সম্পাদকীয়
Posted in সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশিত হলো ঋতবাক প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা। Coincidentally, এ মাসেরই ৮ তারিখে ছিলো “আন্তর্জাতিক নারীদিবস”। আজ থেকে ১০৫ বছর আগে, ১৯১০ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রীদ্বয় লুইজে জিয়েৎস ও ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকের সমান পারিশ্রমিকের দাবীতে ডেনমার্কের কোপনহেগেন-এ যে সম্মেলনের সূচনা, আজ তার তাৎপর্য অনেক ব্যপকতা লাভ করেছে। ৮ই মার্চ দিনটিকে এখন সমাজের সর্বস্তরে নারীর সমানাধিকার দাবীর উদযাপন দিবস হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউনেস্কোর ‘নারী দিবস’ পালনের আহ্বানের উদ্দেশ্যই হলো নারী সচেতনতা বৃদ্ধি। বছর-ব্যাপী নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই কর্মসূচী বজায় থাকে। তারই অংশ হিসাবে ঋতবাক অষ্টম সংখ্যার মূল উপজীব্য বিষয় চেতনায় প্রাধান্য পেয়েছে ‘নারী’।
শতাব্দী প্রাচীন এই স্মারক দিবসটির ইতিহাস সকলের জানা। সে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু যে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি দিবস চিহ্নিত করা এবং সেটিকে যুগপৎ নিষ্ঠা ও উত্তেজনার সঙ্গে পালন করার অর্থই হলো বিষয়টি সম্বন্ধে ব্যপক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস ও প্রয়োজনীয়তা। আর এই প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই কোথায় যেন নিহিত রয়েছে পুরুষের প্রচ্ছন্ন অহংকার। পৃথিবীতে ‘পুরুষ দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা তো কই অনুভূত হচ্ছে না এমন ব্যপক ভাবে? এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই আমার এক প্রকৃত অর্থে প্রগতিশীল, মুক্ত মন, সুরসিক পুরুষ বন্ধু বললেন, যে Risk নেবে, সে তো Advantage নেবেই, Madam ! একদম Primitive Age-এর কথা ভাবো, যখন নারী নিজেই গুহার নিরাপত্তা বেছে নিয়েছিলো প্রতিনিয়ত হিংস্র বন্য প্রাণীর সঙ্গে সংঘর্ষের চাইতে, যে দায়িত্বটা পুরুষকেই নিতে হয়েছিলো। পশুর রাজত্বে সেটা হয়না, তাই সেখানে Chauvinism ও নেই।
আত্মপ্রত্যয়ে টান পড়লো। তবে কি প্রগতির চরম সীমায় দাঁড়িয়েও সেই গুহামানবীর সঙ্গে আমার আসলে পার্থক্য শুধুই সাজ পোষাক আর ‘Whatsapp / Facebook-জ্ঞান’-এ? সমাজতত্ত্ববিদরা কি বলছেন? একটু খুঁজতে গিয়ে হাতে এলো The Millennium Development Goals Report, 2012 –সহ আরো বেশ কিছু রিপোর্ট । তা, কি বলছে MDG -সহ এই রিপোর্টগুলি? অজানা কোনো তথ্য নয়। একবার চোখ বুলিয়ে নিই প্রসঙ্গিক কিছু পরিসংখ্যান-এ।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হোলো, নারীর সামগ্রিক প্রগতি, অর্থাৎ শিক্ষায়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায়, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং সমাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানবাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাই হোলো নারীর নিরাপত্তাহীনতা, যা তাকে কাঙ্খিত লক্ষ্যের চরম সীমায় পৌঁছতে দিচ্ছেনা।
শিক্ষাক্ষেত্র থেকেই শুরু করা যাক। রিপোর্ট বলছে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও প্রাথমিক স্তরে ছেলেদের তুলনার মেয়েদের enrollment লক্ষ্যনীয় ভাবে বিষম – অর্থাৎ কম, যদিও সাফল্যের হার আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক উল্টো, অর্থাৎ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সাফল্য অনেক বেশী। Secondary লেভেলে এই পরিসংখ্যান আরো ভয়ানক। এই পর্যায়ে মেয়েদের আরো কম নথিভুক্তিকরণের সূচকগুলি যথাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আপেক্ষিক অপ্রতুলতা জনিত কারণে বাসা থেকে দূরত্ব – ফলে সেই কিশোরী কন্যার নিরাপত্তাহীনতা, সমাজ ও স্বজনের বিপ্রতীপ পীড়ন ও বাল্য বিবাহের প্রবণতা এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক কারণ হোল – “ Bad Investment Theory ” ।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও চিত্রটা পৃথক নয়। Vulnerable Employment –এ পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ সামগ্রিক ভাবে সারা বিশ্বেই অপেক্ষাকৃত বেশী। প্রাসঙ্গিক কিছু পরিসংখ্যানঃ-
২০১১এ উত্তর আফ্রিকায় Ratio-টা ৪৪:২২, পশ্চিম এশিয়ায় যেটা ৪১:২২, আর সাব সাহারান আফ্রিকায় ৮৫:৬৯। যুগপৎ অকল্পনীয় এবং মর্মান্তিক।
চাষের কাজে সাহায্য, গ্রামাঞ্চলে দূর দূরান্ত থেকে গৃহস্থলীর কাজের প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করা, ইঁট ভাটায় সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করার মতো অজস্র কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় ৬৫% বেশী। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের প্রয়াসে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম দক্ষতা সম্পন্ন একজন নারী পারিশ্রমিক এবং দায়িত্বশীল পদাধিকার লাভে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে পুরুষদের তুলনায়। সামগ্রিক সামাজিক সুরক্ষা লাভের অভাবে উচ্চকোটির স্বনিযুক্তি প্রকল্পেও মেয়েদের অংশগ্রহণ দুঃখজনক ভাবে কম। আন্তর্জাতিক স্তরে Top Level Occupation ও Senior Management Position-এ মেয়েদের অধিকার এখনো মাত্র ২৫% । সমাজের অন্যান্য স্তরে মেয়েদের বহুল চর্চিত বঞ্চনার বিবরণে আর নাই গেলাম!
আচ্ছা, বলুন তো, পরিসংখ্যান গুলি ছাড়া কোন্ তথ্যটা আমাদের অজানা? স্পষ্টতঃই, সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতির নিরিখে নারীজাতির অগ্রগতির হার মোটেই সমানুপাতিক নয়, এ কথা অনঃস্বীকার্য। আসলে নারীর এই সামগ্রিক অনগ্রসরতায় পুরুষের অবদানও কিছু কম নয়। লক্ষ্যনীয়, “পুরুষ” সিংহটি কিন্তু তার সঙ্গিনীটিকে কোনোও অবস্থাতেই Spare করে না। আর এদিকে পুরুষ “সিংহ”-টি আবার তাঁর সঙ্গিনীটিকে Spare না করে নিতান্তই পারেন না। আসলে, গলদটা একেবারে গোড়াতেই।
সচেতনতা বেড়েছে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, সচেতনতা বাড়ার অর্থ কি শুধুই জ্ঞান সংগ্রহ, মোমবাতি মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রদর্শন আর ফেসবুক-ট্যুইটারে পাতা ভরানো? এখনো যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তাবে আর কবে? আমার সন্তানকে কোন্ মুল্যবোধ, কোন্ বাসযোগ্য পৃথিবীর উত্তরাধিকার দিয়ে যাবো, সে কথা ভাবার সময় কি এখনো আসে নি? আর শুধু ভেবে ভেবে বসে থাকাই বা কেন? আসুন না, হাতে হাত মিলিয়ে সক্রিয় প্রয়াস ও সদ্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সম্মার্জনাকে জীবনচর্চার প্রাসঙ্গিক অন্তরঙ্গ সঙ্গী করে তুলি !! আলাদা করে নারী বা পুরুষ নয়, সসম্মানে মানুষ হিসাবে মিলে মিশে ভালো থাকা কি নিতান্তই অসম্ভব?!
আপনাদের সাধু ভাবোন্মেষের সোচ্চার প্রকাশে নিরন্তর সমৃদ্ধ হোক ঋতবাক।
শুভেচ্ছান্তে,
সুস্মিতা বসু সিং
সার্থক সমাদকীয়
ReplyDelete