0

ছোটগল্প - মৈত্রেয়ী দেবনাথ

Posted in


ছোটগল্প


হারজিৎ 
মৈত্রেয়ী দেবনাথ



১)

কাল সারারাত ভ্যাপসা গরম ছিল। এপাশ-ওপাশ করেছেন সারারাত, চোখ ক্লান্তিতে বুজে এলেও ঘুম আসেনি। ভোরের দিকে আলস্যে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু ভোরে ওঠাটা সেই ছোটবেলার অভ্যেস অমিতার। যতই ক্লান্তি আর অনিচ্ছে ঘিরে ধরুক, ভোরের ঠাণ্ডা জলে স্নান করে আধভেজা চুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকাল হতে দেখার যে অনুভূতি, তার সাথে কোনওকিছুর বিনিময়েই সমঝোতা করতে নারাজ অমিতা। বাড়ির এই ঝুলবারান্দার দিকটায় অনেক গাছগাছালি। তাই ভোরের দিকটায় একটু কুয়াশামাখা হাওয়া বয় এইখানে। ডানপাশেই বাঁধানো পুকুরঘাট। এখন আর ব্যবহার হয়ই না বলতে গেলে, তাই একসময়ের ছলাৎছলাৎ জল আজ তার সাবলীল দেহভঙ্গিমা হারিয়ে কচুরিপানার নাগপাশে বন্দী। শরীর ভালো থাকলে অমিতা ঝুলবারান্দা ছেড়ে এই পুকুরঘাটে নেমে আসেন কখনও। গাঢ় পানাজলের আঁশটে ভারী অন্ধকার আলসে গন্ধ প্রাণপণে শুষে নেন ফুসফুসে। বয়সকালে কখনওসখনও একদম ভোরবেলা এই পুকুরঘাটে স্নানও করেছেন। বাইরে উঁচু পাঁচিল থাকলেও বাড়িতেও তখন অনেক লোকজন। তবে তিনি পুকুরঘাটে নাইতে এসেছেন জানলে কোনও কাজের লোকের বা মানুষের তো ছাড়, কার্নিশে দিনরাত বকবকম করা পায়রাগুলোরও এদিকপানে ঘাড় ঘোরাতে সাহস হতো না। ভিজে গায়ে শাড়ী জড়িয়ে যখন তিনি দোতলায় নিজের ঘরে যেতেন, মিত্রবাড়ির প্রতিটা ইঁট প্রতিটা ধুলো অবধি চোখ নামিয়ে রাখতো। তখন যুবতী শরীর, অসামান্য সুন্দরী নাহলেও অমিতার ছিল এক অদ্ভুত আবেদন। লাস‍্য আর প্রগলভতা পেরিয়ে এক অজানা সৌন্দর্য্য যেটা প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব দিয়ে চিরটাকাল মুড়ে রেখেছেন। একঢাল কালো চুল থেকে পায়ের শাড়িমোড়া আলগোছে গোড়ালি অবধি তাঁর ব্যক্তিত্বের তলায় চাপা পড়ে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলো। যত দিন গেছে, সেই ব্যক্তিত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে বই কী! না হওয়ার কোনোও কারণ অবশ্য নেই। প্রবীর যতই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন, ততই নবোঢ়া নিজের ঘোমটা থেকে বেরিয়ে জগতের সম্মুখীন হয়েছেন। সম্পর্ক শীতল থেকে হিমশীতল হয়েছে, আর অমিতা তাঁর সর্বাঙ্গীন কুশলতা দিয়ে মিত্রবাড়িকে বশীভূত করেছেন। সংসার থেকে ব্যবসায় শ্বশুরের পাশাপাশি, কোনওকিছুতেই নিরাশ করেননি মিত্রবাড়িকে। এই বাড়ির প্রতিটা অংশ আজও ভোলেনি কিভাবে আগলেছেন তিনি নিজের সবকিছু দিয়ে। নাহলে আজ মিত্রদের কি হাল হতো কে জানে!! 

এখন আর ওই ঘাটে যাওয়াই হয় না বলতে গেলে। শরীরে দেয় না, মনেও না। ইচ্ছেই হয় না কোনওপ্রকার। অনেক তো হোলো, আর দায়িত্ব নিতে ভালো লাগেনা...কিন্তু এত কষ্টে রক্ষা করা আধিপত্যে কোনও বিচ্যুতিও মেনে নিতে পারেন না। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রবীর সরে যেতে চাইলে, তিনি কি আটকানোর চেষ্টা করেছেন? আরও কিছু কি করতে পারতেন না তিনি? কিন্তু নিজেকে আজ অবধি বোঝাতে পারেননি, যে কেন? কোথায় খামতি ছিল তাঁর? যার জন্য বাড়ির সবার মন জয় করলেও, যাঁর স্বীকৃতি সত্যিই চেয়েছিলেন, তার মনের নাগালই পেলেন না কোনওদিন? একেবারে চেষ্টা যে করেননি প্রথমদিকে তা তো নয়। নাহলে দীপ কখনোও পৃথিবীর আলোই দেখতো না। দীপের নামটা মাথায় আসতেই মনটা আবার কুঁকড়ে যাচ্ছে। খুব যে ঈশ্বরভক্ত ছিলেন তিনি, তা নয়। কিন্তু সবাই যে বলে দেরিতে হলেও ভগবান সবসময় সঠিক বিচার করেন? ভগবানের এ কেমন বিচার! আজন্ম তিনি দীপকে নিজের অধিকারে রেখেছেন, বাবার ছায়াটুকুও যেন তার গায়ে না লাগে--- কঠোর হাতে সেই ব্যবস্থা করেছেন। কারওর কথা কানে তোলেননি। অবশ্য তার কথার বিপরীতে কথা বলার মতো লোক তখন আর কেউ ছিল না, কিন্তু তাও নিজের মতন করে ছেলেকে গড়তে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু আজকাল আর দীপকে চেনা লাগে না তাঁর। মুখের আদল থেকে চুল, সুঠাম দীর্ঘদেহী ছেলের দিকে তাকালে সবকিছুতেই বড্ডো বেশি একজনের মতো লাগে। গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি, চোখ তুলে তাকানো, অবিকল প্রবীর! তাও মেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু স্বভাব, চিন্তাধারা? সেটাও কি করে বাবার মতো হয়? জ্ঞান হওয়ার পরে থেকে বাবাকে চোখের সামনে দেখেছে ক'বার দীপ? গুনতে একটা আঙ্গুলও লাগবে না। তাও কিভাবে সবকিছু মিলে যেতে পারে? নিজের কাছে নিজেই হেরে যাচ্ছেন তিনি। প্রবীর আবারও হারিয়ে দিচ্ছে তাঁকে... না ...না...কিছুতেই না। কিছুতেই হেরে যাবেন না তিনি! তাঁর এত বছরের কষ্টের, সংযমের কি কোনও দাম নেই? প্রবীরকে তিনি আটকাতে পারেননি... যেতে দিয়েছেন। কিন্তু দীপকে তিনি কিছুতেই চলে যেতে দেবেন না, দিতে পারেন না! নাহ্‌, আজ আর বেশিক্ষণ বারান্দায় থাকবেন না তিনি। আজ দীপ এলে ওকে বোঝাতে হবে যেভাবেই হোক। দীপ ছাড়া সত্যিই তো আজ আর কিছু নেই তাঁর। আজ দীপের পছন্দসই রান্নাগুলো নিজের হাতে করবেন। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আটকাবেন নিজের রক্তকে। এলোচুল আনমনেই খোঁপা করে নিলেন অমিতা। তিপ্পান্ন বছর বয়সেও আবার যুদ্ধে নামার জন্য তৈরী করতে হবে নিজেকে। আর এই যুদ্ধে তাঁকে জিততেই হবে।।


২)

সবুজ, খুউউউব নরম সবুজ... এরকম ঘাস আগে কখনও দেখিনি... যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধুই ঢেউখেলানো ঘাসের আস্তরণ। মাথার ওপরে চকচকে নীল আকাশ ছড়িয়ে আছে এমাথা থেকে ওমাথা। কেউ নেই কোত্থাও! কোথায় এটা? কিছু মনে পড়ছে না কেন? এত নরম এত সবুজ ঘাস... হয় নাকি? আরে একটা মানুষ তো থাকবে অন্ততঃ আশেপাশে! এত ফাঁকা হতে পারে নাকি চারিদিক... অন্ততঃ পর্ণাও যদি থাকতো! 

"পর্ণা তো ছিল না দীপ... কখনওই ছিল না... তোমার আর আমার মধ্যিখানে... কেউ কি ছিল? আজও নেই... ভালো করে দেখো... শুধু আমিই আছি... তোমার পাশে... থাকবো..." ---খিলখিল করে হেসে উঠে মেয়েটা আস্তে আস্তে দৌড়তে থাকে ওই ঘাসজমিন বেয়ে... কি নির্ভার তার যাতায়াত! দীপ হাত বাড়িয়েও নাগাল পায় না... কে মেয়েটা? দীপ চেনার চেষ্টা করে... হাসিটা, গলার আওয়াজটা ...বড্ডো চেনা... গেলো কোথায় সে... সবদিকেই তো খোলা মাঠ... এত তাড়াতাড়ি সে কোনদিকে চলে গেল? এদিক ওদিক তাকাতেই আবার হাসির শব্দ কানে আসে দীপের... পিছন ফিরে দেখে ওই তো মেয়েটা খেলছে... কিশোরী বয়েস... হাসিটাও বাচ্চাদের মতো... খুব খুউউব চেনা... কিন্তু কথাগুলো কেমন যেন প্রাপ্তবয়স্ক শোনাচ্ছে... দীপ বুঝতে পারছে, তার চেনা উচিত মেয়েটা কে, কিন্তু কিছুতেই নামটা মনে পড়ছে না... আর ভালো লাগছে না... মাথাটা কেমন যেন দুলছে... ওর চোখের সামনে দিয়েই একটা খুব চেনা ফ্রক দুলে দুলে সরে যাচ্ছে... "এই জামাটা চিনতে পারছো দীপ? তুমি এই জামাটা পড়লেই আমাকে খুব ক্ষেপাতে... মনে আছে? আসলে তোমার এটা খুব পছন্দের জামা ছিল, তোমার মা-ই তো দিয়েছিলেন...মনে নেই?" পুরো ঘাসের দিগন্ত দুলে উঠলো দীপের চোখের সামনে... চিনতে পেরেছে সে...মনে পড়ে গেছে সব... ওই হাসি... ওই জামা... ওই দুলে দুলে দৌড়ানো... সওওব। হাত বাড়ায় দীপ..." না...না... আর যেতে দেব না তোমাক ...প্লিজ যেও না...প্লিজ...প্লিজ...মোম...মোম দি..."


চিৎকার করে উঠে বসে দীপ!! ঠিক চিৎকার না, একটা অব্যক্ত গোঙানি!!
মোম... মোমদি এসেছিল...
...উদভ্রান্তের মতন এদিকসেদিক তাকায়... কোথায় গেল ?
এক লাফ মেরে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় দীপ। মাথাটা কি ভার!মনে হচ্ছে পাঁচমণি পাথর বাঁধা রয়েছে... এখনও দৃষ্টিটা ঘোলাটে। অভ্যস্ত হাতে বেডসুইচ অন করে। টয়লেটে গিয়ে চোখে মুখে মাথায় জল থাবড়ায় ভালো করে। ঠাণ্ডা জল চামড়ায় লেগে মনে হচ্ছে যেন একটু একটু ভালো লাগছে। ভেজা মুখ ভেজা মাথা নিয়েই বিছানায় এসে বসে। চুল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ে জামার গলার পিঠের কাছটা আস্তে আস্তে ভিজতে থাকে। কিন্তু দীপের আর ওসব দিকে খেয়াল হয় না।

স্বপ্ন দেখছিলো সে, এটুকু বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ মোমদি কেন? এতদিন পরে? কিছু বুঝতে পারে না দীপ। ঘড়ির দিকে দেখে, পৌনে তিনটে বাজে! এমনিতে খুব একটা স্বপ্ন দেখে না সে। দেখলেও বেশিরভাগটাই বাবার স্বপ্ন। সেই ছোটবেলায় দেখা বাবা যে এভাবে মনে রয়ে যাবে, সেটা ও নিজেও কখনও ভাবেনি! আর ওর মা'ও ভাবেননি, সে শিওর। যদি মা ঘুণাক্ষরেও টের পেতো, যে সে ভবিষ্যতে কখনও বাবাকে স্বপ্নে দেখতে পেলেও পেতে পারে, তাহলে মা যে সেই সম্ভাবনাটাও গোড়াতেই উপড়ে দিত, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই ওর। বাবার সাথে ওর কোনওরকম সামান্যতম যোগাযোগ যাতে না হতে পারে, সেই বিষয়ে মা সর্বদা সজাগতম দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে, সেই ছোটবেলা থেকেই। অবশ্য কোন বিষয়েই বা দেননি! সবকিছু তো মা'ই ঠিক করে দিত। সবকিছু মানে সবকিছু। সে জানে মা তার ভালোর কথাই ভেবেছে সবসময়। ছোটবেলায় মা'কে আঁকড়েই তো বড় হলো। কিন্তু তার সবকিছু ঠিক করে দেবার প্রবণতাটা মায়ের মধ্যে বাড়তেই থাকলো। ছোটবেলার সেই লেবুপাতার মতো সুন্দর গন্ধওয়ালা মা'টা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। একটু বড় হতেই সে বুঝতে পারলো, তার মা'র দুটোই উদ্দেশ্য; বাবার থেকে তাকে দূরে রাখা আর ছেলের জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা। ছোটো থেকেই মুখচোরা ছেলেটা, কখনও জানেইনি যে মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও যাওয়া যায়! সেরকম কখনও দরকারই হয়নি। তার যে কোন পেন্সিলবক্সটা পছন্দ, মা সেটা জিজ্ঞেসই করেনি কখনও, মা নিজের পছন্দেরটা কিনে দিয়েছে! সে চুপ করে থেকেছে। অপছন্দের রঙের জামা বারবার কিনে দিয়েছে মা... সে মুখ ফুটে বলতেও পারেনি যে, মা...আমার না, নীল রংটা পছন্দ খুব। আর মা'ও কখনও জিগ্যেস করেনি। কক্ষনও না, ভুলেও না। কাঠপুতুল হয়ে বাঁচাটা এমনভাবে বসে গেছিলো জীবনে, দীপ বোঝেইনি যে এর বাইরেও একটা জীবন হয়। প্রথম বুঝলো, যখন মোম'রা সবাই অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেল।

অস্থিরতা চাপা দিতে আর গ্লাসের খোঁজ না করে বোতলের ঢাকনা খুলেই ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নেয় দীপ। আলোটা বন্ধ করে দেয়। বাইরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। জ্যোৎস্নার হালকা আলোতে ছেয়ে আছে চারপাশ। একবার ভাবে পর্ণাকে একটা পিং করবে কিনা, কিন্তু নিজেকে দমিয়ে নেয়। এত রাতে কখনও পর্ণাকে পিং করার দরকার হয়নি আগে। আজকে ও ঠিক বুঝে যাবে কিছু একটা হয়েছে। মোমদির কথা পর্ণা জানে ভাসাভাসা। সে নিজেও বা ভালো করে জানলো কবে? মা তো কিছু বোঝার আগেই সব 'ঠিক' করে দিলো। এখন মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। মোম'দির সাথে ছোটবেলায় কাটানো মুহূর্তগুলো যে মনের মধ্যে এইভাবে লুকিয়ে ছিল, সে আজকের স্বপ্নটা না দেখলে জানতে পারতো কি? আজকে ওর মা'র কাছে যাওয়ার কথা। এখনও গভীর রাত, কিন্তু দিন হিসেবে আজকেই তো হয়। রাতটা অপেক্ষায় আছে, দিনের আলো ফোটার। সেও অপেক্ষায় আছে। এবার, আর অমিতা মিত্রকে তার জীবনের স্টিয়ারিং হুইলের নাগাল পেতে দেবে না।


৩)

- অ্যাই বোকা ছেলে ...কাঁদছিস কেন তুই? আমি কি মরে যাচ্ছি নাকি? 

- আরেকবার বলো দেখি বাজে কথাটা, আমি এক্ষুনি এই চলে যাবো। 
- আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না, কিন্তু তুই এমন কাঁদছিস কেন? বড় কবে হবি বলতো?

- হবো না বড় যাও। নিজে তো দিব্যি ড্যাং ড্যাং করতে করতে চলে যাচ্ছ আমাকে ছেড়ে, আবার বলছে আজেবাজে কথা! দুৎ তুমি যাও তো এখান থেকে!

- আমি ইচ্ছে করে যাচ্ছি না রে তোকে ছেড়ে। তুই তো সবই জানিস। আরো অনেক আগেই আমাদের যাওয়ার কথা। বাবা আর একা পারছে না রে। আমাকেও তো পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে হবে, নাকি? আমার জন্যেই বলতে গেলে বাবা-মা এত বছর আলাদা। এবার তো আমার উচিত ওদের দিকটাও দেখা, বল?

- আমি সব জানি তো মোমদি, তুমি আর নতুন করে কি বলবে? কিন্তু তুমি চলে গেলে আমার কি হবে বলোতো? আমি খুব একা হয়ে যাবো। আমি স্বার্থপরের মতোই চাইছি যাতে তোমার যাওয়াটা ক্যানসেল হয়ে যায়। আচ্ছা কাকিমাকে পাঠিয়ে দাও ওখানে, আর তুমি এখানে আমার কাছে থাকো! এরকমও তো করা যেতে পারে, বলো পারে না?

- না, পারে না। এবার আমাকে যেতে হবেই রে বোকা।
আর তুই এত ভাবছিস কেন, আমি ওখানে গেলে কি ভাবছিস তোকে ছেড়ে দেব? ওখান থেকেই তোর সাথে যোগাযোগ রাখবো, তুইও রাখবি। আমার মেইল এর রিপ্লাই দিবি সময়মতো। আর ভালো করে পড়াশোনা করবি। আমি খোঁজ রাখবো ভালো কলেজের। সুযোগ হলে তুইও চলে আসতে পারবি অস্ট্রেলিয়ায়। আমরা আবার একসাথে থাকতে পারবো। বল, ভালো হবে না?

- সত্যি বলছো? তুমি মেইল করবে আমাকে? আর আমি ভালো করে পড়াশোনা করলে, তোমার কাছে যেতে পারবো? সত্যি?

- একদম সত্যি রে বোকা। তুই বোকাই থেকে যাবি, আমি জানি।


হাসতে না চেয়েও হেসে ফেলে দুজনে। একজনের চোখ তখন জলে ভেজা। আরেকজন একটু দূরে গিয়ে পিছন ফিরে চোখের জল লুকায়।


৪)

- তুমি কবে থেকে এত বড় হয়ে গেলে দীপ, যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেলছ? -কঠোর গলায় প্রশ্ন করেন অমিতা।

- তোমার কাছে হয়তো আমি এখনও ছোটই আছি মা, কিন্তু বয়সটা তো থেমে নেই আসলে। তোমার আঁচলের তলায় থাকতে থাকতেই একদিন বড় হয়ে গেলাম। -ধীরগলায় বলে দীপ।

- এটা আমার প্রশ্নের পুরো উত্তর নয় কিন্তু। নিজের ভালো মন্দ বোঝার মতন বড় হয়েছ কি?

- কিছুটা হয়েছি মা। আমি এটাই চাই মা। তুমি প্লিজ বোঝো। আর যদি আমি নিজেকে ভুল বুঝেও থাকি, তাহলে আমাকে হোঁচট খেতে শিখতে দাও মা। ভুল করতে দাও প্লিজ। -দীপের গলায় আকুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

- বাহ্, ডায়ালগ তো তৈরী করে এসেছো দেখছি! তা নাটকদলে নাম লিখিয়েছো নাকি ক্যানবেরা থেকে উড়ে উড়ে এসেছে কথাগুলো? -কেটে কেটে কথাগুলো বলেন অমিতা।

- কি বলছো তুমি মা! ক্যানবেরা থেকে ডায়ালগ, এই কথাটার মানে কি? 

- আমি যে কি বলছি, সেটা তুমি ভালো করেই জানো দীপ। আজ অবধি কোনওদিন তুমি আমার সাথে এই সুরে কথা বলোনি। আজকে যখন বলছো, আমি ধরে নিতেই পারি যে কোনও প্রভাবে তুমি এমন কথা বলছো।
 
- মা, আমি ভাবতেই পারছি না তুমি এরকম ভাবে সবকিছু ভেবেছো! আমি আমার পছন্দের বিষয়ে রিসার্চ করার সুযোগ পেয়েছি বিশ্বের নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে। সেই সুযোগটা আমি নিতে চাইছি। এর মধ্যে তুমি মোমদি'কে কেন টানছো! তুমি ভালো করেই জানো, অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর থেকে একদিনের জন্যেও মোমদি আমার সাথে যোগাযোগ করেনি! আমি তাহলে কেন ওর কথা ভেবে ওই দেশে যাবো? -হতাশ গলায় মাকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় দীপ।

- টানছি, কারণ তুমি মন থেকে ওকে ভুলতে পারোনি। আমি তোমার মা, তুমি না বললেও আমি জানি। শুধু তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, মোম তোমার থেকে অনেকটাই বড়।

- সত্যিই যদি তুমি আমাকে বুঝতে তাহলে আজকের এই জায়গাটাই আসতো না কখনও। আর আমি জানি মোমদি আমার থেকে কতটা বড়। টু বি ভেরি প্রিসাইজ, তিন বছর চার মাস দুই সপ্তাহ পাঁচ দিনের বড়। আর আমার তাতে কিছুই এসে যায় না। -আর পারে না দীপ নিজেকে সামলাতে।

- তুমি...তুমি এইভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারো না! লজ্জা করছে না তোমার একটুও? -রাগে চিৎকার করে ওঠেন অমিতা। মুহূর্তের জন্য তাঁর সুনিয়ন্ত্রিত অবয়বের মধ্যে খেলা করে যায় ক্রোধ।

- লজ্জা কেন করবে মা? তুমি এইভাবে ভাবতে পারলে, আমি বলতে পারবো না? আর বার বার মোমদি'কে টানছো কেন বলবে একটু? যেখানে তুমি জানো যে ও নিজের ইচ্ছেয় আমাকে সরিয়ে দিয়েছে... আমি কেন যাবো ওর কাছে? কেন ওর কথা ভাববো? -এই প্রথম বোধহয় গলা চড়িয়ে ফেলে দীপ।

অনেক চেষ্টা করেও ঠোঁট থেকে বাঁকা হাসিটা সরাতে পারলেন না অমিতা। দীপ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল মা'র দিকে। আস্তে আস্তে দৃষ্টিটা স্থির হয়ে এলো... ফর্সা মুখে মনে হয় শরীরের সব রক্ত এসে জমেছে! দীপ জানে না সে আগে কখনও এরকম কষ্ট অনুভব করেছে কিনা! সে বুঝতে পেরেছে সবকিছু... তার ইমেইলের পাসওয়ার্ড মায়ের জানা... তাহলে কি... তাহলে কি... আর ভাবতে পারেনা দীপ।।
একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জিজ্ঞেস করে দীপ...
- মা, আমি তাহলে এতদিন ভুল বুঝে এসেছি! 

অমিতা কোনও উত্তর দেন না। চুপ করে থাকেন। বুঝতে পারছেন তিনি, যে জয় আর খুব বেশি দূরে নেই।

অনেকক্ষণ পরে, নেশাগ্রস্তের মতো লাল দুটি চোখ তুলে তাকায় দীপ। অনেক কষ্টে অমিতা নিজেকে সংযত রেখেছেন। অনেকদূর থেকে দীপের গলা ভেসে আসছে যেন,
- তুমি আমাকে যেতে দেবে কি দেবে না, মা?

বিজয়িনীর ভঙ্গিমায় অমিতা বলে ওঠেন... 
- আমি অনেকক্ষণ আগেই 'না' বলে দিয়েছি দীপ। তুমি বোধহয় ঠিক শুনতে পাওনি।


৫)

অনেকদিন বাদে দীপ বিশাল বাড়িটায় এসেছে। ভাদ্রমাসের গরমে চারিদিক ভেপসে যাচ্ছে কিন্তু তাও যেন এই বাড়ির চৌহদ্দিতে এলেই দীপের আর গরম লাগে না। কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ঘিরে ধরে তাকে, সেই ছোটবেলার মতো। 

গাড়ির আওয়াজে বেরিয়ে আসেন অমিতা। গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন ছেলেকে। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে পলকে। এত মিল! ফোয়ারার পাশে দাঁড়ানো দীপ এখনও মায়ের উপস্থিতি টের পায়নি, মনোযোগ দিয়ে ফোয়ারার তলায় ইঁটের সারির পাশে পাশে লাগানো টাইমফুলগুলোর দিকে তন্ময় হয়ে দেখছে! অবিকল প্রবীর! আর এই রংটাও খুব মানিয়েছে ওকে! প্রবীরের প্রিয় রং ছিল নীল। অবচেতনে তাই ওই রংটাকে সরিয়ে দিতে দিতে আজ এই পড়ন্ত বেলায় এসে খেয়াল হলো, নীল রংটা হয়তো দীপেরও প্রিয় ছিল। দীপ কি আজ ইচ্ছে করেই এই রংটা পরে এসেছে? না... না... ও জানবে কি করে যে এটা প্রবীরেরও প্রিয় রং ছিল! নিজেকেই মনে মনে ধমক লাগান। দীপ এখনও ফুলগুলো দেখেই যাচ্ছে। বাড়িটার ওপরে বড্ডো মায়া ছেলেটার! 

একটু গলা খাঁকড়ে নেন অমিতা। দীপের কানে আওয়াজটা যেতেই সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সিঁড়িতে দাঁড়ানো অমিতার কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।

ছেলের হাত ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে আসেন অমিতা। 
- তোর পছন্দের রান্না হয়েছে আজকে ...সব আমি নিজে হাতেই করেছি, তুই জানিস? তুই হাতমুখ ধুয়ে আগে জলখাবারটা খেয়ে নে। সকাল থেকে তো কিছু খাসনি মনে হয়...মুখ শুকিয়ে গেছে।

দীপ চুপ করে বসে থাকে মেঝের দিকে তাকিয়ে। মায়ের চোখের বা মুখের দিকে তাকায় না। 

অমিতা আবার একটু ঠেলা দেন...
- ওরে চল চল, কতোক্ষণ এইভাবে বসে থাকবি?

- তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মা।

দীপের গম্ভীর গলার আওয়াজে চমকে ওঠেন অমিতা। এত দৃঢ়তা আগে কখনও শোনেননি তিনি। বুকটা ঢিপঢিপ করতে থাকে। কেমন অচেনা লাগে নিজের ছেলেকেই।

- আচ্ছা আচ্ছা সেসব হবেখন পরে, আগে খাওয়াটা সার। ওই শুকনো মুখ দেখলে আমার আর তোর কোনও কথাই শুনতে ইচ্ছে করবে না রে।

- নিজের ইচ্ছের বিপরীতে কখনও কোনও কথাই তো শুনতে ইচ্ছে করেনি মা তোমার। 

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অমিতা। মনে মনে আগের থেকে অনেক দুর্বল তিনি, সেটা নিজেও জানেন...
- আজকে তোর সব কথা শুনবো আমি, যা যা বলতে চাস।

- আমি তোমাকে কিছু নতুন শোনাতে আসিনি মা। ফোনে তোমাকে বলেছিলাম। এবার পাকাপাকি বলছি। -কণ্ঠস্বরে একরাশ বিষাদ ঝরে পড়তে থাকে দীপের।

যতটা জোর থাকা উচিত ছিল গলায়, ততটা জোর অনেক খুঁজেও পান না অমিতা...
- তুই বলেছিলি, আমি শুনেছি। ব্যাস হয়ে গেল। এবার চল। 

দীপ চুপ করে বসে থাকে সোফাতে। স্থির গলায় বলে ওঠে...
- শুনেছো মানে?

অমিতা জানতেন এই ঝড়টা আসছে, কিন্তু আরও কয়েকটা ঘন্টা পরে আসবে ভেবেছিলেন, অন্ততঃ দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে নিজে গিয়ে ছেলেকে বোঝাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু আজ কেন জানি তাঁর কোনও হিসেবনিকেশই মিলছে না। ভাঙচুরটা বুঝতে দেন না ছেলেকে...
-তুমি বলেছ, আমি শুনেছি। এটাই বললাম। আমি একবারও বলিনি যে তোমার কথা আমি মানবো।

দীপ দীর্ঘশ্বাসটা আর লুকাতে পারে না...
- তুমি যদি আক্ষরিক অর্থ ধরতে চাও মা, তাহলে বলবো, আমি তোমাকে শোনাতে আসিনি। আমি তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি। আমি কাল ভোরের ফ্লাইটে জার্মানী যাচ্ছ্‌ মা। আমি ওখানের ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চের কাজ পেয়ে গেছি। জানি না আবার কবে আসতে পারবো। আর একটা কথা তোমার জানা দরকার। পর্ণাও ওই একই জায়গায় পোস্ট-ডক করবে, তাই ও আমার সাথেই যাচ্ছে। তোমাকে জানিয়ে রাখলাম, আমরা খুব ভালো বন্ধু, মা, তুমি তার থেকে বেশি কিছু ভেবো না।


মাথাটা কেমন একটু ঘুরে যায় অমিতার। চেয়ারের হাতল ধরে বসে পড়েন।
- তুই এরকম করতে পারিস না আমার সাথে! তোর বাবাও আমাকে ছেড়ে, তোকে ছেড়ে চলে গেছিলো...তুই সব জানিস...তাও তুই এরকম করার কথা ভাবলি কি করে ?

- আমি সব জানতাম না আগে, মা, কিন্তু এখন জানি। মোমদির পাঠানো ইমেইলগুলো তুমি সযত্নে ডিলিট করেছ রোজ, হয়তো আমি যখন কলেজে, তখন, আমার দেখার বা বোঝার আগেই। আমি কখনও সন্দেহ করিনি তোমাকে। নিজে নিজেই কষ্টে কুঁকড়ে গেছি ভিতরে। আর বাবার ব্যাপারে তোমাকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসই পাইনি। বাড়ির অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলেও কেউ আমাকে ঠিকঠাক উত্তর দেয়নি, মা। বাধ্য হয়ে আমি আমার বাবার খোঁজ করি। প্রবীর মিত্র, নামে হাজার একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে দুনিয়ায়। কোনওদিন যার ছবি অবধি দেখিনি, শিশুবয়সের স্মৃতির ওপর ভরসা করে তাকে ভার্চুয়ালি খুঁজে পাওয়াও সহজ না, যদি না আমার সাথে এত মিল থাকতো চেহারায়। আমি বাবার সাথে যোগাযোগ করি মা, আর জানতে পারি, তুমি কখনওই বাবাকে যেতে আটকাওনি। বাবা চেয়েছিল আমাদের নিয়ে যেতে বাবার সাথে, কিন্তু মিত্রবাড়ির সর্বেসর্বা হওয়ার নেশা তোমাকে পাগলের মতো পেয়ে বসেছিল। তুমি বাবাকে আমার দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিলে মা।

আর সহ্য করতে পারেন না অমিতা। মুখের ওপর টেনে রাখা ছদ্ম গাম্ভীর্য খসে যায়। টেবিলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকেন তিনি। দীপও আর কিছু বলতে পারে না। ফুসফুসে আর হাওয়া নেই যেন।

অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে অমিতা উঠে দাঁড়ান। ভাঙা গলায় প্রশ্ন করেন, 
- তোকে আর আমার কাছে পাবো, নাকি পাবো না?

দীপও আর বসে থাকতে পারেনা। কিন্তু যে আনন্দ বিজয়ীর গলায় থাকার কথা ছিল, তার লেশমাত্র খুঁজে পায়না সে। সে জিতে গেছে। কিন্তু একটুও আনন্দ পায়নি। তার জীবনে আর আনন্দ আসবে না কখনও। হেরে যাওয়া গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে...
- তুমি বোধ হয় শুনতে পাওনি ঠিক করে। আমি অনেকক্ষণ আগেই 'না' বলেছি।

0 comments: