0

ছোটগল্পঃ স্বপন দেব

Posted in


ছোটগল্প



কমলার নারী দিবস
স্বপন দেব



কেলাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে কমলা। কমলা মানে যে লক্ষ্মী ঠাকুর সেটা ও জানে। ছেলে দুটোর হাতে খড়ি তো তারই হাতে। কিন্তু এখন আর পারেনা। একজন কেলাস টুয়ে আরেকজন কেলাস থ্রী তে পড়ে। এলাকার দীপা দির কাছে রোজ সন্ধ্যায় পড়তে যায় তারা। না, দীপাদি তার থেকে কোন টাকাকড়ি কিছু নেয়না। তবে মাঝে মাঝে ব্রিগেড কিংবা মিছিলে যেতেই হয় কমলাকে। বিনিময় প্রথা। রেল পুকুরের ধারে বাগুইহাটির এই ন ফুট বাই দশ ফুট ঘর আর তার সাথে এক ফালি বারান্দায় বিয়ের পর শঙ্করই এনে তুলেছিল তাকে। 

বাড়িওয়ালা হীরালাল সাউ এর পানের দোকান হাতিবাগান বাজারে। নিজে এখানে থাকেন না। বাড়িটি পেয়েছিলেন খুব সস্তায় সত্তরের দশকে। ১৯৯৪ সালে আঠারো বছর বয়েস থেকে এখানেই আছে কমলা। রবি আর ববির জন্মও এখানেই। হীরালাল সাউএর খালি পানের দোকান ই ছিলনা গোটা তিনেক ট্যাক্সি ও। তার ই একটা চালাত শঙ্কর। আর সেই সুবাদেই হীরালাল বাবু নাম মাত্র মাসে সত্তর টাকা ভাড়ায় থাকতে দিয়েছিলেন এই ন ফুট বাই দশ ফুট ঘরটায়। অবশ্য এর আর একটা উদ্দেশ্যও ছিল। সেটা হল বাড়ির সুরক্ষা টা যেন থাকে। শঙ্কর যতদিন বেঁচে ছিল, ভাত কাপড়ের অভাব ছিলনা কমলার। বরং মাঝে মধ্যে শঙ্কর ওকে নিয়ে যেত বাগুইহাটির আরতি সিনেমা হল এ। ছবি দেখে বেরিয়ে কোনদিন ফুচকা বা কোনদিন এগ রোল। রাতের আদরে লোকটা কোনওদিনই তেমন সাহসী ছিলনা। নানা ছলাকলায় তার পৌরুষ জাগানোর কাজও কমলাই করেছে—এতে কোন ক্ষোভ ছিলনা কমলার। বরং নিজের মানুষকে বশ করে রেখেছে ভেবে মনে একটা চাপা অহঙ্কার ছিল।

এসব রবি ববি জন্মাবার আগের কথা। দুটো বাচ্চা হতেই তাদের খাওয়ানো, নাওয়ানো, শোয়ানোতেই অনেকটা সময় কেটে যেত কমলার। শঙ্কর ও তখন উদয়াস্ত খাটছে। এক এক দিন দু-শিফটেই ট্যাক্সি চালাতো সে। ঘরে দুটো পয়সা বেশি আসছে বলে কমলাও মেনে নিত। কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল ছিল বুঝলো যেদিন শঙ্কর এইরকম ই এক দু-শিফটের গাড়ি চালিয়ে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল।না। বেশি ভোগেনি লোক টা । ভোগায়ও নি। দিন পাঁচেক এর জ্বর, হাঁসপাতাল, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া আর তারপর শব-বাহী গাড়িতে অল্প কিছু ফুল আর ধূপের গন্ধ মেখে শ্মশানের পথে পাড়ি দিল শঙ্কর। মোমবাতি নেভানোর মত করে নিয়তি এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল কমলার বারো বছরের দাম্পত্য-জীবন। 

শোকে কাতর হওয়ার অবকাশটুকুও পেলনা কমলা। তাদের দিন আনি দিন খাই এর সংসারে তো এখন খাওয়ানো আর পরানোর দায়িত্ব তার ই। দেওর রূপঙ্কর এসেছিল খবর পেয়ে। শ্মশানে আর কাজের দিন বাড়িতে যা কিছু করার সেই করেছিল। কিন্তু কাজ মিটে যাওয়ার পরে আর বসেনি এক মুহূর্ত। তার নিজের ই টানাটানির সংসার। তার মধ্যে এ তিনজন কে গলায় ঝোলাতে রাজী নয় সে। আর এসেছিল দীপা দি। শঙ্করের মারা যাওয়ার দিন ও এসেছিল। পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে কি একটা চিরকুট এনে দিয়েছিল কমলাকে। এটা দেখালে তোমাদের কোন খরচ দিতে হবেনা দাহ করার। আর এই আজ। শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাওয়ার পর দীপা দি কমলার পিঠে হাত দিয়ে বলল,এবার তো তোমাকেই সব সামলাতে হবে ? কাল-পরশু নাগাদ একবার এসো আমার বাড়িতে। আমার বাড়ি চেনো তো ? কমলা ঘাড় হেলালো। চেনে। জোড়া মন্দিরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকদিন ই দেখেছে দীপাদি কে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে থাকতে। কমলাকে দেখে মুচকি হেসেছেও কয়েকবার। বয়সে কমলার থেকে ছোটোই হবে।কমলার এখন তিরিশ। দীপা দির কত হবে ? পঁচিশ কি বড়োজোর আঠাশ ? তবে মুখশ্রী খুব একটা ভালো নয়। বরং কমলার গায়ের রঙ আর মুখশ্রী সে তুলনায় অনেক পোস্কার । 

দিন দুই বাদে কমলা হাজির হোল দীপাদির বাড়ি। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো বেশ বড়ো একটা হল ঘরে তাকে বসালো দীপাদি। জানালার পর্দা গুলো কি সুন্দর ! কমলা মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতে যাচ্ছিল; দীপাদি হাত ধরে তুলে বললে এখানে নয়, এর ওপরে বসো আরাম করে। কি সুন্দর নরম তুলতুলে একটা উঁচু গদির ওপর বসিয়ে দিল কমলাকে। দীপা দি এখানে তোমার কে কে আছে গো ? কেউ না। আমি আর আমার মা। বাবা, কি বড়োলোক তোমরা দীপা দি ! ধুর কে বলেছে তোকে আমি বড়োলোক ? সেই প্রথম কমলাকে তুই বলল দীপা। তোমার খরচা চলে কি করে গো ? পরশু কি খাবে তার চিন্তা করতে করতে আলটপকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাটা। এমা ! তুই জানিস না ? আমি তো পার্টির হোলটাইমার। কমলার মুখটা হাঁ হয়ে গেল আর এক চোখে বিস্ময়বোধক চিহ্ণ এবং আরেক চোখে প্রশ্ন-বোধক চিহ্ণ ঝুলিয়ে দীপাদির দিকে তাকালো কমলা। দীপা দি বুঝলো। আরে আমি পার্টির সবসময়ের কর্মী। তাই ভাতা পাই। ওতেই চলে যায় আমাদের। তারপরে দীপাদি ই ওকে বলল, শোন কমলা, আমি তোর জন্যে দুটো কাজ দেখে রেখেছি। কাল থেকেই লেগে যা। আর দেখি এর মধ্যে যদি ভালো কিছু পাই তোকে জানিয়ে দেব। বাচ্চা গুলোকে খাওয়াতে হবে তো ?

দীপা দির কথামত পরের দিন থেকেই দুটো বাড়ির কাজে লেগে গেল কমলা। ঘরমোছা, বাসন মাজা, জামাকাপড় কাচা সব ই করতে হত। গৃহবধূ কমলা রাতারাতি বনে গেল ঝি ! অবিশ্যি পেরথম দিন কাজ সেরে বাড়িমুখো হওয়ার সময়ে সে ভেবেছিল এতে হয়েছে কি ? এই তো দীপাদি ও তো পার্টির ঝি। কাজ করে মাইনে পায়। দীপাই পরে ওকে বিকেলে একটা বাড়িতে রান্নার কাজে লাগিয়ে দিল।আর হীরালাল বাবু একদিন এসে, শঙ্কর খুব ভালো ছেলে ছিল, কি যে হয়ে গেল -এই সব বলে যাবার আগে কমলার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন।

এখন থেকে কমলার জীবনটা অন্য খাতে বইলেও সেই আতঙ্ক আর ভীতি সে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। ছেলে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করা তাদের জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়া সব ই সে করে। শঙ্করেরে অভাব বুঝতে দেয়না তাদের। কিন্তু মাঝে মাঝে বেশী রাতে হঠাৎ মনে পড়ে যায় শঙ্করের কথা। মনে হয় তার পাশেই যেন শুয়ে আছে শঙ্কর। শরীরের গরম মেটাতে জোরে জোরে তালপাতার পাখা নাড়ে সে। আত্ম-রতি কথাটার মানে সে জানেনা। শোনেওনি কোনদিন। কিন্তু তার শরীর জানে। যেমন কুকুর তাপ ও ভর এর সূত্র না জেনেও গুটি মেরে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে শীত কালে। তাই কমলা আড় চোখে নিদ্রিত দুই ছেলের দিকে তাকিয়েই বুক অবধি টেনে নেয় একটা চাদর। শরীর শরীরের কাজ করে যায় ওই চাদরের তলাতেই ! আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলে কমলার মৃদু হর্ষনাদে ঘুম ভাঙ্গেনা কারোরই।

এ ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। অন্তত ২০০৯ সাল অবধি কমলাকে আর নতুন কোন হ্যাপা পোয়াতে হয়নি। এর মধ্যে হীরালাল বাবু মারা গেছেন। তার ছেলেরা এখন এ বাড়ির মালিক। মাসিক ভাড়ার টাকা তাদের হাতেই দিতে হয় এবং তার জন্যে হীরালাল বাবুর মত কোন রসিদ দেন না তারা। তাতে অবিশ্যি কমলার কিছুই বলার নেই। তারা যে ভাড়া বাড়ানোর বা বাড়ি ছেড়ে দেবার কথা বলেনি এতেই পরম নিশ্চিন্ত কমলা। কিন্তু গত মাসখানেক ধরেই কিছু উটকো লোকের আনাগোনা শুরু হয়েছে বাড়িতে। অবশ্য হীরালাল বাবুর ছেলেদের কেউ না কেউ থাকেন ওদের সঙ্গে। ব্যাপার টা হঠাৎ ই একদিন বে-আব্রু হয়ে গেল কমলার কাছে। হীরালাল বাবুর ছেলে ঘরে ঢুকলো মুস্কোমত একটা লোক কে ঘরে নিয়ে। এলাম দিদি, কিছু কথা আছে। কমলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসল । বাড়িটা প্রোমোটার কে দিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। পাশের লোকটিকে দেখিয়ে গোপাল বললও ইনি উদয় দা। আমাদের প্রোমোটার। উনি কিছু বলবেন তোমায়। এ পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি কমলা। এবার উদয় দা শুরু করলেন। ঘর টি তো এবার আপনাকে ছাড়তে হবে দিদি ! সে কি ? কোথায় যাবো আমি এই বাচ্চা দুটো কে নিয়ে ? কোথায় যাবেন, সেটা আপনার ব্যাপার দিদি। তবে একেবারে খালি হাতে বিদায় করবোনা আপনাকে। হাজার বিশেক টাকা পাবেন। আর সময় পাবেন এক মাস ঘর খালি করে দিতে। এর মধ্যে ব্যবস্থা করে নিন। কথাগুলো বলেই চৌকি ছেড়ে উঠে হাঁটা দিলেন তারা। বজ্রাহতার মত দুই হাতে মুখ ঢেকে অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল কমলা। ৯৪ সাল থেকে এখানে আছে। এটা ২০০৯ এর নভেম্বর। মানে পনেরো বছর ! এক কথায় এই পনেরো বছরের আবাস ছেড়ে কোথায় যাবে সে ?

অন্যদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়ার পরে একটু ভাত ঘুম আসে কমলার চোখে। আজ সেটাও এলনা। চিন্তার ঘুণ পোকা ঘুরছে তো ঘুরছেই মাথার ভেতর। শীতের হ্রস্ব বিকেলে গোধূলির আলো লাগতে বেশী সময় নেয়না। সাড়ে পাঁচটা বাজতেই উঠে পড়ল কমলা। নাঃ, আজ আর বিকেলের কাজে যাবেনা। বরং একবার ঘুরে আসি দীপা দির কাছে। দেখি উনি কি বলেন। কোন সুরাহা হয় কিনা।

দীপা কমলাকে দেখেই বলে উঠল, জানি। শুনেছি। তোদের বাড়ি প্রোমোটারের খপ্পরে পরেছে। তাই তো ? কমলা ঘাড় বেঁকিয়ে সম্মতি জানালো। এখন কি করি বলত দীপা দি ? কোথায় যাবো এখন ? ওরা হাজার কুড়ি টাকা দেবে বলছে। তাতে হয়তো হাতিয়াড়ার দিকে ওই বিশ হাজার টাকা আগাম দিয়ে একটা ছোটোমোটো ঘর পেয়ে যাবো। কিন্তু ভাড়া তো মাসে সাত আটশোর কম নেবেনা। আর ওখানে গেলে কাজ ই বা দেবে কে ? আমি তোমার কাছকাছি থাকতে চাই দীপা দি ! এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে উৎসুক চোখে দীপাদির দিকে তাকিয়ে হাঁফাতে লাগল কমলা। নিজের তর্জনী দিয়ে ঠোঁটে টোকা মারছিল দীপা দি। তুই এক কাজ কর কমলা। কাল ই সন্ধ্যেবালা অনাদি দার কাছে চলে যা। গিয়ে একেবারে সটান পায়ে পড়ে যাবি। বলবি আপনি উদ্ধার করুন অনাদি দা। অনাদি দা খুব ভালো মানুষ। গরীবদের খুব ভালো বাসেন। ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবেন তোর। আর শোন, এখানে যেই প্রোমোটারি করুক না কেন তাকে অনাদি দার অনুমতি নিতে হবে আগাম। কমলা জানে, অনাদি দা এখানকার পঞ্চায়েত প্রধান। গতবছরেই পঞ্চায়েত ভোটের আগে এসেছিল কমলাদের পাড়ায়, এমন কি কমলার ঘরের সামনেও। উনি কি আমার সাথে দেখা করবেন দীপা দি ? করবে। আমি আজ ই বলে রাখবো। তুই বলবি আমি কমলা। দীপাদি পাঠালো আপনার কাছে। তবে গিয়ে কিন্তু আগে পায়ে পড়ে যাবি।

পায়েই পড়েছিল কমলা, নির্জন সন্ধ্যেবেলা, অফিস যখন পুরো ফাঁকা,অনাদি সরকার ঘরে একা – তখন। তুমি ই কমলা ? হ্যাঁ, বলে সজল নয়নে কমলা মুখ তুলে তাকালো অনাদি সরকারের দিকে। ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ছিটকিনি টা তুলে দিয়ে ফিরে এসে অনাদি তার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, হয়ে যাবে। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের লালায় ওর মুখ মাখামাখি করে ভাঙ্গা দাঁতের ফাঁকে জানিয়েছিল, তুই আমায় দেখ আমিও তোকে দেখবো। রাগে, দুঃখে,অপমানে, লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল কমলা। অনাদি আবার বলেছিল, বলছি তো সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেই থেকেই চলছে। প্রথমে এক দু’দিন অন্তর এখন এই মাস তিনেক পর থেকে সপ্তাহে একদিন। বড়োজোর আধঘণ্টা। জামাকাপড় খসিয়ে পায়ের কাছে পুঁটলি করে রাখা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অনাদি সরকার—পঞ্চায়েত প্রধান, পার্টির নেতা। তার ও অঙ্গে বস্ত্র নেই। লোকটাকে এখন আর ভয় পায় না কমলা—তবে ওর স্পর্শে গা ঘিন ঘিন করতে থাকে। লোকটা সক্ষম নয়, ওর উত্থান পতন স্খলন কিছুই নেই—কমলাকে জড়িয়ে ধরা আর ওর শরীর থেকে উত্তেজনা নেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা অনাদি সরকার। অনাদি সরকার ধর্ষনে অক্ষম, তার যৌন সম্ভোগের ক্ষমতা নেই---কাজেই ক্ষমতা প্রদর্শনের আনুষঙ্গিক ঝামেলা নেই। এক্ষেত্রে কেবল নাক মুখ টিপে বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোন ও যন্ত্রণা নেই। এ হল হফতায় হফতায় ভাড়া। শরীর কে এইভাবে ভাড়া দিয়ে কমলা টিঁকিয়ে রেখেছে তার নয় বাই দশ ঘরের দখলি স্বত্ব। 

সেদিন ও অনাদির সাপ্তাহিক পাওনা মিটিয়ে বাড়ি ফিরছিল কমলা। এই সময়ে একটু আনমনা এবং রূঢ় বাস্তব থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে জোরে পা চালায় সে। খেয়াল করেনি। ব্যালকনি থেকে দীপা দির ডাক, এই কমলা একবার ভেতরে আয়। বোস ওখানে। সোফাটার দিকে আঙ্গুল দেখালো দীপা। না দীপা দি, কাজ সেরে ফিরছি। এই বাসী কাপড়ে আমি ওখানে বসবোনা। তুমি বল আমি দাঁড়িয়ে শুনেই চলে যাবো। শোন কমলা, পরশু, মানে এই ৮ তারিখে নারী দিবস। জানিস তো ? দিবস মানে যে দিনের ভালো নাম সেটা জানে কমলা। কিন্তু নারী ? নারী মানে কি দীপা দি ? নারী মানে জানিস না ? আরে তুই আমি আমরা হলাম নারী। তাও বুঝলোনা কমলা। আরে নারী মানে মহিলা—মেয়ে। ও তুমি মেয়েমানুষের কথা বলছ ? ছিঃ মেয়েমানুষ বলতে নেই কমলা। ওটা খারাপ কথা। শোন, ঐ দিন রেলপুকুরের মাঠে একটা সভা হবে। দেখবি কত মহিলারা আসবেন। তোকে কিন্তু আসতেই হবে কমলা সেদিন। ৭ টায় সভা আরম্ভ। কমলা জানে, এটা অনুরোধ বা মিনতি নয়। এটা আদেশ ই। সেই বিনিময় প্রথা। আসবো দীপাদি, তুমি যখন বলেছো নিশ্চয় আসবো। আর কথা না বাড়িয়ে কমলা হাঁটা দিল।

আট ই মার্চ, সন্ধ্যে সাড়ে সাত টায় কমলা শঙ্করের দেওয়া শেষ শাড়ি যাতে হাল্কা ঘিয়ের ওপর সবুজ পাড় বসানো আছে সেটা পরে , কপালে একটা কালো টিপ দিয়ে বেশ নারী নারী ভাব নিয়ে সভায় গেল। উদ্বোধন সঙ্গীতের পর তখন দীপা দি কি সব যেন বলছে। এক কোণে , একটা চেয়ার টেনে নিয়ে জুত করে বসল কমলা। মিনিট চল্লিশ পরে দীপাদি ই ঘোষণা করলো, এবার আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন আমাদের প্রিয় নেতা এবং পঞ্চায়েত প্রধাণ মাননীয় অনাদি সরকার মহাশয়। অনাদি সরকার মঞ্চে উঠলেন আর দীপা দি মঞ্চ থেকে নেমে এসে কমলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ই কমলা বলে উঠলো আমি এবার আসি দীপা দি। বাড়িতে বাচ্চা দুটো একা আছে। আরে না না !! অনাদি দা এর বক্তৃতা শুনে যা ! কত কিছু জানতে পারবি।

অগত্যা আবার বসল কমলা। আর তারপরেই অনাদির এক একটা কথা কেউটে সাপের মত ফণা তুলে ছোবল মারতে থাকলো কমলার সারা শরীরে। নারীদের সন্মান করুন ! কালকেউটের ছোবল ! নারীদের অবহেলা করবেন না। তাঁদের মর্যাদা দিতে শিখুন। নারী হল মায়ের জাত। সমাজে নারীর স্থান সবার ওপরে। কেউটে টা ছোবল মেরেই যাচ্ছে মেরেই যাচ্ছে !! কমলা বিষে নীল হয়ে টলতে টলতে কোনক্রমে বাড়ি ফিরে এল।

0 comments: