে মথুরার উত্তরাধিকারী এবং ভবিষ্যৎ নৃপতি আমি। আর নিজের রাজ্যকে দুই চোখ দিয়ে দেখার জন্য কোনও প্রহরীর প্রয়োজন আমার নেই বন্ধু। নিজের নিরাপত্তা আমি নিজেই করতে সক্ষম। কিন্তু কেউ যদি আমার নিরাপত্তার অজুহাতে আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে আসেন তবে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নিতে অপারগ হবো।

মুহূর্তের মধ্যে একটা শীতল আতংকের স্রোত যেন বয়ে যায় প্রহরীর মেরুদণ্ড বেয়ে।

তার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, বেশি চিন্তা করবেননা, আমি অল্প সময় পরেই ফিরে আসবো। আর জ্যেষ্ঠকে বলে দেবেন আমি নগর ভ্রমণে বেরিয়েছি, যেন দুশ্চিন্তা না করেন। 

দৃঢ় পদক্ষেপে রাজপ্রাসাদের সিংহ দ্বার দিয়ে নগরীর পথে বেরিয়ে আসেন মথুরার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক।

রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে সামনের পথে এগিয়ে যান কৃষ্ণ, আলো আঁধারির মায়ায় লুকিয়ে থাকা শুভ্র নগরী ও যেন নিজের রহস্য উজাড় করে দিতে তাকে নিজের অন্তরে গ্রাস করে নেয় এক মায়াবী আহ্বানে।

(ক্রমশ)

0 comments: