প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বাঙলায় বোমার আবির্ভাব : তিলক ও রবীন্দ্রনাথের চোখে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
[১]
ভারতেব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনায় অগ্রণী বাংলা নামক একটি প্রদেশকে দু’ টুকরো করার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা প্রকাশ্যে এসেছিল ১৯০৪ সালে, যা কার্যকর করা হয় ১৯০৫ সালে। আর এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় যে আন্দোলন বাঙালিরা শুরু করেন, তা কার্যত সারা ভারতের রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় নবযুগের সূচনা করে, যার পরিণতিতে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবিভাজনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। বিনয় সরকার বলেছিলেন, “বাঙালির বাচ্চা আমি, বাঙালির চোখে দুনিয়া দেখি। আমার কাছে ১৯০৫ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম বৎসর। এ একটা খাঁটি যুগান্তর।” যে ঘটনার সূত্রে তাঁর এই মন্তব্য, সেই স্বদেশী আন্দোলন যে শুধু বাঙালিরই নয়, তামাম ভারতবাসীর জাতীয় জীবনে যুগান্তর এনেছিল। এ কথা আজ ইতিহাস-স্বীকৃত। কিন্তু আজকের ‘বাঙালির বাচ্চা’দের অধিকাংশেরই স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা নিতান্তই ভাসা ভাসা। আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ নিশ্চয় জানেন, ১৯০৫ সালে অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশকে দু’ টুকরো করার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সন্দেহ হয়, কি ভাবে এই প্রতিরোধ এক সর্বাত্মক গণআন্দোলনের চেহারা নিয়ে ক্রমে বাঙলার বাইরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল, কি ভাবে তা ছাপ ফেলেছিল সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, শিল্প, শিক্ষা – সমস্ত ক্ষেত্রে, তার খোঁজ আজকের তরুণ বাঙালি কতটা রাখে!
স্বদেশী আন্দোলনের সূত্র ধরে বাংলাদেশে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের সূচনা হয়েছিল, তার প্রধান বাহন বা উপকরণ ছিল বোমা। য়োরোপের রাজনীতিতে বোমাবাহিত সন্ত্রাসবাদ অপরিচিত না হলেও ভারতে সে সময় এই বোমার তন্ত্র ছিল এক অভিনব বস্তু। ১৯০৭ সালের ৬ই মে ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায়, যার সম্পাদক ছিলেন স্বনামধন্য ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ‘কালীমায়ীর বোমা’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লেখা হয়েছিল,
“ইহা বড়ই আনন্দের বিষয় যে, একটি চমৎকার ধরনের বোমা তৈয়ার হইতেছে। ইহার নাম ‘কালীমায়ীর বোমা’। ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখা হইতেছে এবং পরীক্ষা সফল হইলে ইহা প্রতি গৃহে রাখিতে হইবে। এই বোমা এতই হালকা যে, একজন লোক ইহা এক হাতে লইয়া চলিতে পারে, ইহাতে অগ্নিসংযোগ করিতে হয় না ও অল্প আয়াসেই ইহাকে ভূমিতে নিক্ষেপ করিলে বিকট শব্দে ইহা বিস্ফোরিত হয় ও ধরণীকে প্রকম্পিত করে। ...প্রতি গৃহ হইতে একজন সন্তানের প্রয়োজন, যে ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুশীলন করিবে। তাহারা কালীমায়ীর বোমা লইয়া ক্রীড়া করিবে। বোম্ কালী কলকাত্তাওয়ালী!”
[সিডিশন কমিটির রিপোর্ট থেকে পুনরনুবাদ]
অবশ্য এই নিবন্ধটি যখন ‘সন্ধ্যা’য় ছাপা হচ্ছে, বাঙলাদেশে তখনও বোমার প্রাদুর্ভাব হয়নি। তবে এমন মনে করার কারণ আছে যে, বাঙলাদেশের গুপ্তবিপ্লবী সংগঠনগুলিতে বোমা তৈরির প্রস্তুতি এ-সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসেই অরবিন্দ-বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত গুপ্তসমিতির হেমচন্দ্র কানুনগো বোমা তৈরির কৃৎ-কৌশল শিক্ষা করতে ফ্রান্সে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই সমিতিটির বিপ্লববাদী তরুণদের কারও কারও সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধবের পরিচয় ছিল। আবার এমনটাও হতে পারে যে, ব্রহ্মবান্ধব হয়তো কোনও বাস্তব তথ্য হিসেবে নয়, শুধু তাঁর জাতশত্রু ইংরেজ শাসকদের নিছক ভয় দেখাবার উদ্দেশেই বোমার আগমনী ঘোষণা করেছিলেন ।
যে কারণেই ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় উপরোক্ত কথাগুলি লেখা হয়ে থাক না কেন, এটাই ছিল সম্ভবত বাংলার তথা বাঙালির বোমা সম্পর্কে জনমানসের প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া। আক্ষরিকভাবে বোমার আবির্ভাব না হলেও এই মন্তব্যের সমকালে বাঙলাদেশে বন্দুক ও বিস্ফোরক-নির্ভর গুপ্তহত্যার কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৭ সালের শেষ ভাগ থেকেই পুলিশের ওপর আক্রমণ, তাদের চর হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙলাদেশে সহিংস কার্যকলাপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবরে কলকাতার বীডন স্কোয়ারে এক জনসভায় পুলিশি তাণ্ডব ও জনতার বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল চলে, পুলিশের দিকে ও ট্রামগাড়ি লক্ষ করে পাথর ছোঁড়া হয়। নভেম্বরে বাংলাদেশের লেঃ গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার উদ্দেশ্যে উল্লাসকর দত্ত নির্মিত মাইনের সাহয্যে চন্দনগর-মানকুণ্ডু অঞ্চলের রেললাইনে দু'বার চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু ফিউজের গণ্ডগোলে মাইনগুলি কাজ করেনি। শোনা যায় এই দুটি প্রচেষ্টার একটি হয়েছিল কালীপূজার রাতে ও সেটাই ছিল ব্রহ্মবান্ধবের ‘কালীমায়ীর বোমা’ রচনার প্রেরণা। এর পর ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে রেললাইনে মাইন পেতে ফ্রেজারের ট্রেন উড়িয়ে দেবার তৃতীয় চেষ্টা হয়।
১৯০৮ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার পাদরি হিকেনবোথামকে চর সন্দেহে গুলি করা হয়। বোমার যথার্থ প্রয়োগ শুরু হলো হেম কানুনগো পারিস থেকে বিস্ফোরকবিদ্যা শিখে ফিরে আসার পর। [ততদিনে অবশ্য বাঙালির বোমার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ব্রহ্মবান্ধব ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং কয়েক বছর পরে বিপিনচন্দ্র পাল লিখবেন, তাঁর লেখা ঐ ‘কালীমায়ীর বোমা’ বাঙালিকে বোমা তৈরির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।] হেমচন্দ্রের নির্মিত প্রথম বোমাটির প্রয়োগ হয় এপ্রিলে চন্দননগরের ফরাসী মেয়র তার্দিভালকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টায়। এ-বছরই জুন মাসে কাঁকিনাড়ায় চলন্ত ট্রেন লক্ষ করে ছোঁড়া বোমায় একজন শ্বেতাঙ্গ আহত হয়।
বাংলার বোমা- বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া
বাঙলাদেশে বোমা ও প্রাক্-বোমা যুগের এই প্রাথমিক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাগুলির উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘সদুপায়’ প্রবন্ধে [‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থভুক্ত], যেটি প্রকাশিত হয়েছিল এর কয়েক মাস পরে একযোগে প্রবাসী, ভারতী ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। [তিনটিরই শ্রাবণ, ১৩১৫ সংখ্যায়]। উল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলিকে “অন্যায়ের দ্বারা অবৈধ উপায়ের দ্বারা কার্যোদ্ধারের নীতি” বলে নিন্দা করে তিনি লেখেন, “মঙ্গলবুদ্ধির অরাজকতার দিনে নিতান্তই সামান্য কারণে চন্দননগরের মেয়রকে হত্যা করিবার আয়োজন হয়, কোথাও কিছুই নাই, হঠাৎ কুষ্ঠিয়ার নিরপরাধ পাদ্রির পৃষ্ঠে গুলি বর্ষিত হয়, কেন যে ট্রামগাড়ির প্রতি সাংঘাতিক আক্রমণের উদ্যোগ হয়, তাহা কিছুতেই বুঝিতে পারা যায়না; বিভীষিকা অত্যন্ত তুচ্ছ উপায় অবলম্বন করিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতে থাকে, এবং কান্ডজ্ঞানহীন মত্ততা মাতৃভূমির হৃদ্পিন্ডকেই বিদীর্ণ করিয়া দেয়।” প্রবন্ধটিতে পাদটীকা যোগ করে পরে তিনি লেখেন, “কাঁকিনাড়ার কারখানার ইংরেজ কর্মচারীদের প্রতি লক্ষ করিয়া রেলগাড়িতে বোমা ছুঁড়িবার ঘটনার পুর্বে এই প্রবন্ধ লিখিত হয়। কোন ছিদ্রে পাপ একবার অন্তরে প্রবেশ করিতে পারিলে ক্রমশঃই মানুষকে তাহা কি রূপে বিকৃতিতে লইয়া যায়, এই লজ্জাকর শোচনীয় ঘটনাই তাহার প্রমাণ......।” বাংলাদেশে গুপ্তবিপ্লববাদের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে এটাই রবীন্দ্রনাথের সমকালীন প্রতিক্রিয়া।
অবশ্য এখানে উল্লিখিত বিপ্লবকাণ্ডগুলির মধ্যে সর্বশেষটি [অর্থাৎ রেলগাড়িতে বোমা নিক্ষেপ] সংঘটিত হবার আগেই আরেকটি গুরুতর কাণ্ড বাংলার বিপ্লবীরা ঘটিয়েছিলেন বাংলার বাইরে মজঃফরপুরে, যা বাংলার এই ‘বোমা-তন্ত্রের’ জন্মকাহিনীকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় সারা ভারতে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের মূল প্রবন্ধটি লেখা হযেছিল এপ্রিলের সেই বোমাকণ্ডেরও আগে এবং লক্ষ্য করতে হবে যে, তখন পর্যন্ত তাঁর মনে হচ্ছিল যে, এই সব বিপ্লবকাণ্ড নিতান্তই ‘সামান্য কারণে’, বা অত্যন্ত ‘তুচ্ছ উপলক্ষ অবলম্বন’ করে ঘটছে। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকির দুঃসাহসিক অধ্যবসায় যখন বাংলার বোমাকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে দিল, তখন এর কার্যকারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণার পরিবর্তন হয়েছিল কিনা, সেটা আমরা যথাসময়ে লক্ষ্য করব।
মজঃফরপুরে বোমা বিস্ফোরণ ও আলিপুর বোমার মামলার প্রতিক্রিয়ায় দু’একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে ভারতের রাজনীতিক থেকে শুরু করে লেখক, ভাবুক বুদ্ধিজীবীরা কেউই তেমন ভাবে মতামত প্রকাশে এগিয়ে আসেননি, এমনই ছিল সে-সময়কার সরকারি দমননীতির বিভীষিকা! লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক প্রধানত রাজনীতিবিদ্ ও নেতা হিসেবে দেশবিখ্যাত হলেও বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও পণ্ডিতরূপেও তাঁর দাবি নেহাত উপেক্ষনীয় নয় বলে আমরা বোমাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বুদ্ধিজীবীদের অভিমতের দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘কেশরী’-তে প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি বিশেষ প্রবন্ধকে উপস্থিত করতে চাই। এর আর একটি কারণ, এই অসাধারণ প্রবন্ধগুলিতে যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তাতে রাজনীতিকের চেয়ে তিলকের চিন্তাবিদের ভূমিকাটিই যেন বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে!
বাংলার বোমার প্রতিক্রিয়ায় ‘কেশরী’তে তিলকের প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘দেশের দুর্ভাগ্য’। ভারতের মতো শান্তিপ্রিয় ও মৃদু প্রকৃতির দেশেও যে রাশিয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, এতে সবাই দুঃখ আর অস্বস্তি বোধ করবে, এ-কথা উল্লেখ করে তিলক লিখলেন, “যে-পরিস্থিতি রাশিয়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল, ভারতও যে সেই অবস্থায় এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে, তা ভাবা যায়নি! তাঁর মতে “ভারতের শ্বেত আমলাতন্ত্রের ঔদ্ধত্য আর বিকৃতিই আমাদের যুবকদের এত তাড়াতাড়ি নিরাশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।” ধৃত বিপ্লবীদের বিবৃতির উল্লেখ করে তিলক বলেন, তাদের বক্তব্য থেকে মনে হয়না যে, মজঃফরপুরে কোন বিশেষ ব্যক্তির প্রতি ঘৃণাবশত বোমা ছোঁড়া হয়েছিল- নির্দোষ কেনেডিদের মৃত্যুতে ক্ষুদিরাম দুঃখপ্রকাশও করেছেন। তারা এমন নির্বোধ বা উন্মাদ নয় যে, ভাববে- অত্যাচারী ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে দু’-চারটা বোমা ছুঁড়েই উৎখাত করা যাবে! তারা ব্যক্তিস্বার্থচালিত নয় বা গুণ্ডা-বদমায়েশও নয়। বাঙালিরা শ্বেত আমলাতন্ত্রের বেপরোয়া উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়েই গুপ্তসমিতি গঠন করে এই পথে নেমেছে।”
বাংলাদেশে বোমার উদ্ভবের কার্যকারণ বিশ্লেষণের পর এই প্রবন্ধে তিলকের পর্যবেক্ষণঃ-বঙ্গভঙ্গের বিরাট অন্যায়ের পরেও যদি দু'একজনের মাথা গরম না হয়ে যায়, তবে সেটাই হবে বিস্ময়ের ব্যাপার, অবশ্য অপ্রশমিত ক্ষমতার দর্পে উন্মাদ শ্বেত আমলাতন্ত্রের সেই বিস্ময়বোধের ক্ষমতা না থাকতেও পারে। একটা বেড়ালকেও ঘরে বন্ধ করে রাখলে সে ছাড়া পেলেই প্রচণ্ড আক্রোশে উৎপীড়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর বাঙালিরা তো মানুষ! যে-সব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র বিপ্লবপন্থীদের ব্যঙ্গ করেছিল, বা তাদের কাজের জন্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের বক্তৃতা ও রচনাকে দায়ী করে সে-সবকে অবদমনের সুপারিশ করেছিল, তাদেরও তিলক ছেড়ে কথা বলেননি। উপমার সাহায্য নিয়ে তিনি বলেছিলেন, বন্যার তোড়ে যদি বাঁধ ভেঙে যায়, তবে দোষ বন্যার নয়, অতিবৃষ্টির! তেমনই কিছু দেশবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার জন্য দায়ী দায়িত্বহীন, স্বৈরাচারী আর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী গোরা আমলাশাহী। এর পর তিলকের বিষণ্ণ ভবিষ্যদ্বাণীঃ- “আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই সময় আজ সমাগত, যখন ভারতেও রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতির নিহিলিস্ট দলের মতো সংগঠন গড়ে উঠবে।”
সশস্ত্র কার্যবিধির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে এর প্রতি কিছুটা সমর্থনও তিলকের রচনায় ছিল, এমনটা মনে হতেও পারে :- “ভারতীয়েরা যে-বিদেশী শাসকদের থেকে শুধু অত্যাচার আর অবিচারই পেয়ে এসেছে, তাদের প্রতিরোধে দুটি পথই এতদিন অবলম্বন করা হয়েছে, অর্থাৎ আবেদন-নিবেদন ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পথ। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ব্যর্থ হলে এই তিরিশ কোটি মানুষের মধ্যে কেউ অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের অন্য কোন তৃতীয় পথ নেবেনা, এমন কথা বললে তা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।” বলপ্রয়োগের যুক্তি বোঝাতে তিলক একের পর এক উপমা প্রয়োগ করেন :- “হরিণও নিরুপায় হয়ে পড়লে বাঘকে আক্রমণ করে। ...... নাক বন্ধ না করলে মুখ খোলেনা- শাসনব্যবস্থার চাকায় শিক না ঢুকিয়ে দিয়ে উপায় নেই।”
এভাবে যদিও তিলক কিছুই বলতে বাকি রাখলেন না, তবু তিনি অস্বীকার করলেন না যে, এই সহিংস পন্থা বিষবৃক্ষ। কিন্তু এর উন্মূলনের জন্য যে অনিবার্য প্রয়োজন শাসনসংস্কার, সে কথাও তিনি নিষ্কম্প কন্ঠে বললেন। শিক্ষিত ভারতবাসী সন্ত্রাসবাদের বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে, সরকারের এই প্রচারে আপত্তি জানিয়ে তিলক বললেন, মানুষ ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছলেই মজঃফরপুরের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে। তাই একে শুধু নিন্দা করলেই কর্তব্য শেষ হয় না, তাঁর পরামর্শ :- “মজঃফরপুরের ঘটনা থেকে সরকার যেন এই শিক্ষাই নেয় যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ব্যর্থতাই কিছু যুবককে এই পথে ঠেলে দিয়েছে।” [১২ মে, ১৯০৮]
‘কেশরী’র একই সংখ্যার সম্পাদকীয়টি ছিল বাংলার বোমার প্রতিক্রিয়ায় তিলকের দ্বিতীয় রচনা। এতে দু’টি সরকার-সমর্থক কাগজের বক্তব্য খণ্ডন করা হয়। বোমার রাজনীতির কারণস্বরূপ স্বদেশী আন্দোলনকে অবরুদ্ধ করার যে পরামর্শ ‘স্টেটসম্যান’ দিয়েছিল, তার সম্পর্কে তিলক বলেন, তা হলে তো স্বদেশী আন্দোলনের কারণ হিসেবে বঙ্গভঙ্গকে রদ করলেই ঠিক হয়! আর এলাহাবাদের ‘পায়োনীয়র’ এ-রকম বিস্ফোরণের জন্য সন্দেহভাজন নেতাদের যে প্রাণদণ্ড দেবার কথা বলেছিল, সে সূত্রে তিলক স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ইতিহাসের এই শিক্ষা যে, এটা জনগণকে সন্ত্রস্ত করবার একটা প্রচলিত পন্থা বটে, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেছে যে, এই ওষুধে সহিংস প্রবণতা কমার বদলে বেড়েই গেছে।
তিলকের পরবর্তী প্রবন্ধ - ‘একটি দ্বৈত ইঙ্গিত’, ‘কেশরী’তে বের হয় ১৯শে মে। প্রধানাংশে এটির বক্তব্য ছিল আত্মরক্ষামূলক। যে-সব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্রপত্রিকা ও বিদেশী সরকারের দেশী খয়ের-খাঁর দল প্রচার চালাচ্ছিল যে, স্বদেশী নেতাদের আন্দোলন আর রচনাগুলোই এই বোমার উদ্ভবের জন্য দায়ী আর সেই কারণে এই সব নেতাদের কাজকর্ম ও লেখাকে দমন করা হোক, তাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তিলক উলটে সরকারের কাছে এই সব প্রচার বন্ধ করার আর্জি জানালেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করলেন যে, বোমা বা অন্য কিছুর সাহায্যে অপরের প্রাণনাশে তাঁদের নৈতিক সমর্থন নেই এবং কিছু শ্বেতাঙ্গ সরকারি কর্মচারীকে মারতে পারলেই যে পরিণামে স্বরাজ্য লাভ হবে, এমনটাও তিনি বা কেউই মনে করেন না। এই পথ শুধু ভুলই নয়, চরম আত্মঘাতীও। আইনশৃঙ্খলা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে, কিন্তু সেই অজুহাতে যে-সব নেতা জনগণকে তাদের স্বাভাবিক অধিকার অর্জনের শিক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের পথে কাঁটা বিছানো চলবে না।
‘বোমার গুপ্তকথা’ শীর্ষক এর পরবর্তী প্রবন্ধটি ‘কেশরী’তে ছাপা হয় ২রা জুন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে নির্মল সারল্যের ভঙ্গীতে আবৃত করে তিলক লিখলেন,“পাশ্চাত্য বিজ্ঞানই বোমার জন্ম দিয়েছে... সরকারের সামরিক শক্তি-দম্ভকে বোমা ধ্বংস করে। ...বোমার কারণেই এই শক্তিমত্ততা থেকে জন্মানো বিশৃঙ্খলার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।” বোমার প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে তিলকের আরও সরস বর্ণনা :- “যখন সরকারি কর্মচারীরা বিনা কারণে জনগণের অবদমন শুরু করে, এবং সন্ত্রাসের সাহায্যে তাদের হতাশাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালানো হয়, তখনই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উৎসারিত বোমার আওয়াজ কর্তৃপক্ষকে এই শিক্ষা দেয় যে, জনগণ তাদের অনুদার নীতিকে গদগদ ভাবে ভক্তিপ্রদর্শনের থেকে উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে।”
‘কেশরী’তে তিলকের পঞ্চম নিবন্ধটির শিরোনামের মর্মার্থ ছিল :-‘এ-সব প্রতিবিধান স্থায়ী হবেনা’, প্রকাশের তারিখ ৯ই জুন। তিনি তীব্র ভাষায় লিখলেন যে, সভাসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ, বিস্ফোরক আইন ইত্যাদি নতুন নতুন উৎপীড়ন ব্যবস্থা সরকার চালু করেছে, কারণ তার কাঁধে ভূত চেপেছে। ভারতবাসীদের সামান্যতম অস্ত্র রাখবার অধিকারও কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দেশবাসীর পৌরুষকে পিষে মেরে নিজেদের স্বার্থপর শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাবার যে ফন্দী করেছে, তার নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে এই রচনায় তিনি মুঘল শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার তুলনা করে ইংরেজদের নীতিকে তুলনামূলক ভাবে বেশি অনুদার ও স্বার্থান্ধ বলে চিহ্নিত করলেন।
বোমার তন্ত্র সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যকে তিলক আক্রমণ করলেন এই ভাবে :- “কর্তৃপক্ষ এই ভুল কথা প্রচার করছে যে, বাঙালিদের বোমা সমাজনাশী। না, ইয়োরোপের যে-বোমা সমাজ ভাঙতে চায়, তার সঙ্গে বাঙলার বোমার আকাশ পাতাল প্রভেদ। ইয়োরোপের বোমার জন্মদাত্রী হচ্ছে স্বার্থপর কোটিপতিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর বাঙলার বোমার সৃষ্টি তীব্র দেশপ্রেম থেকে। বাঙালিরা নৈরাজ্যবাদী নয়, তবে তারা নৈরাজ্যবাদীদের অস্ত্র ব্যবহার করেছে মাত্র।” তিলকের মতে বোমার কার্যকারিতাও রয়েছে, যা তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি। তিনি জানান যে, বোমার দ্বারাই পর্তুগাল ও রাশিয়ায় শাসনসংস্কার সম্ভব হয়েছে, কাজেই শাসনসংস্কার হলে এ-দেশেও বোমার বিস্ফোরণ আর হবে না।
তিলকের মতে বিজ্ঞানের দৌলতে বোমার সহজ নির্মাণ কৌশল অনেকেই বেশ জেনে গেছে। কলকাতায় আবিষ্কৃত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখের বোমার কারখানাটি থেকেও এ কথার প্রমাণ মেলে। বারীন্দ্রের বোমার মামলার বিবরণ থেকে সরকার কি শিক্ষা নেবে না? আগের রচনাটির মতো এটিতেও তিলক বোমার উদ্ভবের কার্যকারণ ব্যাখ্যার ছলে বোমার রাজনৈতিক উপযোগিতার ওকালতি করতে কসুর করেন নি। তাঁর অনবদ্য ভাষায়:- “বোমাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।...সরকারের কাজকর্মে দেশবাসী কতটা হতাশ, ক্ষুব্ধ বা ক্রোধন্মত্ত হয়েছে... এতদিন সরকারের তা জানার কোনও উপায় ছিলনা।... এতদিন দেশবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছে আবেদনপত্রের মাধ্যমে। আবেদন গ্রাহ্য না হলে তারা সেই যন্ত্রণায় নিজেরাই জ্বলেছে, সরকারের কানে সে খবর পৌঁছয়নি। এখন এই উন্মত্ত মানুষগুলো বোমার বলে বলীয়ান – যে বোমা সরকারের সামরিক শক্তিকেও খর্ব করে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, আগের রচনাগুলোর মতো এখানেও তিলক সরকারের কানে এই কথাটাই ঢুকিয়ে দিতে চাইলেন – “বোমা বন্ধের সঠিক পথ হল জনগণের হাতে স্বায়ত্ত শাসনের জরুরি অধিকার দেবার ব্যবস্থা।”
তিলকের এই পাঁচটি প্রবন্ধের প্রথম ও শেষটির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়, যার পরিণতি ছিল দীর্ঘ ছ’ বছরের জন্য সুদূর মান্দালয়ে্র জেলে নির্বাসন। ভারতের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের ওপর বাংলাদেশে উদ্ভূত এই বোমার রাজনীতির আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আমরা এর পরে লক্ষ্য করব।
[পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়]
আকর-পঞ্জীঃ-
১। আত্মশক্তি ও সমূহ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২।LokamanyaTilak : A BiographyBy- G D Pradhan& A K Bhagwat
[Jaico Publishing House, 1956]
৩। তিলকের পত্রিকায় স্বদেশী আন্দোলন/ শঙ্করীপ্রসাদ বসু [চার] – শিলাদিত্য,
১-১৫ মার্চ, ১৯৮৪।
৪।মা কালীর বোমা/ পিয়ারীলাল দত্ত- বর্ণপরিচয়, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর , ২০০৯।
0 comments: